কলসী আর দড়ি নিলো তিলু, জলকে যাবে। তার আগে মোড়ল পুকুরে গা ধোবে, সেখান থেকেই চলে যাবে কুয়োতলায়। নিখেপ জল আনা চাই। এখন ঘরের আর তেমন কোনো কাজ নাই। সন্ধ্যে দেখাশোনাটা শাশুড়ী করে নেবে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখল জায়ের ছেলে খেলে ফিরছে। এই বাচ্চাটাই তিলুর বুকে শিকড় গেড়েছে মামার বাড়ি যায়নি মার সঙ্গে। জ্যাঠাইমার ন্যাওটা। হারে রঙীন কাঁচের গুলি দেখিয়ে বলল, চারটে পেয়েছি আজকে। তাড়াতাড়ি ঘরে আয় জ্যাঠাই।
তিলু হাসল। এই বালক তাকে বন্দী করেছে। তিলু বলে, ঠাকমা রেগে গেছে, চুপচাপ খেয়ে নিয়ে পড়তে বসে যাবি, আমার আজ লিখেপ। যাবো কি আসবো।
ঘাটে মানুষ আসার সময় পার হয়ে গেছে। তিলুর দেরি হয়েছে আজ অকারণে। কোন কারণ ছিল না দেরির। ঘাটের ঝামার উপর কলসী নামিয়ে কাপড় আজাড়ে গামছা পরার আগে কলসী মাজল। জলে নামল ধীর পায়ে। জলে আয়নায় তিলুর মুখ টলছে। সেই টলা মুখ দেখে সামান্য মজা পেল। এই মরা বেলায় জিয়ল মাছ ফুট কাটছে। জলে দাঁড়ানো বাঁশের উপর এক শাদা বক শান্ত পূজারীর মতো নিথর। চুনো মাছ ভাসলেই ধারালো ঠোঁটে আক্রমণ।
দীর্ঘকায় পাকুড় গাছ ছায়া ফেলেছে। আজ কেমন থমথমে লাগছে। তবে কি সবাই গন্ধ পেয়েছে তিলুর মহোৎসবের? তিলু স্বপক্ষে কিছু যুক্তি খাড়া করল। এতদিনে নিজেকে দোষ দেওয়া তারপর কপাল ধিয়ানো। আজ তিলু এক বলিষ্ঠ যুক্তি খাড়া করেছে। মানুষ শুধু মরতে বলে, সব ত্যাগ করতে বলে, ভালো হতে বলে। বদলে কেউ দেবার জন্যে হাত বাড়ায় না। এই দু’বছর সে হারাধনের অপেক্ষায়। সাত গাঁয়ে রটে গেল তিলু সতীলক্ষ্মী। কেউতো কই একদিনও সময় করে গেল না হারাধনের খোঁজ আনতে। তিলুর এই সুনাম আজ পচা কাসুন্দীর মতো লাগছে। ও যেন ছিড়তে চাইছে, ভাঙতে চাইছে ভিতরে ভিতরে কিছু। জলে ঢেউ দিল। গারে ছায়া ভাঙল, তিলুর মুখ হারাল, তিলু ডুব দিল। জল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভূত দেখল। জলে নামার সময় পুর্ব কোণায় কিছু গাছ নড়ছিল, ভেবেছিল ছাগল টাগল হবে। দেখল যা, তাতে অবাক হবার থেকেও বেশি কিছু। ভূষণ কবরেজ এই তিন সন্ধ্যেবেলায় কোন গাছের শিকড় তুলছে। হাতে ছোট কুড়ুল আর কোমরে বাঁধা তালপাতার থলি। মুখ তুলে ঘাটের দিকে তাকিয়ে ভূষণের মাথা ঝিমঝিম করছিল। ভূষণ ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তিলুদের গরুর কথা। ভুলে গেছে আজ যাবার কথা। এই গাছ-পাগলা ভূষণ কবরেজ কিছুটা দোষীর মতন কুড়ুল আর গোটা গাছটা সমেত এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। তিলু সাত তাড়াতাড়ি করে ভিজে গামছার ওপর কাপড় জড়াল।
তিন সন্ধ্যেবেলায় মোড়লপাড়া থেকে শাঁখ বাজল। পাকুড় গাস্ত্রে কোটর থেকে লক্ষ্মীপেঁচা বার হয়ে প্রথম সাঁঝে ডাক দিয়ে উড়ে গেল।
.
