- বইয়ের নামঃ অক্টোপাসের চোখ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
অক্টোপাসের চোখ
বিজ্ঞান আকাদেমির মহাপরিচালক মহামান্য কিহি কালো গ্রানাইট টেবিলের চারপাশে বসে থাকা অন্য সদস্যদের মুখের দিকে একনজর তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, অনেক দিন পর আজ আমি তোমাদের সবাইকে আমার এখানে ডেকে এনেছি। আমার ডাক শুনে তোমরা সবাই এসেছ সেজন্যে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
আকাদেমির তরুণ সদস্য ফিদা তার মাথার সোনালি চুলকে হাত দিয়ে পিছনে সরিয়ে বলল, মহামান্য কিহি, আপনি আমাদের ডেকেছেন, এটি আমাদের জন্যে কত বড় সৌভাগ্য!
অন্য সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল, বলল, অনেক বড় সৌভাগ্য।
মহামান্য কিহি মৃদু হেসে বললেন, অনেক বয়স হয়েছে, কখন পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়, তাই ভাবলাম একবার তোমাদের সবার সাথে বসি। একটু খোলামেলা কথা বলি।
জীববিজ্ঞানী রিকি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে আমরা এত সহজে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে দেব না। আপনি আরো অনেক দিন আমাদের সাথে থাকবেন।
অন্যেরাও মাথা নাড়ল, গণিতবিদ টুহাস সোজা হয়ে বসে বলল, মহামান্য কিহি, আপনি পৃথিবীর ইতিহাসে বিজ্ঞান আকাদেমির সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপরিচালক। আপনার সময়ে এই পৃথিবী সব দিক দিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গায় পৌঁছেছে।
বিজ্ঞানী ফিদা মাথাটা সামনে এগিয়ে এনে বলল, হ্যাঁ। এই মুহূর্তে পৃথিবী যে অবস্থায় পৌঁছেছে আর কখনো সেরকম অবস্থায় ছিল না। জ্ঞানে বিজ্ঞানে শিল্পে সাহিত্যে সব দিক দিয়ে পৃথিবীর মানুষ একটা নূতন অবস্থায় পৌঁছেছে।
গণিতবিদ টুহাস বলল, এর পুরো কৃতিত্বটা আপনার।
মহামান্য কিহি বাধা দিয়ে বললেন, না-না, তোমরা তোমাদের কথায় অতিরঞ্জন করছ। এটা মোটেই আমার একক কৃতিত্ব নয়। আমি কখনোই একা কোনো সিদ্ধান্ত নিই নি। তোমাদের সবার সাথে কথা বলেছি, কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কাজেই যদি কোনো কৃতিত্ব থাকে তা হলে সেটা আমার একার নয়-আমাদের সবার।
বিজ্ঞানী ফিদা বলল, কিন্তু নেতৃত্বটুকু দিয়েছেন আপনি।
মহামান্য কিহি বললেন, যাই হোক আমি এটা নিয়ে তোমাদের সাথে তর্ক করতে চাই। বরং তোমাদের কী জন্যে ডেকেছি সেটা নিয়ে কথা বলি।
সবাই মাথা নেড়ে সোজা হয়ে বসে উৎসুক চোখে মহামান্য কিহির দিকে তাকাল। মহামান্য কিহি খানিকটা অন্যমনস্কভাবে বললেন, এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে মানুষ হচ্ছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষ এই পর্যায়ে এসেছে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে, তার জন্যে সময় লেগেছে লক্ষ লক্ষ বছর। সেই দুইশ হাজার বছর আগের হোমোস্যাপিয়েন বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বর্তমান মানুষের পর্যায়ে এসেছে। এই বিবর্তনটুকু পুরোপুরি এসেছে প্রকৃতি এবং পরিবেশের প্রভাবে, স্বাভাবিকতাবে।
মহামান্য কিহি একটু থামলেন, তিনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মহামান্য কিহি আবার শুরু করলেন, বললেন, এই মুহূর্তে এই পৃথিবীতে মানব প্রজাতি তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অবস্থায় আছে। আমরা কি জানি, আজ থেকে এক লক্ষ বছর পর কিংবা এক মিলিয়ন বছর পর আমরা কোন পর্যায়ে থাকব? আমরা কি আমাদের মতোই থাকব নাকি অন্যরকম হয়ে যাব?
জীববিজ্ঞানী টুহাস বললেন, আমরা সিমুলেশন করে সেটা দেখেছি।
মহামান্য কিহি মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ, আমি সেই সিমুলেশন দেখেছি। তোমরাও দেখেছ। আমি দেখে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছি। এবং সেজন্যেই আমি তোমাদের ডেকেছি।
মহামান্য কিহি একটু থামলেন, সবার চোখের দিকে তাকালেন এবং বললেন, মানুষ প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এখানে এসেছে কিন্তু এখন বিজ্ঞানের মহিমায় আমাদের আর বিবর্তনের ওপর নির্ভর করতে হয় না। মানুষের ভেতরে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয় আমরা ইচ্ছে করলে সেটা আনতে পারি।
জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, মহামান্য কিহি! আপনি কি বলতে চাইছেন যে আমরা নিজে থেকে মানুষের ভেতরে কোনো পরিবর্তন আনি?
আমি সেটা সেভাবে বলতে চাইছি না। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি। বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্য হিসেবে এই পৃথিবীর মানবজাতির পুরো দায়িত্ব আমাদের হাতে। ভবিষ্যতের মানুষ এই পৃথিবীতে কীভাবে থাকবে সেটা নির্ভর করে বর্তমানের মানুষকে আমরা কীভাবে ভবিষ্যতের জন্যে প্রস্তুত করি। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি পৃথিবীর মানুষ কি ভবিষ্যতের জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত। মানবদেহ কি নিখুঁত?
হঠাৎ করে সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করল, আবার প্রায় সাথে সাথেই সবাই। চুপ করে গেল। জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, না মহামান্য কিহি, মানবদেহ নিখুঁত নয়, এর মাঝে অনেক ত্রুটি আছে-আমরা সবাই সেটা জানি। বিবর্তনের কারণে আমাদের চোখটা ভুল, চোখের ভেতরে আলো সংবেদন কোষ নিচে, নার্ভ উপরে। অক্টোপাসের চোখ হচ্ছে সঠিক।
বিজ্ঞানী ফিদা বলল, তুমি চোখের কথা বলছ কিন্তু আমরা তো সাধারণত চোখের সীমাবদ্ধতাটা দৈনন্দিন জীবনে টের পাই না। যেটা টের পাই সেটার কথা বল না কেন?
সেটা কী?
নবজাতকের মাথা। তুমি জান মানবশি মাথা কত বড়? একজন মায়ের গর্ভনালি দিয়ে মানবশিশু বের হতে পারে না, মায়ের সন্তান জন্ম দিতে কত কষ্ট হয় তুমি জান?
জীববিজ্ঞানী টুহাস বলল, আমি পুরুষ মানুষ, সন্তান জন্ম দিতে হয় না। তাই কষ্টের পরিমাণটুকু জানি না। কিন্তু বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি।
গণিতবিদ রিকি বলল, বিবর্তনের কারণে মানুষ হঠাৎ করে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু হাড়ের সংযোগটা মানুষের পুরো ওজন ঠিকভাবে নিতে পারে না। দুটি পা না হয়ে চারটি পা হলে ওজনটা ঠিকভাবে নিতে পারত। মানুষের হাঁটুও খুব দুর্বল।
প্রযুক্তিবিদ রিভিক কম কথা বলে, সে সবাইকে বাধা দিয়ে বলল, তোমরা কেউ এপেনডিক্সের কথা কেন বলছ না? এটা শরীরের কোনো কাজে লাগে না-হঠাৎ হঠাৎ সংক্রমিত হয়ে কী ঝামেলা করে দেখেছ?
রিভিকের কথার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল, জীববিজ্ঞানী সুহাস বলল, এটা ঝামেলা দিতে পারে কিন্তু এর রুত্ব কম। এর চাইতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরুষ এবং মহিলার জননেন্দ্রীয় এবং এগুলো কোনোভাবেই সঠিক নয়। এর অবস্থান খুবই বিপজ্জনক!
বিজ্ঞানী ফিদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল মহামান্য কিহি হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিলেন। মৃদু হেসে বললেন, আমি জানি মানবদেহের ডিজাইনের অসম্পূর্ণতা নিয়ে তোমাদের সবারই অনেক কিছু বলার আছে! আমরা ইচ্ছে করলে এটা নিয়ে সারা দিন কথা বলতে পারি। কিন্তু আমি সেটা করতে চাইছি না। আমাদের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারে মানবদেহের সীমাবদ্ধতার পুরো তালিকা রয়েছে। তোমরা এখন যা যা বলেছ সেখানে তার বাইরেও আরো অনেক বিষয় আছে। আমি তোমাদের কাছে জানতে চাইছি, আমরা কি প্রাকৃতিক বিবর্তনের ওপর ভরসা করে অপেক্ষা করে থাকব, নাকি আমরা নিজেরা মানবদেহের সীমাবদ্ধতাগুলো মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করব?
বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা আবার সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করলেন, কিছুক্ষণের মাঝেই তারা অবশ্য থেমে গেলেন। তারপর একজন একজন করে নিজের বক্তব্য বললেন। দীর্ঘ আলোচনার পর বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেয়া হল। বিজ্ঞান আকাদেমি সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিল মানবজাতির জিনোমে আগামী একশ বছরে খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনা হবে যেন একশ বছর পর মানবদেহে আর কোনো সীমাবদ্ধতা না থাকে। মানবদেহ হবে নিখুঁত, যেন তারা ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে অত্যন্ত সফল একটা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারে। সিদ্ধান্ত নেবার পর মহামান্য কিহি নরম গলায় বললেন, তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ভবিষ্যতের মানব আজকের এই সিদ্ধান্তের জন্যে তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।
সবাই মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানী ফিদা বলল, আপনার নেতৃত্ব ছাড়া আমরা কখনোই এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না মহামান্য কিহি।
***
বিজ্ঞান আকাদেমির মহাপরিচালকের সামনে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি মাথা তুলে বললেন, এটি আপনি কী বলছেন মহামান্য কিহি।
আমি এটা ঠিকই বলছি। আমি অনেক চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মহামান্য কিহি বললেন, তুমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ কর।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক বলল, আপনার দেহ সুস্থ এবং নীরোগ। আপনি আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। আপনি কেন এখনই শীতলঘরে যেতে চাইছেন?
মহামান্য কিহি বললেন, তার দুটি কারণ। প্রথমত, আমি নূতন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে চাই। আমি দীর্ঘদিন বিজ্ঞান আকাদেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি এখন অন্য কেউ করুক। দ্বিতীয়ত, আমি খুব বেশি বৃদ্ধ হয়ে অচল হবার আগেই শীতলঘরে যেতে চাই। আজ থেকে একশ বছর পর আমি জেগে উঠে পৃথিবীর মানুষকে দেখতে চাই। মানবদেহের সকল অসম্পূর্ণতা আর ত্রুটি দূর করার পর তারা পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করবে আমি সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক বিষণ্ণ গলায় বললেন, আপনি যদি সেটাই চান তা হলে আমরা সেটাই করব। তবে মহামান্য কিহি-পৃথিবীর মানুষ কিন্তু আপনাকে এভাবে হারাতে চাইবে না।
মহামান্য কিহি মৃদু হেসে বললেন, তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমাকে একটা শীতলঘরে রাখার ব্যবস্থা কর। আমাকে জাগিয়ে তুলবে আজ থেকে ঠিক একশ বছর পর।
চিকিৎসা কেন্দ্রের পরিচালক মাথা নুইয়ে বলল, আপনার আদেশ আমাদের সবার জন্যে শিরোধার্য।
***
ক্যাপসুলের ভেতর খুব ধীরে ধীরে চোখ খুললেন মহামান্য কিহি। ভেতরে আবছা এবং নীলাভ এক ধরনের আলো। মাথার কাছে কোনো একটা পোর্ট থেকে শীতল বাতাস বইছে, সেই বাতাসে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ। চোখের কাছাকাছি একটা প্যানেল সেখানে সবুজ আলোর একটা সংকেত, ছোট মিটারটিতে দেখাচ্ছে পৃথিবীতে এর মাঝে একশ বছর কেটে গেছে। মহামান্য কিহি শান্ত হয়ে শুয়ে রইলেন, তার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুক্ষণের মাঝেই সচল হয়ে উঠবে তখন তিনি এই ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবেন। তিনি নিজের ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতে থাকেন।
মহামান্য কিহি যখন ক্যাপসুল খুলে বের হয়ে এলেন তখন পৃথিবীতে সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল নেমে এসেছে। তিনি সুরক্ষিত ঘরের ভারী দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই বাইরের সতেজ সবুজ পৃথিবীর ঘ্রাণ অনুভব করলেন। চারপাশে বড় বড় গাছ, ঘাস উঁচু হয়ে আছে ওপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ। তিনি কান পেতে পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পেলেন, তার বুকের ভেতর তিনি এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করলেন, ফিসফিস করে নিজের মনে বললেন, আহা! এই পৃথিবীটা কী অপূর্ব। সৃষ্টিকর্তা তোমাকে ধন্যবাদ, আমাকে মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যে!
মহামান্য কিহি ঘাসের উপর পা দিয়ে সামনে হেঁটে যেতে থাকেন, তাকে একটা লোকালয়, একটা জনপদ খুঁজে বের করতে হবে। পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ মানুষকে নিজের চোখে দেখতে হবে। তার কৌতূহল আর বাধ মানতে চাইছে না। হঠাৎ মহামান্য কিহি এক ধরনের সতর্ক শব্দ শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন-খানিকটা দূরে কয়েকটি চতুষ্পদ প্রাণী তাদের চারপায়ের ওপর ভর করে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কী বিচিত্র এই প্রাণীটি আর কী বিচিত্র তার দৃষ্টি, তার সময়ে কখনো তিনি এই ধরনের কোনো প্রাণী দেখেন নি।
প্রাণীগুলো এক ধরনের হিংস্র শব্দ করতে করতে হঠাৎ চারপায়ে ভর করে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে এবং হঠাৎ করে মহামান্য কিহি বুঝতে পারেন এগুলো আসলে মানুষ। ভয়াবহ আতঙ্কের একটা শীতল স্রোত ভঁর মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায় তার ভবিষ্যতের মানুষের এটি কোন ধরনের পরিণাম? মানুষগুলো একটু কাছে এলে তিনি বুঝতে পারেন। মাদের সন্তান জন্ম দেবার কষ্ট লাঘব করার জন্যে এদের মাথা ছোট করে দেয়া হয়েছিল, সেজন্যে মস্তিষ্কের আকারও ছোট হয়েছে। এখন তারা আর বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ নয়, তারা এখন বুদ্ধিবৃত্তিহীন পশু। তারা সবাই উলঙ্গ, কাপড় পরার প্রয়োজনীয়তাটুকু পর্যন্ত অনুভব করে না। শরীরের ওজন সঠিকভাবে ছড়িয়ে দেবার জন্যে তারা এখন চার হাত-পায়ে ছোটাছুটি করে। বিবর্তনে মানুষ একবার দুই পায়ে দাঁড়িয়েছিল এখন উল্টো বিবর্তনে আবার তারা চার পায়ে ফিরে গেছে। মহামান্য কিহি এই মানুষগুলোর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন। তাদের ভেতরে আরো অনেক সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সেগুলো বোঝার আগেই মানুষগুলো তাকে ধরে ফেলল-তারা তাদের হাতগুলো এখনো ব্যবহার করতে পারে। শক্ত হাতে তাকে ধরে ফেলে হিংস্র শব্দ করতে করতে মানুষগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে তার কণ্ঠনালি ছিঁড়ে ফেলল।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তাদের চোখের দিকে একবার তাকাতে পেরেছিলেন, বোধহীন পত্র হিংস্র চোখ, কিন্তু সেগুলো ছিল নিখুঁত অক্টোপাসের চোখ।
এক্সপেরিমেন্ট
মধ্যবয়স্ক প্রফেসর মহিলাটিকে বললেন, এই যে এটা হচ্ছে ডায়াল আর এটা হচ্ছে সুইচ। ডায়ালটা যত বেশি ঘোরাবেন ভোল্টেজ তত বেশি হবে। যখন সুইচ টিপে ধরবেন তখন ঐ মানুষটা ইলেকট্রিক শক খাবে।
নির্বোধ ধরনের মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, ঐ মানুষটা কি আমাকে দেখতে পাবে?
না, আপনাকে দেখতে পাবে না।
ইলেকট্রিক শক দিলে কি মানুষটার কষ্ট হবে?
অবশ্যই কষ্ট হবে? প্রফেসর হা হা করে হেসে বললেন, ইলেকট্রিক শক খেলে মানুষের কষ্ট হয় জানেন না?
তা হলে ঐ মানুষটা শক খেতে রাজি হয়েছে কেন?
দুটি কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে এটা একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। আমরা দেখতে চাচ্ছি একজন মানুষ সবচেয়ে বেশি কত ভোল্টেজের ইলেকট্রিক শক কতক্ষণ সহ্য করতে পারে। এই মানুষটা সেই এক্সপেরিমেন্টে বসে ইলেকট্রিক শক খেতে রাজি হয়েছে।
গাধা টাইপের মানুষ?
খানিকটা বলতে পারেন। তবে দ্বিতীয় একটা কারণ আছে–এই মানুষটা যে এক্সপেরিমেন্টে বসতে রাজি হয়েছে সে জন্যে আমরা তাকে কিছু টাকাপয়সা দিব।
কত টাকা?
প্রফেসর হাসার ভঙ্গি করে বললেন, সেটা নাই বা শুনলেন। আমরা টাকার পরিমাণটা গোপন রাখছি।
নির্বোধ ধরনের মহিলাটি বড় চোখ বড় বড় করে বলল, অনেক টাকা নিশ্চয়ই?
মোটামুটি।
তা হলে মনে হয় মানুষটা গাধা টাইপের না। একটু চালু টাইপের।
আপনি সেটাও বলতে পারেন।
মহিলাটি ডায়াল এবং সুইচটা পরীক্ষা করে বলল, আচ্ছা খুব বেশি ইলেকট্রিক শক খেয়ে মানুষটা কি মরে যেতে পারে?
প্রফেসর বললেন, না, মারা যাবার কোনো আশঙ্কা নেই-মানুষটা কষ্ট পাবে, ভোল্টেজ যদি বেশি হয় তা হলে অমানুষিক কষ্ট, কিন্তু মারা যাবে না।
যদি মরে যায়?
মরবে না। আপনার কোনো ভয় নেই-আপনি নিশ্চিত মনে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যান। তা ছাড়া মানুষটাকে দিয়ে বন্ড লিখিয়ে নিয়েছি। এই এক্সপেরিমেন্ট করার কারণে তার যদি শারীরিক কোনো ক্ষতি হয় তা হলে আমরা তার জন্যে দায়ী হব না।
মহিলাটির চেহারায় সন্তুষ্টির ছাপ পড়ল, বলল, সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করতে পারবে না।
না পারবে না। মধ্যবয়স্ক প্রফেসর বললেন, তা হলে আমরা কাজ করি কী বলেন?
ঠিক আছে।
প্রফেসর বললেন, আপনার কাজ খুব সহজ। ডায়ালটা ঘোরাবেন আর সুইচ টিপে ধরবেন। ভেতরে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা আছে সবকিছু রেকর্ড হয়ে যাবে। যখন এক্সপেরিমেন্ট শেষ হয়ে যাবে আমাদের ডাক দেবেন।
ঠিক আছে।
মহিলাটি ছোট জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল, মানুষটা একটা চেয়ারে বসে আছে, চোখেমুখে একটু বেপরোয়া ভাব, তবুও বোঝা যাচ্ছে একটু একটু ভয় পাচ্ছে। দুটো হাত চেয়ারের হাতলের সাথে আর পা চেয়ারের পায়ের সাথে বেল্ট দিয়ে বাঁধা, মানুষটা যেন হঠাৎ করে উঠে চলে যেতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা। মানুষটার দুই হাতে দুইটা ধাতব স্ক্র্যাপ লাগানো সেখান থেকে ইলেকট্রিক তার বের হয়ে এসেছে, এই দুটি ইলেকট্রিক তার দিয়ে মানুষটাকে শক দেয়া হবে। গোলাপি রঙের একটা টি শার্ট আর জিনসের প্যান্ট পরে। আছে, মাথার চুল এলোমেলো, গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। মুখে দু তিন দিনের না কামানো দাড়ি।
মহিলাটি ডায়ালটা সাবধানে একটু ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরল, সাথে সাথে চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা একটু কেঁপে উঠে এদিক-সেদিক তাকাল। ছোট একটা ইলেকট্রিক শক খেয়েছে মনে হয়। মহিলাটি ডায়ালটা আরেকটু ঘুরিয়ে আবার সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা কেঁপে উঠে একটা ছোট শব্দ করল। হঠাৎ করে এই মানুষটার চেহারায় একটা ভয়ের ছাপ পড়ে। সে এদিকে সেদিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে শুরু করেছে।
মহিলাটি ডায়ালটা আরেকটু ঘুরিয়ে আবার সুইচ টিপে ধরতেই মানুষটা প্রথমবার একটু চিৎকার করে উঠল। তার মুখে এই প্রথমবার শুধু ভয় নয় আতঙ্কের ছাপ পড়েছে। মহিলাটি আবার ডায়াল একটুখানি ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা হঠাৎ বিচিত্র ভঙ্গিতে কেঁপে ওঠে, তার মুখটা বিকৃত হয়ে যায়, এবং তার ভেতরে সে গোঙানোর মতন শব্দ করে ওঠে। মহিলাটা জিব দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়, মনে হচ্ছে এখন সত্যিকার অর্থে ইলেকট্রিক শক দেয়া শুরু হয়েছে-সে ডায়ালটার দিকে তাকাল এখনো অনেক দূর যাওয়া বাকি। মাত্র শুরু হয়েছে-যখন আরো বেশি শক দেয়া হবে মানুষটা কী করবে কে জানে।
মহিলাটি ডায়ালটা বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে সুইচটা টিপে ধরতেই মানুষটা চেয়ার থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে, থরথর করে সারা শরীর কাঁপতে থাকে সাথে সাথে সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে-যন্ত্রণার অমানুষিক একটা চিৎকার। সুইচটা যতক্ষণ টিপে রাখার কথা মহিলাটি তার থেকে কয়েক মুহূর্ত বেশি সময় টিপে ধরে রাখল। মানুষটাকে যন্ত্রণা দেয়ার মাঝে অত্যন্ত বিচিত্র একটা আনন্দ রয়েছে যেটা সে আগে কখনোই অনুভব করে নি। চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা এবারে সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে, তার সারা মুখ ফ্যাকাসে এবং রক্তশূন্য, মুখ হাঁ করে রেখেছে এবং চোখগুলোতে অবর্ণনীয় আতঙ্ক।
মহিলাটি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ডায়ালটা আরো বেশ খানিকটা ঘুরিয়ে কাঁপা হাতে সুইচটা টিপে ধরে সাথে সাথে চেয়ারে বেঁধে রাখা মানুষটা অমানুষিক যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। তার সারা শরীর এক ধরনের ভয়াবহ খিচুনিতে থরথর করে কাঁপছে। মনে হয় চোখ দুটো কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসছে। মানুষটা মুখ হাঁ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু মনে হচ্ছে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
যন্ত্রণাকাতর মানুষটিকে দেখে মহিলাটির মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে আসে। সে সুইচটা টিপে ধরে রেখে অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে ওঠা মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে, নিজের অজান্তেই সে একটু পরে পরে মুখে লোল টেনে নিতে থাকে।
.
মনিটরে মহিলাটির কঠিন মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রফেসর নিচু গলায় তার সহকর্মীকে বললেন, কেমন দেখছ?
অবিশ্বাস্য। একজন মানুষ যে অকারণে আরেকজন মানুষকে এভাবে কষ্ট দিতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। সহকর্মী মাথা নেড়ে বলল, আমার রীতিমতো শরীর খারাপ লাগছে।
প্রফেসর সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন তোমার শরীর খারাপ লাগছে? তুমি তো জানো এখানে কোনো ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে না–পুরোটাই মানুষটার অভিনয়।
জানি। আমি খুব ভালো করে জানি। সবকিছু তো আমিই তৈরি করেছি-যন্ত্রপাতি পুরোটাই বোগাস আমি সেটা জানি। কিন্তু মানুষটার অভিনয় এত রিয়েলিস্টিক মনে হচ্ছে আসলেই বুঝি ইলেকট্রিক শক খাচ্ছে!
প্রফেসর দুলে দুলে হাসতে হাসতে বললেন, উনিশ শ একষট্টি সালে স্ট্যানলি মিলগ্রাম প্রথম এই এক্সপেরিমেন্টটা করেছিলেন। সারা পৃথিবীতে তখন হইচই পড়ে গিয়েছিল।
পড়ারই কথা। নির্বোধ মহিলাটা ভাবছে সে এক্সপেরিমেন্ট করছে! আসলে তাকে নিয়েই যে এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে সে জানতেও পারছে না।
প্রফেসর বললেন, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে মজার ব্যাপার।
সহকর্মী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু কী লাভ এই রকম এক্সপেরিমেন্ট করে? আমরা তো এক্সপেরিমেন্ট ছাড়াই জানি মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে!
প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। ভাসা ভাসা জানি ঠিক করে জানি না। এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে এতগুলো টাকা পেয়েছি কেন এক্সপেরিমেন্ট করব না?
সহকর্মী সোজা হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ, অনেকগুলো টাকা দিয়েছে এই প্রজেক্টে, সেরকম খরচ তো নেই!
খরচ নেই তো কী হয়েছে? খরচ করে ফেলব! আমাদের এই অভিনেতাকে টাকা দিয়ে খুশি করে দেব। এরকম প্রফেশনাল অভিনেতা না হলে এই এক্সপেরিমেন্টটা এত ভালো করে করতে পারতাম? কিছু যন্ত্রপাতি কিনব। দেশে বিদেশে কনফারেন্সে যাব-টাকা খরচ করা কোনো সমস্যা নাকি?
সহকর্মী প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু একটা প্রাইভেট কোম্পানি আপনাকে গবেষণা করার জন্যে এত টাকা কেন দিল?
প্রফেসর মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। মনে হয় গাধা টাইপের কোম্পানি! ম্যানেজিং ডিরেক্টর মানুষটাও মনে হয় গাধা টাইপের–
কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রফেসরের ঘরে গোপনে বসিয়ে রাখা ক্যামেরাতে প্রফেসরকে লক্ষ করছিলেন। পাশে বসে থাকা সেক্রেটারি বলল, স্যার, শুনলেন? বলছে আমাদের কোম্পানিটা নাকি গাধা টাইপের আর আপনিও নাকি গাধা টাইপের মানুষ।
শুনেছি।
চার পয়সার প্রফেসরের কত বড় সাহস! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর তার সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রেগে উঠছ কেন?
রাগব না? এরকম কথা শুনলে রাগ হয় না?
দেখ-আমরা গোপনে তার কথা শুনছি। পুরো কাজটা বেআইনি। এরকম বেআইনি কাজ করলে কিছু বেফাঁস কথা শুনতে হয়। তা ছাড়া প্রফেসর তো মিথ্যে বলে নি। এরকম হাস্যকর একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্যে আমরা এত টাকা ঢালছি-তার কাছে মনে হতেই পারে আমরা বোকা। গাধা টাইপের।
কিন্তু কী জন্যে ঢালছি সেটা তো জানে না।
না। জানার কথা না। সে কেমন করে জানবে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার এটা একটা রাস্তা। কোম্পানির কোটি কোটি টাকা আমরা হালাল করে নেব এই চার পয়সার প্রফেসরকে স্বল্প কিছু টাকা দিয়ে। সরকারি মানুষদের বোকা বানানো খুবই সোজা। তবে গোয়েন্দা বাহিনীর নূতন ডিরেক্টর নাকি একটু ত্যাঁদড় টাইপের, শুধু তার থেকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।
.
গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান একটা নিঃশ্বাস ফেলে ইলেকট্রনিক ডিভিশনের কম বয়সী অফিসারকে জিজ্ঞেস করল, পুরোটা রেকর্ড করেছ?
জি স্যার করেছি।
কত বড় সাহস! আমাকে বলে ত্যাঁদড় টাইপের। নূতন ইলেকট্রিক সারভেইলেন্সের যন্ত্রপাতির খবর তো রাখে না তাই এরকম আজেবাজে কথা বলে। যদি জানত আমি সব কোম্পানির সব ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে চোখে চোখে রাখছি-তা হলে এদের সবার পেটের ভাত চাল হয়ে যেত!
ইলেকট্রনিক ডিভিশনের অফিসার বলল, জি স্যার।
একদিক দিয়ে ভালোই হল।
কী ভালো হল স্যার?
এই যে তার পুরো কথাবার্তা রেকর্ড হয়ে থাকল। এই ম্যানেজিং ডিরেক্টর ব্যাটাকে কালকে ডেকে আনব! এইখানে বসিয়ে তাকে এই পুরো ডিডিওটা দেখিয়ে বলব-সোনার চাঁদ এখন বল কে ত্যাঁদড়? তুমি না আমি!
কিন্তু স্যার তা হলে তো জেনে যাবে আমরা সবাইকে সারভেইলেন্সে রেখেছি।
জানুক। না জানলে সে আমাকে টাকাপয়সা দেবে? সবাই আখের গুছিয়ে নিয়েছে। আর আমি এখনো কিছু করতে পারলাম না। এই তো সুযোগ—
ইলেকট্রনিক ডিভিশনের অফিসার বলল, কিন্তু স্যার, আমাদের প্রেসিডেন্ট বলেছেন এটা গোপন রাখতে। সারভেইলেন্সের কথা সবাই জেনে গেলে দেশে হইচই হতে পারে-
গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, আরে! গুল্লি মারো প্রেসিডেন্টের। বুড়ো হাবড়া একটা প্রেসিডেন্ট–
.
প্রেসিডেন্ট দেয়ালে লাগানো মনিটরের দিকে তাকিয়ে টেবিলটা খামচে ধরে নিজের মনে বিড়বিড় করে বললেন, আমি বুড়ো হাবড়া? তুমি কত বড় গর্দভ যে আমার সম্পর্কে এরকম কথা বল? তুমি জান না-আমি পরপর তিনবার এই দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছি? কেউ কি ঘাস খেয়ে একটা দেশের তিনবার প্রেসিডেন্ট হয়?
বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট তার অফিসের নরম চেয়ারে শরীর ডুবিয়ে দিয়ে মনিটরে গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধানের ধূর্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মানুষটাকে কীভাবে শাস্তি দেয়া যায় তার নানা ধরনের পরিকল্পনা প্রেসিডেন্টের মাথায় খেলতে থাকে।
.
তোমার কী মনে হয়? প্রেসিডেন্ট কী রকম শাস্তি দেবে?
মেরে ফেলবে। নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে।
মেরে তো ফেলবেই। কীভাবে মারবে?
দাঁড়াও, মাথাটার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি
একটি মহাজাগতিক প্রাণী প্রেসিডেন্টের মাথায় উঁকি দিয়ে তার নিউরনগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। কোন পরিবেশে মানুষ কী করে সেটা সে ভালো করে জানতে চায়।
অনেক দিন থেকেই তারা পৃথিবী নামে একটা গ্রহের মানুষদের নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছে।
কাবিনের জীবনের একটি দিন
কাবিনের স্ত্রী মুলান ম্লান মুখে বলল, আমাদের কিন্তু টেনেটুনে বড় জোর এক সপ্তাহ চলবে।
মাত্র এক সপ্তাহ? কাবিনের বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু সে সেটা বুঝতে দিল না। মুখে এক ধরনের শান্তভাব বজায় রেখে বলল, তার মাঝে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কীভাবে হবে?
কাবিন জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, শুধু কি আমাদের এক সপ্তাহের মতো ব্যবস্থা আছে? আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ আছে, সবারই এক অবস্থা। সারা পৃথিবীতে এখন এই নিয়ে হইচই হচ্ছে।
হইচই হয়ে কী লাভ? যদি কাজ না হয় তা হলে হইচই করে কী হবে?
কাজ হবে। নিশ্চয়ই কাজ হবে। সাধারণ মানুষ একবার খেপে গেলে কোনো উপায় থাকে না।
মুলান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিশানের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন ছেলেটার জন্ম দিলাম।
নূতন করে আর কী অমঙ্গল হবে? সারা পৃথিবী জুড়েই কি অমঙ্গল হচ্ছে না?
কাবিন কোনো কথা বলল না। মাথায় টুপিটা বসিয়ে ঘাড়ে ঝোলাটা নিয়ে মুলানের দিকে তাকিয়ে খানিকটা অন্যমনস্কভাবে হাত নেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পথে একটু পরে পরেই মানুষের জটলা, সবার ভেতরে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ, মনে হয় একটা বিস্ফোরণের পথ খুঁজছে। পার্কের সিঁড়িতে একজন মানুষ হাত নেড়ে কথা বলছিল, তাকে ঘিরে একটা ছোট ভিড় জমে গেছে। কাবিন একটু এগিয়ে যেতেই মানুষটার গলার আওয়াজ শুনতে পেল, সে চিৎকার করে বলছে, এই যে ভাই, তোমরা দেখেছ আমাদের অবস্থা? বিশ্বাস হয় নিজের চোখকে? আমরা এখন একদিন একদিন করে বেঁচে আছি। অন্য মানুষের লোভের মূল্য দিচ্ছি আমরা। আমি, তুমি আর অন্যেরা। কেন আমাদের তাদের লোতের জোগান দিতে হবে? কেন?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভেতর থেকে কয়েকজন গলা উঁচিয়ে বলল, কেন? কেন?
তার কারণ আমরা সেটা হতে দিয়েছি। আমরা তাদের লম্বা জিবকে সহ্য করেছি। তোমরা বল, তোমরা কি আরো সহ্য করতে চাও? ধুকে ধুকে মরতে চাও?
অনেকে চিৎকার করে বলল, চাই না! চাই না!
যদি না চাও তা হলে কিন্তু রাস্তায় নামতে হবে। মানুষটা হাত তুলে চিৎকার করে বলল, বল, তোমরা রাস্তায় নামতে রাজি আছ কি না?
অসংখ্য মানুষ চিৎকার করে বলল, আছি। আছি।
চল তা হলে। সবাই মিলে যাই।
একজন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
প্রথমে কংগ্রেস ভবনে। সেটা ঘেরাও করতে হবে। সিনেটরদের জিজ্ঞেস করতে হবে তারা আমাদের রক্ষা করবে নাকি আমরা নিজেদের রক্ষা করব?
একজন চিৎকার করে বলল, সিনেটররা ধ্বংস হোক।
অসংখ্য মানুষ চিৎকার করে বলল, ধ্বংস হোক। ধ্বংস হোক।
পার্কের সিঁড়িতে আধবুড়ো একজন মানুষ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কংগ্রেস ভবন ঘেরাও করে কোনো লাভ নেই।
তা হলে কী ঘেরাও করতে হবে?
ঘেরাও করার সময় চলে গেছে। আধবুড়ো মানুষটা হাত তুলে চিৎকার করে বলল, এখন আমাদের ছিনিয়ে নেয়ার সময়।
অসংখ্য মানুষ চিৎকার করে বলল, ছিনিয়ে নাও। ছিনিয়ে নাও।
আধবুড়ো মানুষটা উন্মত্তের মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ভাইয়েরা আমার! তোমাদের যদি বুকে বল থাকে, তা হলে চল আমরা কোম্পানি দখল করে তার মজুত করে রাখা সবকিছু লুট করে নিই।
দেখতে দেখতে মানুষের ভিড় অনেক বেড়ে গেছে, তার ভেতর থেকে ক্রোধোন্মত্ত মানুষ হুংকার দিয়ে বলল, ছিনিয়ে নাও! লুট করে নাও! পুড়িয়ে দাও।
কিছু বোঝার আগেই কাবিন আবিষ্কার করল বিশাল একটা জনস্রোতের সাথে সে এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষজন চিৎকার করছে, হাত-পা শূন্যে ছুঁড়ে বুকের ভেতর চেপে থাকা। ক্রোধটি প্রকাশ করছে, সূর্যটা গনগনে হয়ে উপরে উঠছে আর তার প্রচণ্ড উত্তাপে সবার ক্রোধকে যেন শতগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। জনস্রোতটা যতই এগুতে থাকে ততই ফুলে ক্ষেপে উঠতে থাকে, পুঞ্জীভূত ক্রোধ ততই বিস্ফোরণোন্মুখ হতে থাকে।
সিনেটর কাজিস্কী টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, এরা কারা। কী করছে?
সেক্রেটারি মেয়েটি নিচের ঠোঁটটি দাঁতে কামড়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, পাবলিক।
পাবলিক? পাবলিক এমন খেপেছে কেন? কোথায় যাচ্ছে?
প্রথমে ঠিক করেছিল কংগ্রেস ভবন ঘেরাও করবে।
সিনেটর কাজিস্কী চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ। তারপর?
তারপর ঠিক করেছে অক্সিরন কোম্পানি ঘেরাও করবে।
অক্সিরন? অক্সিরন কেন?
সবার ধারণা অক্সিরন তাদের প্রোডাকশন কমিয়ে দিয়েছে, সবকিছু কালোবাজারিতে চলে গেছে। দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে।
সিনেটর কাজিস্কী ইতস্তত করে বলল, কিন্তু মানে ইয়ে- বাক্যটা অসম্পূর্ণ রেখে সে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষগুলোর হাতে লাঠিসোটা কেন?
সবাই খুব রেগে আছে।
রেগে আছে? রেগে আছে কেন?
সেক্রেটারি মেয়েটি খুব কষ্ট করে মুখে স্বাভাবিক একটা ভাব ফুটিয়ে রেখে বলল, রেগে আছে কারণ কারো বাসায় একদিনের কারো বাসায় দুদিনের-বড় জোর এক দুই সপ্তাহের সাপ্লাই আছে।
সাপ্লাই না থাকলে কিনে নেবে, এটা নিয়ে এত হইচই করার কী আছে?
কেনার পয়সা নেই। দাম আকাশছোঁয়া।
সিনেটর কাজিস্কী তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, কী মুশকিল! এই লোকগুলো অক্সিরনে গিয়ে কী করবে?
ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট বলছে মানুষগুলো ঠিক করেছে অক্সিরন কোম্পানি লুট করে পুরো কোম্পানি জ্বালিয়ে দেবে।
সিনেটর কাজিস্কী তার চেয়ারে প্রায় লাফিয়ে উঠল, কী বলছ তুমি?
জি স্যার! সেইটাই রিপোর্ট।
সর্বনাশ! পুলিশ মিলিটারি পাঠানো হয়েছে? সিকিউরিটি ফোর্স?
যাচ্ছে স্যার। কিন্তু
কিন্তু কী?
এই লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠেকানোর ক্ষমতা পুলিশ মিলিটারির নেই।
কেন থাকবে না? গুলি করবে। ক্রশফায়ার করবে।
সেক্রেটারি মেয়েটি শীতল চোখে সিনেটর কাজিস্কীর দিকে তাকিয়ে থাকে, সে নিজের ভেতরে এক ধরনের ঘৃণা অনুভব করে। বিষয়টি কারো অজানা নেই অক্সিরন কোম্পানির শেয়ারের বড় অংশের মালিক সিনেটর কাজিস্কীর পরিবার। তাই বুঝি কোম্পানিটাকে বাচানোর জন্যে এত সহজে মানুষকে ব্রাশফায়ারে গুলি করে মেরে ফেলার কথা বলতে পারে।
সিনেটর কাজিস্কী ছটফট করে টেলিভিশনের দিকে তাকায়, বিড়বিড় করে বলে, কী আশ্চর্য! মানুষগুলো দেখি পশু হয়ে যাচ্ছে? একজনের চেহারা দেখেছ? কী ভয়ংকর?
সেক্রেটারি মেয়েটি কোনো কথা বলল না। তার কথা বলার রুচি হল না।
.
অক্সিরন কোম্পানির সামনে সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষেরা পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সঁজোয়া গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে একজন অফিসার মেগাফোনে চিৎকার করে বলল, সবাইকে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। এই মুহূর্তে চলে যেতে বলা হচ্ছে। কোনোরকম বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না। বিশৃঙ্খলা সহ্য করা হবে না।
লক্ষ লক্ষ মানুষের চিৎকারে অফিসারের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল। সমুদ্রের গর্জনের মতো মানুষের হুংকার দিয়ে বলল, ধ্বংস হোক! ধ্বংস হোক! জ্বালিয়ে দাও! পুড়িয়ে দাও! ছিনিয়ে নাও ছিনিয়ে নাও!
নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষেরা তাদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, সোজাসুজি জনতার দিকে তাক করে ধরে রাখে। সূর্যের আলোতে অস্ত্রের ধাতব নলগুলো চকচক করতে থাকে।
মাথায় একটা লাল রুমাল বাঁধা মধ্যবয়স্ক মানুষ লাফিয়ে একটা গাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, সংগ্রামী বন্ধুরা আমার! তোমরা কি প্রাণ দিতে প্রস্তুত?
হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে বলল, প্রস্তুত!
আমরা আমাদের প্রাণ দিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যে নূতন একটা পৃথিবী দিয়ে
যাব।
মানুষ চিৎকার করে বলল, দিয়ে যাব! দিয়ে যাব!
তা হলে সবাই প্রস্তুত হও। মানুষটা খ্যাপার মতো হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, আমরা এই মিলিটারিদের পদদলিত করে এগিয়ে যাব! তাদের গুলিতে হয়তো আমি তুমি মারা যাব, কিন্তু তারপরেও আমাদের লক্ষ লক্ষ জনতা থাকবে। তারা দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে! অক্সিরনের পুরো ভবন জ্বালিয়ে দেবে। মজুদ রাখা সবকিছু ছিনিয়ে নেবে! আমরা পৃথিবীর ইতিহাস থেকে অক্সিরনের নাম চিরদিনের জন্যে মুছে দেব।
লক্ষ লক্ষ মানুষ চিৎকার করে বলল, মুছে দেব। মুছে দেব!
তোমরা প্রস্তুত? প্রাণ দিতে প্রস্তুত?
প্রস্তুত প্রস্তুত!
কাবিন হতচকিতের মতো মাথায় লাল রুমাল বাধা মানুষটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঐ বিশাল জনস্রোত এক্ষুনি বাঁধভাঙা পানির মতো ছুটে যবে, তারপর কিছু বোঝার আগেই গুলি খেয়ে শত শত মানুষ মরে যাবে। দরিদ্র দুর্ভাগা মানুষ, তাদের মৃত্যুতে কার কী এসে যাবে? দেশের বা পৃথিবীর কী ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে? চোখের সামনে এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড সে কেমন করে দেখবে?
কিছু বোঝার আগেই কাবিন হঠাৎ করল সে লাফিয়ে লাল রুমাল বাধা মানুষটার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে সে হাত নেড়ে চিৎকার করে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা! আমার একটা কথা শুনো–
মানুষেরা গর্জন করে উঠল, কী কথা?
আমার বাসায় একটি অসুস্থ শিশু আছে। সে আশা করে আছে আমি সারা জীবনের জন্যে তার দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে দেব। তার বদলে যদি আজ বিকেলে আমার লাশ পৌঁছানো হয় সে কি খুশি হবে?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রুদ্ধ মানুষেরা চিৎকার করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
সেটা বলার আগে তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
কী প্রশ্ন?
তোমার বাসায় কি তুমি তোমার সন্তানদের রেখে এসেছ? তোমার স্ত্রীদের রেখে এসেছ? তারা কি তোমার লাশের জন্যে অপেক্ষা করছে?
উপস্থিত জনসমুদ্র হঠাৎ করে থমকে যায়। নিজেদের ভেতর নিচু স্বরে কথা বলতে থাকে। সেটা একটা গুঞ্জরনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কাবিন গলা উঁচিয়ে বলল, তোমাদের স্ত্রী আর তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের লাশের জন্যে অপেক্ষা করছে না! তুমি আমি লাশ হয়ে গেলে অক্সিরনের কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা ভেতরে ঢুকে এই কোম্পানি জ্বালিয়ে দিলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না-ইন্স্যুরেন্স থেকে তারা শেষ পাই পয়সা পর্যন্ত পেয়ে যাবে। তা হলে কেন আমরা এটা করতে চাইছি? যেটা করা দরকার সেটা কেন করছি না?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষ চিৎকার করে বলল, কী করা দরকার?
অক্সিরনের বারোটা বাজিয়ে দেই না কেন? তাদের মেরুদণ্ড কেন ভেঙে দিই না।
কীভাবে ভেঙে দেব?
খুবই সোজা। তোমরা যারা দাঁড়িয়ে আছ সবাই হাত তুলে বল তোমরা জীবনে কখনো অক্সিরনের কিছু কিনবে না, তোমার মুখের কথাটি উচ্চারণ করার আগে তাদের শেয়ারে ধস নামবে। এক মিনিটের ভেতর কোম্পানির লাল বাতি জ্বলে যাবে।
সামনে দাঁড়ানো লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের ভেতর কথা বলতে থাকে। তারা পুরো ব্যাপারটা এখনো বুঝতে পারছে না। কাবিন চিৎকার করে বলল, তোমরা যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর, তা হলে এখনই সেটা পরীক্ষা করে দেখ! হাত তুলে আমার সাথে সাথে বল, আমরা জীবনে অক্সিরনের কোনো কিছু কিনব না!
লক্ষ লক্ষ মানুষ হাত তুলে বলল, আমরা জীবনে অক্সিরনের কোনো জিনিস কিনব না।
.
সিনেটর কাজিস্কী মাথার চুলে খামচে ধরে শূন্য দৃষ্টিতে সেক্রেটারি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখছ কী হচ্ছে?
সেক্রেটারি মেয়েটি বলল, দেখছি। অক্সিরন কোম্পানিটা বাতাসের মতো উবে যাচ্ছে। দেখেন শেয়ারবাজারটা দেখাচ্ছে।
সিনেটর কাজিস্কী বিড়বিড় করে বলল, এর চাইতে অনেক ভালো ছিল যদি মানুষগুলো কোম্পানিটা জ্বালিয়ে দিত।
সেক্রেটারি মেয়েটি কোনো কথা না বলে শীতল দৃষ্টিতে সিনেটর কাজিস্কীর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
মুলান হাসি হাসি মুখে কাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি টেলিভিশনে তোমাকে দেখেছি।
তাদের ছোট ছেলে কিশান বলল, আমিও দেখেছি।
কাবিন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, সবাই দেখেছে।
মুলান বলল, তোমার অনেক বুদ্ধি।
সব বুদ্ধি সব সময় কাজে লাগে না-এটা কাজে লেগেছে।
কোম্পানিটা শেষ হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। নিলামে বিক্রি হয়ে গেছে। নূতন ম্যানেজমেন্ট দায়িত্ব নিয়েছে। তারা আর বদমাইশি করবে না। মজুদ যা ছিল সব বিক্রি করে দিয়েছে।
কী মজা!
হ্যাঁ, আমি এক বছরের সাপ্লাই কিনে এনেছি।
মুলান হাসি হাসি মুখে বলল, এক বছর! এক বছর আমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না?
না। এক বছর আমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না।
ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক জেনেও কাবিন তার মুখের উপর লাগানো অক্সিজেন মাস্কটি খুলে শিশুসন্তান কিশানের গালে চুমু খেয়ে আবার মাস্কটি পরে নেয়। তাদের সবার মুখেই অক্সিজেন মাস্ক লাগানো-পৃথিবীর মানুষ পুরো বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত করে ফেলেছে। কেউ এখন এই বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে না, দোকান থেকে অক্সিজেন কিনে সেই অক্সিজেনে নিঃশ্বাস নিতে হয়।
মানুষ আগে যেরকম খাওয়ার জন্য খাবার কিনে রাখত, এখন সেরকম নিঃশ্বাস নেবার জন্যে বাতাস কিনে রাখে।
চাঁদ
আজহার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, শালা হারামজাদা।
সাজ্জাদ চমকে উঠে বলল, কী বললেন?
বলেছি শালা হারামজাদা।
কাকে বললেন?
চাঁদটাকে।
আজহার আর সাজ্জাদ অফিসের কাজে এই এলাকায় এসে ছিমছাম একটা গেস্ট হাউজে উঠেছে। রাতে খাবার পর দুজনে হাঁটতে বের হয়েছে, গাছপালা ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হতেই হঠাৎ করে থালার মতো বিশাল পূর্ণিমার চাঁদটা তাদের চোখে পড়েছে। শহরের ব্যস্ত কাজকর্মের মাঝে কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, এই নিরিবিলি এলাকায় না চাইলেও আকাশের দিকে তাকাতে হয়, চাঁদটা দেখতে হয়।
সাজ্জাদ জোছনার আলোতে আজহারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে বলল, আপনি চাঁদটাকে শালা হারামজাদা বলে গালি দিচ্ছেন?
আজহার মুখ শক্ত করে বলল,হ্যাঁ দিচ্ছি।
কেন?
ওই শালা হারামজাদার জন্যে আমি আমার লাইফের সবচেয়ে বড় দাওটা মারতে পারি নি। যদি মারতে পারতাম তা হলে এখন আমি ব্যাংকক সিঙ্গাপুরে ফাইভস্টার হোটেলে বিজনেস করতাম। আপনার সাথে এই পাড়গ্রামের রেস্ট হাউজে কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে অন্ধকারে মশার কামড় খেতে খেতে কাদামাটিতে হাঁটতাম না।
আজহারের কথার ভঙ্গি যথেষ্ট উদ্ধত, সাজ্জাদ সূক্ষ্মভাবে অপমানিত বোধ করল। সেটা অবিশ্যি সে বুঝতে দিল না, বলল, কী হয়েছিল?
লম্বা স্টোরি।
বলেন শুনি।
আজহার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তখন নূতন বিজনেস শুরু করেছি। একটা মালদার ইন্টারন্যাশনাল এনজিওকে ধরে খুব বড় একটা প্রজেক্ট বাগিয়েছি। হাওর এলাকায় উন্নয়ন যে গ্রামগুলো আছে তার ইলেকট্রিফিকেশান, হাওরের পানিতে লাইফ সাপোর্ট, এরকম অনেক কিছু। কোনোরকম দুই নম্বুরি না করলেও নিট প্রফিট দুই কোটি টাকা। বিদেশী এনজিও একটু গাধা টাইপের হয়। একটু ভুচুং ভাচুং করে মাথায় হাত বুলালে আরো এক দেড় কোটি টাকা।
আজহার কথা বন্ধ করে দেয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে দাঁত খোঁচাতে থাকে। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?
সব যখন ঠিকঠাক তখন কান্ট্রি ডিরেক্টর বলল জায়গাটা একবার নিজের চোখে দেখতে চায়। আমেরিকান বুড়া, মাথায় একটু ছিট আছে। আমি আর কী করি, একটা ট্রলার ভাড়া করে তাকে হাওরে নিয়ে গেছি। বর্ষাকাল হাওর পানিতে টইটম্বুর। দিনের বেলা সবকিছু দেখে ফিরে আসতে আসতে সন্ধে হয়ে গেছে। ঠিক তখন বিশাল হাওরের মাঝখানে হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একটা চাঁদ উঠল। বিশাল একটা চাঁদ, দেখে টাসকি লেগে যাবার অবস্থা। সেই চাঁদ দেখে আমেরিকান বুড়ার মাথা পুরাপুরি আউলে গেল। সে চাঁদের দিকে তাকায় আর বুকের মাঝে থাবা দিয়ে বলল, ও মাই গড। ও মাই গড। হাউ বিউটিফুল! তারপর আমার দিকে তাকিয়ে কী বলল জানেন?
বলল, এত সুন্দর জায়গা ইলেকট্রিফিকেশান করা যাবে না, প্রকৃতিকে ডিস্টার্ব করা যাবে না। এটাকে এইভাবেই রাখতে হবে। কোনোভাবে হাওরের পানিতে এই সুন্দর চাঁদের দৃশ্য নষ্ট করা যাবে না। এক কথায় পুরা প্রজেক্ট ক্যান্সেল।
ক্যান্সেল?
আজহার দাঁত ঘষে বলল, হ্যাঁ, ক্যান্সেল। ইচ্ছা হচ্ছিল শালা বুড়া ভামকে ধাক্কা মেরে হাওরের পানিতে ফেলে দিই। সাথে অন্য লোকজন ছিল তাই শেষ পর্যন্ত ফেলি নাই। তবে
তবে কী?
বুড়া ভামকে আমি ছাড়ি নাই।
ছাড়েন নাই?
না। পরিচিত মাস্তান আছে তারে দিয়ে এমন ধোলাই দিয়েছি যে ব্যাটা জন্মের মতো সিধা হয়ে গেছে।
সাজ্জাদ একটু ইতস্তত করে বলল, ধোলাই? মানে মারপিট?
নয়তো কী? সকালে লেকের পাড়ে মর্নিং ওয়াকে বের হয় সেইখানে একলা পেয়ে আচ্ছা মতন পালিশ দেয়া হল। এক মাস হাসপাতালে তারপর সোজা দেশে ফেরত। আজহার হা হা করে হাসল, আনন্দহীন হাসি।
সাজ্জাদ একটু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি তো ডেঞ্জারাস মানুষ।
আজহার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, সেইটা ভুল বলেন নাই। আমি মানুষটা একটু ডেঞ্জারাস! জীবনে অকাম কুকাম কম করি নাই।
আজহার হঠাৎ সুর পাল্টে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তা যাই হোক আপনাকে এই সব কথা বলেছি সেটা যেন দশজনকে বলে বেড়াবেন না। কথায় কথায় হঠাৎ মুখ ফসকে বের হয়ে গেল।
সাজ্জাদ ভয়ে ভয়ে বলল, না বলব না।
হ্যাঁ বলবেন না। বললে বিপদ। আমার আপনার দুই জনেরই।
কেন দুজনেরই বিপদ সেটা সাজ্জাদ ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলার সাহস করল না। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আপনার ক্ষতি করেছে চাঁদটা। আপনার তো শোধ নেয়ার দরকার ছিল চাঁদের উপর। খামকা বুড়ো কান্ট্রি ডিরেক্টর-
নিচ্ছি চাঁদের উপর নিচ্ছি।
কীভাবে নিচ্ছেন?
এই যে উঠতে বসতে ব্যাটাকে শালা হারামজাদা বলে গালি দেই। কত বড় খচ্চর সেটা সবাইকে বলি।
খচ্চর? চাঁদ খচ্চর?
খচ্চর নয়তো কী? ব্যাটার নিজের কোনো আলো নেই, সূর্যের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কত বড় দালালি!
কিন্তু কী সুন্দর চাঁদের আলো। কী নরম জোছনা–
কাঁচকলা। আজহার মুখ বিকৃত করে বলল, দুনিয়াতে কত সুন্দর রঙ আছে লাল নীল সবুজ হলুদ, এই ভুয়া চাঁদের আলোতে কি কোনো রঙ দেখা যায়? যায় না।
সাজ্জাদ দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটায় তো একটা অন্য রকম সৌন্দর্য আছে।
ভুয়া। ভুয়া সৌন্দর্য। চাঁদের আলোটাই ভুয়া।
কিন্তু আমি তো কাউকে কখনো বলতে শুনি নি চাঁদের আলো ভুয়া।
কেউ জানে না সেই জন্যে বলে না। সেইটাই হচ্ছে সমস্যা। আপনি জানেন চাঁদের আসল রঙ কী? জানেন?
কী?
কুচকুচে কালো। কয়লার মতো! সূর্যের আলোর শতকরা মাত্র সাত ভাগ চাঁদ ব্যাটা রিফ্লেক্ট করে। সেইটা নিয়েই শালার কত বাহাদুরি।
আজহার ক্রুদ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, দেখে মনে হয় পারলে সে বুঝি তখনই চঁদটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। মুখ ভেংচে বলল, দেখেন তাকিয়ে দেখেন। এর মাঝে কোনো সৌন্দর্য আছে? গোল একটা থালার মতো। তাও যদি সুন্দর থালা হত। ফাটাফুটো থালা-দেখেছেন কেমন কালো দাগ? মেছেতার মতো। ছিঃ!
সাজ্জাদ একটু অবাক হয়ে আহজারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ যে চাঁদ নিয়ে এরকম কিছু বলতে পারে সেটা নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করত না।
আজহার ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চঁদের উল্টা পিঠটা তবু ভালো, খানাখন্দ কালো দাগ কমব্যাটা এমনই খবিস যে তার এই পিঠটাই আমাদের দেখাবে- কখনোই উল্টো পিঠ দেখাবে না।
সাজ্জাদ ভুরু কুঁচকে বলল, তাই নাকি।
হ্যাঁ। আমরা চাঁদের এক পিঠ সব সময়েই দেখি। দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর। উল্টো পিঠ দেখতে হলে সেখানে রকেটে করে যেতে হয়।
সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, বলল, ইন্টারেস্টিং।
চাঁদ নিয়ে খালি একটা ভালো খবর আছে। মাত্র একটা।
সেটা কী?
যতই দিন যাচ্ছে এই বদমাইশটা আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। বছরে এক ইঞ্চির মতন। একসময় এত দূরে চলে যাবে যে তখন আর এই শালা হারামজাদাকে দেখাই যাবে না।
কিন্তু সে তো অনেক পরে। লক্ষ লক্ষ বছর পরে।
সেইটাই আফসোস। তখন বেঁচে থাকব না। যদি বেঁচে থাকতাম তা হলে গরু জবাই করে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতাম। আজহার সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসল, সেই হাসি দেখে সাজ্জাদ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।
.
কয়েক মাস পরের কথা। কক্সবাজারের সমুদ্রতীরে আজহার অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে। অনেক রাত-সমুদ্রতীরে কোনো মানুষ নেই, আজহার হঠাৎ করে সেটা বুঝতে পেরে একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকটা দূর চলে এসেছে-এখনই হোটেলে ফিরে যাওয়া দরকার। ঘুরে হাঁটতে শুরু করতেই সে দেখে দুজন মানুষ ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে তার বুকটা ধক করে উঠল, সে শুকনো গলায় বলল, কে?
একজনের হাতের টর্চ লাইটটা জ্বলে ওঠে, সরাসরি তার মুখে আলো ফেলে মানুষটা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম আজহার।
হ্যাঁ। কেন? কী হয়েছে?
নূতন কিছু হয় নাই। তবে আগে যেটা হয়েছে সেটা তোমার থেকে ভালো করে কে জানে?
হঠাৎ করে আজহার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। অনেক কিছুই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, এবারে সে লোভ একটু বেশি করে ফেলেছে। অপরাধজগতের যে অলিখিত নিয়মের দাগ কাটা থাকে সে তার কোনো একটা দাগ অতিক্রম করে ফেলেছে। কোনো একজন গডফাদারের পা সে না বুঝেই মাড়িয়ে দিয়েছে।
আজহার শুকনো গলায় বলল, ভুল হয়ে গেছে।
ভুল তো হয়েছেই। আবার যেন না হয় সেইটা দেখার একটা দায়িত্ব আছে না?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা জিজ্ঞেস করল, ওস্তাদ, জানে মেরে ফেলব?
না?
তয়?
হাসপাতালে যেন কমপক্ষে এক মাস থাকতে হয় সেরকম ব্যবস্থা করতে হবে।
ঠিক আছে।
শেষ মুহূর্তে আজহার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না, মানুষ দুজন তাকে ধরে ফেলল।
সমুদ্রের বালুকাবেলায় তার কাতর চিৎকার কেউ শুনতে পেল না।
.
আজহার বালু খামচে উঠে বসার চেষ্টা করল, পারল না। আবার সে বালুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। এখান থেকে সে নিজে নড়তে পারবে না। কেউ একজন তাকে নিয়ে না গেলে সে যেতে পারবে না। গভীর রাতে নির্জন বালুকাবেলায় কে তাকে নিতে আসবে? আজহার দাতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ভোর হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে।
ঠিক তখন সে আকাশে চাঁদটাকে দেখতে পায়। বড় থালার মতো একটা চাঁদ, আজহারের মনে হল চাঁদটা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হারামজাদা। আজহার বিড়বিড় করে বলল, শালা হারামজাদা।
আজহারের হঠাৎ মনে হল চাঁদটা যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হেসে দিয়েছে। আজহার ভালো করে তাকাল, দুর্বল শরীরে সে এখন উল্টোপাল্টা জিনিস কল্পনা করতে শুরু করেছে?
খুন করে ফেলব। আজহার বিড়বিড় করে বলল, শালা, তোকে খুন করে ফেলব!
