- বইয়ের নামঃ অরূপরতন ঘোষের গল্প
- লেখকের নামঃ অরূপরতন ঘোষ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্য – অরূপরতন ঘোষ
মূল শহরটা যেন এতক্ষণ দম বন্ধ করেছিল, এইমাত্র হাঁপ ছাড়ল। তাই হঠাৎ দেখা গেল বেশ কিছুটা সবুজ মাঠ। খোলা হাওয়া। যদিও তার চারপাশ ঘিরেই হুমকি দিচ্ছে। একটু ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসা কংক্রিটের অরণ্য বা সারি সারি মানুষ বাস করার মেশিন। কিন্তু এই সবুজ মাঠটায় মাঝেমাঝেই টের পাওয়া যাচ্ছে কিছুটা বাতাসের
স্পর্শ আর সঙ্গে সঙ্গে নম্রতার শাড়ির আঁচলের কিছু ব্যর্থ ওড়াউড়ি। ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা কেউ কেউ দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ বাড়ি যাচ্ছে বা অন্য কোথাও এদিক ওদিক চলাফেরা করছে। আর কেউ লক্ষ না করলেও অনেক ওপরে আকাশে কয়েকটি মেঘের টুকরো কোথায় যেন ছুটে যাচ্ছিল সেই সময়।
—বল কি শুনবি বল?’ নম্রতা বলল।
—তুই যা বলবি। এম. এ ইংরেজির ছাত্র তরুণ যেন শিশুর মত বলে উঠল।
—”কিছু শুনেছিস আমার সম্পর্কে?
—হ্যাঁ, তোকে তোর হাজব্যান্ড মারত।
–হুঁ ঠিকই শুনেছিস।
-কিন্তু কেন?
–এমনি।
-হ্যাঁ, রে। সব সময় যে মারত তা নয়। মাঝেমাঝে বেড়াতে নিয়ে যেত। সন্ধ্যেবেলা আমরা সি-বিচে যেতাম। কিন্তু মাঝেমাঝেই বাড়িতে ফিরে এসে, শোবার সময় ড্রিংক করত, তারপর মারত।
একুশ বছরের তরুণ কিছু বুঝতে পারে না। এত সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটাকে মারতে কেন একটা লোক? আসলে বিয়ে, বিয়ে ব্যাপারটা সম্পর্কেই বিশেষ ধারণা নেই ওর। এত অল্প বয়েস, পড়াশুনো নিয়ে থাকে—এ সব কিছু বোঝে না। বাড়িতে কোনও বোনও নেই যে তাকে কেন্দ্র করে কোনও বিয়ের পরিস্থিতি বা আবহাওয়া তৈরি হবে। একটু আধটু ব্যাপারটা বুঝতে পারবে তরুণ।
—আবার কি জানিস তো, কখনও কখনও মারার পর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইত।
তরুণ তার চারপাশের একটু দেখা জীবন, ইংলিশ অনার্সের নাটক, উপন্যাস—এ সবের ভেতরের কাহিনীর সঙ্গে মনে মনে মেলানোর চেষ্টা করে নম্রতার এই ব্যাপারটাকে। কিন্তু কোথাও কোনও মিল নেই। না সেক্সপিয়রে, না ডিকেন্সে, না শেরিডনে। ইবসেনের সঙ্গে বোধহয় একটু মিল আছে। দি ডলস হাউস নাটকের নোরার সঙ্গে। সেই যে নোরা বেরিয়ে এল স্বামীকে ছেড়ে। বলল, কারুর স্ত্রী, কারুর মেয়ে, কারুর মা—এসবের চেয়েও আমার প্রথম এবং আসল পরিচয় আমি নারী। আমি বাবার ঘরেও একটা পুতুল ছিলাম আর তোমার কাছেও একটা পুতুল হয়েই আছি, তাই এই পুতুল-ঘর ভেঙে দিয়ে আমি চললাম। না, নম্রতা ঠিক নোরার মতো অতটা র্যাডিকাল নয়। ও বিয়ে করে সংসার করতেই চেয়েছিল। কিন্তু স্বামীর অত্যাচারে ওকে চলে আসতে হল। না ওর বিয়েটা আবার কাকিমা, পাড়ার মিনু বৌদি কারুর সঙ্গেই মিলছে না।
