কথাগুলো বলে ভুবনবাবু আড়চোখে তাকালেন ঝর্ণা-হিরণের মুখের দিকে। ওষুধে কাজ হয়েছে। দুজনের চোখই জলে ভরে গেছে।
ভুবনবাবু আবার কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই দেওয়াল ঘড়িতে শোনা গেল একটা বাজার শব্দ।
—এবার উঠি। কাল তোমাদের সাথে আবার বসবো। ঠিক বেলা এগারোটায় চলে এসো।
—মেলোমশাই, আজ আর একটু সময় দিন। অনুরোধ জানাল হিরণ। সঙ্গে সঙ্গে ঝর্ণাও ঐ একই কথার পুনরাবৃত্তি করল।
-মনে কিছু করো না। আমাকে আজ বেরোতেই হবে। লাঞ্চের পরই আমি মেয়ের বাড়ি যাব। সুতরাং আজ আর আমায় কোন অনুরোধ করো না।
—আপনি খেয়ে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে ছেড়ে দেব। হাতজোড় করে বললে ঝর্ণা। হিরণও সাথে সাথে হাতজোড় করে অনুরোধ জানাল।
ওদের সকরুণ মুখের দিকে তাকিয়ে ভুবনবাবু আর ‘না’ বলতে পারলেন না।
—ঠিক আছে। বসো। তবে আমি কিন্তু আর একঘন্টার বেশি সময় দিতে পারবো না।
চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন ভুবনবাবু। যেতে যেতে বললেন-কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কফি খেতে খেতে দুজনে গল্প করো। বাট নো একসাইটমেন্ট। আই ওয়ান্ট অ্যাডজাস্টমেন্ট।
লাঞ্চ সেরে অফিসে এসে ঝর্ণা-হিরণকে শুধালেন ভুবনবাবু—কি, দুজনে কথা কাটাকটি হয় নি তো আবার?
–না। দুজনের মুখেই সলজ্জ হাসি।
–ভেরি গুড। এই তো চাই। এই তো হওয়া উচিত। আসলে রাগ আর জেদই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। এর জন্যেই যত অশান্তি। যতটা সম্ভব এ দুটোকে এড়িয়ে চলবে। আর ভুল-ভ্রান্তি তো মানুষ মাত্রেই হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে চাই উভয়ের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং। চাই অ্যাজ্জাস্টমেন্ট। ঝর্ণা, তোমার বাবা মাকে…
কথার মাঝখানেই ঘরে ঢুকল রত্না। আলুথালু চুল। চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ।
–কি রে, কখন এলি? মেয়েকে শুধালেন ভুবনবাবু।
—এক্ষুণি।
—ওপরে যাসনি?
-না
—কিছু বলবি?
—হ্যাঁ।
—আজ তো তোর বাড়ি যাব বলে ঠিক করেছি।
আমার কিছু জরুরি কথা আছে বাবা।
—চল। ঝর্ণা-হিরণকে একটু অপেক্ষা করতে বলে রত্নাকে নিয়ে ঘর-সংলগ্ন বারান্দায় এলে
—একি চেহারা হয়েছে তোর? ব্যাপার কি? সব খুলে বল তো মা! সদা শান্ত ভুবনবাবুকে বেশ অশান্ত দেখাল।
—আমি ঐ বাড়ি থেকে চলে এসেছি বাবা। আর কোনদিনও ওখানে যাব না। বাবাকে জড়িয়ে ধরে মেয়ের সে কি কান্না! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রত্না। ঠোঁট কামড়ে ধরে।
প্রচণ্ড আঘাত আর ব্যথায় সারাটা বুক মোচড় দিয়ে উঠল ভুবনবাবুর। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না তিনি। জলে ভরে উঠল তার দুচোখ। মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ধরা গলায় বললেন—এভাবে কাঁদিস না মা! চল, ওপরে চল। লোকে দেখলে কি বলবে!