—ভাত কি দেয় ভাতারে, ভাত দেয় গতরে।
ঠক করে পিতলের কলসী কুয়োতলার চটা-ওঠা সিমেন্টের মেঝেতে নামিয়ে পারুল বললে। কে জানে কী কারণে ও আজ মুড়ি-ভাজা খোলার মতন তেতে আছে। কুয়োতলায় যারা ছিল তারা বেশি গা করল না পারুলের কথায়, জানে ওকে নষ্ট মেয়ে বলেই।
পারুল ও গাঁয়ের ঠোঁটকাটা। বিয়ের দু’বছর ঘোরার পর চার মাসের ছেলে কোলে গাঁয়ে ফিরে এসেছিল। স্বামীর মারধর, আইবুড়ো দেওরের হাত ধরে টানা, পারুলের একদম পোষায়নি। ভাইরা খুশী হয়নি। বড়দার বৌ তো উঠতে বসতে খোঁটা দিত। পারুল দাদাদের কাছে সামান্য ভিটে চেয়ে নেয়। তারপর ওর সঙ্গে জুটে যায় সহদেব। এধারের মাটি ওধার করে পারুল কপাল ফিরিয়েছে। ওর পিতলের কলসীতে বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছে। এখন পারুলের অবস্থা ফিরছে তরতর করে। ওসব কথা পারুলের সাজে, পারুলের মানায়। এখন ওর দাদারাই অভাবে পারুলের কাছে হাত পাতে।
বিকেলবেলায় গাঁয়ের কোনো কুয়োতলায় দাঁড়ালে এইরকম দৃশ্য। এ সময়টাই বৌঝিদের সংসার জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি, খবরের আদান-প্রদান। রটনা-ঘটনা।
এ গাঁয়ে কুয়ো বলতে একটাই। অন্য দুটোর জল তেমন ভালো নয়। একটার পাড় চুইয়ে পুকুরের জল ঢোকে। অন্যটায় লক্ষ্মী ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, তাই সে জল আর কেউ নেয় না। এ কুয়োর বয়েস কেউ জানে না। যারা জানতো তারা মরে গেছে। যারা জানে তারা ঠিক-বেঠিক মিশিয়ে জানে।
সেই কবে লালমুখো সাহেবের বন্দুক নিয়ে কাছার পাড়ে পাখি-মারা, তারপর কী একটা কাগজে লিখে টিপসই। তারপর কুয়ো। কুয়োর কপিকল বার কয়েক বদলেছে। মাথার উপর পাতানো কাঠ দেখলে মালুম হবে কাঠটা কত পুরনো দিনের সাক্ষী। গায়ে তার, অসংখ্য দড়ির দাগ। সবাই বলে, এ কুয়ো পীরের থানের বলেই এর জল এত ভালো। কুয়োর থামের পাশে লেখা ‘এলাহি, ভরসা, মিস্ত্রী সেখ কাবাতুল্লা, সাকিন রসুলপুর।’ ‘সন’ কথাটার পর থেকে চটা উঠে গেছে। কুয়োয় গোল মেঝের উপর সিমেন্টের চিহ্ন নেই। বৌ-ঝিদের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে সেও অনেকটা দুঃখী মানুষের মতো সহনশীল ও নিথর।
সারি সারি কলসী বসেছে কুয়োতলায়, হরেক রকমের কলসী। কোনোটা ঝকঝকে, কোননোটার গায়ে পড়েছে সময়ের ময়লা, কোনোটার কানা বাঁকা। কোথাও কোনোটার গা বেড়ানো, অতীত দিনের অসাবধানতায় পড়ে টাল খেয়ে যাওয়া, নয়তো কোনো অত্যাচারের কাহিনী। এরই মধ্যে বেমানান মাটির কলসী। কলসী দেখ আর কলসীর মালিককে দেখ! ঠিক আটকাল করতে পারবে কলসীর সঙ্গে মানুষের কত যোগ। কে কেমন, তার কলসী কেমন? যে কেমন কলসী তার তেমনি। কুয়োতলায় কলসীই মানুষদের মুখের কথা বলে।