- বইয়ের নামঃ জাফর ইকবালের বিশেষ রচনা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অন্য রকম ফেব্রুয়ারি
এই ফেব্রুয়ারিটা অন্য রকম। প্রতিবছর আমি ফেব্রুয়ারি মাসটার জন্য আলাদাভাবে অপেক্ষা করি। সারা বছর লেখালেখি করার সময় পাই না। তাই ক্যালেন্ডারে যখন দেখতে পাই ফেব্রুয়ারি মাস আসি আসি করছে, তখন আমি নাক-মুখ গুঁজে লিখতে বসি। ফেব্রুয়ারি মাস আসতে আসতে লেখালেখি শেষ করে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি। যদি ঢাকা শহরে থাকতাম, তাহলে নিশ্চয়ই প্রতিদিন বইমেলায় হাজির হতাম, কিন্তু সেটি আমার ভাগ্যে নেই। ছুটিছাটায় যাই, বই দেখি, বইপাগল মানুষ দেখি। ভারি ভালো লাগে!
একটি একটি করে দিন কাটে। আমি তখন একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করি। একুশে ফেব্রুয়ারি, কী অসাধারণ একটি দিন! একসময় সেটা ছিল শোকের দিন; এখন এটি শোকের দিন নয়, এটি ভালোবাসার দিন। মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা, মাতৃভাষার জন্য ভালোবাসা। এই ভালোবাসা এখন শুধু আমাদের জন্য নয়, এখন সেটা সারা পৃথিবীর সব মানুষের মাতৃভাষার জন্য ভালোবাসা।
এই দিনে সম্ভব হলে আমি ঢাকায় চলে আসি। ভোরবেলা আমি শহীদ মিনারের পাশে মানুষের যে ঢল নামে, সেই ঢলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। গভীর রাত থেকে শত শত নয়, হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করে। যত মানুষ, আমার তত আনন্দ। আমি শহীদ মিনার যতটা দেখতে যাই, তার চেয়ে বেশি যাই মানুষ দেখতে। বাবা শিশুপুত্রটিকে ঘাড়ে নিয়ে এসেছে, কিশোরী মেয়েটি এসেছে মায়ের হাত ধরে, তরুণীটি এসেছে তার ভালোবাসার তরুণের সঙ্গে। সবার হাতে ফুল, গালে বাংলা বর্ণমালা। কী অপূর্ব একটি দৃশ্য! একটু একটু করে মানুষগুলো এগিয়ে যায়, আর আমি তাদের পেছনে পেছনে হাঁটি। মানুষের ভিড়ে অনেক সময় শহীদ মিনারের কাছে যেতে পারি না। তখন কোনো একজন তেজি তরুণের হাতে ফুলগুলো দিয়ে বলি, আমার হয়ে ফুলগুলো শহীদ মিনারে দিয়ে দিয়ো। সে ঘাড় নেড়ে রাজি হয়।
আমি তখন মানুষের মুখ দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়াই। একটি দেশ তো শুধু দেশের মাটি নয়, দেশ হচ্ছে দেশের মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দেশের মানুষ দেশের জন্য ভালোবাসা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আমি সেই মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের ভেতরে একধরনের শক্তি অনুভব করি। নতুন একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। আমি বুঝতে পারি, এই দেশে কখনো কোনো অন্ধকার শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো আলাদা করে কিছু করে না; তার পরও আমি অবাক হয়ে দেখি, তাদের ভেতরে কী এক আশ্চর্য শক্তি লুকিয়ে থাকে। সেই শক্তির ভেতরে থেকে আমি নিজের ভেতরে শক্তি খুঁজে পাই। সে জন্য প্রতিবছর আমি আলাদাভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য অপেক্ষা করি।
এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসটা অন্য রকম। এই বছর আমার শুধু একটি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না, আমি যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করি, এই বছর প্রতিটি দিনই সে রকম। প্রতিদিন চারপাশে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ। কেউ যখন দেশকে ভালোবেসে ঘর থেকে বের হয়, সেই মানুষগুলো হয় অন্য রকম। প্রথমে ছিল কমবয়সী তরুণ-তরুণী, তারপর এসেছে বৃদ্ধ-যুবা। এসেছে শিশু-কিশোর। তারা ঘুরে-ফিরে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা বাঙালি। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যারা এই দেশ চায়নি, তাদের এ দেশে স্থান নেই। পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে যারা অংশ নিয়েছে, তাদের তারা শুধু বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় না, বিচার করে শাস্তি দিয়ে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে চায়। তারুণ্যের এত বড় জোয়ার কি আগে কখনো দেখেছে এ দেশের মানুষ? দেখেছে পৃথিবীর মানুষ?
সে জন্য এই ফেব্রুয়ারিটা অন্য রকম। এই দেশের তরুণেরা আমাদের বায়ান্ন দিয়েছিল, ঊনসত্তর দিয়েছিল। বুকের রক্ত দিয়ে একাত্তর দিয়েছিল। এখন তারা ২০১৩ দেবে?
আমরা অপেক্ষা করে আছি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
অমর একুশে ২০১৩ বিশেষ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৩
আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড
ছোট থাকতে আমাদের শেখানো হয়েছিল, ‘রোগই সংক্রামক স্বাস্থ্য নহে’। যার অর্থ খারাপ বিষয়গুলোই একজন থেকে অন্যরা শেখে, ভালোগুলো শেখে না। বড় হয়ে আবিষ্কার করেছি, আসলে কথাটা সত্যি না—ভালো বিষয়গুলোই একে অন্যের কাছ থেকে শেখে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড! প্রথম যখন শুরু করা হয়েছিল তখন সবার ভেতরেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল, এখন সেই দুশ্চিন্তা নেই। এর ভালো বিষয়গুলো সবাই শিখে গেছে, একজনকে দেখে অন্যজন শিখছে। শুধু তা-ই নয়, গণিতের সঙ্গে সঙ্গে দেশে এখন বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড, প্রাণরসায়ন অলিম্পিয়াড, ভাষা অলিম্পিয়াড, জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড এমনকি দাবা অলিম্পিয়াড পর্যন্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যই সংক্রামক রোগ নহে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, নামে অলিম্পিয়াড হলেও আসলে এগুলো হচ্ছে উৎসব। এই উৎসবে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের আনন্দে ছোটাছুটি দেখে মনে হয়, আহা রে! ছোট থাকতে আমাদের জন্য যদি কেউ এগুলো করত, কী মজাই না হতো!