আজহার স্পষ্ট দেখতে পেল চাঁদটা আবার ফিক করে হেসে দিয়েছে। শুধু থেমে যায়। নি, ফিসফিস করে বলছে, তোকে আমি খুন করব।
আজহার চমকে উঠে বলল, কী? কী বলছিস তুই?
চাঁদ তার কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে বিদ্রুপের দৃষ্টিতে একদৃষ্টে আজহারের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ঠিক এরকম সময় আজহার হঠাৎ করে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পায়। সাথে সাথে সে বুঝে যায় চাঁদটা তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। বালুকাবেলায় সে অসহায়ভাবে শুয়ে আছে সেই সুযোগে চাঁদটা সমুদ্রের পানিকে টেনে আনছে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার উপর এনে ফেলবে, লোনা পানিতে ডুবিয়ে মারবে তাকে।
আজহার হিংস্র গলায় বলল, না। না-তুই এটা করতে পারবি না। কিছুতেই করতে পারবি না।
চাঁদ আজহারের হিংস্র চিৎকার আর কাতর অনুনয় কিছুই শুনল না। সমুদ্রের পানি টেনে এনে আজহারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
অনন্তকাল থেকে দিনে দুইবার সে পানিকে এভাবে টেনে আনছে। পৃথিবীর মানুষ এটার নাম দিয়েছে জোয়ার।
.
আজহার অবিশ্যি সেটা কখনোই বিশ্বাস করে নি।
জিনোম জনম
০১.
কম বয়সী একটা মেয়ে খুট করে দরজাটা খুলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এস, এস। তোমরা ভেতরে এস, আমরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি।
মেয়ের মুখের হাসি এবং কথাটুকু মেপে মেপে বলা কিন্তু তারপরেও ভঙ্গিটাতে এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল, দরজার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রন এবং তার কম বয়সী স্ত্রী নিহা সেটা অনুভব করতে পারে। রন নিহার হাত ধরে ঘরের ভেতরে ঢুকে চারদিক একনজর দেখে বলল, বাহ! কী সুন্দর।
ঘরের ভেতরটুকু খুব সুন্দর করে সাজানো, কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে অনেক দূরের পর্বতমালাকে দেখা যায়। ঘরের অর্ধস্বচ্ছ দেয়ালের ভেতর থেকে এক ধরনের কোমল আলো বের হয়ে ঘরটাকে মায়াময় করে রেখেছে। প্রশস্ত ঘরের মাঝামাঝি কালো গ্রানাইটের একটা টেবিল, টেবিলটাকে ঘিরে কয়েকটা আরামদায়ক চেয়ার। কম বয়সী মেয়েটি দুটো চেয়ার একটু টেনে সরিয়ে এনে রন এবং নিহাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলল, তোমরা কী খাবে বল। আমাদের কাছে বিষুবীয় অঞ্চলের সতিকারের কফি আছে। তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি আল্পস পর্বতের ঢালে জন্মানো আঙুরের রস আছে। যদি স্নায়ু উত্তেজনক কোনো পানীয় চাও আমরা সেটাও দিতে পারি।
রন মাথা নেড়ে বলল, আমার কিছুই লাগবে না। আমাকে একটু পানি দিলেই হবে। এই শুকনো সময়টাতে একটু পরপরই কেমন যেন গলা শুকিয়ে যায়।
নিহা বলল, আমি বিষুবীয় এলাকার কফি খেতে পারি। এটা সত্যিকারের কফি তো?
কম বয়সী মেয়েটি বলল, হ্যাঁ এটা সত্যিকারের কফি। তুমি এক চুমুক খেলেই বুঝতে পারবে।
নিহা হাসিমুখে বলল, চমৎকার!
তোমার কফিতে আর কিছু দেব? ভালো ক্রিম কিংবা কোনো ধরনের সিরাপ। সাথে আরো কিছু খেতে চাও?
নিহা হেসে বলল, না। আর কিছু লাগবে না। তোমার কথা শুনে মনে হতে পারে আমরা বুঝি নিম্নাঞ্চলের বুভুক্ষু মানুষ-তোমাদের এখানে কিছু খেতে এসেছি!
কম বয়সী মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল যেন নিহা খুব মজার একটা কথা বলেছে। কথাটি আসলে হেসে ওঠার মতো কথা নয়। নিম্নাঞ্চলে অনগ্রসর মানুষেরা থাকে। এ বছর সেখানে খাবারের ঘাটতি হয়েছে। অনেক মানুষ সেখানে অনাহারে-অর্ধাহারে আছে-ব্যাপারটিতে কৌতুকের কিছু নেই।
রন বলল, আমরা কি তা হলে কাজের কথা শুরু করে দেব?
কম বয়সী মেয়েটি বলল, অবশ্যই। অবশ্যই কাজের কথা শুরু করে দেব। তোমরা এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ তোমাদের এক মিনিট সময় অপচয় করা রীতিমতো দওযোগ্য অপরাধ।
নিহা রনের দিকে তাকিয়ে একটু আদুরে গলায় বলল, রন। তুমি কিন্তু আমাকে তাড়া দিতে পারবে না। আমি কিন্তু আজকে সময় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি।
রন মুখে হাসি টেনে বলল, আমি তাড়া দেব না নিহা। একটা সন্তান বেছে নেয়া চাট্টিখানি কথা নয়-তুমি তোমার সময় নাও। তোমার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে সন্তানটি ডিজাইন করে নাও।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, আমি তা হলে আমাদের চিফ ডিজাইনারকে ডেকে আনছি। মেয়েটি গলা নামিয়ে বলল, আপনারা যেহেতু আমাদের কাছে এসেছেন আমি। অনুমান করছি আপনারা নিশ্চয়ই আমাদের চিফ ডিজাইনার উগুরুর নাম শুনেই এসেছেন?
নিহা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। তার নাম শুনেছি। নেটওয়ার্কে তার কাজের বর্ণনা পড়েছি। কিছু অসাধারণ কাজ আছে তার।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, উগুরু যে বাচ্চাগুলো ডিজাইন করেছেন আমি লিখে দিতে পারি আজ থেকে বিশ বছর পরে তারা এই পৃথিবীটার দায়িত্ব নেবে। আর্টস বলেন, বিজ্ঞান বলেন, প্রযুক্তি বলেন, স্পোর্টস বলেন সব জায়গায় তারা হবে পৃথিবীর সেরা।
রন মাথা নাড়ল, বলল, সে জন্যেই আমরা এখানে এসেছি।
কম বয়সী মেয়েটি বলল, আপনারা বসুন, আমি উগুরুকে ডেকে আনছি।
উওরু নাম শুনে নিহার চোখের সামনে যে চেহারভেসে উঠেছিল মানুষটি দেখতে ঠিক সেরকম। মাথায় এলোমেলো হলদে চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। কোটরাগত জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। অত্যন্ত দামি পোশাক অত্যন্ত অগোছালোভাবে পরে থাকা এবং মুখে এক ধরনের নিরাসক্ত ঔদাসীন্য যেটাকে ঔদ্ধত্য বলে ভুল হতে পারে।
উগুরু রন এবং নিহার সামনে বসে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমাদের কোম্পানিতে আপনাদের অভিবাদন
রন বলল, আমাদের সময় দেয়ার জন্যে আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
উগুরু বলল, আমি যেটুকু বুঝতে পারছি আপনি নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত মানুষ। প্রতিরক্ষা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত সময় বলতে গেলে কিছুই থাকে না।
রন বলল, আমারও নেই। কিন্তু আমার স্ত্রীর জন্যে আমি আজকে সময় বের করে এনেছি।
চমৎকার। উরু একটু ঝুঁকে মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করে, কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে তার মুখে সেটি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না। সেই অবস্থাতেই উগুরু বলল, আমি নিশ্চিত আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, আমাদের কোম্পানির কাজ প্রথম শ্রেণীর কাজ কিন্তু সেটি যে কোনো হিসেবে অত্যন্ত খরচ সাপেক্ষ।
রন মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি।
এর আগেও অনেকে আমার কাছে এসেছেন কিন্তু খরচের পরিমাণটা জানার পর পিছিয়ে গেছেন।
রনের মুখে সামরিক বাহিনীর মানুষের উপযোগী এক ধরনের কাঠিন্য ফুটে ওঠে, সে মাথা নেড়ে বলল, আমি পিছিয়ে যাব না।
চমৎকার! উগুরু আবার একটু হাসার চেষ্টা করল এবং তার হাসিটি এবারে বেশ খানিকটা সাফল্যের মুখ দেখল। উরু মুখের দাড়িটি অন্যমনস্কভাবে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আপনারা কী ধরনের সন্তান চাইছেন? সফল শোবিজ তারকা? স্পোর্টসম্যান? নাকি অন্য কিছু?
নিহা লাজুক মুখে বলল, আমরা কি একসাথে অনেক কিছু চাইতে পারি না? একই সাথে সুন্দর চেহারা এবং প্রতিভাবান এবং মেধাবী!
অবশ্যই চাইতে পারেন। একটি শিশুর জীবনের নীলনকশা থাকে তার জিনে। ক্রোমোজোমগুলোর মাঝে সেগুলো লুকিয়ে আছে। বিজ্ঞানীরা সেগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। আমরাও সেগুলো বের করার চেষ্টা করছি। কোন ক্রোমোজোমে কোন জিনটার মাঝে একটা শিশুর কোন বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে সেটা আমাদের চাইতে ভালো করে কেউ জানে না। আপনারা বলবেন, আমরা সেই জিনটা আপনাদের পছন্দমতো পাল্টে দেব।
নিহা মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার!
উগুরু তার আঙুলের সাথে জুড়ে থাকা লেখার মডিউলটা স্পর্শ করে বলল, তা হলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করি, এটি নিশ্চয়ই আপনাদের প্রথম সন্তান?
হ্যাঁ। রন বলল, আমরা মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সন্তান নেয়ার সরকারি অনুমতি পেয়েছি।
ছেলে না মেয়ে? কী চান আপনারা?
রন সোজা হয়ে বলল, ছেলে। অবশ্যই ছেলে। কথা শেষ করে সে নিহার দিকে তাকিয়ে বলল, তাই না নিহা?
নিহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আমরা প্রথম সন্তান হিসেবে একটি ছেলে চাই।
তার শারীরিক গঠনের ব্যাপারে আপনাদের নির্দিষ্ট কিছু চাওয়ার আছে?
নিহা বলল, হ্যাঁ। লম্বা আর সুগঠিত।
চুলের রঙ?
সোনালি।
চোখ?
নীল। অবশ্যই নীল। নিহা মাথা নেড়ে বলল, মেঘমুক্ত আকাশের মতো নীল।
গায়ের রঙ?
তামাটে। ফর্সা রঙ যখন রোদে পুড়ে একটু তামাটে হয় সেরকম।
উগুরু অন্যমনস্কভাবে তার দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, গত শতাব্দীর কিছু চলচ্চিত্র অভিনেতা, কিছু ক্রীড়াবিদের জিনোম আমাদের কাছে আছে। আমরা অ্যালবামগুলো দেখাচ্ছি। আপনারা তার মাঝে থেকে বেছে নিতে পারেন।
নিহা বড় বড় চোখ করে বলল, সত্যি?
সত্যি।
রন নিহার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আমাদের সন্তান কি দেখতে আমাদের মতো হওয়া উচিত না? চলচ্চিত্র অভিনেতার মতো কেন হবে?
নিহা হিহি করে হাসতে থাকে এবং তার মাঝে উগুরু বলে, আপনাদের সন্তান। আপনাদের মতোই হবে-আমরা শুধু সেটাকে বিন্যস্ত করে দেব! চুলের রঙ, চোখের রঙ এই সব। আমাদের সিমুলেশান প্যাকেজ আপনাদের দেখিয়ে দেবে সে দেখতে কেমন হবে! ছোট থাকতে কেমন হবে বড় হলে কেমন হবে!
নিহা বলল, আমি আমার শখের কথা বলতে পারি?
অবশ্যই। অবশ্যই বলতে পারেন।
আমি চাই আমার ছেলে দেখতে যেরকম সুদর্শন হবে ঠিক সেরকম তার ভেতর অনেক গুণ থাকবে। সে ছবি আঁকতে পারবে। গান গাইতে পারবে তার ভেতরে লেখার ক্ষমতা থাকবে। পৃথিবীর বর্তমান সময়টা হচ্ছে বিজ্ঞানের সময়-তাই আমি চাই তার ভেতরে যেন বিজ্ঞানের মেধা থাকে। সে যেন সত্যিকারের গণিতবিদ হয়। একই সঙ্গে আমি চাই সে যেন। হয় তেজস্বী আর সাহসী। তার ভেতরে যেন একটা সহজাত নেতৃত্বের ভাব থাকে।
রন হা হা করে হেসে বলল, সোজা কথায় তুমি চাও তোমার ছেলে হবে একজন মহাপুরুষ!
নিহা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, কেন? তাতে দোষের কী আছে? আমি কি চাইতে পারি যে আমার ছেলে একজন মহাপুরুষ হোক?
উগুরু বলল, অবশ্যই চাইতে পারেন। আগে সেটি ছিল মায়েদের স্বপ্ন-এখন সেটি আর স্বপ্ন নয় এখন সেটি আমাদের হাতের মুঠোয়।
নিহা উৎসুক চোখে বলল, তা হলে আমি কি সত্যি সত্যি এরকম একজন সন্তান পেতে পারি?
অবশ্যই পারেন। উগুরু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা গত কয়েক শতাব্দীর পৃথিবীর সব বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, ক্রীড়াবিদ, অভিনেতা, দার্শনিক, নেতা, নেত্রীর জিনোম সগ্রহ করেছি। তাদের ভেতরে ঠিক কোন জিনটি আলাদাভাবে তাদের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছে সেটা আলাদা করেছি। সেই জিনটি বিকশিত করতে হলে আর অন্য কোন জিনের সহযোগিতার দরকার আমরা সেগুলোও বের করেছি। কাজেই আপনারা যেটা চাইবেন আমরা সেটা আপনাদের সন্তানের মাঝে দিয়ে দেব!
নিহা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সত্যি সত্যি সেটাই দিতে পারবেন?
অবশ্যই! উগুরু মাথা নেড়ে বলল আমাদের কাছে আইনস্টাইন থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেলা, জ্যাক নিকলসন থেকে শুরু করে মাও জে ডং টনি মরিসন থেকে শুরু করে বিল গেটস সবার জিনোম আছে। উগরু হঠাৎ মাথা ঝুঁকিয়ে নিচু গলায় বলল, আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। আমরা হিটলারের জিনোমও সগ্রহ করেছি!
হিটলার? কেন? হিটলার কেন?
এমনিই। হতেও তো পারে কোনো একজন নিও নাৎসি কেউ তার সন্তানের ভেতর হিটলারের ছায়া দেখতে চাইবে! যাই হোক যেটা বলছিলাম আপনারা ঠিক কী চাইছেন বলে দেন আমরা আপনার সন্তানকে ডিজাইন করে দেব। সবচেয়ে বড় কথা আপনারা যে সন্তানটি পাবেন সে হবে সম্পূর্ণভাবে নীরোগ-তাকে কোনো রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করবে না। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
আমাদের কোম্পানি থেকে আমরা আপনাদের সার্টিফিকেট দেব।
সার্টিফিকেট?
হ্যাঁ উগুরু মাথা নেড়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আমরা যদি একটি শিশু ডিজাইন করে তাকে সার্টিফিকেট দেই সেটা সব জায়গায় গ্রহণ করা হয়। আপনাদের সন্তান স্কুলে সবচেয়ে বেশি সুযোগ পাবে। লেখাপড়ায় তাকে সবচেয়ে আগে নেয়া হবে-যখন সে তার জীবন শুরু করবে তখন তার ধারেকাছে কেউ থাকবে না। একজন সন্তানের জন্যে এর চাইতে বড়। বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।
রন মাথা নিচু করে বলল, আমরা জানি। সে জন্যেই আমরা আপনাদের কাছে এসেছি।
উগুরু তার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, তা হলে চলুন আমরা কাজ শুরু করি। ভেতরে আমাদের বড় ডিসপ্লে রয়েছে সেখানে আমরা পুরো প্রক্রিয়াটি সিমুলেট করতে পারি। আপনাদের দুজনের ক্রোমোজোমগুলো নিয়ে আপনাদের সামনেই আপনাদের সন্তানকে ডিজাইন করব। সন্তান জন্ম দেবার আগেই আপনারা আপনাদের সন্তানদের দেখতে পাবেন।
নিহা রনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল। ফিসফিস করে বলল, চল রন। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না!
রন বলল, চল। কিন্তু তোমার সন্তানের জন্য তোমাকে অন্তত নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
০২.
রিশ গামলার পানি দিয়ে রগড়ে রগড়ে শরীরের কালি তুলতে তুলতে বলল, তিনা। আজকে রাতে আমরা কী খাচ্ছি?
রিশের স্ত্রী তিনা কাপড় ভাঁজ করে তুলতে তুলতে বলল, মনে নেই? আজ আমরা বাইরে খেতে যাব?
রিশের সত্যি মনে ছিল না, সে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। সে জন্য আমি কিছু রাধি নি।
কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
তিনা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমরা কি আর পার্বত্য অঞ্চলে খেতে যাব? এই আশপাশে কোথাও বসে খেয়ে নেব।
রিশ একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেল। তারা নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ, হঠাৎ করে খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। আশপাশে অনেক মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে আছে এরকম সময় বাইরে যেতে যেতে এক ধরনের অপরাধবোধের জন্ম হয় কিন্তু দিন-রাত পরিশ্রম করতে করতে মাঝে মাঝেই দুজনের ইচ্ছে করে বাইরে কোথাও সুন্দর একটা জায়গায় বসে খেতে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে। হালকা কোনো বিনোদনে সময় কাটিয়ে দিতে।
রিশ তার তেলকালি মাখা কাপড় পাল্টে পরিষ্কার কাপড় পরে বলল, তিনা, আমিও রেডি। চল, যাই। যা খিদে পেয়েছে মনে হয় একটা আস্ত ঘোড়া খেয়ে ফেলতে পারব।
তিনা খিলখিল করে হেসে বলল, যদি খেতেই চাও তা হলে আস্ত ঘোড়া কেন, অন্য কিছু খাও! ঘোড়া কি একটা ধাওয়ার জিনিস হল?
রিশ বলল, এটা একটা কথার কথা! ঘোড়া কি কোথাও আছে? চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও কি ঘোড়া দেখেছ কখনো?
সেজন্যই তো বলছি-দুই চারটে যা কোনোমতে টিকে আছে সেটাও যদি খেয়ে ফেলতে চাও তা হলে কেমন করে হবে?
.
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনা বাইরে যাবার পোশাক পরে বের হয়ে এল। তাকে একনজর দেখে রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার খুব দুর্ভাগ্য যে তুমি নিম্নাঞ্চলে জন্ম নিয়েছ! যদি তোমার পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম হত তা হলে নিশ্চয়ই সামরিক অফিসারের সাথে বিয়ে হত। গলায় হীরার নেকলেস পরে তুমি এক পার্টি থেকে আরেক পার্টিতে যেতে!
তিনা হাসতে হাসতে বলল, ভাগ্যিস আমার পার্বত্য অঞ্চলে জন্ম হয় নি! আমি পার্টি দুই চোখে দেখতে পারি না!
রিশ তিনার হাত ধরে বলল, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় তোমার খুবই দুর্ভাগ্য যে আমার মতো চালচুলোহীন একজন মানুষের সাথে বিয়ে হয়েছে! তোমার এর চাইতে ভালো একটা জীবন পাবার কথা ছিল।
তিনা রিশের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, তুমি যখন নাটকের ব্যর্থ নায়কদের মতো কথা বল তখন সেটা শুনতে আমার ভারি মজা লাগে! অনেক হয়েছে-এখন চল।
ঘরে তালা লাগিয়ে দুজন যখন বাইরে এসেছে তখন শহরের রাস্তায় সান্ধ্যকালীন উত্তেজনাটুকু শুরু হয়েছে। ফুটপাতে মাদকসেবী ছিন্নমূল মানুষ বসে বসে বিড়বিড় করে কথা বলছে। উজ্জ্বল পোশাকপরা কিছু তরুণী কৃত্রিম ফুল বিক্রি করছে। পথের পাশে উত্তেজক পানীয়ের দোকানে হতচ্ছাড়া ধরনের কিছু মানুষের জটলা। পথের পাশে দ্রুতলয়ের সঙ্গীতের সাথে সাথে কিছু নৃত্যপ্রেমিক মানুষের ভিড়। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে কয়েকটি দোকান চারদিকে অনেক মানুষ। খুব ভালো করে খুঁজলেও কিন্তু কোথাও একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিম্নাঞ্চলে শিশুর খুব অভাব।
রিশ আর তিনা তাদের পছন্দের একটা ছোট রেস্টুরেন্টে জানালার পাশে একটা টেবিলে এসে বসে। টেবিলের প্যানেলে স্পর্শ করে খাবার অর্ডার দিয়ে তারা তাদের পানীয়ে চুমুক দেয়। রিশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, তিনা, তোমাকে আজকে খুব সুন্দর লাগছে!
তিনা খিলখিল করে হেসে বলল, আমি আগেও দেখেছি–পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেবার সাথে সাথে তোমার আমাকে সুন্দর লাগতে থাকে!
এরকম সৌন্দর্য নিয়ে তোমার আমার মতো একজন কাঠখোট্টা মানুষকে বিয়ে করা ঠিক হয় নি। তোমার নাটকে কিংবা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা উচিত ছিল!
তিনা রহস্য করে বলল, তার কি সময় শেষ হয়ে গেছে? আমি তো এখনো নাটকে না হয় চলচ্চিত্রে চলে যেতে পারি!
রিশ মাথা নেড়ে বলল, উঁহু! আমি তোমাকে এখন আর কোথাও যেতে দেব না। আমি সারা দিন ফ্যাক্টরিতে কাজ করি। বড় মেশিনগুলো চালিয়ে চালিয়ে সময় কাটাই আর ভাবি কখন আমি বাসায় আসব আর কখন তোমার সাথে দেখা হবে!
তিনা বলল, আমাদের ফ্যাক্টরিতে একটা ছেলে কাজ করে, সে কী বলেছে জান?
কী বলেছে?
সে নাকি পড়েছে যে পুরুষ মানুষেরা কখনো একটি মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারে! কত দিন পরেই তার মন উঠে যায় তখন তারা অন্য মেয়েদের পিছনে ছোটে। ভ্রমরের মতো।
রিশ বলল, হতে পারে। আমি তো আর বেশি লেখাপড়া করি নি তাই আমি জানি না পুরুষ মানুষদের কেমন হওয়া উচিত। আমি তাই আমার মতন রয়ে গেছি। এখনো ভ্রমরের মতো হতে পারি নি।
তিনা বলল, আমিও তাই চাই। তুমি যেন সব সময় তোমার মতো থাক কথা বলতে বলতে হঠাৎ তিনা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
রিশ তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, কী হল তিনা, তুমি অন্য কিছু ভাবছ?
তিনা রিশের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ রিশ, আমি আজকে তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলার জন্যে এখানে ডেকে এনেছি।
বিশেষ কথা? বিশ সোজা হয়ে বসে বলল, আমাকে বলবে?
হ্যাঁ।
কী কথা?
তিনা দুর্বলভাবে একটু হেসে বলল, আমি একটা সন্তানের জন্ম দিতে চাই। আমি মা হতে চাই।
রিশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল তিনা কী বলেছে সেটা সে বুঝতে পারে নি। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তু-তুমি সন্তান জন্ম দিতে চাও? আমার আর তোমার সন্তান?
হ্যাঁ। তিনা এবার বেশ জোর দিয়ে বলল, আমার আর তোমার সন্তান।
কিন্তু সেটা তো অসম্ভব। সন্তান জন্ম দিতে হলে অনেক কিছু থাকতে হয়। আমাদের কিছু নেই-আমাদের কখনো অনুমতি দেবে না!
দেবে।
দেবে?
হ্যাঁ। বিয়ের পর থেকে আমি একটু একটু করে ইউনিট জমাচ্ছি-একজন সন্তান চাইলে তার ব্যাংকে যত ইউনিট থাকতে হয় আমার সেটা আছে!
রিশ চোখ কপালে তুলে বলল, সত্যি?
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ সত্যি। সে একটু এগিয়ে রিশের হাত স্পর্শ করে বলল, রিশ, আমি তোমাকে কখনো ভালোমন্দ খেতে দিই নি। ভালো পোশাক কিনতে দিই নি। আমরা কখনো কোথাও বেড়াতে যাই নি। কখনো আমি কোনো প্রসাধন কিনি নি। কোনো গয়না কিনি নি-দাঁতে দাঁত কামড়ে আমি শুধু ইউনিট জমিয়ে গেছি। দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি ওভারটাইম কাজ করেছি। আমি তোমাকে দিয়ে ওভারটাইম করিয়েছি। যখন অসুখ করেছে তখন ডাক্তারের কাছে যাই নি। উৎসব আনন্দে কাউকে কোনো উপহার দিই নি-যক্ষের মতো ইউনিট জমিয়ে গেছি! তুমি বিশ্বাস করবে কি না আমি জানি না আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এখন দশ হাজার ইউনিট জমা হয়েছে-আমরা এখন সন্তানের জন্যে আবেদন করতে পারি।
দশ হাজার?
হ্যাঁ, দশ হাজার!
কিন্তু রিশ ইতস্তত করে বলল, কিন্তু…
কিন্তু কী?
শুধু সন্তান জন্ম দিলেই তো হবে না। তাকে মানুষ করতে হবে না?
হ্যাঁ। তিনা মাথা নাড়ল, অবশ্যই সন্তানকে মানুষ করতে হবে। তুমি আর আমি মিলে আমাদের সন্তানকে মানুষ করতে পারব না? আদর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে স্নেহ দিয়ে।
তিনা, তুমি তো খুব ভালো করে জান এখন সন্তান জন্ম দেবার আগে সবাই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যায়। তারা সুস্থ সবল নীরোগ প্রতিভাবান সন্তান ডিজাইন করে দেয়। লক্ষ লক্ষ ইউনিট খরচ করে সেই সব প্রতিভাবান সন্তানেরা জন্ম নেয়। তারা বড় হয়ে বিজ্ঞানী হয় ইঞ্জিনিয়ার হয়। কবি-সাহিত্যিক লেখক হয়! আমাদের সন্তান তো সেরকম কিছু হবে না–সে হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ-
তিনা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমাদের সন্তান হবে খুব সাধারণ একজন মানুষ। ঠিক আমাদের মতো। আমার মতো আর তোমার মতো। সে আমাদের সাথে থাকবে আমরা তাকে বুক আগলে বড় করব। বড় হয়ে আমাদের মতো কোনো ফ্যাক্টরিতে চাকরি করবে। যদি সে ছেলে হয় তা হলে টুকটুকে একজন মেয়েকে বিয়ে করবে-আমরা উৎসবের দিন উপহার নিয়ে তাদের দেখতে যাব। যদি মেয়ে হয় সে বড় হয়ে তোমার মতো একজন সুদর্শন হৃদয়বান মানুষ খুঁজে নেবে-তারা উৎসবের দিন আমাদের দেখতে আসবে।
রিশ তার পানীয়ের গ্লাসটা টেবিলে রেখে বলল, তিনা, তুমি কি জান তুমি কী সাংঘাতিক কথা বলছ? একটি সন্তান কত বড় দায়িত্ব তুমি জান? শুধু বেঁচে থাকার জন্যে আমি আর তুমি কত কষ্ট করি তুমি ভেবে দেখেছ? সেই কঠোর পৃথিবীতে তুমি একটা শিশু আনতে চাইছ? যেই শিশুর জন্ম হবে একেবারে অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে। জীবনের প্রতিটি পদে তাকে অবহেলা করা হবে। সে স্কুলে ঢুকতে পারবে না-যদি বা ঢুকে সে পাস করতে পারবে না। শিক্ষা নিতে পারবে না-বন্ধুরা তাকে তাচ্ছিল্য করবে। শিক্ষকরা অবেহলা করবে। বড় হবে এক ধরনের হীনম্মন্যতা নিয়ে। তার জন্যে জীবনের কোনো সুযোগ থাকবে না-কোনো আশা থাকবে না-কোনো স্বপ্ন থাকবে না। কে জানে হয়তো তোমার কিংবা আমার কোনো একটা ব্যাধি তার শরীরে ঢুকে যাবে। হয়তো
তিনা বাধা দিয়ে বলল, এভাবে বোলো না রিশ। আমাদের সন্তান হবে ঠিক তোমার আর আমার মতো। আমরা যেরকম স্বপ্ন দেখি সে ঠিক সেরকম স্বপ্ন দেখবে। আমরা যেরকম কঠিন একটা জীবনে যুদ্ধ করতে করতে একজন আরেকজনের ভেতরে সাহস খুঁজে পাই সেও সেরকম সাহস খুঁজে পাবে! আমাদের সন্তান সাধারণ একজন মানুষ হয়ে বড় হবে। কিন্তু তাতে সমস্যা কী? একসময় কি সাধারণ মানুষ এই পৃথিবীকে এগিয়ে নেয় নি!
রিশ বিষণ্ণ মুখে বলল, কিন্তু তিনা এখন সেই পৃথিবী নেই। এখন পৃথিবীর মানুষ পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। যাদের অর্থবিত্ত আছে, তারা একভাগ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রতিভাবান, বুদ্ধিমান। অন্যভাগ হতদরিদ্রতারা কোনোমতে শুধু টিকে থাকে। তারা পৃথিবীর সৌভাগ্যবান মানুষের জীবনের আনন্দটুকু নিশ্চিত করার জন্যে দিন থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করে আমি সেই জীবনে একজন শিশুকে আনতে চাই না তিনা। আমার নিজের সন্তানকে সেই কঠোর কঠিন একটা জীবন দিতে চাই না
তিনা রিশের দুই হাত জাপটে ধরে বলল, রিশ! তুমি না কোরো না। দোহাই তোমার-আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি আমার একটা সন্তান হবে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরব। সে আমার বুকের ভেতর ছোট ছোট হাত-পা নেড়ে খেলা করবে। দাঁতহীন মাঢ়ী দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে। আমি তাকে কোলে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়াব। আমি তার জন্যে ছোট ছোট জামা বানাব। সেই লাল টুকটুকে জামা পরে সে খিলখিল করে হাসবে। তুমি না কোরো না রিশ তুমি না কোরো না।
রিশ তিনার হাত ধরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আমার কাছে কখনোই কিছু চাও নি তিনা। আমার কিছু দেবার ক্ষমতা নেই সে জন্যেই বুঝি চাও নি! এই প্রথম তুমি আমার কাছে কিছু চেয়েছ–আমি তোমাকে কেমন করে না করব?
