- বইয়ের নামঃ অশোককুমার কুণ্ডুর গল্প
- লেখকের নামঃ অশোককুমার কুণ্ডু
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু
বর্ষা এসেছে তিলুর উঠোনে। চোইত বোশেখের পোড়ামাটিতে আজই প্রথম বর্ষার এক ঝট। গন্ধ উঠেছিলো মাটির! আকাশটা তেমন জমেনি। প্রথম বর্ষা তো, কিছুটা কুমারী মেয়ের মন, দাঁড়ালো না। এসেছিলো, চলে গেল, উঁকি দিলো, সবটা দেখা গেল না।
বুও দুকুঠরী ঘরের পশ্চিম মটকার কোণের আকাশ যেন ধান সিজোনো হাঁড়ির কালো মুখ, মিশকালো। যেন মরা বিকেলে আবার নামবে। এই এলো, আবার গোটাও পাততাড়ি, গোয়ালের গরু সামলাও, খামার থেকে তুলে আনো বন্দিনী তিলের শুটি, মাকাই ও সরষের বীজ, রোদ খেতে দেওয়া ঋতুমতী গমের বীজদের। হাওয়া বইলো দমকা মেরে। গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় গা ঘষাঘষি, ঠেকাঠেকি, অনেকদিন প্র যেন প্রাণখোলা প্রতিবেশী।
এই কদিন দেখতে দেখতে শেষ আষাঢ়ের আরও পাঁচটা দিন গেল। তিলুর ক্যালেণ্ডার বলতে একটি তালপাতা। সে তালপাতায় আছে গোয়ালার গুণ-ছুঁচের হিসাবে দাগ। পাচদিন হলো মনে মনে হিসেব করলো তিলু, কেননা এই পাঁচদিন হয়েছে, কালো গাই-গরুটা ডাকছে। মাঠ দেখানোর সময়। এ সময় এই প্রথম ডাক পার হলে বড় মুশকিল, অথচ এই গরুটা তিলুর বাপের বাড়ির সামগ্রী। বিয়ের পরই দেওয়া, তিলুর বাচ্চা দুধ খাবে।
এই পাঁচদিন তিলুর ভিতরে কোথাও মেঘ জমেছে? কোথাও কি বর্ষার পায়চারি কিংবা কোথাও বেড়ার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাম মেহদী ফুলের গন্ধ? তিলু সামান্য নাড়া খেয়েছে, ঐ যে কথায় বলে, আগুনের কাছে ঘি থাকলে গলবেই গলবে।
দুপুরে প্রথম জলের আগেই হুটোপাটি করে সংসারের জিনিসপত্র ভোলাতুলির সময় পেজালি বসেছিলো উঠোনে, ভাতঘুম থেকে ওঠার পর তিলু দেখলো সেইসব পেঁজালিগুলি মুছে গেছে প্রায়। গাই গরুটাকে দেখতে ভূষণ আসবে, আজকে চারদিনের ওষুধ শেষ হয়েছে। গরুটাও দস্যি, বলিহারি যাও! খোঁটার দড়ি ছিঁড়ে লড়াই করে ডাইরে শিং ভেঙে, ও একবারে রক্তের কন্যা। তারপর এই ডাক। বিপদের উপর আরও এক গেরো। এই সব ঘরগেরোস্তো, শ্বশুরবাড়ি, কাঠ কয়লার গনগনে আগুনের মত জা মায়া, আর তার বড় ছেলে, তিলুর বড় ন্যাওটা। এই সব পাঁচমিশেলি ভাবনায় তিলুর মন আজ আনচান। ভূষণ আসবে বিকেলে। ভূষণ এসেছিলো ফিরে লক্ষ্মীবার। সেই মানুষটার কোনো খবর নাই বহুদিন।
খিড়কির পশ্চিমপাড়ে তালগাছ একপায়ে সব কথায় সাক্ষী। পাশের যে পাতাটা ঝুলে পড়েছে সেটায় বাবুই পাখিদের দিনের শেষবেলাকার আলোয় কিছু মজলিশি নালিশ। সেদিকে তাকাল তিলু। ভূষণ কবরেজ আসছে না কেন? শাশুড়ী গেছে পাড়া বেড়াতে। এখুনি এই নাগাদ সন্ধ্যের ফিরবে। ঐ মানুষটার কথার ভাষ্যি নেই। গাছপালার শিকড়কড় খুঁজতে খুঁজতে মাথার মধ্যে কথা শিকড় হয়ে গেছে না হলে আজ এত দেরি? জানে ধ্ব, অথচ কী করছে কে জানে, হয়তো ভুলে মেরে দিয়েছে। নয়তো অন্য গায়ে কোনো খেত আকন্দের ফুলের সন্ধান পেয়েছে। লাছদুয়ারে এসে মুখ বাড়াল তিলু।
