এইসব কত কথাই না ভেসে উঠছে ভুবনবাবুর মনের পর্দায়। তাই কাজে আর তেমন মন বসছে না। দিনটাও ভারি বিশ্রি। সকাল থেকেই আকাশের বুকে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। মাসটা আশ্বিন হলেও দিনটার মতিগতি বর্ষার দুরন্ত ঢলের দিকে। তাই আবছা অন্ধকার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে গোটা কলকাতা। কোথায় দেখা যাবে এখন শরতের ঝকঝকে রোদের চকচকে হাসি, তা না আবছা আলোর ঝাঁপসা একটা দিন যেন গুমরামুখো হয়ে আছে সেই সকাল থেকে। যে কোন মুহূর্তে আকাশের চৌবাচ্চাটা ফুটো হয়ে হড়হড় করে জল পড়তে পারে। তাছাড়া অফিসও ফাঁকা। না আছে মক্কেল, না আছে ফোনের চিৎকার।
ভুবনবাবুর ভাল লাগছে না। একেবারে না। এত বছরের মধ্যে এমনি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়নি তাকে কোনদিনও। তাই মনে মনে ঠিক করেন লাঞ্চের পর আর অফিসে আসবেন না। বিকেলের দিকে স্ত্রীকে নিয়ে সোজা চলে যাবেন মেয়ের বাড়ি। ওখানে মেয়েকে সারপ্রাইজ দেবেন। সারপ্রাইজ আর দিতে পারেননি ভুনববাবু। তার আগেই রত্না চলে এসেছিল তার কাছে। যাক সে কথা। রত্নার কথা রত্না আসার পরে হবে। এখনকার কথা এখন হোক।
আলমারিতে সাজানো বইগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন ভুবনবাবু। বেলা একটা বাজলেই উঠে পড়বেন এমন সময় আলমারি থেকে একটি বই টেনে বের করলেন। নাম কর্তব্য। বইটির পাতা ওল্টাচ্ছেন আর কি যেন ভাবছে। হঠাৎ সেই সময় অফিসে উপস্থিত হল এক নব দম্পতি। কিছুদিন আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়েটা হয়েছিল ভুবনবাবুর কাছেই।
ওরা দুজনে এসে দাঁড়াল ভুবনবাবুর সামনে। দুজনেরই মুখ ভার।
—কি খবর? দুজন এত গম্ভীর কেন?
—আপনার সাথে কিছু কথা আছে মেলোমশাই। ছেলেটি বলল।
হাতের বইটা টেবিলে রেখে ওদের বসতে বললেন ভুবনবাবু। ক্ষণিকের নীরবতা। নীরবতা ভাঙ্গে ভুবনবাবুর কথায়।
—আজ আমি একটু ব্যস্ত আছি। আমার অন্য একটা জরুরি কাজ আছে। তোমরা বরং কাল এসো। আজ আমাকে একবার বেরোতেই হবে।
–প্লিজ মেলোমশাই, প্লিজ। আমাদের জন্যে একটু টাইম দিন। দুজনেই অনুরোধ জানাল একসঙ্গে।
—বেশ। এখন বারোটা বাজে। একটা পর্যন্ত আমি আছি। একঘন্টার মধ্যে হলে ভাল। না হলে কাল আসবে, কেমন? বলল এবার তোমাদের প্রেম-বিরহের কথা। দরদভরা কণ্ঠে বললেন ভুবনবাবু।
–ঝর্ণা ভীষণ অবুঝ। চট করে বলে উঠল ছেলেটি।
—অবুঝ তুমিও কম না হিরণ। ঝর্ণার স্বরেও উত্তেজনা।
—আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? আসল কথাটাই তো এখনো বললে না কেউ। উত্তেজনায় কি সমস্যার সমাধান হয়? ঠাণ্ডা মাথায় বল। আমি তো তোমাদের বাবার
—আপনি তো সবই জানেন মেলোমশাই। আমার প্রতি ঝর্ণার মা-বাবার আচরণের কথা, বিয়ের সময় আপনাকে আমরা দুজনেই বলেছি।
—তা তো শুনেছি। কিন্তু এখন কি হল?