সত্যি তুমি রাজি হয়েছ?
সত্যি।
মন খারাপ করে রাজি হয়েছ?
না। মন খারাপ করে না। খুশি হয়ে রাজি হয়েছি। তিনা তুমি জান আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি যদি আনন্দ পাও-আমি তা হলে আনন্দ পাই। তুমি যখন মন খারাপ কর তখন আমার মন খারাপ হয়ে যায়! তুমি যেটা চাইবে, যেভাবে চাইবে সেটাই হবে। সেভাবেই হবে!
তিনা রিশের হাত ধরে রেখে বলল, একদিন ছিলাম শুধু তুমি আর আমি। এখন হব আমরা তিনজন। তুমি আমি আর রিকি।
রিকি?
তিনা লাজুক মুখে হেসে বলল, হ্যাঁ। যদি আমাদের ছেলে হয় তা হলে আমরা তার নাম রাখব রিকি। মেয়ে হলে কিয়া।
রিশ চোখ বড় বড় করে বলল, নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে?
হ্যাঁ। নাম পর্যন্ত ঠিক হয়ে গেছে।
রিশ হাসতে হাসতে তার পানীয়ের গ্লাসটি তুলে নেয়।
০৩.
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি চোখ বড় বড় করে তিনার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক বার চেষ্টা করে বলল, তুমি কী বলছ? তুমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবে?
হ্যাঁ। আমি স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেব
তুমি কি জান কেউ স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেয় না? যখন ঐণটার বয়স তিন থেকে চার মাস হয় তখনই এটাকে জন্ম দিয়ে হাসপাতালের সেলে তার শরীরে রক্ত সরবরাহ করে তাকে বড় করা হয়?
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। কিন্তু আমি তবুও স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দিতে চাই।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, না। স্বাভাবিক উপায়ে মায়ের বাচ্চা জন্ম দেয়া কী ভয়ংকর কষ্ট তুমি জান না। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান এই পদ্ধতি বের করেছে। এই পদ্ধতিতে ভ্রণ হিসেবে বাচ্চার জন্ম দেয়া হয়। দ্রুণটির আকার ছোট বলে মায়ের কোনো কষ্ট হয় না।
তিনা বলল, আমি সেটাও জানি। আমি এই বিষয়গুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি।
তা হলে তুমি কেন স্বাভাবিক উপায়ে বাচ্চা জন্ম দেবার কথা বলছ?
দুটি কারণে। প্রথম কারণ হচ্ছে এটাই প্রকৃতির বেছে নেয়া উপায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই নূতন প্রক্রিয়া বের করার আগে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এই প্রক্রিয়ায় সন্তান জন্ম দিয়েছে কাজেই এটা নিশ্চয়ই একটা গ্রহণযোগ্য উপায়। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে জ্বণ হিসেবে সন্তানের জন্ম দিয়ে হাসপাতালে কৃত্রিম পরিবেশে তাকে বড় করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমরা সেই পরিমাণ অর্থ অপচয় করতে চাই না।
মধ্যবয়স্কা মহিলাটি ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার যদি প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকে তা হলে তুমি কেন সন্তান জন্ম দিতে চাইছ?
সন্তান জন্ম দেবার জন্যে রাষ্ট্রীয় নিয়মে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন আমাদের সেই পরিমাণ অর্থ আছে। কিন্তু আমি কৃত্রিম উপায়ে সন্তানের জন্ম দিতে চাই না। আমি সন্তানকে নিজের শরীরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করতে চাই। আমি মনে করি একজন মায়ের সেই অধিকার আছে।
মহিলাটি হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমি যদি আগে জানতাম তুমি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেবে তা হলে আমি কখনোই তোমাকে মা হতে দিতাম না!
তিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি। তাই আমার এই সিদ্ধান্তের কথাটি আগে বলি নি।
তিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এখন যাই? আমার সন্তান জন্মানোর আগে আগে আমি আসব-তখন হয়তো একজন ডাক্তারের প্রয়োজন হবে।
মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, একেবারে না এলেই ভালো। পুরোটাই নিজে নিজে করে ফেলতে পার না?
রিশ এতক্ষণ তিনার পাশে বসেছিল, একটি কথাও বলে নি। এবার সে প্রথম মুখ খুলল, বলল, যদি প্রয়োজন হয় আমরা সেটাও করে ফেলতে পারব। তুমি নিশ্চয়ই জান নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা কিন্তু তোমাদের সাহায্য ছাড়াই বেঁচে আছে!
মহিলাটি কোনো কথা বলল না, রিশ আর তিনা হাত ধরে বের হয়ে যাবার পর মহিলাটি সঁতে দাঁত ঘষে বিড়বিড় করে বলল, পৃথিবীটাকে তোমাদের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল। তোমাদের জন্যেও আমাদের জন্যেও।
০৪.
রন নিহার হাত ধরে বলল, তোমার কেমন লাগছে নিহা?
নিহা বলল, ভালো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আমার সন্তানের জন্ম দিয়েছি।
হ্যাঁ, কিন্তু সে এখনো আমাদের সন্তান হয়ে ওঠে নি। সে এখনো একটা ঐণ। ডাক্তারেরা তাকে একটা কাচের জারের ভেতর তরলে ডুবিয়ে রেখেছে। তার শরীরে রক্ত সরবরাহ নিশ্চিত করছে।
কখন এটা শেষ হবে?
আমি জানি না।
যখন শেষ হবে, তখন কি আমরা তাকে দেখতে পাব?
চাইলে নিশ্চয়ই দেখতে পারব। কিন্তু
কিন্তু কী?
রন ইতস্তত করে বলল, ডাক্তারেরা চায় না জ্বণ হিসেবে আমরা তাকে দেখি। এখনো সে দেখতে মানবশিশুর মতো নয়। এখন তাকে দেখলে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
নিহা বলল, আমার নিজের সন্তানকে দেখে আমার মোটেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না।
রন নিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই হবে না। তবুও আমার মনে হয় আমরা ছয় মাস পরেই তাকে দেখি। তখন সে সত্যিকারের মানবশিশু হয়ে যাবে।
নিহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তান আমার শরীরের ভেতর বড় হচ্ছিল, সেটা চিন্তা করেই আমি নিজের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করেছি। এখন সে আমার শরীরের ভেতরে নেই তাকে দেখতেও পাব না-চিন্তা করে মন খারাপ লাগছে। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
আমার মনে হয় প্রাচীনকালের নিয়মটাই ভালো ছিল। তখন মায়েরা তাদের সন্তানকে নিজের ভেতর ধারণ করত। তাকে পূর্ণ মানবশিশু হিসেবে জন্ম দিত।
রন শব্দ করে হেসে বলল, একজন পূর্ণাঙ্গ শিশুকে জন্ম দেয়া কত কঠিন তুমি জান? সেটি কী ভয়ংকর যন্ত্রণা তুমি জান?
কিন্তু একসময় তো পৃথিবীর সব শিশু এভাবেই জন্ম নিত!
একসময় আরো অনেক কিছু হত নিহা। মহামারী হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যেত। প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিত। মানসিক রোগীকে চারদেয়ালের ভেতর বন্ধ করে রাখা
নিহা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার সন্তানকে জন্ম দিয়ে নিজেকে কেমন জানি খালি খালি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কী যেন হারিয়ে গেল।
ওটা কিছু নয়। রন নিহার হাত ধরে বলল, ডাক্তার বলেছে শরীরে হরমোনের তারতম্য থেকে এটা হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিহা কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। ঠিক কী কারণ জানা নেই তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
০৫.
তিনার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। রিশের মুখ ভয়ার্ত এবং রক্তশূন্য। দুই হাতে শক্ত করে সে তিনার একটা হাত ধরে রেখেছে। হঠাৎ চমকে উঠে বলল, ঐ যে-শব্দ হল না? মনে হয় ডাক্তার এসে গেছে।
তিনার যন্ত্রণাকাতর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, না রিশ। কোনো শব্দ হয় নি। কোনো ডাক্তার আসে নি। আমি জানি কোনো ডাক্তার আসবে না।
কেন আসবে না?
আসবে না, কারণ আমাদের জন্যে কারো মনে কোনো ভালবাসা নেই, রিশ। তুমি আমাকে বলেছিলে পৃথিবীর মানুষ এখন দুই ভাগে ভাগ হয়েছে-সুখী আর হতভাগা! আমরা হতভাগা দলের।
রিশ কাঁপা গলায় বলল, এখন এভাবে কথা বোলো না তিনা।
ঠিক আছে বলব না। কিন্তু তোমাকে আমার সাহায্য করতে হবে। পারবে না?
পারব।
পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আমিও দেব।
অবশ্যই দেবে।
কী করতে হবে আমি তোমাকে বলব। তুমি শুধু আমার পাশে থাক।
আমি তোমার পাশে আছি তিনা।
আমি যদি যন্ত্রণায় চিৎকার করি তুমি ভয় পাবে না তো?
রিশ বলল, না। আমি ভয় পাব না।
আমার ব্যথাটা একটু পরে পরেই আসছে। আমার মনে হয় আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমি আমার বাচ্চাটার জন্ম দেব।
ঠিক আছে তিনা। তোমার কোনো ভয় নেই। আমি আছি।
আমি জানি তুমি আছ।
তুমি ঠিকই বলেছ তিনা। পৃথিবীর কোটি কোটি মা এভাবে সন্তান জন্ম দিয়েছে। তুমিও পারবে।
তিনা যন্ত্রণার একটা প্রবল ধাক্কা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে সহ্য করতে করতে বলল, পারব। নিশ্চয়ই পারব।
রিশ অনুভব করে একটু আগে তার ভেতরে যে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক এসে ভর করেছিল সেটা কেটে যাচ্ছে। তার বদলে তার নিজের ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসে ভর করছে। নিজের ভেতর সে এক ধরনের শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। সে পারবে। নিশ্চয়ই সে তিনাকে তার সন্তানের জন্ম দিতে সাহায্য করতে পারবে।
ভয়ংকর যন্ত্রণা ঢেউয়ের মতো আসতে থাকে। তিনা সেই যন্ত্রণা সহ্য করে অপেক্ষা করে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার শরীরের ভেতর বেড়ে ওঠা সন্তানকে পৃথিবীর আলো বাতাসে নিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করে।
অমানুষিক একটা যন্ত্রণায় তার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে যেতে চায়। চোখের ওপর একটা লাল পর্দা কাঁপতে থাকে। তিনা কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু ভাবতে পারে না। পৃথিবীর আদিমতম অনুভূতির ওপর ভর করে সে তার সন্তানকে জন্ম দেয়ার চেষ্টা করে যায়। ভয়ংকর যন্ত্রণায় সে অচেতন হয়ে যেতে চায় তার ভেতরেও চেতনাকে জোর করে ধরে রাখে- যখন মনে হয় সে আর পারবে না ঠিক তখন হঠাৎ করে সমস্ত যন্ত্রণা মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং পরের মুহূর্তে সে একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল। তিনার ঘামে ভেজা সমস্ত শরীর তখন থরথর করে কাপছে। সে হাত তুলে বলল, রিশ, আমার বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও। আমার বুকের মাঝে দাও।
রিশ রক্তমাখা সন্তানটিকে দুই হাতে ধরে সাবধানে তিনার বুকের ওপর শুইয়ে দিল। তিনা দুই হাতে তাকে গভীর ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে। রক্ত ক্লেদ মাখা শিশুটি তখনো তার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। তিনা জানে এই কান্না কোনো দুঃখের কান্না নয়, কোনো যন্ত্রণার কান্না নয়। পৃথিবীর বাতাস বুকে টেনে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রথম প্রক্রিয়া হচ্ছে এই কান্না। সে সুস্থ সবল একটা শিশুর জন্ম দিয়েছে।
তিনা গভীর ভালবাসায় তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তার এখনো বিশ্বাস হয় না সে তার নিজের শরীরের ভেতর তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা মানবশিশুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মানবশিশুটি একান্তভাবেই তার। তার আর রিশের।
০৬.
ছোট একটা ব্যাসিনেটে একটা শিশু শুয়ে শুয়ে হাত-পা নাড়ছে, নিহা অপলক শিশুটির দিকে তাকিয়ে রইল। রনের হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এটি আমাদের সন্তান?
হ্যাঁ। এটি আমাদের সন্তান। দেখছ না কী সুন্দর নীল চোখ, আকাশের মতো নীল, ঠিক যেরকম তুমি বলেছিলে।
নিহা মাথা নাড়ল, বলল, মাথায় এখন কোনো চুল নেই। যখন চুল উঠবে সেটা হবে সোনালি। তাই না?
হ্যাঁ।
আমার এই বাচ্চাটি যখন বড় হবে তখন সে হবে পৃথিবীর সেরা প্রতিভাবান। তাই না?
রন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ সে হবে পৃথিবীর সেরা প্রতিভাবান। সে ছবি আঁকতে পারবে, গণিত করতে পারবে। সে হবে খাঁটি বিজ্ঞানী। সে হবে সুদর্শন, সুস্থ সবল নীরোগ। মনে নেই উগুরু বলেছে সে আমাদের একটা সার্টিফিকেট দেবে?
মনে আছে। নিহা মাথা নাড়ল, দেখে আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এই ছোট বাচ্চাটা একদিন বড় হয়ে পৃথিবীর সেরা প্রতিভাবান একজন মানুষ হবে! আমি বাচ্চাটাকে ছুঁয়ে দেখি?
রন হেসে বলল, অবশ্যই নিহা। এটা তোমার বাচ্চা-তুমি শুধু ছুঁয়ে দেখবে না তুমি ইচ্ছে করলে তাকে কোলে নেবে। তাকে বুকে চেপে ধরবে। তার গালে চুমু খাবে।
নিহা খুব সাবধানে শিশুটিকে একবার স্পর্শ করে। তারপর তাকে কোলে তুলে নেয়। বুকে চেপে ধরে শিশুটির গালে তার মুখ স্পর্শ করে। সে তার বুকের ভেতর এক বিচিত্র কম্পন অনুভব করে এটি তার সন্তান, নিজের সন্তান!
শিশুটিকে বুকে চেপে ধরে নিহা যখন রনের সাথে সাথে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসছিল ঠিক তখন তারা দেখতে পায় করিডোর ধরে উগুরু এগিয়ে আসছে। উরু তার মুখের দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে হাসি ফুটিয়ে বলল, জানতে পারলাম আজকে আপনারা আপনাদের সন্তানকে নিতে আসছেন। তাই আমি নিজেই দেখতে চলে এলাম।
রন হাসিমুখে বলল, আমি সেটা বুঝতে পারছি! আপনি আপনার ডিজাইন করা বাচ্চাটিকে দেখতে চাইবেন সেটা খুবই স্বাভাবিক।
হ্যাঁ। উগুরু মাথা নাড়ল। আমি এখন পর্যন্ত যত শিশু ডিজাইন করেছি তার মাঝে এই শিশুটি সবচেয়ে চমকপ্রদ। আটটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য এর মাঝে বিকশিত করা হয়েছে। বর্তমানে যে মানদণ্ড দাঁড়া করা হয়েছে তার হিসেবে আপনার এই শিশুটি পুরো আশি পয়েন্টের একটি শিশু!
রন হাসতে হাসতে বলল, আমি আপনাদের এই পয়েন্টের হিসেব বুঝি না। ধরে নিচ্ছি আশি পয়েন্টের শিশু বলতে একজন প্রতিভাবান শিশু বোঝানো হয়।
উরু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। সারা পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আশি পয়েন্টের শিশু খুব বেশি ডিজাইন করা হয় নি। উগুরু তার পকেট থেকে একটা খাম বের করে রনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই যে এখানে আমার কোম্পানির সার্টিফিকেটের একটা কপি। মূল সার্টিফিকেট রয়েছে জাতীয় ডাটাবেসে যখন খুশি তখন আপনি সেটা ব্যবহার করতে পারবেন! এই সার্টিফিকেটের কারণে আপনার এই শিশুটির জীবনের অনেক কিছুই খুব সহজ হয়ে যাবার কথা।
নিহা মাথা নেড়ে বলল, অনেক ধন্যবাদ।
উগুরু গলা লম্বা করে নিহার কোলে ধরে রাখা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছেন? আমাদের সিমুলেশন বাচ্চাটির যে চেহারা তৈরি করেছিল তার সাথে হুবহু মিলে গেছে?
সিমুলেশনে বাচ্চার চেহারা কেমন ছিল নিহার মনে নেই তবুও সে ভদ্রতা করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। উগুরুর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়েছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ও আচ্ছা-সার্টিফিকেটের সাথে আমি একটা ক্রিস্টাল দিয়ে দিয়েছি।
কী ক্রিস্টাল?
আপনাদের বাচ্চার প্রোফাইল আছে এখানে। তার ক্রোমোজোমে আমরা যে বিশেষ জিনগুলো দিয়েছি সেগুলো বিকশিত করার জন্যে কী করতে হবে তার ঘুঁটিনাটি সব নির্দেশ দেয়া আছে।
নিহা ভুরু কুঁচকে বলল, সেগুলো নিজে থেকে বিকশিত হবে, না আমাদের কিছু করতে হবে?
অবশ্যই আপনাদের কিছু কাজ করতে হবে তা না হলে কেমন করে হবে! তার ভেতরে শিল্পী হবার জিন যাচ্ছে কিন্তু যদি সে ব্যাপারে আপনি তাকে উৎসাহ না দেন সে তো কখনো তার সেই প্রতিভাটাকে কাজে লাগাবে না!
ও আচ্ছা!
উগুরু আবার মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনার হাতে আপনি যে বাচ্চাটিকে ধরে রেখেছেন সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বাচ্চার একজন। কিন্তু এই বাচ্চাটি তার সেই প্রতিভাকে ব্যবহার করবে কি করবে না সেটা কিন্তু নির্ভর করছে আপনাদের দুজনের ওপর!
আমাদের ওপর?
হ্যাঁ, তার কোন বয়সে কীভাবে উদ্দীপনা দিতে হবে তার সবকিছু ক্রিস্টালে বলে দেয়া আছে। কোনো সমস্যা হবার কথা নয়।
রন মাথা নাড়ল, বলল, না। সমস্যা হবে না আমরা অনেক ইউনিট খরচ করে আমাদের সন্তানকে ডিজাইন করেছি। আমরা সেটি কিছুতেই বৃথা যেতে দেব না।
উগুরু তার দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকব আপনাদের সন্তানের সাফল্যের খবর শোনার জন্যে!
নিহা বলল, তার জন্যে আপনাকে মনে হয় অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
হ্যাঁ। আমি তার জন্যে অনেক দিনই অপেক্ষা করব। আমার শুধু তার নামটি জানতে হবে।
নিহা বলল, আমরা আমাদের ছেলের নাম রেখেছি নীল।
রন হেসে যোগ করল, নিহার সাথে মিল রেখে নীল।
চমৎকার। উরু বলল, আমি মিডিয়ার দিকে লক্ষ রাখব নীলের খবরের জন্যে। আমার সিমুলেশন আমাকে বলে দেবে কখন তার খবর মিডিয়াতে আসবে!
০৭.
উগুরুর দেয়া ক্রিস্টালে রাখা সিমুলেশন অনুযায়ী নীলের দাঁত ওঠার কথা পাঁচ মাসে সত্যি সত্যি তার নিচের মাঢ়ী থেকে ছোট দুটো দাঁত উঁকি দিল ঠিক যখন তার বয়স পাঁচ মাস। সিমুলেশন অনুযায়ী নীলের দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার কথা এগার মাসে, সত্যি সত্যি এগার মাস দুই দিন বয়সে সে টলতে টলতে কয়েক পা হেঁটে ফেলল। সিমুলেশন থেকে নিহা আর রন জানতে পারল নীল দুই বছর এক মাস থেকেই কথা বলতে শুরু করবে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি সত্যি দেখা গেল নীল ঠিক দুই বছর এক মাস কয়েক দিন বয়স থেকে আধো আধো বুলিতে কথা বলতে শুরু করেছে। ঠিক একইভাবে দেখা গেল সিমুলেশনের সাথে মিল রেখে নীল দুই বছর তিন মাস বয়স থেকে মোটামুটি সত্যিকারের ছবি আঁকতে শুরু করল। তিন বছর বয়স থেকে নীল পড়তে শুরু করল এবং চার বছর বয়স থেকে সে গণিতের প্রাথমিক বিষয়গুলো চর্চা করতে শুরু করল।
রন আর নিহা তাদের সন্তানের নানামুখী প্রতিভা বিকশিত করার জন্যে যখন যেটা করার প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করে দিল। তার ঘরে ছোট বাচ্চাদের ব্যবহারের উপযোগী কম্পিউটার, তার সাথে নেটওয়ার্ক সংযোগ আর ইলেকট্রনিক মিউজিক সেন্টার। সঙ্গীত সৃষ্টি করার নানা ধরনের ব্যবহারী সফটওয়্যার, ছবি আঁকার জন্যে বিশেষ ইলেকট্রনিক প্যাড, লেখাপড়ার জন্যে তার বয়সোপযোগী নানা ধরনের বই, স্টিমুলেটিং খেলনা এই সব দিয়ে রন আর নিহা তাদের সন্তানের ঘর ভরে ফেলল।
ঠিক একই সময়ে রিশ এবং তিনার সন্তান রিকিও অনেকটা নিজের মতো করেই বড় হতে লাগল। ছেলে হলে তার নাম রাখার কথা ছিল রিকি। নামটি রিশের কাছে একটু বেশি সাদামাটা মনে হলেও সে মেনে নিয়েছে। নীলের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেরকম সুনির্দিষ্ট ছকে বাধা, রিকির জীবন ছিল ঠিক সেরকম অগোছালো। রিকি ঠিক কখন হামাগুড়ি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেল, ঠিক কখন হাঁটতে শুরু করল এবং কখন কথা বলতে শুরু করল সেটা তিনা কিংবা রিশ কেউই ভালো করে লক্ষ করে নি। নীলের মতো বড় হওয়ার জন্যে সে একশ রকমের উপকরণের মাঝে, নিয়মকানুন আর পদ্ধতির মাঝে বড় হয় নি সেটি সত্যি কিন্তু যে জিনিসটার তার কখনো অভাব হয় নি সেটা হচ্ছে ভালবাসা। বাবা-মায়ের ভালবাসা তো আছেই–দরিদ্র মানুষের শিশুসন্তান পাওয়ার অধিকার নেই বলে পুরো এলাকাতেই শিশু বলতে গেলে রিকি ছিল একা–তাই সে সবার ভালবাসাটাই পেয়েছে। শুধু যে ভালবাসা পেয়েছে তা নয় সে বড় হয়েছে নিম্নাঞ্চলের বনভূমিতে, নদীতে, বিস্তীর্ণ মাঠে, খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থেকে।
তিনা তাকে বর্ণ পরিচয় শিখিয়েছে। তার আগ্রহের কারণে সে লিখতে পড়তে শিখেছে। রিশ তাকে অল্প কিছু গণিত শিখিয়েছে– জীবনের বাকি জ্ঞানটুকু এসেছে দৈনন্দিন জীবন থেকে। সেই জ্ঞানের জন্যে কোথা থেকেও সে সার্টিফিকেট পাবে না সত্যি কিন্তু তার গুরুত্বটুকু কিন্তু একেবারেই কম নয়। তার বয়সী একজন বাচ্চার জন্যে রিকির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার রীতিমতো অভাবনীয়। তার দৈনন্দিন একটা দিনের হিসেব নিলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
০৮.
রিকি বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছিল, তার মুখের ওপর এলোমেলো চুল এসে পড়েছে। রিশ তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, রিকি বাবা আমার! ঘুম থেকে উঠবি না?
রিকি ঘুমের মাঝে একটু শব্দ করে নড়েচড়ে পাশ ফিরে শুলো। রিশ বলল, কী হল, উঠবি না?
রিকি আবার একটু শব্দ করে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে রইল। রিশ বলল, সকাল হয়ে গেছে। দেখ কত বেলা হয়েছে।
রিকি আবার একটু শব্দ করল। রিশ বলল, মনে নেই আজ আমাদের হ্রদে যাবার কথা?
সাথে সাথে রিকি চোখ খুলে তাকাল, চোখ পিটপিট করে বলল, হ্রদে?
হ্যাঁ। মনে নেই আজকে আমাদের একটা ভেলা বানানোর কথা?
ভেলা? এবারে রিকির চোখ পুরোপুরি খুলে যায়।
হ্যাঁ বাবা। চট করে উঠে পড়, আমরা বেরিয়ে পড়ি। অনেক দূর যেতে হবে।
একটু আগেই যাকে ঠেলেঠুলে তোলা যাচ্ছিল না, এবারে সে প্রায় তড়াক করে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ল! কিছুক্ষণের মাঝেই সে হাতমুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে। তিনা তার প্লেটে এক টুকরো রুটি আর এক মগ দুধ দিয়ে বলল, নে খা।
রিকি দুধের মগ হাতে নিয়ে বলল, এটা কীসের দুধ মা? এটা কি কৃত্রিম না খাঁটি?
তিনা মাথা নেড়ে বলল, ও বাবা! ছেলের শখ দেখ, সে খাঁটি দুধ খেতে চায়। পৃথিবীতে খাঁটি দুধ কি পাওয়া যায় এখন?
কেন মা? খাঁটি দুধ কেন পাওয়া যায় না?
ফ্যাক্টরিতে কত সহজে কৃত্রিম দুধ তৈরি করে-কে এখন খাঁটি দুধের জন্যে গরুর পিছনে পিছনে ছুটবে?
একজন মানুষ খাঁটি দুধের জন্যে একটা গরুর পিছনে পিছনে ছুটছে দৃশ্যটা রিকির বেশ পছন্দ হল। সে হিহি করে হেসে বলল, গরুর পিছনে ছুটলে কী হয় মা?
যখন কোথাও একটা গরু দেখবি তখন তার পিছু ছুটে ছুটে দেখিস কী হয়?
রিশ তার শুকনো রুটি চিবুতে চিবুতে বলল, রিকি বাবা, খাবার সময় তুই যদি এত কথা বলিস তা হলে খাবি কেমন করে?
রিকি রুটির টুকরোটা দুধে ভিজিয়ে নরম করে মুখে পুরে দিয়ে বলল, আমরা যদি নাক দিয়ে না হলে কান দিয়ে খেতে পারতাম তা হলে কী মজা হত তাই না বাবা।
রিশ ভুরু কুঁচকে বলল, তা হলে কেন মজা হত?
তা হলে আমরা একই সাথে কথাও বলতে পারতাম। খেতেও পারতাম!
তিনা বলল, তোর তো কোনো সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না! যে মুখ দিয়ে খাচ্ছিস সেই মুখ দিয়েই তো সমানে বকবক করে যাচ্ছিস!
.
কিছুক্ষণের মাঝেই রিকি তার বাবার হাত ধরে বের হল। যাবার আগে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি আমাদের সাথে কোথাও যেতে চাও না কেন?
আমিও যদি তোদের পিছু পিছু বনে জঙ্গলে পাহাড়ে টিলায় নদী বিল হ্রদে ঘোরাঘুরি করতে থাকি তা হলে এই সংসারটা দেখবে কে?
কাউকে দেখতে হবে না মা, তুমিও চল। দেখবে কত মজা হবে।
রক্ষে কর। গ্লাইডারে করে পাহাড় থেকে লাফিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ানোর মাঝে তোরা বাবা-ছেলে অনেক মজা পাস-আমি কোনো মজা পাই না! বর্ণনা শুনেই ভয়ে আমার হাত-পা শরীরের মাঝে সেঁধিয়ে যায়!
রিকি হিহি করে হেসে বলল, মা! তুমি যে কী ভিতু! আমি তোমার মতো কোনো ভিত মানুষ কখনো দেখি নি!
রিকি মোটর বাইকের পিছনে বসে রিশকে শক্ত করে ধরতেই রিশ প্যাডেলে চাপ দেয়। প্রায় সাথে সাথেই গর্জন করে মোটর বাইকটা ছুটে চলতে থাকে। দেখতে দেখতে তারা শহর পার হয়ে শহরতলিতে চলে এল। শহরতলি পার হতেই রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো হতে শুরু করে। রাস্তার দুই পাশে পরিত্যক্ত বাড়িঘর, গাছপালায় ঢেকে আছে। আরো কিছুদূর যাবার পর রাস্তাটা আরো খারাপ হয়ে গেল। খানাখন্দে বোঝাই, জায়গায় জায়গায় বুনো গাছ ঝোঁপঝাড় উঠে গেছে। মোটর বাইক দিয়েও আর যাবার উপায় নেই।
রিশ মোটর বাইকটা থামিয়ে ঠেলে একটা গাছে হেলান দিয়ে বলল, বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। পারবি না বাবা রিকি?
রিকি মাথা নেড়ে বলল, পারব। তারপর দাঁত বের করে হেসে যোগ করল, আর যদি না পারি তা হলে তুমি আমাকে ঘাড়ে করে নেবে!
রিশ মাথা নেড়ে বলল, উঁহু! তুই এখন বড় হয়েছিস-তোকে এখন মোটেও ঘাড়ে করে নেয়া যাবে না!
কেন বাবা? বড় হলে কেন ঘাড়ে নেয়া যায় না?
সেটাই হচ্ছে নিয়ম। যত বড় হবি ততই সবকিছু নিজে নিজে করতে হয়।
রিকি মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, আমি সবকিছু নিজে নিজে করি বাবা।
আমি জানি। রিশ বলল, নিজে নিজে করলেই নিজের ওপর বিশ্বাস হয়। সেইটার নাম আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস যদি কারো থাকে তা হলে সে সবকিছু করে ফেলতে পারে। আর যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে তা হলে সে জীবনে কিছুই করতে পারে না।
রিশ কী বলছে রিকি সেটা ঠিক করে বুঝতে পারল না। কিন্তু সে সেইটা তার বাবাকে বুঝতে দিল না। সবকিছু বুঝে ফেলেছে সে রকম ভান করে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে থাকল।
বাবা আর ছেলের ছোট দলটি কিছুক্ষণের মাঝেই রওনা দিয়ে দেয়। রিশের পিঠে হ্যাঁভারসেক। সেখানে খাবারের প্যাকেট, পানীয় আর কিছু যন্ত্রপাতি। রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দুজনেই বনের ভেতর ঢুকে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে তারা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির সামনে এসে পড়ে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে বাড়িগুলো প্রায় সময়েই ধসে পড়েছে, গাছপালায় ঢেকে গেছে, ঘন লতাগুল্মে সবকিছু ঢাকা। জনমানবহীন এই বাড়িগুলো দেখলে বুকের ভেতর কেমন যেন এক ধরনের কাঁপুনি হয়। লতাগুল্মে ঢাকা বড় একটা পরিত্যক্ত বাড়ি দেখে রিকি হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল। বাবাকে ডেকে বলল, বাবা।
কী হল?