—লোকের কথায় আর কি হবে বাবা! যা হবার তো হয়েই গেছে। আজ হোক আর কাল হোক, জানাজানি তো হয়েই যাবে।
–চল আমার সাথে। আমি যাবি তোর শ্বশুরবাড়ি।
—এতদিনে যখন যাবার সময় পাওনি, এখন আর গিয়ে কি হবে!
—আমি ওঁদের বুঝিয়ে বলবো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
—কোন লাভ নেই। ওখনে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
—কি বলছিস তুই!
—ঠিকই বলছি বাবা।
—মাথা ঠাণ্ডা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সামান্য জেদের জন্য এমন কাজ করিস না মা।
—আমি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি বাবা। ওদের সাথে অ্যাডজাস্ট করা আর সম্ভব নয়। চোখ মুছতে মুছতে বলল রত্না।
—এটাই কি তোর শেষ কথা? অসহায়ের মত মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন ভুবনবাবু।
—হ্যাঁ, এটাই আমার শেষ কথা। কালই আমি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করব।
হঠাৎ তখন মেঘের গর্জনের সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকে উঠল আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত।
ভুবনবাবু বুঝলেন রত্নার মত আর পাল্টাবার নয়। মেয়েকে তো তিনি জানেন। তবু আর একবার বললেন–ভাল করে ভেবে দ্যাখ মা।
—সব ভেবে-চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবা।
ভুবনবাবু আর কথা বললেন না। গুণ-ছেঁড়া ধনুকের মত তিনি যেন প্রাণেমনে ছিঁড়ে গেলেন। মুহূর্তে পাল্টে গেল মুখের চেহারা। কে যেন কালি ঢেলে দিল সারামুখে। উদভ্রান্তের মত মেয়ের দিকে তাকালেন একবার। তারপর অস্ফুটে বললেন—আমার সারাজীবনের সাধনা আজ শেষ হয়ে গেল।
উদ্দাম বাতাসের দাপটের পাশে নিমগাছটা থেকে তখনি ভেঙ্গে পড়ল পাখির বাসা? ঝড় উঠেছে। দুরন্ত ঝড়।
আবার একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন ভুবনবাবু। তাকালেন শরতের মসীবরণ আকাশের দিকে। অসাড় অচৈতন্য তার সর্বাঙ্গ। ঘুরছে মাথাও। গোটা পৃথিবীটাই মনে হচ্ছে যেন শূন্য। কেউ নেই, কিছু নেই। আস্তে আস্তে বারান্দা থেকে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন ভুবনবাবু। ঘরে ঢুকে তাকালেন ঝর্ণা-হিরণের দিকে। তাকালেন অফিসের ছেলেমেয়েটির দিকেও। তারপর সকরুণ চোখে তাকালেন নিজের চেয়ার, টেবিল, বইপত্রের দিকে। বাইরে তখন শুরু হয়েছে উন্মত্ত হাওয়ার মাতামাতি। খোলা জানালা-দরজা দিয়ে দুরন্ত বাতাস আছড়ে পড়ছে ঘরের মধ্যে। ঝড়ের দাপটে উড়ে যাচ্ছে টেবিলের সব কাগজপত্র। খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল জানলার কাচ। জোরে জোরে দুলছে ঝাড়বাতিটাও। দেখতে দেখতে সেই উদ্দাম হাওয়ার সাথে হাত মেলাল প্রবল বর্ষণ। জল ঝড়ের সেকি তাণ্ডব! ভেঙ্গে-ভিজে ঘরের সব জিনিস লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে ভুবনবাবুর চোখের সামনে। সব শেষ, সব শেষ। বাইরে বৃষ্টির জল, ভেতরে ভুবনবাবুর চোখে জল। হঠাৎ সেই জলভরা চোখে আর একবার তাকালেন তিনি ঝর্ণা-হিরণের দিকে। না, না—আর কোন কথা নয়-কোন উপদেশও না। আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। এ ঘরের আর কোন আকর্ষণ নেই তার কাছে। থাকবেও না কোনদিন। এখানকার সব স্মৃতি ভুলে যেতে চান তিনি।