কিন্তু নম্রতার এই ঘটনাটা লিখব কি করে রে বাবা! গল্প হতে চাইছে নম্রতা। নিদারুণ ঝড়ে বিপর্যস্ত ওর বাইশ বছরের জীবনটাকে নিয়ে ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাওয়ায় আঁচল উড়ে যাচ্ছে ওর। নম্রতা বলতে লাগল—
কোথা থেকে যেন বিটোফেনের সেভেনথ সিম্ফনির সুর শোনা যেতে লাগল। নম্রতার কথার সঙ্গে সঙ্গে অর্কেস্ট্রার সুর কখনও উঁচুতে উঠছে কখনও নামছে। তরুণের বা আমার কানে ভেসে আসে এই সুন্দর সুর। অন্ধ সঙ্গীতকারের এই সুরবদ্ধ সিম্ফনিতে মনে হয় কখনও যেন পাপীরা সমুদ্রে স্নান করছে। আমিই তরুণ নাম দিয়ে শুরু করেছিলাম এই গল্প বা চিত্রনাট্যটা। নম্রতার সঙ্গে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের লনে সেই যে বসেছিলাম তা প্রায় কুড়ি বছর আগের কোনও একদিন। যেন চোখের সামন ভাসছে সেদিনটা। যেন থমকে আছে সেদিনের বাতাস, সবুজ মাঠ আর তার প্রান্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়ি ও অন্যান্য নগর-দৃশ্য। সেই আশির দশকে দৃশ্য-দূষণের সচেতনার যুগ তখনও আসেনি।
সিম্ফনিটা বাজছে—পাপীদের জলস্নাত হয়ে পবিত্র হওয়া। নাবিক ও সমুদ্র রঙ্গের মাখামাখি।
শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্যে অবধারিত ভাবেই এরকম ভাবে বিটোফেনের আসার কথা ছিল।
নম্রতা আবারও বলল, এমনি মাঝে মাঝে বেশ ভালো ব্যবহার করত। সন্ধ্যেবেলা সি বিচে বেড়াতে নিয়ে যেত।
সমুদ্র উত্তাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন বাঁধান এলাকায়।
আমি মনের চোখে সি বিচ কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। আরব সাগরের বিস্তৃত জলরাশি আর বষের তীরভূমির মেলামেশা। সেই কুড়ি বছর বয়েসে আমি তখনও বম্বে দেখিনি। আরব সাগরও না। কোনও সমুদ্রই তখনও আমার দেখা হয়নি। এখন বম্বের সমুদ্র আমার দেখা। কুড়ি বছর আগের নম্রতার কথাগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুম্বাইয়ের সমুদ্র। ইন্ডিয়া গেটসংলগ্ন বাঁধান তটে তার দুরন্ত উচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়া কিংবা জুহু বিচের বালির বিস্তৃত বিছানায় নির্দ্বিধায় সমুদ্রের কিছুটা এগিয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়া। অন্যদিকে পর্যটকদের নিয়ে উত্তাল সমুদ্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়া লঞ্চ। মুম্বাইয়ের সমুদ্র বলতে এসবই এখন একসঙ্গে মনে পড়ে।
বহু দিন থেকেই চলচ্চিত্র পরিচালক বা ফিল্মমেকার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। তাই চোখের সামনে স্ব কিছু সিনেমার মতো করে দেখার অভ্যাস হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লন-এ বসে নম্রতার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তারপর কত সময় পার হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত। নম্রতা যখনই সি বিচে বেড়ানোর কথা বলে, তখনই যেন একটা আছড়ে পড়া সমুদ্রের দৃশ্য বসে গেল মনের মধ্যে। চিত্রনাট্য লিখলে বা চলচ্চিত্র পরিচালনা করলে এ রকমই একটা দৃশ্য বা সিকোয়েন্স আমি রাখতাম।