ভাঁড়ার ঘরের পাশে ঝিটচালের পাঁচিল অনেকটা পড়ে গেছে। ওখানে এই বর্ষার গন্ধে গজাবে কিছু লতাগুল্ম, বর্ষার স্পর্শে শিহরিত হবে। আর ওদিকে পুকুরের পাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা বৈচি গাছে সবুজ ফল ধরেছে। এ কদিনে তিলুর মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটি গাছ নিতান্তই অবহেলায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো শাশুড়ীর ঘোড় দৌড়। বেড়ার পাশে ঝিঙে ফুলের হলুদ রঙ। শাশুড়ী বেড়ার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললো, ঝিঙে ফুলে বেলা মরলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না দেখছো, জল আনতে আমি এই বুড়ো বয়সে যাই, ঠ্যাঙ হাত ছড়িয়ে ভোগ করো তোমরা, আমি মরে গেলে। তিলু নীরব। সরব হয় অন্তরের অন্তরীক্ষে। মাটির দেওয়ালে লাগানো ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখে তিলু।
জা বাপের ঘর গেছে সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে, ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে। তিলু এ সংসারে বড় অবৈধ। ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে যাওয়াটা এই প্রথম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে মানুষ বড় কাঁদে। তিলুর বোধহয় কান্নাও শুকিয়ে গেছে। বস্তুত আজকাল সে আর কাঁদে না। মুখে একটা মৃত হাসি জিইয়ে রেখে আজ দিন পাঁচেক সে কিছুটা আলাদা। গাঁয়ের বৌদের যেখানটায় খুটি সেখানটায় তিলু আশ্রয়হীন। অথচ দোষ তার কোথায়? এতদিন এই তিন বছরে বিয়ের পর, সে হিসেব করে দেখল প্রথম কমাসের জন্যে আলোকিত অধ্যায়। তারপর সামান্য কথা কাটাকাটি এবং হারাধনের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া। চলে যাবার পর তিল ভেবেছিলো ওটা সাবেকী ঢঙ, সব পুরুষ মানুষেরই যেমন। তার শাশুড়ীর তিলুকে বাপের বাড়ি পাঠানো। তারপর ঐ রকম সময়টুকুর জন্যে হঠাৎ আবির্ভাব। কোথাও ছিলো না এমন লেখা। তিল যখন বাপের বাড়িতে পাঁচদিন কাটালো, ভেবেছিলো হারাধন নোক পাঠাবে কিংবা নিজে আসবে। তখন সে হারাধনের হাত ধরে আবার ফিরে আসবে এখানে। হয়নি। সেই মিথ্যে অভিমান প্রসব করেছে এক বঞ্চনা। লোকে বলে হারাধন নাকি ফিরবে এ ভিটেয়, তিলু মরার। অন্তত শাশুড়ীর তাই রটানো খবর। এক একবার শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁদেছে। তারপরে শাশুড়ীর মুখঝামটায় সমস্ত দুঃখের খবরগুলো বাসি হয়ে গেছে।
না না বেলা যাচ্ছে। আষাঢ়ের অহর প্রহর দীর্ঘ বেলারও মৃত্যু হয়। গাছের মল সহনশীলা তিলু চঞ্চল! সমস্ত ঘটনার কারণ হিসেবে প্রথম প্রথম সে নিজেকে দোষী করত, তারপর কপালকে মন্দ বলত। আজকাল তিলু অন্য কিছু ভাবছে।