নমিতার ইচ্ছে আজই সাঁঝ প্রহরেই জিজ্ঞেস করে নেবে তিলুকে ঝাঁপজল এ কী শুনছি–ঝাঁপজলের বিশ্বাস তিলু ওকে লুকোবে না।
কিন্তু নমিতার ভয় হয় ঐ পরান ডোবার বাঁকটায়, ওখানে অন্ধকার বড় ঘুরঘুটি। সেদিন পালেদের বড় ছেলে ওখানে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছিল নমিতার। মানুষের বেঁচে থাকার কী জ্বালা! বাঁশ গাছের থেকে কেন লাউডগা সাপ নামে না? কেন ওকে সেই সাপ কাটে না?
***
শেষ কথাটাই ভূষণ কবরেজের কানে বাজছে। তিলু বলে গেল, মানুষ হয়তো বোঝে, চাল হয়তো সেজে।
ভূষণ উত্তর দিয়েছিল, আমারও হাল নাই, তোমারও বলদ নাই। এসো তবে। কিন্তু গলার ভিতর থেকে উত্তর আসেনি। ভূষণ শাদা আঁকোডের গাছটা ফেলে দিল জলে। এই শিকড়বাকড় দিয়ে আজন্ম কাটছে। গুরুর কথা মনে পড়ছে ভূষণের! গোঘাটের পঞ্চবটী থানের গুরু। কতবার বলেছে ভূষণকে, বাপ এবার বে কর। কাজে অনেক বল পাবি। অত দুঃখ রাখিবি কোথায়? না হলে পাগল হবি।
ভূষণ বালা কুড়ুলের মুখ থেকে মাটি মোছে। গাই গরুটার ডাক শোনা যাচ্ছে এখনও। ভূষণ জানে ও ডাক কীসের। গরুটার একটা কঠিন অসুখ। মাঠ দেখানোর পর ওর পেটে বাচ্চা আসবে। দুধের মোড় ফুলে উঠবে। দুধ জমবে। কিন্তু ও বিয়োতে পারবে না। সেবার অনেক কষ্টে মরা বাচ্চা ভূষণের হাতেই নেমেছিল। এবার মারা যাবে গাইটা নিজেই। তাই ভূষণ এড়িয়ে চলছে।
কিন্তু—সব কথার পিঠে কিন্তু।
বনবাদাড়ের আনাচে কানাচে ব্যাঙ ডাকছে। মিটিমিটি করে জোনাকি জ্বলছে। অহেতুক কিছু শব্দ ভূষণকে নাড়ায়—পূর্বসূরীদের ডাকের মতন।
ভূষণ ঘরে আসে। দড়মা থেকে শালপাতা বের করে চটা পাকায়। আরও একটু রাত বাড়বে। তারপর সে আজ জীবনের শেষ গাছ তুলবে। এ গা ছেড়ে দেবে। চলে যাবে গুরুর কাছে দুরে দুরে গোঘাট গাঁয়ে। গিয়ে বলবে, এই দ্যাখো ওস্তাদ শ্বেত করঞ্জার ফুল। এই লাও বনবৈচির শিকড়। এই দেখ পূর্ণিমায় লক্ষ্মীবারে ভোলা প্রতিষ্ঠা করা আশুদ গাছের ছাল।
ঘরের সমস্ত সঞ্চয় যা ছিল একটা কুপীর আলো, মাটির হাঁড়ি, ঠ্যাং-ভাঙা কুকুর, সব ঠিক তেমনি আছে। ভূষণ মনে মনে ঠিক করল কিছুই নেবে না। এক কাপড়ে চলে যাবে। শুধু নেবে ওর বয়সকালের আড় বাঁশি। অনেকদিন ছোঁয়নি এটা।
বুকে বেশ বাতাস দিচ্ছে। এমনি বাতাস ভূষণের দিয়েছিল সেবার, যেবার ও তিলুকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। শাশুড়ীর বঁটির আঘাতে তিলুর কোমর কেটে ঘা। তিলু মরতে চেয়েছিল। ভিতরে ভিতরে ঘা বেড়ে যাই-যাই। মাঝরাতে তিলুর দেওর নিমাই এসে ডেকেছিল ভূষণকে।
তিলু ওষুধ খেতে চায়নি। ভূষণকে উত্তর দিয়েছিল, শিকড়কড়ে আর বাঁচতে আমি চাই না। শুধু চাই এই ঘা সোরোশ করে যেন ঢুকতে পারে কলজেতে। ভূষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, মনিষি মরলেই তো মাটি হয়ে গেল। তালে কেন আর এই জীবন?