এই বাসাগুলোতে এখন আর মানুষ থাকে না কেন?
মানুষের সংখ্যা কমছে–তাই কেউ থাকে না।
কেন মানুষের সংখ্যা কমছে?
শিশুদের জন্ম না হলে সংখ্যা কমবে না?
শিশুদের জন্ম হচ্ছে না কেন?
রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীটাই তো দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ হচ্ছে বড়লোক। পৃথিবীর সব সম্পদ তাদের হাতে। তারা পৃথিবীটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আরেক ভাগ আমাদের মতো যাদের একটু কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়।
রিকি গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল, বলল, আমাদের মোটেও কষ্ট হচ্ছে না বাবা?
রিশ হেসে ফেলল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের মোটেও কষ্ট হচ্ছে না-ঠিকই বলেছিস! কষ্ট ব্যাপারটা আপেক্ষিক।
আপেক্ষিক মানে কী রিকি বুঝতে পারল না। কিন্তু তারপরেও সে গম্ভীর মুখে এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে।
দুজনে যখন হ্রদের পাড়ে পৌঁছেছে তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর। হ্রদের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে সেটা ঝিকমিক করছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে রিকি বলল, কী সুন্দর বাবা!
হ্যাঁ। খুবই সুন্দর।
কেন সুন্দর বাবা?
এটা তো কঠিন প্রশ্ন রিকি। কেন যে একটা কিছু দেখে সুন্দর মনে হয় কে জানে! মানুষের ধর্মটাই মনে হয় এরকম। পানি দেখলেই ভালো লাগে। আমাদের শরীরের ষাট সতুর ভাগই তো পানি মনে হয় সেজন্যে।
রিশ এবারেও ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝতে পারল না কিন্তু তারপরেও সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। রিশ লেকের তীরে একটা বড় গাছের ছায়ায় দুই পা ছড়িয়ে বসে রিকির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, খিদে পেয়েছে বাবা?
রিকি মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বাবা, খিদে পেয়েছে। গলাটাও শুকিয়ে গেছে।
আয়, কাছে আয়। ব্যাগটা খুলে দেখি তোর মা কী দিয়েছে খেতে।
রিকি তার বাবার শরীরে হেলান দিয়ে বসে। রিশ ব্যাগ খুলে খাবারের প্যাকেট আর পানীয়ের বোতল বের করল। প্যাকেট খুলে মাংসের পুর দেয়া পিঠে বের করে দুজনে খেতে শুরু করে। পানীয়ের বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা ঝাঁজালো পানীয় খেয়ে রিশ বলল, তুই ঠিকই বলেছিস রিকি।
আমি কী ঠিক বলেছি বাবা?
আমাদের জীবনে কোনো কষ্ট নেই-আমরা খুব আনন্দে আছি।
রিকি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ বাবা। আনন্দে আছি।
.
খাওয়ার পর দুজনে মিলে ভেলাটাকে দাঁড় করানোর কাজে লেগে গেল। হ্রদের তীরে পড়ে থাকা নানা আকারের গাছের গুঁড়িগুলো একত্র করে উপরে নিচে কাঠের দণ্ড মিশিয়ে শক্ত করে বেঁধে নেয়। ভেলাটার মাঝামাঝি একটা ছোট খুপরির মতো তুলে নেয়। পুরো কাজ যখন শেষ হল তখন সূর্য খানিকটা ঢলে পড়েছে। রিশ ভেলাটার দিকে তাকিয়ে বলল, ভেলাটা কেমন হয়েছে রিকি?
খুবই সুন্দর।
আয় এখন এটাকে ভাসিয়ে দিই।
চল বাবা।
রিশ ভেলাটাকে ঠেলে ঠেলে পানিতে নিয়ে আসে। ভেলার বেশ খানিকটা ডুবে গিয়ে উপরের অংশটুকু পানিতে ভাসতে থাকে। রিশ ভেলার উপর দাঁড়িয়ে রিকিকে টেনে উপরে তুলে নেয়। দুজনের ভারে ভেলাটা দুলতে থাকে, গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে পানি এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিল। রিকি আনন্দে হাসতে হাসতে বলল, আমাদের কী সাংঘাতিক একটা ভেলা হল। তাই না বাবা?
হ্যাঁ। আমাদের খুব সুন্দর একটা ভেলা হল।
এই ভেলা করে আমরা কোথায় যাব বাবা?
আমাদের যেখানে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব।
আমরা কি পৃথিবীর একেবারে শেষ মাথায় যেতে পারব বাবা!
চাইলে কেন পারব না? যেতে চাস?
আজ না বাবা।
কেন না?
আরেক দিন। মাকে নিয়ে যাব।
রিশ শব্দ করে হেসে ফেলল, বলল, তোর মা এই ভেলাতেই উঠবে না।
ঠিক বলেছ। মা খুব ভিতু তাই না বাবা।
উঁহু। বিশ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তোর মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষ।
কেন বাবা? মা কেন সাহসী?
তোর মা যদি সাহস না করত তা হলে তোর জন্মই হত না।
মায়ের সাহসের সাথে তার জন্ম নেয়ার কী সম্পর্ক রিকি সেটা ঠিক বুঝতে পারল না, কিন্তু সে সেটা বুঝতে দিল না। গম্ভীরভাবে এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সে এটাও বুঝে ফেলেছে।
রিশ একটা বড় লগি দিয়ে ভেলাটাকে ধাক্কা দিতেই ভেলাটা পানিতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যায়। রিকি বাবার পা ধরে অবাক হয়ে হ্রদের সুবিস্তৃত পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাথার উপর কিছু গাঙচিল উড়ছে, পানির ভেতর থেকে একটা শুশুক হঠাৎ লাফিয়ে পানি ছিটিয়ে চলে যায়। দূরের বন থেকে কোনো একটা প্রাণী করুণ স্বরে ডেকে ডেকে যায়। রিকি এক ধরনের মুগ্ধ বিষয় নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
হ্রদের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেরিকি হঠাৎ দেখে পানির নিচে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি। দেখে মনে হয় যেন একটা স্বপ্নরাজা– তার মায়ের রূপকথার গল্পের সেই মৎস্যকন্যার নগরী। সে অবাক হয়ে বলল, বাবা! পানির নিচে কার বাড়ি?
একসময় মানুষের ছিল। এখন ডুবে গেছে।
কেন ডুবে গেছে বাবা?
পানি বেড়ে গেছে সেজন্যে ভুলে গেছে।
পানি কেন বেড়ে গেছে বাবা?
যারা পৃথিবীটা ভোগ করে তাদের লোভের জন্যে পৃথিবীর পানি বেড়ে গেছে। পৃথিবীটা ধীরে ধীরে গরম হয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে গিয়েছে তো সেজন্যে পৃথিবীর পানি বেড়ে যাচ্ছে।
মানুষের লোভের জন্যে কেন মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে রিকি সেটাও পরিষ্কার বুঝতে পারল না কিন্তু সেটা নিয়েও সে মাথা ঘামাল না-গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল যেন সবকিছু বুঝে ফেলেছে। বড়দের অনেক কথাই সে সব সময় বুঝতে পারে না, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। এখন সে শুধু শুনে যায়-বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝবে।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল রিশ খালি গায়ে ভেলার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। রিকি নগ্নদেহে ভেলার ওপর থেকে হ্রদের নীল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মাছের মতো সাঁতার কেটে হ্রদের নিচে ডুবে থাকা প্রাচীন নগরীর কাছে পৌঁছে সেটাকে সে দেখার চেষ্টা করে! পৃথিবীতে এত রহস্য ছড়িয়ে আছে, একটি জীবনে সে সব রহস্য দেখতে পারবে? বুঝতে পারবে?
রিকির ছোট মাথাটাতে এই বয়সে কত বড় বড় ভাবনা খেলা করে–সে যখন বড় হবে তখন তার কী হবে?
০৯.
প্রতিভাবান শিশুদের বিশেষ স্কুলের প্রিন্সিপাল কেটি মধ্যবয়সী হালকা পাতলা একজন মহিলা। সে তার সহকারী ক্রানাকে জিজ্ঞেস করল, স্কুল বাসটা কি এসেছে?
ক্রানা বলল, এসেছে কেটি।
সব ছাত্রছাত্রী বাস থেকে নেমেছে?
নেমেছে।
ক্লাস ঘরে ঢুকেছে?
ক্রানা বলল, হ্যাঁ ঢুকেছে। ক্লাস টিচার সবাইকে নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে।
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, চমৎকার!
ক্রানা বলল, আচ্ছা কেটি, তুমি প্রত্যেক দিনই এই ব্যাপারটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তার মাঝে থাক, ব্যাপারটা কী?
ব্যাপার কিছুই না-কিন্তু বুঝতেই পারছ, এই স্কুল বাসে করে যে বাচ্চাগুলো আসে তাদের বাবা মায়েরা হচ্ছে-দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ! কাজেই বাচ্চাগুলো ঠিকমতো পৌঁছাল কি না সেটা খুবই জরুরি একটা ব্যাপার। তার থেকেও জরুরি ব্যাপার কী জান?
কী?
এই বাচ্চাগুলোর সবাই হচ্ছে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করা বাচ্চা। প্রতিভার স্কেলে কেউ চল্লিশের কম নয়। বিশ্বাস কর আর নাই কর একজনের পয়েন্ট আশি! এই বাচ্চাগুলো সবাই মিলে যদি একসাথে কিছু পরিকল্পনা করে আমাদের সাধ্যি নেই সেটা ঠেকানো!
ক্ৰানা অবাক হয়ে বলল, কী পরিকল্পনা করবে?
জানি না।
এরা তো ছোট বাচ্চা, বয়স সাত আট মাত্র!
জানি। কিন্তু এরা সবাই অসাধারণ। এরা বড়দের মতো চিন্তা করতে পারে। বলতে পার ছোট বাচ্চাদের শরীরে কিছু বড় মানুষ আটকা পড়ে আছে। কোনো কারণে যদি বিগড়ে যায় কিছু একটা করতে চায় আমরা কোনোভাবে ঠেকাতে পারব না।
ক্রানা হেসে বলল, তুমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছ কেটি। এটা কোনোদিনই হবে না। এই বাচ্চাগুলো শুধু শুধু কেন বিগড়ে যাবে?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, আমি জানি আমি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি। কিন্তু আমার মনে হয় একটু সতর্ক থাকা ভালো। হঠাৎ কী মনে করে প্রিন্সিপাল কেটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল বাচ্চাগুলো একটু দেখে আসি।
বিল্ডিংয়ের এক কোনায় বড় একটা রুমের মাঝামাঝি ঘোট ঘোট চেয়ার-টেবিলে বারো জন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে একটা বড় অ্যাকোয়েরিয়াম, সেখানে একটা বড় এঞ্জেল ফিশ। অ্যাকোয়েরিয়ামের পাশে একজন হাসি খুশি শিক্ষিকা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। প্রিন্সিপাল কেটি আর তার সহকারী ক্ৰানাকে দেখে কথা থামিয়ে তাদের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী খবর কেটি? কী মনে করে আমাদের ক্লাস রুমে?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, অনেক দিন আমি বাচ্চাদের দেখি না। ভাবলাম আজ একনজর দেখে আসি। কেমন আছে সবাই?
হাসি-খুশি শিক্ষিকা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরাই বল তোমরা কেমন আছ?
কালো চুলের একটা মেয়ে বলল, আমরা তো ভালোই আছি–আমাদের দুশ্চিন্তা আমাদের মায়েদের নিয়ে!
প্রিন্সিপাল কেটি চোখ বড় বড় করে বলল, কেন? তোমাদের মায়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?
কেন? তোমরা জান না আমাদের সবার একটা করে সিমুলেশন আছে?
হ্যাঁ জানি। ডিজাইনাররা তোমাদের সবার জন্যে একটা করে সিমুলেশন দিয়েছে!
আমাদের কাজকর্ম যদি সিমুলেশনের সাথে না মেলে তা হলে আমার মা খুব ঘাবড়ে যায়। কালো চুলের মেয়েটি বড়দের মতো ভঙ্গি করে বলল, সেটা খুবই ঝামেলার ব্যাপার!
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, কিন্তু সিমুলেশনের সাথে মিলবে না কেন? অবশ্যই মিলবে। তোমরা তো জানো তোমাদের অনেক যত্ন করে ডিজাইন করা হয়েছে! তোমরা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে প্রতিভাবান বাচ্চা!
লাল চুলের একটা মেয়ে ঠোঁট উল্টে বলল, কী জানি! এত কিছু বুঝি না! সবাই শুধু বলে প্রতিভাবান! প্রতিভাবান। আমি তো এত কিছু বুঝি। আমি তো সেরকম কিছু দেখি না।
ছোট ছোট করে চুল ছাটা একটা ছেলে বলল, আমিও সে রকম কিছু দেখি না। ছেলেটা তার পাশে বসে থাকা সোনালি চুলের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি বুঝ নীল?
নীল গম্ভীর মুখে বলল, কেমন করে বুঝব? সেটা বোঝার জন্যে আমাদের দরকার একজন সাধারণ মানুষ। তার সাথে তুলনা করলে না হয় বুঝতাম!
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, এই যে আমি! আমার কোনো প্রতিভা নেই। আমি খুব সাধারণ-আমার সাথে তুলনা কর!
নীল খুক করে একটু হেসে বলল, তুমি তো বড় মানুষ! বড় মানুষদের আমি একেবারে বুঝতে পারি না!
পাশে বসে থাকা একটা মেয়ে বলল, আমিও বুঝতে পারি না!
অনেকেই সায় দিয়ে বলল, আমিও পারি না!
কালো চুলের মেয়েটা বলল, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
বড় মানুষেরা আসলে একটু বোকা!
কথাটা মনে হয় সবারই খুব পছন্দ হল, সবাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে হিহি করে হাসতে রু করে। নীল সবার আগে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের বোকা বলেছি বলে তোমরা কিছু মনে কর নি তো?
প্রিন্সিপাল কেটি হাসিমুখে বলল, না। আমরা কিছু মনে করি নি!
হাসি-খুশি শিক্ষিকা এতক্ষণ চুপ করে বাচ্চাদের ছেলেমানুষি কথা শুনছিল এবারে সে মুখ খুলল। বলল, বাচ্চারা তোমরা তো বোকা আর বুদ্ধিমান নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ তাই না? আমি দেখতে চাই তোমরা আসলে ব্যাপারটা বুঝ কি না! আমরা আগামী কয়েক দিন বিভিন্ন রকম প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করব। আজকে এনেছি একটা মাছ। সারা দিন এই মাছটাকে নিয়ে সময় কাটাব-এই মাছটার বুদ্ধিমত্তা কীভাবে কাজ করে সেটা বোঝার চেষ্টা করব। আগামীকাল আনব একটা গিরগিটি এক ধরনের সরীসৃপ। এর পরের দিন আনব একটা পাখি। তার পরের দিন একটা ছোট কুকুরের বাচ্চা-একটা স্তন্যপায়ী প্রাণী। সবশেষে আনব একটা শিম্পাঞ্জি। তোমরা দেখবে কীভাবে একটা প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে।
নীল হাততালি দিয়ে বলল, কী মজা।
হ্যাঁ। অনেক মজা। হাসি-খুশি শিক্ষিকা বলল, চল তা হলে আমরা কাজ শুরু করে দিই। কোন প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা কী রকম সেটা বোঝার জন্যে কিছু এক্সপেরিমেন্ট ঠিক করে ফেলি।
কালো চুলের মেয়েটি বলল, এই মাছটাকে নিয়ে কী করা যায় সেটা আমি ঠিক করে ফেলেছি!
শিক্ষিকা বলল, হ্যাঁ আমরা সেটা শুনব।
প্রিন্সিপাল কেটি কানার দিকে তাকিয়ে বলল, বাচ্চারা ক্লাস করুক। চল, আমরা যাই।
চল। ক্ৰানা প্রিন্সিপাল কেটির পিছনে পিছনে ক্লাস ঘর থেকে বের হয়ে এল। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রিন্সিপাল কেটি বলল, ক্রানা। আমার মাথায় একটা অসাধারণ আইডিয়া এসেছে।
কী?
এই বাচ্চাগুলো এখন বিভিন্ন প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করছে। মাছ, সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী-সবশেষে একটা শিম্পাঞ্জি। আমার কী মনে হয় জান? শিম্পাঞ্জিতে থেমে গিয়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলে কেমন হয়?
আরো এক ধাপ?
হ্যাঁ। সবশেষে আনা হবে এই বাচ্চাদের বয়সী একটা মানবশিশু। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ডিজাইন করা মানবশিশু নয় একেবারে সাধারণ মানবশিশু।
সাধারণ?
হ্যাঁ। প্রিন্সিপাল কেটি উত্তেজিত গলায় বলল, একেবারে সাধারণ একটা মানবশিশু। সেই শিশুটার সাথে তারা যদি একটা দিন কাটাতে পারে তা হলে এই বাচ্চারা বুঝতে পারবে তারা কত প্রতিভাবান! বুদ্ধিমত্তা কাকে বলে তার একটা বাস্তব ধারণা হবে!
ক্ৰানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু
কিন্তু কী?
কিন্তু সেরকম বাচ্চা তুমি কোথায় পাবে? আর যদি খুঁজে পেয়েও যাও তাদের বাবা মা কেন রাজি হবে শিম্পাঞ্জির পাশাপাশি নিজের বাচ্চাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে!
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, নিম্নাঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলোর মাঝে খোজাখুঁজি করলেই এরকম একটা বাচ্চা পাওয়া যাবে। আর বাচ্চাটাকে আনার সময় আমরা কি কখনো বলব যে তাকে আনছি শিম্পাঞ্জির পরের স্তর দেখানোর জন্যে? আমরা বলব তাকে আনছি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের জন্যে! বড় বড় কথা বলে বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেলব।
ক্রানা মাথা নাড়ল, বলল, আইডিয়াটা খারাপ না। এই বাচ্চাদের তাদের সমবয়সী একটা সাধারণ বাচ্চা দেখা দরকার।
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, তা হলে দেরি করে কাজ নেই। তুমি খোজাখুজি শুরু করে দাও। বেশি দরিদ্র মানুষকে বাচ্চা নেয়ার অনুমতি দেয়া হয় না–তাই হতদরিদ্রদের মাঝে না খুঁজে একটু নিম্নবিত্তদের মাঝে খোঁজ কর।
ক্রানা বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, কেটি। আমি খুঁজে বের করে ফেলব।
১০.
খাবার টেবিলে তিনা বলল, আজকে খুব বিচিত্র একটা চিঠি এসেছে।
রিশ সুপের বাটি থেকে এক চামচ গরম সুপ মুখে নিয়ে বলল, বিচিত্র?
হ্যাঁ। চিঠিতে কী লেখা জান?
কী?
দাঁড়াও, আমি পড়ে শোনাই। বলে তিনা একটা কাগজ হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে :
আপনি শুনে আনন্দিত হবেন যে শহরতলির শিশুদের মূলধারার জীবনের সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে আয়োজিত একটি প্রোগ্রামে আপনাদের সন্তানকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সেই প্রোগ্রামের আওতায় আগামী সপ্তাহে তাকে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এবং একটি স্কুলে পরিদর্শনের জন্যে নেয়া হবে। এই পরিদর্শনের যাবতীয় দায়িত্ব নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠান বহন করবে। যোগাযোগ করার জন্যে বিনীত অনুরোধ করা যাচ্ছে।
রিশ মাথা নেড়ে বলল, ভাঁওতাবাজি।
রিকি খুব মনোযোগ দিয়ে তার বাবা-মায়ের কথা শুনছিল। রিশের কথা শুনে বলল, কেন বাবা? এটা ভাঁওতাবাজি কেন? ভাঁওতাবাজি মানে কী?
যখন একটা কিছু বলা হয় কিন্তু উদ্দেশ্য থাকে অন্য কিছু, সেটা হচ্ছে ভাঁওতাবাজি।
এরা ভাঁওতাবাজি কেন করবে?
পার্বত্য অঞ্চলে যে বড়লোক মানুষগুলো থাকে তারা আসলে অন্যরকম। আমাদের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা কখনোই আমাদের জন্যে ভালো কিছু করে না।
কেন করে না বাবা?
আমাদেরকে তারা তাদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে না। তাই হঠাৎ করে যদি দেখি তাদের আমাদের বাচ্চাদের জন্যে মায়া উথলে উঠেছে তা হলে বুঝতে হবে এর ভেতরে অন্য একটা উদ্দেশ্য আছে।
তিনা রিকির প্লেটে এক টুকরো রুটি তুলে দিয়ে বলল, তা হলে তুমি এখানে রিকিকে পাঠাতে চাও না?
রিশ আরো এক চামচ সুপ খেয়ে বলল, কেমন করে পাঠাব? সামনের সপ্তাহে আমাদের ফ্যাক্টরির একটা জরুরি চালান সামাল দিতে হবে-আমি কেমন করে রিকিকে নিয়ে যাব?
তিনা বলল, আসলে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। মানুষগুলো বলেছে তারাই নিয়ে যাবে, সবকিছু দেখিয়ে ফিরিয়ে দেবে। দুই দিনের প্রোগ্রাম, প্রথম দিন চিড়িয়াখানা আর মিউজিয়াম। দ্বিতীয় দিন স্কুল।
রিশ কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। রিকি ডাকল, বাবা।
বল।
আমি যেতে চাই বাবা।
যেতে চাস?
হ্যাঁ। আমি কোনোদিন চিড়িয়াখানা দেখি নি।
রিশ বলল, দেখিস নি সেটা খুব ভালো। দেখলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
কেন বাবা? মন খারাপ কেন হবে?
তুই যখন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াস তখন দেখেছিস সেখানে পশুপাখিগুলো মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। চিড়িয়াখানায় সেই একই পশুপাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে।
তিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি একটু বেশি বেশি বলছ। বনে জঙ্গলে রিকি আর কয়টা পশুপাখি দেখেছে? চিড়িয়াখানায় কত রকম প্রাণী আছে! বাঘ সিংহ হাতি জলহস্তী সাপ কুমির-কী নেই?
রিকি আবার বলল, বাবা আমি চিড়িয়াখানা দেখতে চাই।
রিশ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চিড়িয়াখানা জাদুঘর ঠিক আছে। আমার আসল আপত্তিটা হচ্ছে স্কুলে।
কেন বাবা? স্কুলে আপত্তি কেন?
বড়লোকের ছেলেমেয়েদের স্কুল-দেখে তোর মন খারাপ হবে। তোক তো আমরা স্কুলেই পাঠাতে পারি না-কোনো স্কুলই নেই তোর জন্যে!
রিকি মাথা নাড়ল, না বাবা। আমার মন খারাপ হবে না।
রিশ কিছুক্ষণ রিকির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, সত্যিই যেতে চাস?
হ্যাঁ বাবা।
ঠিক আছে। যা তা হলে। মনে হয় জীবনে সব রকমেরই অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। হলই না হয় একটা খারাপ অভিজ্ঞতা।
তিনা মৃদু কণ্ঠে বলল, রিশ। তুমি যদি আসলেই না চাও তা হলে রিকিকে পাঠানোর কোনো দরকার নেই। আমরাই কখনো একবার রিকিকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব হয়।
থাক। যেতে চাইছে যখন যাক।
রিকি খাবার টেবিলে বসে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। আনন্দের হাসি।
১১.
গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে থামতেই রিকি তার পাশে বসে থাকা ক্ৰানাকে জিজ্ঞেস করল, এটা চিড়িয়াখানা?
ক্ৰানা ইতস্তত করে বলল, না। এটা চিড়িয়াখানা না।
আমাদের আগে না চিড়িয়াখানায় যাবার কথা? তারপর জাদুঘর?
কানা জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, আসলে পরিকল্পনায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। দুই দিনের প্রোগ্রাম ছিল সেটাকে একদিনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
তার মানে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব না? জাদুঘরে যাব না?
ক্ৰানা শুকনো গলায় বলল, না। আমরা শুধু দ্বিতীয় দিনের প্রোগ্রামে যাব। সেজন্যে এই স্কুলে এসেছি।
রিকির চোখে-মুখে আশা ভঙ্গের একটা স্পষ্ট ছাপ এসে পড়ল, সে সেটা লুকানোর চেষ্টা করল না। ক্রানার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে আমার বাবা আসলে ঠিকই বলেছিল।
ক্ৰানা ভুরু কুঁচকে বলল, তোমার বাবা কী বলেছিল?
আমার বাবা বলেছিল, আসলে পুরোটা ভাঁওতাবাজি।
ক্রানা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, কেন? ভাঁওতাবাজি কেন হবে?
কেউ যদি একটা জিনিসের কথা বলে অন্য একটা জিনিস করে সেটাকে বলে ভাঁওতাবাজি। তোমরা ভাঁওতাবাজি করেছ।
ক্ৰানা কঠিন গলায় বলল, বাজে কথা বোলা না ছেলে।
আমার নাম রিকি।
ঠিক আছে রিকি। এস আমার সাথে।
রিকি ক্ৰানার পিছু পিছু হেঁটে যায়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠে, করিডোর ধরে হেঁটে যায় এবং শেষে একটা বড় ঘরের সামনে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতরে মাঝামাঝি বেশ কয়েকটা ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল সেখানে রিকির বয়সী ছেলেমেয়েরা বসে আছে। তাদের সামনে হাসি খুশি চেহারার একজন মহিলা কথা বলছিল। ক্রানার সাথে রিকিকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। গলার স্বরে একটা আনন্দের ভাব ফুটিয়ে বলল, এস। এস তুমি, ভেতরে এস। তারপর সামনের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ সবাই। আজকে তোমাদের সাথে কে এসেছে। একটা ছেলে। তোমাদের বয়সী একটা ছেলে।
ক্ৰানা রিকির হাত ধরে ক্লাস ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। ছোট ঘোট চেয়ার-টেবিলে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিকির দিকে তাকিয়ে রইল-রিকি ঠিক কী করবে বুঝতে পারে না। এক ধরনের অস্বস্তি নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে।
হাসি-খুশি মহিলাটি বলল, তোমাদের মনে আছে এ সপ্তাহে আমরা কী নিয়ে আলোচনা করছিলাম? বুদ্ধিমত্তা! শুরু করেছি মাছ দিয়ে, একটা এঞ্জেল ফিশ আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। তারপর ছিল একটা গিরগিটি। শীতল দেহের এক ধরনের সরীসৃপ। এরপর ছিল পাখি, দেখে বোঝা যায় না কিন্তু আমরা আবিষ্কার করেছি পাখির বুদ্ধিমত্তা অনেক। পাখির পরে ছিল বুদ্ধিমত্তার উপরের দিকের একটা প্রাণী, সেটা কুকুর ছানা। সেটাকে নিয়ে আমাদের অনেক মজা হয়েছে। তাই না?
কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাচ্চাগুলো হাসি-খুশি মহিলার কথায় সাড়া দিল না। মহিলাটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কুকুর ছানার পর আমরা এনেছি শিম্পাঞ্জি। তোমাদের বলেছি শিম্পাঞ্জির জিনোম শতকরা নিরানব্বই ভাগ আমাদের মতো কাজেই তার বুদ্ধিমত্তাও অনেকটা আমাদের মতো। শিম্পাঞ্জির পর আমরা এনেছি একটা ছেলে! তোমরা আজকে এই ছেলেটার বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করবে। ঠিক আছে?
এবারেও সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েগুলো হাসি-খুশি শিক্ষিকার কথার উত্তর দিল। মহিলাটি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, এই ছেলেটিকে আমরা তোমাদের সাথে রেখে যাচ্ছি। এই ছেলেটির সাথে তোমাদের একটা খুব বড় পার্থক্য আছে। সেটি কী। বলতে পারবে?
পার্থক্যটা কী বাচ্চাগুলো অনুমান করতে পারছিল কিন্তু তবু কেউ উত্তর দিল না। হাসি খুশি মহিলা বলল, পার্থক্যটা হচ্ছে তোমাদের জিনোমে। এই ছেলেটির জিনোম সাধারণ তোমাদের জিনোম অসাধারণ। এই ছেলেটির জিনোম কোনো বৈশিষ্ট্য নেই-তোমাদের আছে। আমি চাই তোমরা সবাই মিলে এই ছেলেটিকে পরীক্ষা কর। তোমরা সারা দিন পাবে, বিকেলে আমি তোমাদের রিপোর্ট নেব। ঠিক আছে?
বাচ্চাগুলো এবারেও হাসি-খুশি মহিলার কথার উত্তর দিল না।
শিক্ষিকা আর ক্রানা চলে যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল। রিকি নিজের ভেতরে এক ধরনের অপমান, ক্রোধ এবং দুঃখ অনুভব করে। তার ছোট জীবনে এর আগে কখনোই সে এরকম অনুভব করে নি। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না ইচ্ছে করছিল ছুটে পালিয়ে যেতে, কিন্তু সে জানে তার ছুটে পালিয়ে যাবার কোনো জায়গা নেই। রিকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘরটা পরীক্ষা করল, ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল একটা ঘর। বড় বড় জানালা, উঁচু ছাদ। ঘরের পাশে নানা ধরনের সৃজনশীল খেলনা। ছবি আঁকার ইজেল, কম্পিউটার, বড় বড় মনিটর এবং যন্ত্রপাতি। সামনে বসে থাকা বাচ্চাগুলোকে সে এবারে লক্ষ করে। সবাই তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। রিকি কী করবে বুঝতে না পেরে বলল, এটা। একটা ভাঁওতাবাজি।
নীল জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?
আমি বলেছি এটা একটা ভাঁওতাবাজি।
ভাঁওতাবাজি?
হ্যাঁ।
ভাঁওতাবাজি মানে কী?
একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য একটা জিনিস করাকে বলে ভাঁওতাবাজি।
কালো চুলের মেয়েটি বলল, তোমার সাথে একটা জিনিস করার কথা বলে অন্য জিনিস করেছে?
