- বইয়ের নামঃ রাজনগর
- লেখকের নামঃ অমিয়ভূষণ মজুমদার
- বিভাগসমূহঃউপন্যাস
০১. ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রো
রাজনগর – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার
ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রোর হাওয়াঘরটা ছিলো নদীর দিকে মুখ করে। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘর। কিছুদূরে কদমগাছের নিচে তার সেই বেঁটে হাতি। কখনো এক পা এগোয়, কখনো এক পা পিছিয়ে আসে। কখনো শুঁড় তোলে। দু পাশে কলাগাছের স্তূপ–পচা হাজা শুকনোর উপরে নতুন টাটকা গাছ। বোঝা যায় কেউ আছে যে প্রাণীটাকে আহার দিচ্ছে। কিন্তু হাওয়াঘর? কে বসবে সেখানে? কোথায় ওয়ারিশান?
একদিন দেখা গেলো পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে উঠছে শিবমন্দির। মন্দির সে তো পূজার জন্যই–আর তা গ্রামনগরেই উঠে থাকে। এখানে গ্রামের বাইরেনদীর ধারে একটেরে নিঃসঙ্গ হলো না?
কিন্তু তা হচ্ছে রানীর নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং কেন কী জিজ্ঞাসা না করে যা হচ্ছে তা চোখে, যা হবে তা কল্পনায় দেখে নেয়া ভালো। দেখার মতো ব্যাপারও। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘরের ভিত আছে, চওড়া চওড়া সিঁড়িগুলো আছে, মন্দির কিন্তু উঠছে নিচের মাটি থেকে, ইদারার মতো গেঁথে তোলা। হাওয়াঘরের মেঝে থাকবে মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা চত্বর হয়ে। সে চত্বরে উঠতে হবে পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে, অন্য নতুন সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে মন্দিরের গর্ভে পুজো দিতে। অখাদ্য-খাওয়া অনাচারী সেই আধা-ফরাসীর হাওয়াঘরের মেঝেতে মন্দির হয়?
দেখতে দেখতে অনেকটা উঠেছেও মন্দিরটা। এখনই যেন আন্দাজ করা যায় আর কতদূর উঠবে, শেষ পর্যন্ত তা কী রকমের হবে। নদীর দিক থেকে সরে এসে চত্বরের শেষে কিছুটা ছেড়ে প্রায় গোলাকার হয়ে গড়ে উঠেছে মন্দির। প্রায় গোলাকার বলতে হয় কেননা মন্দিরের মেঝে যেন মধুর খোপ এমন ষট্কোণ। দেয়াল সোজা উঠছে। কিন্তু এখনই বোঝা যায় তা গম্বুজে শেষ হবে না, বরং যেন রথ। সেই রথের মাথায় থাকবে পদ্ম; পদ্মের একটা ভারি পিতলের গোলা-শিবলিঙ্গের মাথায় যেমন বজ্র। তা চত্বরযুক্ত মন্দিরটার গড়নই যেন গৌরীপাটসমেত আর এক শিবলিঙ্গ।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু লোক কাজ করছে মন্দিরে। মন্দিরের কিছু পিছনে বাঁয়ের দিকে পিয়েত্রোর বাংলো। বাংলোর কাছে আর একদল কর্মব্যস্ত মানুষ। তারা কুমোর। মনে হয় একটা টালির কারখানা বসিয়েছে। ছোটো, বড়ো, নকশাদার; রোদে শুখানো হচ্ছে, পোআনে পোড়াচ্ছে।
মিস্ত্রি, জোগানদার, কুমোর মিলে অনেক লোক। কিন্তু যত লোক লাগুক, এমন এক মঠ কি দু-চার-ছমাসে হয়? আর এক শীতই পার হয়ে যাবে হয়তো।