সে তো গেল বছর। ভূষণ অনুভব করল এই যে সব গাস্ত্রে শিকড়বাকড়, এই যে সব প্রতিদিন মাটি খুঁড়ে তুলে আনা, এতে তো সব অসুখ সারে না। ভূষণের নিজের ভিতরেও তো ব্যথা আছে। বাড়লেই গুরুর কাছে চলে যায়। হাউ হাউ করে কাঁদে আর তখনই ভূষণকে গুরু বলে, এবার একটা বে কর ভূষণ। মাটির কলসী থেকে ভূষণ কিছুটা জল খেল। খুব ভাসা ভাসা লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিনে মানুষের। যে সমস্ত উপকার করেছে তা কত কম, কত সামান্য।
কিছু আর খেতে ইচ্ছে করল না। খুঁটিতে হেলান দিয়ে আকাশ দেখল। সাঁঝতারা বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠেছে। এখন সারা আকাশে যেন একথালা সুপুরি—অগুনতি অসংখ্য তারা। সাতভাই উঠেছে। চাদের একটা বেশ বের হচ্ছে। আষাঢ়ের কালো মেঘ সাঝে সাঝে ছুটে এসে চাপা দিচ্ছে আলো। আবার অন্ধকার, আবার আলো। এই সমস্ত খেলাটাই চলছে ভূষণের ভিতর। ভূষণ মনে মনে তৈরি হয়ে নেয়। ওকে চলে যেতে হবে এই ঘর, এই গ্রাম, এই মনীষ্যিদের ছেড়ে।
তবে এটা বুঝেছে সে, যে মেয়েদের স্বামী নাই সে মেয়েরা দশ হাত কাপড়েও ন্যাঙটো, কত অসহায়!
.
তিলুর আজ যা কিছু চরম ঘটার জন্যে ইচ্ছে করছে রুখে দাঁড়াতে। কুয়োতলায় পার্বতী এখনও দাঁড়িয়ে। তিলুকে দেখে দখনো বাতাসের মতো তার বুক জুড়ে যায়। তিলু ওকে রশি বালতি দেয়।
পার্বতী শুধায়, তুমি আগে নিয়ে যাবে? তোমায় তো আরও দুখেপ এসতে হবে। তিলু অন্যদিনের থেকে একটা আলাদা। না, তুমিই আগে নাও পিসি, আমি পরে নোব। আজ আমার এই এক খেপ জল।
তিলু হাঁপাচ্ছে, কলসীর মুখে ছোট্ট একটা চাদ। কলসীর মুখের কানায় জলের শব্দ উঠছে। বালতির জল আজ একটা বেশি চলকাচ্ছে। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল। কোন নাঙ কুয়োতলায় ছিল যে এত দেরি, কুয়ো কেটে কি জল আনচু তেয়োধাতালীর ঝি? কলসী বালতি নামিয়ে রেখে তিলু জানত, এরপর কী। চুলের গুছি ধরে দুটো চড়। খুঁটিতে হাতটা লেগে শাখাটা ভাঙ্গল তিলুর। রবারের তিনটে চুড়ি ছিটকে বেরিয়ে গেল। উঠোনে গাছের ছায়ায় বোঝা গেল না। ঘর থেকে দেওর বেরিয়ে এসে মাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। দেওরের ছেলে পরান টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল। এ সমস্ত দৃশ্যে পরান অভ্যস্ত, এমন কি এই উঠোনে পোঁতা তুলসীগাছও।
তিলুর চোখের ভাষ্য আজ সামান্য আলাদা। কলসী নিয়ে দ্বিতীয়বার বের হল। খেয়াল করল না পরান ওর পিছে পিছে এসেছে কুয়োতলা অব্দি।
শেষ খেপ জল নিয়ে যখন ঘরে ফিরল, তখন শুনতে পেল প্রথম প্রহর শেষের চৌকিদারের ডাক, হো—হো–হো-ও।