হ্যাঁ। রিকি বলল, আমাকে বলেছিল চিড়িয়াখানা নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে না এনে এখানে এনেছে। ভাঁওতাবাজি করেছে।
লাল চুলের মেয়েটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা সব সময়েই ভাঁওতাবাজি করে। তাই না?
অনেকেই রাজি হয়ে মাথা নাড়ল। কোন বড় মানুষ কার সাথে কী ভাঁওতাবাজি করেছে সেটা নিয়ে সবাই কথা বলতে রু করছিল তখন ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের ছেলেটা বলল, ভালোই হয়েছে তোমাকে চিড়িয়াখানায় নেয় নাই। জায়গাটা খুবই হাস্যকর। খুবই দুর্গন্ধ। বাঘ সিংহ হাতি বাথরুম করে রাখে তো।
ছেলেটার কথা শুনে অনেকেই হেসে উঠল। একজন বলল, কিন্তু চিড়িয়াখানায় বানরের খাঁচাটা অনেক মজার। বানরগুলো অনেক বদরামো করে। দেখে কী মজা লাগে! তাই না?
রিকি বলল, আমি বানরের বাঁদরামো দেখেছি।
কোথায় দেখেছ?
আমাদের বাসা থেকে জঙ্গলে যাওয়া যায়। সেখানে বানর আছে। ছোট একটা। বানরের বাচ্চা আমার খুব বন্ধু।
সাথে সাথে সবগুলো বাচ্চা চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর নীল জিজ্ঞেস করল, বানরের বাচ্চা তোমার বন্ধু?
হ্যাঁ।
বানরের বাচ্চা কেমন করে তোমার বন্ধু হল? তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছ। তাই না?
রিকি মুখ শক্ত করে বলল, আমি মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলছি না। আমার সাথে চল, আমি তোমাকে এখনই দেখাব।
বাচ্চাগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। একজন বলল, কী দেখাবে?
বানরের বাচ্চাটা আমার বন্ধু আমি সেটা দেখাব। আমাকে দেখলেই সেটা আমার কাছে এসে ঘাড়ে বসে। কথা বলে।
কথা বলে? নীল বলল, মিথ্যা কথা।
মোটেও মিথ্যা কথা না।
তোমার সাথে কী কথা বলে?
কিচিমিচি করে বলে, আমি বুঝি না।
বাচ্চাগুলো এতক্ষণ তাদের চেয়ারে বসেছিল, এবারে কয়েকজন উঠে এল, রিকিকে কাছে থেকে দেখল। কালো চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
রিকি। তোমার নাম কী?
মাতিষা।
নীল এগিয়ে এসে বলল, আমার নাম নীল।
আমার নাম কিয়া।
আমার নাম লন- হঠাৎ করে সবাই একসাথে নিজের নাম বলতে শুরু করল, রিকি খুক করে হেসে বলল, আমি তোমাদের সবার নাম মনে রাখতে পারব না।
কোনো দরকার নাই মনে রাখার। আমরা যদি একসাথে খেলি তা হলেই নাম মনে হয়ে যাবে। তাই না?
সবাই মাথা নাড়ল।
লাল চুলের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, কী খেলবে নীল।
রকেট মেশিন খেলতে পারি। নীল রিকিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি রকেট মেশিন খেলা জানো?
না।
তা হলে কোনটা জান?
আমি কোনো খেলা জানি না।
তুমি কোনো খেলা জান না?
না।
তা হলে তুমি কী কর?
আমি জঙ্গলে বেড়াই। না হলে হ্রদে ভেলা নিয়ে ভাসি। মাঝে মাঝে আকাশে উড়ি।
কী কর? মাতিষা নামের মেয়েটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী কর তুমি?
আকাশে উড়ি।
তুমি কি পাখি যে আকাশে উড়ো?
রিকি হেসে বলল, ধুর বোকা! আমি কি বলেছি আমি পাখির মতো পাখা দিয়ে উড়ি? আমি গ্লাইডার দিয়ে উড়ি!
নীল মাথা নেড়ে বলল, গ্লাইডার! কী দারুণ!
হ্যাঁ। আমার বাবা বানিয়েছে। ভেতরে ঝুলে পাহাড়ের ওপর থেকে ছুটে লাফ দিতে হয় তখন সেটা আকাশে ভেসে ভেসে নিচে নামে। দুপুরবেলা যদি গরম বাতাস ওপরে উঠতে থাকে তখন অনেকক্ষণ আসা যায়।
কিয়া নামের মেয়েটা বলল, তোমার ভয় করে না।
রিকি হিহি করে হেসে বলল, ধুর! বোকা মেয়ে! ভয় করবে কেন? গ্লাইডার কখনো পড়ে যায় না। কিন্তু আমার মা ভয় পায়।
কিয়া গম্ভীর মুখে বলল, তয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
রিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার মা অনেক কিছু ভয় পায়। মাকড়সাকে ভয় পায়। টিকটিকিকে ভয় পায়। সাপকে ভয় পায়।
মাতিষা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সাপকে ভয় পাও না?
কেন ভয় পাব?
যদি কামড় দেয়।
কেন কামড় দেবে শুধু শুধু? সাপকে বিরক্ত না করলে সে মোটেও কামড়াবে না। তা ছাড়া এখানে যে সাপ থাকে তাদের বিষ নেই।
তুমি কেমন করে জান?
জানি। আমি তো জঙ্গলে ঘুরি–সেই জন্যে এগুলো জানতে হয়।
নীল তীক্ষ্ণ চোখে রিকির দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমরা যদি তোমার সাথে জঙ্গলে যেতে চাই, গ্লাইডারে উড়তে চাই তুমি আমাদের নেবে?
কেন নেব না।
মাতিষা মাথা নাড়ল, বলল, বড়রা আমার কোনোদিন যেতে দেবে না। বলবে। সিমুলেশনে নাই।
কিয়া বলল, আমার আর সিমুলেশন মতো চলতে ইচ্ছা করে না।
আমারও করে না।
নীল বলল, চল আমরা সবাই রিকির সাথে পালিয়ে যাই।
সবাই চোখ বড় বড় করে নীলের দিকে তাকাল, পালিয়ে যাবে?
হ্যাঁ। আমার খুবই গ্লাইডারে উড়ার ইচ্ছে করছে।
কিয়া বলল, আমার বানরের বাচ্চা দেখার ইচ্ছে করছে। সেটা খামচি দেবে না তো?
রিকি বলল, আমার সাথে থাকলে দেবে না।
মাতিষা বলল, আমার ভেলায় উঠতে ইচ্ছে করছে। ভেলা ডুবে যাবে না তো?
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ভেলা কখনো ডুবে না। নৌকা ডুবে যায় কিন্তু ভেলা ডুবে না।
মাতিষা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি শুধু টেলিভিশনে হ্রদের ছবি দেখেছি। সত্যিকারের হ্রদ দেখি নাই। হ্রদ দেখতে কি খুবই সুন্দর?
রিকি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। খুবই সুন্দর। হ্রদের নিচে একটা শহর ডুবে আছে। সেটা দেখলে তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তোমরা সাঁতার জানো তো?
জানি। কিন্তু আমি শুধু সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছি। পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ। ইয়াক থুঃ!
হ্রদের পানিতে কোনো গন্ধ নাই।
মাতিষা মুখ শক্ত করে বলল, আমিও পালাতে চাই।
নীল বলল, কারা কারা পালাতে চাও হাত তুল।
রিকি অবাক হয়ে দেখল সবাই হাত তুলেছে। নীল গম্ভীর হয়ে বলল, চমৎকার! তা হলে একটা পরিকল্পনা করতে হবে। বড়রা কোনোদিনও আমাদের পালাতে দিবে না।
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। তারা সিমুলেশনের বাইরে কিছুই করতে চায় না।
শান্তশিষ্ট চেহারার একজন বলল, যদি বড়রা আমাদের ওপর রাগ হয়?
তা হলে আমরাও বড়দের ওপর রাগ হব। বলব, আমরা সিমুলেশন মানি না। তখন সবাই ভয় পেয়ে যাবে। তারা সিমুলেশনকে খুব ভয় পায়।
মাতিষা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বড়রা খুবই বোকা।
সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হ্যাঁ, তাদের বোকামির তুলনা নেই।
নীল ভুরু কুঁচকে বলল, রবিবার।
রবিবার কী?
আমরা রবিবার পালাব। মনে আছে রবিবার আমাদের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট দেখতে যাওয়ার কথা?
হ্যাঁ। মনে আছে।
আমরা সেখানে না গিয়ে রিকির বাসায় চলে যাব।
কীভাবে?
নীল দাঁত বের করে হাসল, বলল, চিন্তা করে একটা বুদ্ধি বের করব।
অন্যেরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ চিন্তা করে বুদ্ধি বের করব।
চল, এখন তা হলে আমরা খেলি।
এস, আমরা রিকিকে রকেট মেশিন খেলাটা শিখিয়ে দেই।
হ্যাঁ। রকেট মেশিন খুবই মজার একটা খেলা।
কিয়া মনে করিয়ে দিল, আমাদের যে রিকির বুদ্ধিমত্তার ওপর একটা রিপোর্ট লিখতে হবে?
সেটা আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখে ফেলব।
কিয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, তারা বুঝতেও পারবে না যে আমরা বানিয়ে বানিয়ে লিখেছি!
এরপর সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রকেট মেশিন খেলতে শুরু করল, যা একটা মজা হল সেটা বলার মতো নয়।
১২.
হাসি-খুশি শিক্ষিকার কাছে বাচ্চাগুলো যে রিপোর্টটি দিল সেটা ছিল এরকম :
রিকি নামের ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই নিচু শ্ৰেণীর। সে আমাদের বলেছে তার সাথে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। ভাঁওতাবাজি শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক নয় এই ছেলেটা সেটা জানে না। তাকে বলা হয়েছিল যে তাকে চিড়িয়াখানা এবং জাদুঘরে নেয়া হবে কিন্তু সেখানে না নিয়ে তাকে আমাদের স্কুলে আনা হয়েছে। ছেলেটির বুদ্ধিমত্তা খুবই কম কারণ সে বুঝতে পারে নাই যে তাকে আসলে কখনোই চিড়িয়াখানা নেয়া হবে না। সে নিম্নাঞ্চলের একজন সাধারণ ছেলে তাকে চিড়িয়াখানায় নেয়ার কোন কারণ নেই–এই অতি সাধারণ বিষয়টাই তার বোঝার কোনো ক্ষমতা নেই। বড় মানুষেরা সব সময়েই আমাদেরকে ন্যায়নীতির কথা বলে কিন্তু তারা নিজেরা সেগুলো বিশ্বাস করে না এবং তারা সেগুলো পালন করে না। আমাদের বুদ্ধিমত্তা চল্লিশ থেকে আশি ইউনিটের ভেতর তাই আমরা এই ব্যাপারগুলো চট করে বুঝে ফেলি। কিন্তু রিকি নামক ছেলেটা সেটা বুঝতে পারে। নাই কারণ তার বুদ্ধিমত্তা খুবই কম।
আমরা আমাদের সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে স্কুলে লেখাপড়া করি বলে আমাদের প্রতিভার বিকাশ হচ্ছে। রিকির প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই কারণ সে কখনো স্কুলে যেতে পারে না। সময় কাটানোর জন্য সে জঙ্গল পাহাড় এবং হ্রদে ঘুরে বেড়ায়, বানরের সাথে তার বন্ধুত্ব। যার বানরের সাথে বন্ধুত্ব তার বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই খুব কম।
রিকি কোনো অ্যালজেবরা জানে না, কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে না, টাচ প্যাড ব্যবহার করে ছবি আঁকতে পারে না, রকেট মেশিন বা অন্য কোনো খেলা জানে না। এরকম কোনো ছেলে থাকা সম্ভব আমরা সেটি জানতাম না, রিকিকে নিজের চোখে দেখে এটা আমরা জানতে পেরেছি…
হাসি-খুশি শিক্ষিকা পুরো রিপোর্টটি মন দিয়ে পড়ে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। রিপোর্টটিতে একটুও ভুল তথ্য নেই কিন্তু পড়ে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মনে হয় এখানে যা লেখা হয়েছে তার বাইরেও কিছু একটা আছে। পুরো রিপোর্টটি যেন এক ধরনের তামাশা ছোট ছোট বাচ্চাগুলো যেন বড় মানুষদের নিয়ে এক ধরনের তামাশা করছে।
ঠিক কোথায় সেটা ধরতে পারছে না।
হাসি-খুশি শিক্ষিকা অনেক দিন পর হঠাৎ করে একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে না ঠিক কোথায় কিন্তু মনে হতে থাকে কোথায় যেন একটা কিছু ঠিক নেই।
১৩.
স্কুল বাসটি সময়মতো ছেড়ে দিল। আজ রবিবার, বারো জন অত্যন্ত প্রতিভাবান শিশুকে স্থানীয় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে নিয়ে যাবার কথা। বারো জন শিশু তাদের বাসে শান্ত হয়ে বসে আছে, তাদের মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবাই অত্যন্ত উত্তেজিত। সবাই পরিকল্পনা করে অজি রিকির কাছে পালিয়ে যাবে।
বাস ড্রাইভার তার জি.পি.এসে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের ঠিকানা প্রবেশ করিয়ে বাসটি চালাতে শুরু করে। যেদিকে যাবার কথা বাসটি সেদিকেই যেতে থাকে, ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বাসটাকে শুধু নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখে।
নীল এরকম সময়ে তার পকেট থেকে ছোট কম্পিউটারটা বের করে, আজকে তার সাথে সে একটা ওয়্যারলেস ইন্টারফেস লাগিয়ে এনেছে। বাসের পিছনে বসে সে বাস ড্রাইভারের জি.পি.এসে গন্তব্য স্থানটি পাল্টে দিল-নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের পরিবর্তে নগর কেন্দ্রের রেলস্টেশন। বাস ড্রাইভার জানতেও পারল না সে বারোটি অসম্ভব প্রতিভাবান বাচ্চাকে রেলস্টেশনে নিয়ে যাচ্ছে।
নীল এবারে সবাইকে কাছাকাছি ডাকল-তারা কাছে আসতেই সে ফিসফিস করে বলল, সবার মনে আছে তো কী করতে হবে?
মাতিষ ঝঙ্কার দিয়ে বলল, মনে থাকবে না কেন?
নীল মুখটা গম্ভীর করে বলল, এটা আমাদের প্রথম অ্যাডভেঞ্চার কাজেই কোনো যেন ভুল না হয়। রেলস্টেশনে থামতেই আমি ইলেকট্রনিক বোতাম টিপে দরজা খুলে দেব এক দৌড়ে সবাই নেমে যাবে। যাবার সময় বলব আমরা যাচ্ছি শপিং সেন্টার আসলে শপিং সেন্টারের পাশ দিয়ে যাব রেলস্টেশন।
মাতিষা বলল, জানি। আমরা সব জানি।
নীল মাথা নেড়ে বলল, তবু আরেকবার পুরোটা ঝালাই করে নেই। স্টেশন কাউন্টারে গিয়ে সবাই ভিড় করে দাঁড়াবে, হইচই করে টিকেট কিনবে বিনোদন পার্কের। মনে আছে তো?
মনে আছে। মনে আছে।
ঠিক এই সময়ে আমি আর কিয়া ঘুরে ঘুরে মেশিনগুলো থেকে তেতাল্লিশ নম্বর স্টেশনের টিকেট কিনব। সেটা হচ্ছে রিকির এলাকার স্টেশন। ঠিক আছে?
ঠিক আছে!
তারপর আমরা সবাই মিলে একসাথে ছুটতে ছুটতে হাসতে হাসতে বিনোদন পার্কের কথা বলতে বলতে যাব-কাজেই সবাই ধরে নেবে আমরা যাচ্ছি বিনোদন পার্কে। পরে যখন আমাদের খোঁজ করতে আসবে সবাই যাবে বিনোদন পার্কে।
কিয়া হিহি করে হেসে বলল, কী মজাটাই না হবে!
হ্যাঁ। নীল গম্ভীর হয়ে বলল, যদি সবকিছু ঠিক ঠিক করে করতে পারি তা হলে অনেক মজা হবে।
লন বলল, এবারে বাকিটা আরেকবার বলে দাও।
বাকিটা সোজা। একসাথে আমাদের বারো জনকে দেখলেই সেটা সবাই মনে রাখবে তাই আমরা প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা দেবার সময় আলাদা হয়ে যাব। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সাত নম্বর ট্র্যাক। আমরা সেখানে পৌঁছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাব, যেন কেউ কাউকে চিনি না। সবাই উঠব আলাদা আলাদা বগিতে। কেউ আমাদের আলাদা করে লক্ষ করবে না।
নীল হাতের কম্পিউটারটা একবার দেখে বলল, তেতাল্লিশ নম্বর স্টেশনে নেমে সবাই বাইরে চলে আসবে রিকি বলেছে বাকি দায়িত্ব তার।
মাতিষা বলল, যদি রিকি বাকিটা করতে না পারে?
পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। সেদিন দেখ নাই রিকির কত বুদ্ধি? আমাদের সবার যত বুদ্ধি রিকির একার তত বুদ্ধি।
মাতিষা মাথা নাড়ল। বলল, তার অনেক সুবিধা-সে বনে জঙ্গলে ঘুরে মাথার বুদ্ধি বাড়াতে পারে। আমরা শুধু একটা ঘরে বসে থাকি আমাদের কপালটাই খারাপ।
লন বলল, আর কপাল খারাপ থাকবে না। আমরাও এখন থেকে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব।
নীল তার কম্পিউটারের দিকে চোখ রাখছিল, সে এবারে চাপা গলায় বলল, সবাই এখন নিজের সিটে যাও, আমরা রেলস্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর মনে রেখো সবার ভিডিফোন বন্ধ করে দাও কেউ যেন আমাদের ট্র্যাক করতে না পারে।
সবাই নিঃশব্দে নিজেদের সিটে গিয়ে বসল, তাদের মুখের দিকে তাকালে কেউ বুঝতেও পারবে না যে কিছুক্ষণের ভেতরেই তারা এত বড় একটা কাও কল্পতে যাচ্ছে।
ঠিক এরকম সময় বাস ড্রাইভার ব্রেক কষে বাসটা থামিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করল। নীল জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে!
আশ্চর্য ব্যাপার! বিশাল দেহের ড্রাইভার হাত নেড়ে বলল, আমি নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে রওনা দিয়েছিলাম-চলে এসেছি রেলস্টেশনে!
নীল এবং তার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল। ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কী হল? তোমরা সবাই উঠেছ কেন? বস। যার যার সিটে বস।
নীল ইলেকট্রনিক সুইচটা টিপে ধরতেই শব্দ করে বাসের দুটি দরজা খুলে গেল। সবাই হুড়মুড় করে নামতে থাকে, বাস ড্রাইভার চোখ কপালে তুলে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করতে থাকে-–সিট বেল্টে বাধা বাস ড্রাইভার তার বেন্ট খুলে উঠতে উঠতে যেটুকু সময় লাগে তার মাঝে সবাই বাস থেকে নেমে ছুটতে শুরু করেছে। বাস ড্রাইভার আতঙ্কিত মুখে বলল, কোথায় যাও তোমরা? কোথায় যাও?
শেষ ছেলেটি গলা উঁচিয়ে বলল, শপিং সেন্টার। তারপর মুহূর্তের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বাস ড্রাইভার কী করবে বুঝতে না পেরে বাসের সিঁড়িতে বসে পড়ে। পকেট থেকে ভিডিফোন বের করে সে কাঁপা হাতে ডায়াল করতে থাকে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বাচ্চাগুলো এই বাস থেকে নেমে গেছে, আজকে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। শুধু তার না, আরো অনেকের সর্বনাশ হবে!
১৪.
গুস্তাভ তার পিকআপ ট্রাকের পিছনের টায়ারে একটা লাথি দিয়ে সেটাকে পরীক্ষা করে মুখ দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে রিকির দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যি সত্যি তোমার বন্ধুরা আসবে তো?
রিকি হাতে কিল দিয়ে বলল, একশবার আসবে।
এত ছোট ছোট বাচ্চা কেমন করে আসবে? কোনো ঝামেলায় না পড়ে যায়!
রিকি দাঁত বের করে হাসল, বলল, ছোট বাচ্চা হলে কী হবে? তাদের মাথার বুদ্ধি বড় মানুষ থেকে অনেক বেশি।
গুস্তাভ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সেইটাই হচ্ছে বিপদ। ছোট মানুষের বুদ্ধি যদি বড় মানুষ থেকে বেশি হয় তা হলে সেইটা খুব বড় বিপদ।
কেন বড় বিপদ কেন?
বড় মানুষেরা ভুল করে আর সেই জন্যে ছোট মানুষদের একশ রকম ঝামেলা হয়।
ঠিক এই সময় একটা ট্রেনের চাপা গর্জন শোনা গেল, মাটিতে একটা মৃদু কম্পন শোনা যায় এবং একসময় শব্দটা মিলিয়ে আসে।
গুস্তাভ পিচিক করে রাস্তার পাশে থুতু ফেলে বলল, নয়টা বাহান্নর ট্রেন এসেছে। দেখা যাক তোমার বন্ধুরা আসতে পেরেছে নাকি!
কিছুক্ষণ পরেই প্যাসেঞ্জাররা বের হয়ে আসতে থাকে এবং তাদের মাঝে ছোট একটা বাচ্চাকে গুটিগুটি এগিয়ে আসতে দেখা গেল। বাচ্চাটির চোখে-মুখে উদ্বেগের একটা চিহ্ন স্পষ্ট, রাস্তার পাশে রিকিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে তার সমস্ত উদ্বেগ দূর হয়ে গেল। বাচ্চাটি ছুটে রিকির কাছে এসে বলল, তুমি এসেছ? আমরা যা দুশ্চিন্তায় ছিলাম!
রিকি বলল, কোনো দুশ্চিন্তা নাই। পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠে শুয়ে পড় যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়!
বাচ্চাটি পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠতে উঠতেই একজন দুইজন করে অন্য বাচ্চারাও উদ্বিগ্ন মুখে বের হতে শুরু করল। রিকি তাদের সবাইকে পিকআপ ট্রাকের পিছনে তুলতে থাকে। সবার শেষে এল নীল, সে ছুটে এসে রিকির হাত ধরে বলল, সবকিছু ঠিক আছে?
রিকি বুড়ো আঙুল উপরে তুলে বলল, শতকরা একশ দশ ভাগ!
চমৎকার। চল তা হলে যাই।
পিকআপ ট্রাকের মেঝেতে সবাই গাদাগাদি করে শুয়ে আছে, গুস্তাভ সবাইকে একনজর দেখে গোঁফে একবার হাত বুলিয়ে বলল, এই ট্রাকে করে আমি শহরে হাঁস-মুরগি নিয়েছি, শাক-সবজি নিয়েছি, বালু-পাথর নিয়েছি কিন্তু এরকম কার্গো কখনো নিই নি!
রিকি বলল, ভালোই তো হল এখন তোমার লিস্টিটা আরো বড় হল!
তা হয়েছে কিন্তু ধরা না পড়ে যাই।
ধরা পড়বে না গুস্তাভ। আমরা সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে থাকব কেউ দেখবে না।
গুস্তাভ পিকআপের পিছনের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বলল, শহরতলিটা পার হলেই সোজা হয়ে বসতে পারবে। জঙ্গলের রাস্তায় আজকাল কোনো মানুষজন যায় না।
পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় পিকআপ, ঝাঁকুনিতে সবার শরীর থেকে হাড় এবং মাংস আলাদা হয়ে যাবার অবস্থা কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে কোনো অভিযোগ করল না। বরং তারা হাসিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল, দেখে মনে হতে লাগল খানাখন্দে ভরা রাস্তায় লক্কড়ঝক্কড় একটা পিকআপে করে ঝাঁকুনি খেয়ে খেয়ে তার মেঝেতে শুয়ে থেকে যাবার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতে নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই ড্রাইভিং সিট থেকে গুস্তাভ চিৎকার করে বলল, এখন তোমরা উঠে বসতে পার। জঙ্গলের রাস্তায় চলে এসেছি।
সাথে সাথে সবাই উঠে বসে, বাতাসে তাদের চুল উড়তে থাকে, তারা সবিস্ময়ে বাইরে তাকায়। দুই পাশে ঘন অরণ্য একসময় সেখানে মানুষের বসতি ছিল হঠাৎ করে ঝোঁপঝাড় লতাগুলো ঢাকা একটি দুটি ধসে যাওয়া বাড়িঘর সেটি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে রাস্তা খারাপ থের্কে আরো খারাপ হতে থাকে। বড় একটা ঝাঁকুনি খেয়ে পিকআপের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবার পর গুস্তাভ রাস্তার পাশে পিকআপটা থামিয়ে বলল, আমার গাড়ি আর যাবে না! তোমাদের এখানেই নামতে হবে গো।
সবাই আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, পিকআপের ডালাটা খোলা মাত্রই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। একজন আরেক জনকে ধাক্কা দিতে দিতে তারা সবিস্ময়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। নীল পুরো পিকআপটা একপাক ঘুরে দেখে নিয়ে গুস্তাভকে জিজ্ঞেস করল, তোমার এই গাড়িটা কোন বছরের?
গুস্তাভ তার গোঁফে হাত বুলিয়ে বলল, কঠিন প্রশ্ন করেছ।
কেন? এটা কঠিন প্রশ্ন কেন?
তার কারণ আমার পিকআপের চেসিস বাইশ সনের, ইঞ্জিন ছাব্বিশ সনের, ফুয়েল সিস্টেম তেইশ সনের, ট্রান্সমিশন চব্বিশ সনের আর চাকাগুলো এই সেদিন লাগিয়েছি-তা হলে তোমরাই বল গাড়িটা কোন বছরের।
কিয়া হিহি করে হেসে বলল, সবগুলো বছর যোগ দিয়ে গড় করে ফেলতে হবে।
নীল বলল, আমি আগে কখনো এরকম গাড়ি দেখি নাই।
গুস্তাভ হাসতে হাসতে বলল, তোমরা যেখান থেকে এসেছ সেখানে এরকম গাড়ি দেখার কথা না। শুধু গাড়ি না আরো অনেক কিছু দেখার কথা না!
রিকি এগিয়ে এসে বলল, আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। চল আমরা শুরু করে দিই, আমাদের কিন্তু অনেক দূর হাঁটতে হবে। আগে কোথায় যাবে বল।
সবাই চিৎকার করে তাদের পছন্দের জায়গার কথা বলতে যাচ্ছিল নীল হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিল, বলল, না। এভাবে হবে না। একেকজনের পছন্দ একেক জায়গায় কাজেই সেভাবে হবে না। রিকি ঠিক করুক সে আমাদের কোথায় নিতে চায়। আমরা সবাই রিকির পিছু পিছু যাব।
ঠিক আছে।
রিকি হচ্ছে আমাদের লিডার।
সবাই চিৎকার করে বলল, রিকি হচ্ছে আমাদের লিডার।
রিকি বনের রাস্তাটা দেখে বলল, আমরা এই পথ দিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে বনে ঢুকে যাব। সেখান দিয়ে পাহাড়ে উঠে প্রথমে গ্লাইডারে উড়ব। তারপর সেখান থেকে হ্রদে গিয়ে ভেলা। ঠিক আছে?
সবাই সমস্বরে বলল, ঠিক আছে।
গুস্তাভর পিকআপটা চলে যাওয়া পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করে তারপর তারা বনের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। প্রথমে মাতিষা মৃদু স্বরে এবং একটু পরে গলা ছেড়ে গান গাইতে থাকে-সবাই তার সাথে গলা মেলায়।
নির্জন বনভূমি হঠাৎ করে কিছু শি গানের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে।
১৫.
প্রিন্সিপাল কেটির মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। সে আর্তকণ্ঠে বলল, কী বলছ তুমি?
ড্রাইভার বলল, আমি ঠিকই বলছি প্রিন্সিপাল। বাসটা যাবার কথা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে-সেটা চলে এল রেলস্টেশনে।
প্রিন্সিপাল কেটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তুমি কোথায় বাস নিয়ে যাচ্ছ সেটি দেখবে না?
কখনোই তো দেখি না, জি.পি.এস আমাদের নিয়ে আসে। কেমন করে যে গন্তব্যটা পাল্টে গেল!
প্রিন্সিপাল কেটির মাথায় তখন হাজারো রকম আশঙ্কার কথা উঁকি দিচ্ছে, সে ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না। বিড়বিড় করে বলল, তুমি বাচ্চাগুলোকে নামতে দিলে কেন?
আমি কী নামতে দিয়েছি? কিছু বোঝার আগেই ইলেকট্রনিক দরজা খুলে সবাই নেমে গেল। বলল শপিংমলে যাচ্ছে।
শপিংমল? এই বাচ্চারা শপিংমলে কেন যাবে?
আমি জানি না প্রিন্সিপাল কেটি। কী করতে হয় আপনি করেন।
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, কী করব আমি জানি না তবে তুমি জেনে রাখ যদি এই বাচ্চাদের কারো কিছু হয় তা হলে তুমি আমি কিংবা এই স্কুলের কারো কিন্তু রক্ষা নাই। বুঝেছ?
কিছুক্ষণের মাঝেই স্কুল কম্পাউন্ডে অনেকগুলো পুলিশ, সেনাবাহিনীর এবং অভিভাবকদের গাড়ি এসে হাজির হল। প্রিন্সিপাল কেটি তার অফিসে অসহায়ভাবে বসে রইল এবং তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
রন সরাসরি অফিস থেকে চলে এসেছে। তার শরীরে পূর্ণ সামরিক পোশাক, এই পোশাকে তাকে একজন অপরিচিত মানুষের মতো দেখায়। তার মুখ পাথরের মতো কঠিন। সে চাপা এবং হিংস্র গলায় বলল, আপনারা দাবি করেন যে আপনাদের স্কুল আমাদের সন্তানদের পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়েছে। তা হলে কোথায় আপনাদের দায়িত্ববোধ? আমাদের ছেলেমেয়েরা কোথায়?
প্রিন্সিপাল কেটি দুর্বল গলায় বলল, আমি আপনাদের বলেছি-এই বারো জন শিশু পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান শিশু। এরা যদি কোনো একটা পরিকল্পনা করে কিছু একটা করে তা হলে আমরা দূরে থাকুক আপনারা সবাই মিলেও তাদের থামাতে পারবেন না।
আপনি বলছেন তারা পরিকল্পনা করে পালিয়ে গেছে?
হ্যাঁ। আমার তাই ধারণা। খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে তারা পালিয়ে গেছে।
রন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের সন্তানেরা এতদিন ঠিকভাবে থেকে হঠাৎ করে কেন খেপে উঠল? কেন তারা স্কুল থেকে পালিয়ে গেল? কী করেছেন আপনারা তাদের?
