ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনুষ্ঠানে আমরা সব সময়েই তাদেরকে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিই– যারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছে তারা জানে কত বিচিত্র ধরনের প্রশ্ন দিয়ে তারা বড় বড় মানুষদের নাস্তানুবাদ করে দেয়। ভাগ্যিস সেখানে আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ, আলী ইমাম এবং হায়াৎ মাসুদের মতো মানুষেরা ছিলেন, তাই তাদের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া গেছে! কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি– মানুষ মারা গেলে কেন সেটাকে ‘পটল তোলা’ বলা হয় সে রকম একটা প্রশ্ন! দোয়েল পাখি থেকে কাক অনেক বেশি, তাহলে জাতীয় পাখি কাক কেন হল না সে রকম আরেকটি প্রশ্ন!
[সাথে সাথেই কাক আর দোয়েল পাখি নিয়ে ভোটাভুটি করে অবশ্যি দোয়েল পাখিকেই জাতীয় পাখির সম্মান দিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।]
সব প্রশ্নই যে মজার প্রশ্ন ছিল তা নয়, কিছু কিছু প্রশ্ন আমাদের লজ্জিত করেছে, ব্যথিত করেছে। একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেআমাদের জিজ্ঞেস করল, ভাষা মতিনের মতো একজন মানুষ– যিনি মৃত্যুর পর নিজের চোখ পর্যন্ত দান করে গেছেন তাঁকে কেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হল না? আমাদের কাছে মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া এই প্রশ্নের আর কোনো উত্তর ছিল না।
প্রতিযোগিতার শেষে পুরস্কার দেওয়া হয়– দেখে মনে হতে পারে এটি বুঝি খুব আনন্দের একটা অংশ, আসলে এই অংশটি আমার কাছে একটু দুঃখের। যারা পুরস্কার পায় তাদের আনন্দ থেকে আমাকে বেশি দুঃখ দেয় যারা পুরস্কার পায়নি বলে মন খারাপ করে। সে জন্যে এ ধরনের অনুষ্ঠানে আমি সব সময়েই বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করি, প্রতিযোগিতা বিষয়টা আসলে খুব ভালো কিছু নয়। পৃথিবীর কোনো বড় কাজ প্রতিযোগিতা দিয়ে হয় না– সব বড় কাজ হয় সহযোগিতা দিয়ে।
এই যে বাংলা ভাষার জন্যে ভালোবাসার অনুষ্ঠান শব্দকল্পদ্রুম — এর আয়োজন করার জন্যেও অনেক ভলান্টিয়ার দিন রাত করেছে। ভলান্টিয়ারদের খুজেঁ বের করা হয়েছে ইন্টারনেটে ঘোষণা দিয়ে। আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনও-ই বিশ্বাস করতাম না যে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের ঘোষণা দেখে এতগুলো ছেলেমেয়ে কাজ করার জন্যে চলে এসেছে।
[ফিরে আসার বাসের সময়টা হঠাৎ করে এগিয়ে নিয়ে আসায় আমার হঠাৎ করে চলে আসতে হয়েছে বলে, এই ভলান্টিয়ারদের ঠিক করে ধন্যবাদ পর্যন্ত দিয়ে আসতে পারিনি!]
কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাকে বাচ্চাদের অনেক ‘অটোগ্রাফ’ দিতে হয়। আজকাল শুধু অটোগ্রাফে শেষ হয় না, তার সাথে সাথে ‘ফটোগ্রাফ’ও তোলা হয়। শুধু ফটোগ্রাফে শেষ হয়ে যায় না– ‘সেলফি’ তুলতে হয়। যারা এখনও শব্দটার সাথে পরিচিত হয়নি তাদের বলে দিই, নিজের ছবি নিজে তোলার নাম ‘সেলফি’, আগে ডিকশনারিতে এই শব্দটি ছিল না এখন যোগ করা হয়েছে।
ডিকশনারিতে নূতন শব্দ যোগ করা যায় তার এ রকম জলজ্যান্ত উদাহরণ আছে বলে শব্দকল্পদ্রুম এ আমরা ছেলেমেয়েদের নূতন শব্দ তৈরি করারও একটা সুযোগ করে দিয়েছিলাম। প্রথমবার বলে আমরাই পাঁচ ধরনের মানুষের কথা বলেছি। প্রথমটি ছিল: যার সত্যিকারের বন্ধু নেই, সব ফেসবুকের বন্ধু! এই ধরনের মানুষদের ছেলেমেয়েরা অনেক বিচিত্র নাম নিয়ে এসেছে, কয়েকটা এ রকম ‘ফেসবুকানি’ , ‘ফেস-পোকা’ কিংবা ‘আলে-বান্দর’ !
ঠিক এ রকম, যে শিক্ষক ক্লাসে পড়ায় না কিন্তু কোচিংয়ে পড়ায়, তার নাম দিয়েছে ‘ল্যাম্পো মাস্টার’ , ‘কোচিক্ষক’ কিংবা ‘লোভীক্ষক’ ! যে দিন রাত কম্পিউটারে গেম খেলে, তাকে বলেছে ‘গেম-খিলাড়ি’ কিংবা ‘গেম বাবু’ ! পাকিস্তান বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলায় যে পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে তাদেরকে বেশিরভাগই ‘রাজাকার’ ডেকেছে। এ ছাড়াও আছে ‘পাকিংলাদেশি’ এবং ‘বাংকিস্তানি’ ! যে ভাত খেতে চায় না, শুধু ফ্রাইড চিকেন খেতে চায়, তাদেরকে নাম দিয়েছে ‘হাভাতে চিকেন’ কিংবা খুবই সংক্ষেপে ‘চিকু’ !
নিছক মজা করার জন্যেই এই নূতন শব্দের জন্ম, কিন্তু কে বলবে একদিন হয়তো এরকম একটা শব্দ ডিকশনারিতে স্থান পেয়ে যাবে!
২.
এতক্ষণ যে কথাগুলো বলেছি সেটা হচ্ছে ভূমিকা, এবারে আসল বক্তব্যে আসি। আমরা দিন রাত বাংলায় কথা বলি বলে, এই ভাষাটি কী অসাধারণ সেটা সবসময় লক্ষ্য করি না। কম্পিউটারে বাংলা ভাষার স্থান করে দিতে গিয়ে আমি নিজে অনেক কিছু প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করেছি যেগুলো ভাষাবিদেরা বহুদিন থেকে জানেন। যারা একটু স্বচ্ছল তারা বাংলা থেকে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন ইংরেজিতে। অনেক পরিবারেই ছেলেমেয়েদের পাওয়া যাবে যারা বাংলা পড়তে পর্যন্ত চায় না। অনেকেই বাংলা পড়তে চাইলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প পড়তে চায় না। অনেক ছোট ছোট শিশু টেলিভিশনের সামনে বসে বসে বাংলা শেখার আগে হিন্দি শিখে বড় হচ্ছে।
টেলিভিশনে এক ধরনের বিচিত্র বাংলা উচ্চারণ আছে– রেডিওতে সেটি আরও ভয়াবহ। আজকাল সবচেয়ে সস্তা মোবাইল টেলিফোনেও বাংলা লেখা যায়, কিন্তু বেশিরভাগ এসএমএস লেখা হয় ইংরেজি হরফে। ইচ্ছে করলে এই তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু মন খারাপ করা কথা লিখতে ভালো লাগে না।
তাই আমার মনে হয়, যারা বড় হয়ে গেছে তাদেরকে হয়তো বাংলা ভাষা নিয়ে আর উৎসাহিত করা যাবে না, কিন্তু যারা ছোট তাদের ভেতরে নিশ্চয়ই নূতন করে একটা ভালোবাসার জন্ম দেওয়া সম্ভব।