কিন্তু ইতিমধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেলো। এসে পড়লো তারা। যেন হুমহাম শব্দও উঠছে এমনভাবেই ওরা গ্রামে ঢুকলো। আর তা স্বাভাবিকই। কারণ তারা তো পঞ্চতীর্থের মাটিই আনেনি শুধু, প্রায় তিন হাত উঁচু তিন হাত বেড় নিকষের সেই থামটিও এনেছে যা নাকি শিব হবে।
খবর পেয়ে রাজবাড়ির স্বর্ণকার অষ্টধাতুর সেই পদ্ম তৈরি করতে লেগে গেলো। সে তো থাকবে লিঙ্গের গোড়ায় মাটির নিচে, বসিয়ে দিলে তা আর চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু সাগরেদদের বললো– সে, দেখবে তো কারিগরি সেই একজনই যে সব দেখে।
আর তখন হঠাৎ শোনা গেলো যে সাতদিনের মধ্যে শিব বসে যাবেন তাঁর মন্দিরে। একটু কেন, বেশ খানিকটা অবাক হওয়ারই কথা। মন্দির শেষ হলো কোথায়? গ্রামের পণ্ডিতেরা পাঁজি খুললো। সার্বভৌমপাড়ায় এখনো তো টোল আছে। এমন কী মাহেন্দ্রক্ষণ বয়ে যায় যে এখনই এই অপ্রস্তুত অবস্থায় শিব বসাতে হবে? মিস্ত্রিরাজদের মধ্যেও বিস্ময় দেখা দিলো। মনে করো উপর থেকে এক থান ইট খুলেই বা পড়ে লিঙ্গের উপরে।
নরেশ ওভারশিয়ার এলো। হরদয়াল শুনলো। একটু ভেবে বললো–আর কত গাঁথা বাকি?
বারো হাত।
গাঁথাও তো পনেরো হলো শুনেছি। হরদয়াল আর একটু ভেবে নিয়ে বললো–কড়ি বরগার মতো মোটা কাঠ বসিয়ে তার উপরে অস্থায়ী ছাদ করে, তার উপর বাকি দেয়াল গাঁথা চলে?
মিস্ত্রিরা, আজ্ঞা হাঁ বলে উঠে পড়লো। সোজার মধ্যে এমন পাকা বুদ্ধি বলেই না দেওয়ান।
কিন্তু এমন করে শিব বসানো অশাস্ত্রীয় যে তাও তো উড়িয়ে দেয়া যায় না। ওদিকে আবার রানীই ঠিক করেছেন তিথিটাকে।
.
০২.
দিন সাতেক আগে রানী বসবার ঘরে রূপচাঁদকে ডেকে বলেছিলেন উকিলসাহেবকে খবর দিতে।
এখনো এটাকে দেওয়ানকুঠি বলে। বাড়িটা তৈরির সময় থেকেই যে নামে পরিচিত ছিলো তা সহজেই বদলায় না। যদিও রাজবাড়ির লোকেরা এবং কাছারির আমলারা জানে এখনো সেখানে হরদয়াল থাকে বটে, সে কিন্তু দেওয়ান নয় আর।
পদমর্যাদায় কিছু লাঘব হয়েছে বৈকি। সেই একই লোক তো, আগে দেওয়ান ছিলো, এখন আর তা নয়, যদিও তেমনই প্রায় সবই–চালচলন, কথাবার্তা। বেতনটা কমেছে, তাহলেও গ্রামের কেন, সদরের হিসাবেও এখনো তা অনেক। কোনো বিষয়েই রানীর মত জানা সহজ নয়। সদর নায়েবমশাই এই বিষয়ে একদিন শুনেছিলেন এরকম : মানী লোক তো, তাছাড়া ওই টাকাই তো ওঁর অভ্যাস ছিলো। কেউ কেউ বলে উকিল। এটা একটা ব্যথার মতো ব্যাপার নাকি? রানী তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। দু-তিনটি বছর গড়িয়ে গেলো না? ওদিকে কিন্তু তারপর আর কেউ দেওয়ান হয়নি।
হরদয়াল ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। চেয়ারের হাতলে কাঁচের গ্লাসে কিছু পানীয়। অন্ধকার হয়ে আসছে। মশালচি ওদিকের দরজায় বসে হিংসের একটা বড় বাতিকে ঠিক করছে। অন্ধকারে একটা কোমল ভুলে যাওয়া, দূরে সরে যাওয়ার ভাব দেখা দিয়েছে। হরদয়ালের হাত দুখানা কোলের উপরে রাখা। কিছু ভাবছে সে।