—তা নিয়েই তো অশান্তি। ঝর্ণা এখন প্রায়ই বাবা-মার কাছে যায় অথচ আজ পর্যন্ত একদিনও তারা আমাদের বাড়িতে আসেননি। তাই আমি ঝর্ণাকে বলেছি তারা যখন আসেন না তুমিও সেখানে যাবে না। ব্যস, আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি। এবার আপনি বলুন মেসোমশাই, আমার দোষটা কোথায়।
–এছাড়া আর কিছু বলোনি? ঝর্ণা আবার উত্তেজিত।
—কি বলেছি, বলো না?
—তুমি আমরা বাবা-মা সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করোনি?
–করেছি।
–তবে?
–তবে কি?
—শুনুন মেসোমশাই। ভুবনবাবুর মুখের দিকে তাকাল ঝর্ণা।
—কি বলেছে হিরণ? ভুবনবাবু শুধালেন।
—যা সত্যি তাই বলেছি।
–ঠিক আছে। তবে সত্যি কথাটা তো আমার জানা দরকার।
—সেটাই আপনাকে বলছি। বিয়ের আগে ঝর্ণা নিজেই বলেছিল ওর বাবা-মা যদি আমার যথাযথ মর্যাদা না দেন তাহলে ও আর কোনদিন তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবে না। আমি কি তাঁদের কাছ থেকে সেই মর্যাদা পেয়েছি? ও কি সম্পর্ক ছিন্ন করেছে? আর সে কথা বলতে গেলেই ওর বাবা-মার বিরুদ্ধে…..
—নিশ্চয়ই। হিরণের কথা শেষ হরাবর আগেই আবার ঝর্ণার রণং দেহি মূর্তি।
এদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়ছিলেন ভুবনবাবু। দৃষ্টি তার দূর দিগন্তের পানে। যেন কোন গম্ভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি। কোন কথা নেই তার মুখে। কথা নেই ঝর্ণা-হিরণের মুখেও। সবাই চুপচাপ। সারা ঘরে বিরাজ করছে একটা অখণ্ড নীরবতা। নীরবতা ভেঙ্গে ভুবনবাবুই প্রথমে বললেন ঝর্ণা, তুমি তোমার বাবা-মাকে একটু বোঝাও। হাজার হোক এখন তো হিরণ তাদের জামাই।
–বিশ্বাস করুন মেসোমশাই, আমি বলি।
—তো তোমার কথা যখন তার কানে তোলেন না তখন তুমিই বা সেখানে যাও কেন? এবার বিরক্তি এবং উত্তেজনা দেখা গেল হিরণের কথায়।
–কথায় কথায় তোমরা এতে উত্তেজিত হলে চলবে কি করে! একটু ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে। সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত উত্তেজিত হলে একসাথে। থাকবে কি করে?
—এভাবে একসাথে থাকা আর সম্ভব নয়। দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল।
—তাহলে কি বলছো, আলাদা থাকবে? ভুবনবাবু শুধালেন।
–তাছাড়া উপায় কি? বেদনাহত কণ্ঠে বলল হিরণ।
—চমৎকার! সামান্য ব্যাপারটাকে দেখছি অসামান্য করে তুললে তোমরা। ভালবাসার চেয়ে জেদই বড় হল। ধমকের সুরে বলে উঠলেন ভুবনবাবু।
দুজনে নীরব। দুজনের মুখেই বেদনার ছাপ। দুজনেই মাথা নিচু করে বসে আছে ভুবনবাবুর সামনে।
এবার উপদেশের সুরে বললেন ভুবনবাবু—তোমরা দুজনেই শিক্ষিত। ঠিক ঠিক শিক্ষা পেলে, কি না হয় মানুষে। সত্যিকারের শিক্ষাই মানুষের মনে উদারতা আনে। তোমরা সে শিক্ষা পেয়েছো। তোমাদের মধ্যে আমি তা দেখেছি। আজ সামান্য অ্যাডজাস্টমেন্টের অভাবে এরকম হবে কেন? তাছাড়া তোমাদের ভালবাসার কথাও তো আমার অজানা নয়। কি গভীর সেই ভালবাসা মনে করো অতীরে সেই সব দিনগুলোর কথা। মনে পড়ে, একটা দিনও কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতে না? মনে পড়ে, সেই অভিসারের জন্যে ঝড়-জল মাথায় নিয়ে ছুটে গেছ যত্রতত্র? মনে পড়ে, শুনশান জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেছো একে অপরের জন্যে? মনে করো, সেইসব দিনের কথা। পুরনো সেই দিনের কথা, প্রাণের কথা কি এত সহজে ভোলা যায়!