আমরা কিছুই করি নি! ঠিক যেভাবে তাদের লেখাপড়া করানোর কথা, যখন যেটা যেভাবে শেখানোর কথা হুবহু সেভাবে শিখিয়ে আসছি। পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছেও একটা রহস্য।
কাঁদো কাঁদো গলায় একজন মা বলল, আমারশান্তশিষ্ট মেয়ে পালিয়ে গেছে? আমি বিশ্বাস করতে পারি না। ভিডিফোনটা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। কী আশ্চর্য।
ঠিক এরকম সময় পুলিশের এক কর্মকর্তার ভিডিফোন বেজে ওঠে, সে নিচু গলায়। কিছুক্ষণ কথা বলে হাসিমুখে ঘরের সবার দিকে তাকাল। বলল, খোঁজ পাওয়া গেছে।
খোঁজ পাওয়া গেছে? সত্যি? রন অবাক হয়ে পুলিশ কর্মকর্তার দিকে তাকাল। কোথায় আছে তারা।
স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা বারো জন কাছাকাছি একটা বিনোদন কেন্দ্রের টিকেট কিনেছে। আমি দুই প্লাটুন পুলিশ বিনোদন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছি।
একজন মা অবাক হয়ে বলল, বিনোদন কেন্দ্র? আমি তো চেষ্টা করেও আমার ছেলেকে কোনো দিন বিনোদন কেন্দ্রে নিতে পারি না। তারা দল বেঁধে এখন বিনোদন কেন্দ্রে গিয়েছে?
প্রিন্সিপাল কেটি মাথা নেড়ে বলল, আপনারা এই বাচ্চাদের খাটো করে দেখবেন না এরা সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে-আসলে তারা বিনোদন কেন্দ্রে যায় নি। অন্য কোথাও গেছে।
পুলিশ কর্মকর্তাকে এবারে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখায়, সে কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, কিন্তু বিনোদন কেন্দ্রটা একটু দেখে এলে তো কোনো ক্ষতি নেই। তারা তো যেতেও পারে। পারে না?
প্রিন্সিপাল কেটি বলল, যেতে পারে কিন্তু তার সম্ভাবনা খুবই কম। তারা অন্য কোথাও গেছে।
রন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলল, কিন্তু কোথায়?
কাঁদো কাঁদো গলায় একজন মা বলল, তার চেয়ে বড় কথা, কেন? কেন?
১৬.
রিকি নীলকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি শক্ত করে ধরেছ?
নীল গ্লাইডারের হালকা অ্যালুমিনিয়ামের টিউবটা শক্ত করে ধরে বলল, হ্যাঁ ধরেছি।
তোমার ভয় করছে না তো?
নীলের বুকের ভেতর ধক ধক শব্দ করছিল কিন্তু সে মুখে বলল, না। ভয় করছে না।
ঠিক আছে। আমি যখন বলব এক দুই তিন তখন দৌড়াতে শুরু করব। বুঝেছ?
বুঝেছি।
দশ পা দৌড়ে পা দিয়ে পাহাড়টাকে ধাক্কা দিয়ে লাফ দেব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
যখন ভাসতে থাকব তখন পাগুলো পিছনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ব। শরীরের ওজনটা সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বুঝেছ?
বুঝেছি।
সমানভাবে না ছড়ালে গ্লাইডারটা গোত্তা খেয়ে পড়তে থাকবে।
নীল বলল, আমি শুয়ে ওজনটা সমানভাবে ছড়িয়ে দেব।
ঠিক আছে তা হলে আমরা শুরু করি। রিকি বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এক দুই তিন_ তারপর দৌড়াতে শুরু করল। গুনে গুনে দশ পা দৌড়ে দুজনে একসাথে পাহাড়টাকে ধাক্কা দিয়ে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাথে সাথে গ্লাইডারটা আকাশে ভেসে যায়!
রিকি খুশিতে চিৎকার করে বলল, চমৎকার!
নীল রিকির দেখাদেখি সাবধানে নিজের শরীরটা ভেতরে টেনে এনে ক্যানভাসের টুকরোটার ওপর শুয়ে পড়ে। গ্লাইডারটা ধীরগতিতে ভেসে যেতে থাকে, নীল দেখতে পায় নিচে অন্যেরা দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। কয়েক মিনিট যাবার পর নীল যখন বুঝতে পারল হঠাৎ করে তারা পড়ে যাবে না-ডানা ছড়িয়ে থাকা একটা পাখির মতোই তারা শান্ত ভঙ্গিতে আকাশে উড়ে যাবে, তখন নীল বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে বলল, কী আশ্চর্য!
কী হয়েছে?
আমরা কী বোকা।
কেন তোমরা বোকা কেন?
নীল গ্লাইডারের পিছনের রাডারকে একটু টেনে ডান দিকে ঘুরিয়ে বলল, আমরা একটা ঘরের ভেতরে বসে কম্পিউটারে ফ্লাইট সিমুলেশন খেলতাম–আকাশে উড়ার একটা কম্পিউটারের খেলা! আর তুমি সত্যি সত্যি আকাশে উড়ো!
এখন তো তুমিও উড়ছ।
হ্যাঁ। আমিও উড়ছি। নীল হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করল।
রিকি জিজ্ঞেস করল, কী হল? হাসছ কেন?
আমাদের প্রিন্সিপাল কেটি এখন কী করছে চিন্তা করে হাসছি!
কী করছে?
জানি না। আমরা যেন সব সময় নিরাপদে থাকি, কোনোভাবে যেন আমাদের কোনো বিপদ না হয় সেটার চিন্তা করতে করতেই সে অস্থির হয়ে থাকে। এখন যদি দেখত আমি গ্লাইডারে করে আকাশে উড়ছি তার নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই মাথা উঁচিয়ে গ্লাইডারে করে ভেসে যাওয়া রিকি আর নীলের দিকে তাকিয়ে রইল। কিয়ার ঘাড়ে বসে একটা ছোট বানরের বাচ্চা খুব মনোযোগ দিয়ে এক টুকরো রুটি কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বানরের বাচ্চাটার। সাথে ভাব করে সে তাকে শেষ পর্যন্ত নিজের কাছে নিতে পেরেছে। সে বানরের বাচ্চাটির মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই যে বানর বাহাদুর। তুমি কি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে? দেখো আমি তোমাকে কত আদর করব!
বানরের বাচ্চাটি দাঁত বের করে মুখভঙ্গি করে এক ধরনের শব্দ করল। কিয়া উত্তেজিত গলায় বলল, দেখেছ? দেখেছ? আমার সাথে যেতে রাজি হয়েছে!
মাতিষা হিহি করে হেসে বলল, কচু রাজি হয়েছে। সে মুখ খিঁচিয়ে বলেছে, কখনো যাব না!
কিয়াও এবারে হিহি করে হাসতে থাকে, বলে, খা! মনে হয় সেটাই হয়েছে! বানরের বাচ্চাটা বলছে আমাকে কি মানুষের বাচ্চার মতো বোকা পেয়েছ যে তুমি বলবে আর আমি চলে যাব?
লন অনেকক্ষণ থেকে তার কনুইয়ের কাছে চুলকাচ্ছিল, জায়গাটা লাল হয়ে উঠেছে। লাল চুলের একটা মেয়ে বলল, এখনো চুলকাচ্ছে।
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
মাতিষা মুখ শক্ত করে বলল, তোমার একটা উচিত শিক্ষা হয়েছে! রিকি এত করে বলল এই গাছটার কাছে যেও না। পাতাগুলো বিষাক্ত–তুমি বিশ্বাস করলে না! বাহাদুরি করতে এগিয়ে গেলে।
লন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল আমি ভেবেছিলাম রিকি ঠাট্টা করছে! গাছের পাতা আবার বিষাক্ত হয় কেমন করে? এমন সুন্দর কচি সবুজ পাতা!
এখন বুঝেছ তো?
লন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ বুঝেছি।
ঠিক এরকম সময় গাছের শুকনো পাতায় সরসর করে একটা শব্দ হল, সবাই মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে একটা মোটা সাপ হেলে-দুলে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরপর মুখের ভেতর থেকে জিব বের করে চারপাশের অবস্থাটা একটু পরীক্ষা করে দেখছে।
ছোট ছোট চুলের ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল, দেখেছ? দেখেছ সাপটা কী সুন্দর?
হ্যাঁ। কী সুন্দর গায়ের রঙ। আর কী স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী।
মনে হচ্ছে হাত দিয়ে টিপে দেখি!
কিয়া মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। রিকি বলেছে বনের কোনো প্রাণীকে বিরক্ত করতে হয় না। তাদের শুধু দেখতে হয়।
মাতিষা কিছু বলল না, কয়দিন আগে হলেও সে সাপ দেখলে ভয়ে চিৎকার করত। মাকড়সা দেখলে ঘেন্নায় সিটিয়ে যেত! কিছুক্ষণ রিকির সাথে থেকেই সে জেনে গেছে আসলে এই পৃথিবীটা সবার জন্যে! এখানে মানুষও থাকবে পশুপাখিও থাকবে পোকামাকড়ও থাকবে। কেউ কাউকে ভয় পাবে না কেউ কাউকে ঘেন্না করবে না!
ওপর থেকে হঠাৎ নীলের গলার স্বর শুনে সবাই ওপরে তাকাল-গ্লাইডারটা খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে-গাছের ডালে লেগে যেন গ্লাইডারের পাখাগুলো ভেঙে না যায় সে জন্য তারা পাহাড়ের ঢালটা বেছে নিয়েছে। খুব ধীরে ধীরে অতিকায় একটা পাখির মতো গ্লাইডারটা নেমে এল।
সবাই চিৎকার করতে করতে গ্লাইডারের কাছে ছুটে যেতে থাকে। গলা ফাটিয়ে সবাই বলতে থাকে, এবারে আমি! এবারে আমি! এবারে আমি!
.
হ্রদের তীরে একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে সবাই দুপুরের খাবার সেরে নিল। প্রতিদিন খাওয়াটা তাদের জন্যে একটা মস্ত বিড়ম্বনা কিন্তু আজ তারা সবাই কাড়াকাড়ি করে খেল। পানির বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে একজন গা এলিয়ে বালিতে শুয়ে পড়ে বলল, আমি আর বাড়িতে যাব না! আমি এখানেই থেকে যাব।
তার দেখাদেখি আরো কয়েকজন বালিতে শুয়ে পড়ে বলে, আমরাও যাব না!
রিকি হেসে বলল, ঠিক আছে যেও না। থেকে যাও।
মাতিষা বলল, কিন্তু আমি ভেলায় উঠতে চাই। হ্রদের নিচে রহস্য নগরী দেখতে চাই।
হ্যাঁ, চল। রিকি বলল, আগে ভেলাটাকে ঠেলে পানিতে নামাতে হবে।
হ্রদের তীরে ঝোঁপঝাড়ে লুকিয়ে রাখা ভেলাটাকে টেনে বের করে সবাই মিলে সেটাকে ঠেলে ঠেলে পানিতে নামিয়ে নেয়। তারপর অকারণেই চিৎকার করতে করতে সবাই সেই ভেলার ওপর উঠে বসে। রিকি ধাক্কা দিয়ে ভেলাকে পানির গভীরে নিয়ে বুকে ভর দিয়ে ওপরে উঠে এল।
লাল চুলের মেয়েটি হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে দিয়ে বলল, দেখেছ পানিটা কী চমৎকার। একেবারেই ঠাণ্ডা নয়!
রিকি মাথা নাড়ল, বলল, ওপরের পানি ঠাণ্ডা নয়। নিচে দেখ কী ঠাণ্ডা। একেবারে মাছের পেটের মতন।
সত্যি?
হ্যাঁ। চল আগে হ্রদের মাঝামাঝি যাই, নিচে যেখানে ঘরবাড়ি আছে সেখানে আমরা পানিতে নামব। দেখবে কী সুন্দর মনে হয় এক্ষুনি বুঝি কোনো ঘরের জানালায় একটা মৎস্যকন্যা এসে দাঁড়াবে!
কিয়া হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, ইস! সত্যি সত্যি যদি একটা মৎস্যকন্যা পাওয়া যেত। তা হলে কী মজাই না হত। তাই না?
মাতিষা হ্রদের পানি হাতে নিয়ে নিজের মুখে ঝাপটা দিতে দিতে বলল, সেটা আর কঠিন কী? আমরা বাসায় না গিয়ে এইখানে পানিতে থাকি তা হলেই তো আমরা মৎস্যকন্যা। হয়ে যাব?
নীল বলল, মৎস্যকন্যা হওয়া এত সোজা নয়। মৎস্যকন্যাদের অর্ধেক হয় মাছের মতো!
মাতিষা বলল, কে বলেছে তোমাকে? অর্ধেক মাছের মতো না হলেও মৎস্যকন্যা হওয়া যায়। যে মাছের সাথে থাকে সেই হচ্ছে মৎস্যকন্যা!
ঠিক তখন একটা শুশুক তাদের পাশে তুশ করে ভেসে উঠে আবার পানির নিচে ডুবে গেল। পানির ঝাপটায় সবাই ভিজে গিয়ে চমকে ওঠে। রিকি বলল, এটা হচ্ছে শুশুক। আমি যখনই ভেলা নিয়ে আসি তখন আমার চারপাশে খেলা করে!
সত্যি?
হ্যাঁ। আমি একদিন এটার সাথে বন্ধুত্ব করব। তখন সে আমাকে পানির নিচে নিয়ে যাবে।
মাতিষা বলল, আমিও যাব! আমিও যাব!
ঠিক আছে, আগে বন্ধুত্ব করে নিই। এখনো শুকটা আমার বেশি কাছে আসে না, একটু দূরে দূরে থাকে।
কথা বলতে বলতে সবাই ভেলাটাকে ভাসিয়ে হ্রদের আরো গভীরে নিয়ে আসে। নিচে ডুবে যাওয়া বাড়িগুলো আবছা আবছা দেখা যায়। শ্যাওলা ঢাকা সবুজ বাসাগুলোর মাঝে এক ধরনের রহস্য লুকিয়ে আছে। বাচ্চাগুলো পালা করে নিচে নেমে দেখার চেষ্টা করে। চোখে গগলস নেই বলে পরিষ্কার দেখা যায় না-পানির ভেতর আবছা একটা রহস্যপুরীর মতো মনে হয়।
পানিতে অনেকক্ষণ ঝাপাঝাপি করে তারা যখন একবার ভেলার ওপর উঠে আসে তখন হঠাৎ করে দূরে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পায়। নীল হেলিকপ্টারগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হেলিকপ্টার।
কিয়া নীলকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, হেলিকপ্টার দেখে এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমি আগে কখনো হেলিকপ্টার দেখ নি?
দেখব না কেন, দেখেছি। কিন্তু এই হেলিকপ্টারগুলোর একটা ব্যাপার আছে!
কী ব্যাপার?
এগুলো আমাদের খুঁজতে বের হয়েছে। মনে হয় আমাদের দেখে ফেলেছে। দেখছ এগুলো এদিকে আসছে।
সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সত্যি সত্যি হেলিকপ্টারগুলো হ্রদের ওপর দিয়ে তাদের দিকে উড়ে উড়ে আসতে থাকে।
লন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ধরা পড়ে গেছি।
নীল গম্ভীর গলায় বলল, তোমরা সবাই এদিকে এস। তাড়াতাড়ি।
মাতিষা বলল, কেন নীল?
কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যাবে। ধরে নেয়ার আগে আমি একটা জিনিস করতে চাই।
কী জিনিস?
রক্ত শপথ!
রক্ত শপথ?
হ্যাঁ, রক্ত শপথ?
কী নিয়ে রক্ত শপথ?
নীল গম্ভীর মুখে বলল, আমরা আজকে বুঝতে পেরেছি আমাদের জীবনটাতে আসলে ভুল হয়েছে। বড় মানুষেরা আমাদের নিয়ে অনেক বড় বড় অন্যায় করে। আমরা রক্ত শপথ করব যে যখন আমরা বড় হব তখন আমরা অন্যায় করব না।
সবাই গম্ভীর হয়ে বলল, করব না।
আমরা রিকির মতন হব।
রিকির মতন হব।
মাতিষা বলল, হেলিকপ্টার চলে আসছে। তাড়াতাড়ি রক্ত শপথ শুরু কর।
নীল বলল, এই যে ছোট চাকুটা দিয়ে সবাই আঙুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্ত বের করে এই শ্যাওলার ওপর রাখ। তারপর সবাই হাতে হাত ধরে বল-
ভেলাটার ওপর হেলিকপ্টারগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে। হেলিকপ্টারে বসে থাকা ন্যাশনাল সিকিউরিটির একজন বড় কর্মকর্তা অবাক হয়ে দেখল বাচ্চাগুলো একে অপরের হাত ধরে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা বলছে। কী বলছে সে শুনতে পেল না কিন্তু কথাগুলো নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ-তাদের চোখ-মুখ দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছে!
১৭.
নীল একটা চেয়ারে বসেছে, সামনে আরো দুটো চেয়ার, তার একটাতে বসেছে রন। অন্যটাতে নিহা। নীল বেশ চেষ্টা করে মুখে একটা নির্লিপ্ত ভাব ধরে রেখেছে।
রন কঠিন গলায় বলল, নীল, তুমি এখন বল ঠিক কী হয়েছে।
কিছু হয় নি বাবা।
রন একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, কিছু হয় নি মানে? তোমরা স্কুলের সব ছেলেমেয়ে পালিয়ে চলে গেলে, সারা দিন যতসব ভয়ংকর কাজ করে বেড়াচ্ছ। ন্যাশনাল সিকিউরিটি ব্যবহার করে তোমাদের খুঁজে আনতে হয়েছে আর তুমি বলছ কিছুই হয় নি?
তোমরা এত ব্যস্ত হলে কেন? আমরা সবাই তো ফিরে আসতাম।
কিন্তু তোমরা পালিয়ে গেলে কেন?
আমরা যেখানে গিয়েছিলাম, যার কাছে গিয়েছিলাম তোমরা কি আমাদের তার কাছে যেতে দিতে?
রন একটু থতমত খেয়ে বলল, আমাদের কাছে কি সেটা জিজ্ঞেস করে দেখেছ?
নীল এবারে খুক করে হেসে ফেলল। রন কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
আমরা যে ছেলেটার কাছে গিয়েছিলাম তার নাম রিকি! রিকিকে ভাঁওতাবাজি করে আমাদের কাছে এনেছিল। কেন এনেছিল জান?
নিহা একটু অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে বলল, কেন?
আমাদের দেখানোর জন্যে আমরা কত বুদ্ধিমান, সে কত বোকা! আমরা কী দেখেছি জান?
কী দেখেছ?
ঠিক উল্টোটা। আমরা কত বোকা আর রিকি কত বুদ্ধিমান।
নিহা আর রন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিহা ইতস্তত করে বলল, এটা হতে পারে না। তোমরা সবাই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে ডিজাইন করা ছেলেমেয়ে। তোমাদের ভেতরে নানা ধরনের প্রতিভার জিন আছে।
নীল আবার খুক করে হেসে ফেলল। নিহা একটু থতমত খেয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমার কোন কথাটি শুনে তোমার হাসি পাচ্ছে?
এই যে বলছ আমাদের ভেতরে প্রতিভার জিন আছে!
নিহা একটু অবাক হয়ে বলল, এটা কি একটা হাসির কথা?
হ্যাঁ। নীল হাসি চেপে বলল, তোমরা জোর করে আমার ভেতরে ছবি আঁকার জিন ঢুকিয়ে দিয়েছ। কিন্তু মা, আমার ছবি আঁকতে ভালো লাগে না। আমি কখনো ছবি আঁকব না–তা হলে? এই জিন দিয়ে আমি কী করব?
নিহাকে কেমন যেন অসহায় দেখায়, সে কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তা হলে তুমি কী করবে ঠিক করেছ?
পুরোটা ঠিক করি নি। একটু একটু ঠিক করেছি।
রন এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, এবারে কঠিন গলায় বলল, একটু একটু কী করবে ঠিক করেছ?
নীল হঠাৎ মুখ কঠিন করে বলল, সেটা বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না।
আমরা সবাই রক্ত শপথ করেছি।
কী করেছ?
রক্ত শপথ।
সেটা কী?
সবাই আঙুল কেটে রক্ত বের করে একটু শ্যাওলার ওপর লাগিয়ে শপথ করেছি। সেটা হচ্ছে রক্ত শপথ।
নিহা ছোট একটা আর্তচিৎকার করে বলল, হাত কেটে রক্ত বের করেছ? যদি ইনফেকশন হয়?
নীল তার মায়ের কথার কোনো উত্তর দিল না। রন থমথমে গলায় বলল, রক্ত শপথ ছাড়া আর কী কী করেছ?
আরো অনেক কিছু করেছি। কিন্তু সেগুলো শুনলে তোমরা ভয় পাবে, না হয় রাগ হবে, না হয় মন খারাপ করবে। কাজেই তোমাদের শুনাতে চাই না।
নিহা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা নীল। আমরা তোমার জন্যে এত কিছু করেছি আর তুমি এমন কাজ করছ যেটা শুনে আমরা ভয় পাব, রাগ হব না হয় মন খারাপ করব?
নীল তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা সে জন্যে কিন্তু আমি দায়ী না।
কে দায়ী? আমরা?
হ্যাঁ মা। তোমরা। বড় মানুষেরা আসলে ছোট বাচ্চাদের বুঝতে পারে না। তোমরা অনেক ভুল কাজ কর।
রন হঠাৎ করে রেগে উঠে বলল, আমার এই পুঁচকে ছেলের কাছে শুনতে হবে আমি তাদের ঠিক করে মানুষ করি না? আমি ভুল করি?
নীল তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, আমরা আসলে পুঁচকে ছেলে না। তোমরাও সেটা জান। তোমরা আমাদের জিনোম পাল্টে দিয়ে আমাদের বড় মানুষ করে ফেলেছ। আমরা বড় মানুষের মতো কথা বলি, বড় মানুষের মতো চিন্তা করি। তোমরা কী কর কী ভাব আমরা সব বুঝতে পারি। আমরা এত ছোট বয়সে বড় মানুষ হতে চাই না। তোমরা আমাদের ছোট থাকতে দাও নি, জোর করে বড় মানুষ করেছ। উরুর কোম্পানি থেকে সার্টিফিকেট এনেছ।
নিহা নীলকে থামানোর চেষ্টা করে বলল, কিন্তু নীল-
নীলের চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়। সে ভাঙা গলায় বলল, মা! আমরা সবাই ছোট বাচ্চা থাকতে চাই। জন্মের পরের দিনই আমরা বড় মানুষ হতে চাই নাই। তোমরা জোর করে আমাদের বড় মানুষ বানিয়ে দিও না।
রন এবং নিহা পাথরের মতো মুখ করে তাদের আশি পয়েন্টের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে রইল।
১৮.
প্রতিভাবান বাচ্চাদের বিশেষ স্কুলের বাচ্চারা তাদের কোম্পানির দেয়া সিমুলেশন অনুযায়ী বড় হচ্ছিল। হঠাৎ করেই তাদের মাঝে বড় একটা বিচ্যুতি হল। তারা আর কেউই সেই সিমুলেশনের মাঝে আবদ্ধ রইল না। তাদের সবারই নিজের একটা জগৎ তৈরি হল যার সাথে কোম্পানির দেয়া সার্টিফিকেটের কোনো মিল নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান এই শিশুগুলোর কেউই খুব বিখ্যাত হয়ে বড় হল না। তারা সবাই বড় হল খুব সাধারণ মানুষ হিসেবে। কেউ সমাজকর্মী, কেউ স্কুলের শিক্ষক, কেউ খুব একজন সাধারণ ডাক্তার। এই বাচ্চাগুলোর ভেতর একটা মিল ছিল। তারা সবাই ছিল হাসি-খুশি এবং আনন্দময়। তারা ছিল পরিশ্রমী, উৎসাহী আর উদ্যোগী। সাধারণ মানুষের জন্যে ছিল তাদের বুক ভরা ভালবাসা। যারাই তাদের কাছাকাছি এসেছিল তারাই কখনো না কখনো তাদের বলেছে, তুমি ইচ্ছে করলে অনেক বড় কিছু হতে পারবে!
সেই কথা শুনে তারা হা হা করে হাসত। হেসে হেসে বলত, কে বলেছে আমি অনেক বড় কিছু হই নি। আমি আসলে অনেক বড় কিছু হয়েছি!
কেউই এ কথাগুলোর অর্থ ঠিক করে বুঝত না–কিন্তু সবাই অনুভব করত কথাগুলো সত্যি। অনেক বড় না হয়েও মানুষ কেমন করে অনেক বড় হয় সেটা নিয়ে সবাই একটু ভাবনায় পড়ে যেত।
কেমন করে এটা হল কেউই জানে না। অনেকে অনুমান করে সেই শৈশবে রিকির সাথে রক্ত শপথ করার সাথে এর একটা সম্পর্ক আছে। কী নিয়ে সেই রক্ত শপথ করা হয়েছিল সেটি কেউ কখনো জানতে পারে নি!
প্যারামন
অধ্যাপক গ্রাউস চতুর্মাত্রিক জগতের দ্বিঘাত সমীকরণটির সমাধান বের করতে করতে হঠাৎ করে থেমে গেলেন, তিনি মাথা ঘুরিয়ে তার ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমরা বলতে পারবে মানুষ পৃথিবীর অন্য জীবিত প্রাণী থেকে কোন দিক দিয়ে ভিন্ন?
চতুর্মাত্রিক জগতের দ্বিঘাত সমীকরণের সাথে এই প্রশ্নটির কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু তার ছাত্রছাত্রীরা সেটা নিয়ে মোটেও অবাক হল না। আপনভুলো এই বৃদ্ধ অধ্যাপক ক্লাসে পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝেই এরকম আনমনা হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুতে চলে যান। সেই ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে প্রায় সময়েই ক্লাসের সময় পার হয়ে যায়- আপনভুলোলা অধ্যাপকের সেটাও মনে থাকে না।
অধ্যাপক গ্রাউসের প্রশ্ন শুনে ছাত্রছাত্রীরা তাদের চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। সামনের দিকে বসে থাকা চটুল ধরনের ছাত্রীটি বলল, চেহারা। অবশ্যই চেহারা। অন্য সব প্রাণীদের থেকে মানুষ দেখতে ভালো।
অধ্যাপক গ্রাউস হাসিমুখে বললেন, চেহারাটা আপেক্ষিক। আমাদের সবার চেহারা যদি বানরের মতো হত তা হলে সেটাকেই আমাদের ভালো মনে হত।
দার্শনিক ধরনের একজন বলল, একজন মানুষ যদি ভালো হয় তা হলে তার চেহারা খারাপ হলেও তাকে দেখতে ভালো লাগে।
অনেকেই তার কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়তে থাকে এবং আলোচনাটা মানুষের ভালোমন্দের দিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয়। প্রফেসর গ্রাউস আবার সবাইকে থামালেন, বললেন, আমি জানতে চাইছি-মানুষ কেমন করে অন্য প্রাণীদের থেকে ভিন্ন।
পিছনের দিকে বসে থাকা একজন বলল, ভাষা! মানুষের ভাষা আছে অন্য কোনো প্রাণীর ভাষা নেই।
প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। তুমি এটা ঠিকই বলেছ। অন্যান্য প্রাণীদের কারো কারো খুব সহজ কিছু তথ্য আদান প্রদানের ব্যবস্থা আছে-কিন্তু মানুষের মতো কারো নেই। মানুষের ভাষা অত্যন্ত উঁচু মানের।
মাঝামাঝি বসে থাকা একজন ছাত্রী বলল, পশুপ্রাণীর ভাষা খুব সহজ তথ্য বিনিময়ের জন্যে ব্যবহার হয়-নিরাপত্তার জন্যে বংশবিস্তারের জন্যে।
এবারে অনেকেই পশুপাখির তথ্য বিনিময় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে এবং আলোচনাটা আবার অন্য দিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয়। প্রফেসর গ্রাউস সবাইকে থামালেন, বললেন, আমি পশুপাখির ভাষা নিয়ে আলোচনায় যেতে চাই না আমি জানতে চাই মানুষ কোন দিক দিয়ে পশুপাখি থেকে ভিন্ন। অন্য জীবিত প্রাণী থেকে ভিন্ন।
কঠোর চেহারার একজন বলল, অন্য সকল জীবিত প্রাণী থেকে মানুষ অনেক বেশি নিষ্ঠুর। অন্য জীবিত প্রাণী কোনো প্রয়োজন না হলে একে অন্যকে হত্যা করে না, মানুষ প্রয়োজন ছাড়াও হত্যা করে। নিষ্ঠুরতা দেখায়। পশুতে পশুতে কখনো যুদ্ধ হয় না-মানুষে মানুষে যুদ্ধ হয়।
প্রফেসর গ্রাউস কঠোর চেহারার এই তরুণের কঠিন কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণের জন্যে আনমনা হয়ে গেলেন। একটা নিঃশ্বাস ফেললেন এবং বললেন, তোমার কথার মাঝে খানিকটা সত্যতা আছে কিন্তু আমার মনে হয় তুমি মানুষকে একটু বেশি কঠোরভাবে বিচার করছ। মূল মানবগোষ্ঠী নিষ্ঠুর নয়–তার একটা বিচ্ছিন্ন অংশ নিষ্ঠুর। আমার ধারণা সেই মানুষগুলোকে বিশ্লেষণ করলে তার কারণটি বের হয়ে যাবে।
কঠোর চেহারার তরুণটি প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার পাশে বসে থাকা কালো চুলের মেয়েটি তাকে বাধা দিয়ে বলল, প্রাণীদের সবাই বেঁচে থাকে তাদের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে। মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না-মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে তাদের শিখে থাকা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে।
প্রফেসর গ্রাউস সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের ভেতরে তার সহজাত প্রবৃত্তি কতটুকু রয়ে গেছে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারলে মন্দ হত না!
কালো চুলের মেয়েটি বলল, সেটি কেমন করে দেখা যাবে?
প্রফেসর গ্রাউস বললেন, সেটি দেখার সহজ কোনো উপায় নেই। আমরা মানুষের যে সমাজে বাস করি সেই সমাজ কখনোই একজনকে শুধু সহজাত প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকার মতো কাজে ঠেলে দেবে না।
প্রফেসর গ্রাউস অন্যমনস্কভাবে টেবিলে তার আঙুল দিয়ে শব্দ করছিলেন, তখন অস্থির ধরনের ছটফটে একজন তরুণী বলল, প্রফেসর গ্রাউস। আপনি কীভাবে একজন মানুষকে অন্য জীবিত প্রাণী থেকে আলাদা করেন?
আমি?
ছটফটে তরুণীটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আপনি।
প্রফেসর গ্রাউস হাসার ভঙ্গি করে বললেন, আমি চতুর্মাত্রিক জগতের গণিত পড়াই, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালো জানি না। তোমাদের থেকে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বেশি জানি বলে মনে হয় না। তবে আমার ধারণা–
ধারণাটা কী না বলে প্রফেসর গ্রাউস চুপ করে অনেকটা আপনমনে চিন্তা করতে থাকেন। ছাত্রছাত্রীরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে এবং প্রফেসর গ্রাউস একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার ধারণা মানুষ একমাত্র প্রাণী যে তার জ্ঞানটুকু মস্তিষ্কের বাইরেও রাখতে পারে।
প্রফেসর গ্রাউস ঠিক কী বলছেন বুঝতে না পেরে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল। প্রফেসর গ্রাউস বললেন, অন্য সব প্রাণীর বুদ্ধিমত্তাই থাকে তাদের মস্তিষ্কে। আমাদের বেলায় সেটা সত্যি নয়। আমরা যখন কিছু একটা জানি সেটা বইপত্রে লিখে রাখতে পারি। যার মস্তিষ্কে সেই জ্ঞানটুকু নেই সে বই থেকে সেটা শিখে নিতে পারে। কাজেই বলা যেতে পারে মানুষের কার্যকর মস্তিষ্ক শুধু তার মাথার করোটির মাঝে নেই সেটা বইপত্র লাইব্রেরি জার্নালে ছড়িয়ে আছে। একটি বানর এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের। ডালে লাফ দেবার সময় তার নিজের মস্তিষ্কের ভেতরের তথ্য কিংবা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। মানুষকে একটা ডাল থেকে অন্য ডালে লাফ দিতে হলে সে সেটা নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। নিউটনের সূত্র পড়ে সে ইচ্ছে করলে নিজের নিরাপত্তার জন্যে লাফ নাও দিতে পারে।
ধারালো চেহারার লাল চুলের একটা মেয়ে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, অধ্যাপক গ্রাউস-এই ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অনেক ভালো মনে হয়। আপনি কি মনে করেন এর মাঝে কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে?
অধ্যাপক গ্রাউস মাথা নেড়ে বললেন, আমি খুবই খুশি হয়েছি যে তুমি এই প্রশ্নটা করেছ। আমি তোমাকে এই প্রশ্নটা করি, দেখি তুমি কী উত্তর দাও।
মেয়েটি ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমি তো কোনো বিপদ লুকিয়ে থাকতে দেখছি না। আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদের বয়সে যেটুকু জানত আমরা সেই একই বয়সে তাদের থেকে অনেক বেশি জানি। আমাদের আগের প্রজন্মের যেটুকু বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল আমাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা তার থেকে অনেক বেশি। সারা পৃথিবী জোড়া নেটওয়ার্কে যে তথ্য আছে আমরা চোখের পলকে সেটা পেতে পারি, বিশ্লেষণ করতে পরি, আমাদের কাজে ব্যবহার করতে পারি। প্রফেসর গ্রাউস আমি এর মাঝে কোনো বিপদ দেখতে পাই না।
প্রফেসর গ্রাউস একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পাই।
ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই এবারে সোজা হয়ে বসল, বসে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রফেসর গ্রাউসের দিকে তাকাল তার কথা শোনার জন্যে। প্রফেসর গ্রাউস নিচু গলায় বললেন, আমরা যদি ধরে নিই আমাদের মস্তিষ্ক দুই ভাগে বিভক্ত এক ভাগ আমাদের মাথার ভেতরে দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে পৃথিবীর লাইব্রেরি, জার্নাল কিংবা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নেটওয়ার্ক, তা হলে আমরা দেখব যতই দিন যাচ্ছে আমরা মস্তিষ্কের দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ বাইরের অংশটুকুতে লাইব্রেরি, জার্নাল কিংবা নেটওয়ার্কে অনেক বেশি নির্ভর করতে শুরু করেছি। বাইরের জগৎ থেকে তথ্য নেয়া কিংবা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করা যতই সহজ হয়ে যাচ্ছে দশ বিলিয়ন নিউরনের আমাদের এই মস্তিষ্কটাকে ততই আমরা কম করে ব্যবহার করছি।
প্রফেসর গ্রাউস একটু থামতেই ধারালো চেহারার মেয়েটি বলল, কিন্তু আমরা যদি এই . পদ্ধতিতেই আগের চাইতে বেশি সৃষ্টিশীল হতে পারি তা হলে কি সমস্যা আছে?
প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, না নেই। কিন্তু
প্রফেসর গ্রাউস আবার থেমে গেলেন এবং তার ছাত্রছাত্রীরা ধৈর্য ধরে তার কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রফেসর গ্রাউস বললেন, এখন পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তাটুকু আমাদের মস্তিকে, বাইরের জগতে আছে তথ্য। বাইরের জগতে যেটুকু বুদ্ধিমত্তা আছে সেটা তুচ্ছ। কিন্তু এই তুচ্ছ বুদ্ধিমত্তা যদি কোনোভাবে বিকশিত হয়ে উঠে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়ব।
ধারালো চেহারার লাল চুলের মেয়েটি তার জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সেটা কি কখনো হতে পারে?
প্রফেসর গ্রাউস মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি জানি না।
***
নিউলাইট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর উপস্থিত সব ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আজ আপনাদের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবার জন্যে ডেকেছি।
ডিরেক্টরদের সবাই বয়স্ক, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কথায় নড়েচড়ে এক কোনায় বসে থাকা লাল চুলের মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েদের বয়স সব সময় অনুমান করা যায় না, এই মেয়েটিরও বয়স অনুমান করা সম্ভব নয়–ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের ভেতর যে কোনো একটা বয়স হতে পারে। এই মেয়েটি ডিরেক্টরদের কেউ নয়, কোম্পানির একজন সাধারণ গবেষক, ম্যানেজিং ডিরেক্টর যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেবে তার সাথে এই মেয়েটির নিশ্চয়ই একটা ভূমিকা আছে।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাত তুলে মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দেবার আগে আমি আপনাদের সাথে আমাদের গবেষক লানার পরিচয় করিয়ে দিই।
লানা তার জায়গায় বসে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে হাত নাড়ল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, আজ থেকে সাত বছর আগে লানা আমার কাছে গবেষণার একটি বিষয় নিয়ে এসেছিল। আমার কাছে কখনো কোনো গবেষক সরাসরি আসে না। কিন্তু লানা এসেছিল তার কারণ তার ডিপার্টমেন্ট তার গবেষণার প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিল।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর একটু হেসে বলল, আমারও সেই প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দেয়া উচিত ছিল, কারণ প্রস্তাবটি ছিল অত্যন্ত উদ্ভট, আজগুবি এবং বিপজ্জনক। ঠিক কী কারণে জানি না আমি সেই উদ্ভট আজগুবি আর বিপজ্জনক প্রস্তাবটি অনুমোদন করে দিয়েছিলাম। লানা অত্যন্ত মেধাবী এবং পরিশ্রমী গবেষক, গবেষণা কাজের নেতৃত্ব দিতেও তার কোনো তুলনা নেই। চার বছরের মাথায় সে প্রথম প্রটোপাইপ তৈরি করেছে। ছয় বছরে ফিল্ড টেস্ট শেষ করেছে এবং এই সপ্তম বছরে তার একটা বাণিজ্যিক মডেল তৈরি হয়েছে। আমরা বাণিজ্যিক মডেলটি বাজারে ছাড়ার জন্যে প্রস্তুত এবং আজকে আপনাদের সবাইকে ডেকেছি তার ঘোষণাটি দেয়ার জন্যে।
সবচেয়ে বয়স্ক ডিরেক্টর খনখনে গলায় বলল, তুমি তো দেখি এক ধরনের হেঁয়ালি ভরা কথা বলছ। কী মডেল কীসের মডেল কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর হাসি হাসি মুখে বলল, সেটা আপনাদের জানানোর জন্যে আজকে এখানে লানা এসেছে। ম্যানেজিং ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, লানা। তুমি বল।
লানা উঠে দাঁড়িয়ে হলোগ্রাফিক প্রজেক্টরটা চালু করে বলল, আমি তখন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমাদের গণিতের একজন প্রফেসর ছিলেন, তার নাম প্রফেসর গ্রাউস। একদিন ক্লাসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন মানুষের মাঝে অন্য প্রাণীর পার্থক্য কোথায় আমরা সেটা জানি কি না। আমরা সবাই আমাদের মতো করে উত্তর দেবার চেষ্টা করেছিলাম-প্রফেসর গ্রাউস সেগুলো পুরোপুরি মানতে রাজি নন। তিনি বলেছিলেন মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর পার্থক্য তার মস্তিষ্কের ব্যাপ্তিতে। অন্য সব প্রাণীর মস্তিষ্ক তার করোটিতে। মানুষের মস্তিষ্কের একটা অংশ তার করোটিতে বাকিটুকু বাইরের জগতে, নেটওয়ার্কে।
উপস্থিত ডিরেক্টরদের সবাই নিজেদের ভেতরে মৃদুস্বরে কথা বলতে শুরু করে। লানা বলল, আপনারা কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, বাইরের নেটওয়ার্কের তথ্য ছাড়া আমরা কেউ এক মুহূর্ত বেঁচে থাকতে পারি না। এখন কয়টা বাজে? আজ কোথায় যেতে হবে? কীভাবে যেতে হবে? কী খাব? কী করব? কার সাথে কথা বলব? শরীর কি ভালো আছে? তালো না থাকলে কেন ভালো নেই? কোথায় জানাব? কীভাবে চিকিৎসা করাব? এরকম সব প্রশ্নের উত্তরের জন্যে আমাদের নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করতে হয়। লানা এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো কথা বলে একটু থেমে যোগ করল, আজকে যদি আপনাদের বলা হয় নেটওয়ার্কের সাহায্য না নিয়ে আপনাদের একটা দিন কাটাতে হবে–সারা পৃথিবীর একজন মানুষও সেটি পারবে না।
ডিরেক্টরদের বেশিরভাগই নিজের অজান্তেই মাথা নাড়ে। লানা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা ক্রমাগত তথ্যটুকু নেই নেটওয়ার্ক থেকে, সেগুলো বিশ্লেষণ করাই নেটওয়ার্ককে দিয়ে, সেগুলো ব্যবহার করি নেটওয়ার্ককে দিয়ে কিন্তু সেটা করতে হয় কোনো এক ধরনের ইন্টারফেসিং মডিউল দিয়ে। সেটা চোখ দিয়ে দেখতে হয় কান দিয়ে শুনতে হয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয়। আমি তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম যদি আমাদের জীবন পৃথিবীর নেটওয়ার্কের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে থাকে যে এটা আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তা হলে কেন আমরা সত্যি সত্যি নেটওয়ার্ককে মস্তিষ্কের অংশ তৈরি করে ফেলি না?
বয়স্ক ডিরেক্টর খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলতে চাইছ? কীভাবে নেটওয়ার্ককে মস্তিষ্কের অংশ করে ফেলবে?
লানা ভিডিও প্রজেক্টরে স্পর্শ করতেই পেছনের ত্রিমাত্রিক একটা যন্ত্রের ছবি ভেসে উঠল এবং সেটা ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। লানা হাত দিয়ে সেটাকে স্পর্শ করে বলল, এই যন্ত্রটা দিয়ে। আপনাদের এটা বড় করে দেখানো হয়েছে। আসলে এটা খুবই ঘোট, মাথার চামড়ার নিচে ঠিক করোটির উপর বায়ো গ্লু দিয়ে আটকে দেয়া যায়। পুরো অপারেশন শেষ করতে সময় নেয় দশ মিনিট, মাথার চামড়ার ক্ষত সারতে সময় নেয় চব্বিশ ঘণ্টা। যন্ত্রটি চালু হয় এক সপ্তাহ পরে খুব ধীরে ধীরে। কয়েক সপ্তাহ পর যখন এটা পুরোপুরি চালু হয়ে যায় তখন মানুষের মস্তিষ্ক সরাসরি নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
বৃদ্ধ ডিরেক্টর আবার তার খনখনে গলায় বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ!
লানা বলল, আমি একটা উদাহরণ দিই। মনে করুন আপনার মাথায় আমরা এই যন্ত্রটা লাগিয়েছি। কাজেই আপনি এখন সরাসরি নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন- আপনার মস্তিষ্ক যেটা করবে আপনি সেটা জানতেও পারবেন না। ধরা যাক আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করবেন কিন্তু তার ভিডি ফোনের নম্বর মনে করতে পারছেন না। আগে আপনাকে ইন্টারফেস খুলে নেটওয়ার্ক থেকে নম্বরটি নিতে হত। এখন আপনি বুঝতেও পারবেন না কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক নেটওয়ার্ক থেকে নম্বরটি নিয়ে আসবে আপনি দেখবেন হঠাৎ করে নম্বরটি আপনি জেনে গেছেন!
তুলনামূলকভাবে কম বয়সী একজন ডিরেক্টর অবিশ্বাসের গলায় বলল, আমি এটা বিশ্বাস করি না।
লানা বলল, বিশ্বাস করার কথা নয়। কিন্তু এটা সত্যি। আমরা ফিল্ড টেস্ট করেছি। কয়েক হাজার মানুষের ওপরে পরীক্ষা করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরীক্ষা করতে দিয়েছে?
না, প্রথমে দেয় নাই।
তা হলে?
আমরা দরিদ্র দেশে গিয়ে সেই দেশের মানুষকে দিয়ে পরীক্ষা করেছি। পরীক্ষার ফলাফল দেখার পর আমাদের শেষ পর্যন্ত এই দেশে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে। আমরা তখন আমাদের দেশেও তার ফিল্ড টেস্ট করেছি।
কী দেখেছ?
সেটা আমি নিজে না বলে সরাসরি দেখাতে চাই। মাথায় এই যন্ত্রটি বসানো হয়েছে এরকম একজন মেয়েকে আমি আপনাদের সামনে আনব। আপনারা তার সাথে কথা বলুন।
লানা ইঙ্গিত করতেই দরজা খুলে সোনালি চুলের একটা মোল-সতের বছরের মেয়ে ঘরে এসে ঢুকল, লানা হাত নেড়ে ডাকল, ত্রিনা, এদিকে এস।
ত্রিনা নামের মেয়েটা লানার কাছে এগিয়ে আসে। লানা মেয়েটার পিঠে হাত রেখে বলল, এ হচ্ছে ত্রিনা। ঠিক ছয় সপ্তাহ আগে তার মাথায় এই যন্ত্রটা বসানো হয়েছে। আমরা তাকে অভ্যস্ত হওয়ার জন্যে দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছি। এখন তার মস্তিষ্ক সব সময়েই নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। আপনারা তাকে যেভাবে খুশি প্রশ্ন করতে পারেন।
বুড়ো ডিরেক্টর খনখনে গলায় জিজ্ঞেস করল, এই মেয়ে, বল দেখি আমার স্ত্রী কী করে?
মেয়েটি বুড়ো ডিরেক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার স্ত্রী নেই। দুই বছর আগে মারা গেছেন।
বড় ছেলের নাম কী?
ক্লাড। একজন শিল্পী।
একজন মহিলা ডিরেক্টর জিজ্ঞেস করল, পরের মহাকাশ ফ্লাইট কবে আছে?
মঙ্গলবার। দুপুর তিনটা চৌত্রিশ মিনিট।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবর কী?
তাতিস্কার প্রেসিডেন্টকে এই মাত্র গুলি করে মেরে ফেলেছে।
মেরে ফেলেছে নাকি? সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
মধ্যবয়স্ক একজন বলল, পাইয়ের এক হাজার চারশত পঁচানব্বইতম সংখ্যাটি কী?
চার। তারপর এক নয় সাত তিন পাঁচ।
মানুষটি বিস্ময়ে শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করল, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেমন করে এটা করছ?
মেয়েটা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি কিছুই করছি না। আমি শুধু আপনাদের প্রশ্নটার উত্তর কী হতে পারে সেটা চিন্তা করছি এবং সাথে সাথে উত্তরটা জেনে যাচ্ছি। কীভাবে হচ্ছে সেটা আমি জানি কারণ সেটা আমাকে বলা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপারটা যখন ঘটছে আমি বুঝতেও পারছি না। এটা করা হচ্ছে আমার অজান্তে।
অবিশ্বাস্য। অতি উৎসাহী একজন ডিরেক্টর হাততালি দিয়ে বলল, অবিশ্বাস্য!
লানা জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি লিনাকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?
ডিরেক্টরদের কয়েকজন মাথা নেড়ে বলল, না। আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।
লানা ত্রিনাকে বিদায় দিয়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি আর কিছু জানতে চান?
ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, না। আপাতত কিছু জানতে চাই না। তুমি বস। সে ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এই মাসের শেষ থেকে এই যন্ত্রটি বাজারজাত করব। আমরা এর নাম দিয়েছি প্যারামন। প্যারামনকে নিয়ে চমৎকার কিছু বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়েছে আমি সেগুলোও আপনাদের দেখাব। আমার ধারণা প্রথম এক বছরে আমরা এক বিলিয়ন প্যারামন বিক্রি করতে পারব।
উপস্থিত ডিরেক্টররা আবার শিস দেয়ার মতো একটা শব্দ করল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলল, এই হিসেবটি অত্যন্ত সতর্ক হিসেব। প্রকৃত সংখ্যাটি আরো অনেক বেশি হওয়ার কথা। আমার ধারণা আগামী পাঁচ বছরে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ এটা তাদের মাথায়। লাগিয়ে নেবে। আমরা সারা পৃথিবীতে একটা অসাধারণ বিপ্লব দেখার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি।
বৃদ্ধ ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে। তুমি এরকম একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছ, তোমার নিশ্চয়ই খুব গর্ব হচ্ছে?
লানা মাথা নেড়ে বলল, না।
বৃদ্ধ ডিরেক্টর অবাক হয়ে বলল, কেন না?
আমি আমার যন্ত্রের এই মডেলটি নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। প্রফেসর গ্রাউসের অনেক বয়স হয়েছে একটা ক্লিনিকে আছেন। কাউকে চিনতে পারেন না। আমি আমার যন্ত্রটির কথা তাকে বলেছি। তখন তিনি
লানা থেমে গেল। বৃদ্ধ ডিরেক্টর বলল, তখন তিনি কী?
লানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, প্রফেসর গ্রাউস খপ করে আমার হাত ধরে বললেন, না-না-না। তুমি এটা কিছুতেই বাজারজাত কোরো না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? প্রফেসর গ্রাউস বিড়বিড় করে বললেন, তা হলে মানুষ এই যন্ত্রটার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে। নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করবে না। মানুষের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি বললাম, আমরা তো এখনো বাইরের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছি এখন কি আমাদের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? প্রফেসর গ্রাউস বললেন, এখন বাইরের নেটওয়ার্ক আমাদের সাহায্যকারী। তোমার যন্ত্র ব্যবহার করা হলে মূল মস্তিষ্ক হয়ে যাবে সাহায্যকারী আর নেটওয়ার্কটাই হবে আমাদের মূল মস্তিষ্ক।
লানা একটু থেমে বলল, আমি বাসায় ফিরে এসে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি। চিন্তা করে দেখেছি প্রফেসর গ্রাউস আসলে ঠিকই বলেছেন। এই প্যারামন আমাদের মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে অকেজো করে দেবে–আমরা নেটওয়ার্কের ওপর এত নির্ভরশীল হয়ে যাব যে নিজের মস্তিষ্ক আর ব্যবহার করব না।
বৃদ্ধ ডিরেক্টর সরু চোখে লানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
আমি প্যারামন বাজারজাত করতে চাই না।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর হা হা করে হেসে বলল, এটা বাজারজাত করা হবে কি হবে না সেটা তোমার সিদ্ধান্ত নয় লানা। সেটা কোম্পানির সিদ্ধান্ত। তুমি কোম্পানির গবেষক হিসেবে তোমার কাজ করেছ। আমরা কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে আমাদের কাজ করব।
লানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমি তবু আপনাদের কাছে কাতর গলায়। অনুরোধ করতে চাই, প্যারামন বাজারজাত করবেন না। এটা বিজ্ঞানের একটা ছোট আবিষ্কার হিসেবে থাকুক। ল্যাবরেটরিতে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা হোক, কিন্তু পুরো মানবজাতিকে টার্গেট করে প্যারামনকে বাজারজাত করবেন না। দোহাই আপনাদের।
মধ্যবয়স্ক একজন ডিরেক্টর লানার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একজন বুড়ো প্রফেসরের কথায় পুরো বিষয়টাকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে শুরু করেছ। আমরা এতজন ডিরেক্টর এটাকে মোটেও নেতিবাচক হিসেবে দেখছি না। আমরা মনে করি প্যারামন আমাদের মানসিক জগতে একটা যুগান্তকারী বিপ্লব বয়ে আনবে। আমরা সাধারণ মানুষও অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠব।
লানা বলল, মানুষ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অসাধারণ হয়ে উঠুক। আমি কৃত্রিমভাবে জোর করে তাদের অসাধারণ হতে দিতে চাই না।
বৃদ্ধ ডিরেক্টর খনখনে গলায় বলল, সেই বিষয়টি তোমার আগে চিন্তা করা উচিত ছিল মেয়ে। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তীর তোমার হাতের ধনুক থেকে ছুটে গেছে, এখন সেই তীরকে তোমার হাতে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
লানা অসহায়ভাবে নিউলাইট কোম্পানির বয়স্ক ডিরেক্টরদের দিকে তাকিয়ে রইল।
***
অ্যালার্মের শব্দ শুনে গভীর রাতে ফায়ার ব্রিগেডের চিফ মিশি ঘুম থেকে উঠে বসে। শহরের কোথাও আগুন লেগেছে। মিশি জানালার কাছে এসে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায়, শহরের দক্ষিণ দিকে আগুনের লাল আভা, মাঝে মাঝে আগুনের শিখাঁটিও দেখা যাচ্ছে। বছরের এই সময়টা শুকনো সময়, প্রতি বছরই বেশ কয়েকটা ছোটখাটো এবং অন্তত একটা বড় অগ্নিকাণ্ড হয়। মনে হচ্ছে এটা এ বছরের বড় অগ্নিকাণ্ড-মিশি আগুনের লাল আভাটির দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। দক্ষিণের ইউনিটগুলোকে এখনই চালু করে আগুনের কাছে পাঠাতে হবে।
মিশি ইউনিটগুলোর জরুরি সংকেতটি ব্যবহার করতে গিয়ে হঠাৎ করে আবিষ্কার করে যে জরুরি সংকেতটি মনে করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করেও মনে করতে না পেরে মিশি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। তার কী হয়েছে? কেন সে এই অতি সাধারণ সংকেতটি মনে করতে পারছে না? মিশি তার ডেপুটির যোগাযোগ সংকেতটিও মনে করতে পারল না। কী আশ্চর্য!
মিশির স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে ঘুম ঘুম চোখে মিশির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি মাঝরাতে ঘরের মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
দক্ষিণে আগুন লেগেছে। কিন্তু কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমি ইউনিটের জরুরি সংকেত মনে করতে পারছি না।
মনে করতে পারছ না? কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। ডেপুটির নাম্বারও মনে করতে পারছি না। নিরাপত্তা বাহিনী কেন্দ্রীয় যোগাযোগ-কিছুই মনে করতে পারছি না।
মিশির স্ত্রী ভীত চোখে বলল, কী বলছ তুমি? কী হয়েছে তোমার?
জানি না। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না।
মিশির স্ত্রী স্বামীর হাত ধরে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও–তুমি আগেই এত ঘাবড়ে যেও। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলি।
এক মুহূর্ত পর মিশির স্ত্রী শূন্য দৃষ্টিতে মিশির দিকে তাকিয়ে বলল, কী আশ্চর্য! আমিও কিছু মনে করতে পারছি না।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। মিশির স্ত্রী বলল, শুধু ডাক্তারের নম্বর নয় কারো নম্বর মনে করতে পারছি না।
মিশি কাছাকাছি একটা চেয়ারে ধপ করে বসে বলল, তার মানে বুঝতে পারছ?
কী?
নেটওয়ার্ক ফেল করেছে।
নেটওয়ার্ক ফেল করেছে! মিশির স্ত্রী আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করে উঠল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। তা না হলে এতক্ষণে ওই আগুন নিভিয়ে দেয়ার কাজ শুরু হয়ে যেত।
কী হবে এখন?
মিশি কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে ঘরের আলো নিভে গেল। মিশির স্ত্রী একটা চাপা আর্তনাদ করে মিশিকে আঁকড়ে ধরল। জানালা দিয়ে আগুনের লাল আভা ঘরের দেয়ালে বিচিত্র প্রায় অলৌকিক এক ধরনের আলো ছায়া তৈরি করেছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিশি চাপা গলায় বলল, আমাদের পৃথিবী মনে হয় এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাইরে তখন অসংখ্য অসহায় মানুষের কোলাহল শোনা যেতে থাকে।
***
রাষ্ট্রপ্রধান শুকনো মুখে বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান প্রফেসর তাকিতাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী হবে প্রফেসর তাকিতা?
প্রফেসর তাকিতা মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি না।
রাষ্ট্রপ্রধান ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, আপনি আমাদের বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান; আপনি বলতে পারেন না যে আমি জানি না।
পারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি। প্রফেসর তাকিতা শুকনো গলায় বললেন, আমি বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান কারণ নেটওয়ার্কের বিজ্ঞান বিষয়ের সকল তথ্যে আমার অধিকার ছিল সবচেয়ে বেশি। এখন নেটওয়ার্ক নেই এখন আমার ভেতরে আর আপনার রান্নাঘরের বাবুর্চির ভেতরে খুব একটা পার্থক্য নেই। প্রফেসর তাকিতা তার হাতের কাগজটা রাষ্ট্রপ্রধানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই দেখেন আমি বেশ কিছুক্ষণ থেকে চার অঙ্কের একটা সংখ্যার বর্গমূল বের করার চেষ্টা করছি। পারছি না। আমার মস্তিষ্ক নেটওয়ার্কের সাহায্য নিতে নিতে এত অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে এখন আমি এই তুচ্ছ সমস্যাটাও নিজে সমাধান করতে পারছি না।
তার মানে কী?
তার মানে হচ্ছে যদি নেটওয়ার্ক আবার চালু না করা যায় তা হলে মানব সভ্যতার সমাপ্তি এখানেই।
রাষ্ট্রপ্রধান আতঙ্কিত গলায় বললেন, নেটওয়ার্ক আবার চালু করা না যায়-মানে কী? কেন এটা চালু করা যাবে না?
বিজ্ঞান আকাদেমির প্রধান তাকিতা তার চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসে বললেন, নেটওয়ার্কটি কীভাবে আবার চালু করা যাবে সেই তথ্যটি আমাদের দিতে পারে শুধু এই নেটওয়ার্কটি। বলতে পারেন এটা এক ধরনের হেঁয়ালির মতো-নেটওয়ার্কটি চালু থাকলেই আমরা নেটওয়ার্ক চালু করতে পারব। এখন নেটওয়ার্ক চালু নেই তাই নেটওয়ার্কটি আবার কীভাবে চালু করা যাবে আমরা জানি না।
তার মানে এই নেটওয়ার্ক আর চালু হবে না?
না। এটা চালু করার মতো বুদ্ধিমত্তা আমাদের নেই। আমরা আমাদের মাথায় প্যারামন লাগিয়ে নিজের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে ভুলে গেছি। শুধু তাই নয় আমরা গত কয়েক প্রজন্ম প্যারামন লাগিয়ে পার করেছি– আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সিনান্স সংযোগ বলতে গেলে নেই। আমরা এখন আর সত্যিকার মানুষ নই মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান, আমরা এখন হচ্ছি অবমানব।
অবমানব?
হ্যাঁ।
এখন পৃথিবীতে কী হবে?
নৈরাজ্য এবং বিশৃঙ্খলা। প্রথম কয়েক বছর রাজত্ব করবে অস্ত্রধারীরা। রোগ শোক অনাহারে বেশিরভাগ মানুষ মরে যাবে। মানুষজন তখন ছোট ছোট এলাকায় ভাগ হয়ে যাবে। নূতন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে-যার গায়ে জোর বেশি সে হবে নেতা। তারপর সম্পূর্ণ নূতন একটি সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হবে। অবমানবের নূতন এক ধরনের সমাজ। আফ্রিকার জঙ্গলের গরিলাদের সমাজের মতো কিংবা বোনিওর ওরাং ওটানের সমাজের মতো কিংবা–
থামুন! রাষ্ট্রপ্রধান চিৎকার করে বললেন, আপনি থামুন।
প্রফেসর তাকিতা দুর্বলভাবে বললেন, আমি থামছি মহামান্য রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু বাইরের পৃথিবী থেমে নেই। তাকিয়ে দেখুন। তারা কিন্তু এর মাঝে পিছনের দিকে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে।
রাষ্ট্রপ্রধান জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দূরে আগুনের লেলিহান শিখা, কালো ধোঁয়া এবং মানুষের চিৎকার। ধীরে ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে।
***
গাছের বাকলের ছোট পোশাক পরা দুজন কিশোর-কিশোরী গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। তাদের সুস্থ-সবল দেহ থেকে যেন জীবনের আভা ফুটে বের হচ্ছে। কিশোরটির হাতে একটা ধনুক, মেয়েটি ছোট একটা পাতায় কোনো একটা গাছের আঠা ধরে রেখেছে। ছেলেটি তার নিজ হাতে তৈরি তীরে গাছের আঠাটি লাগিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয়? কাজ করবে?
কিশোরীটি মাথা নেড়ে বলল, আমি অনেক খুঁজে বের করেছি। একশবার কাজ করবে।
কিশোরটি তার ধনুকে তীর লাগিয়ে দূরে ঘাস খেতে থাকা হরিণটির দিকে তাক করল। তীর দিয়ে শরীর অবশ করিয়ে দেয়ার এই নূতন গাছের আঠাটি তারা পরীক্ষা করছে, সত্যি সত্যি এটা কাজ করবে কি না সেটা তারা এখনো জানে না। নূতন কিছু করার মাঝে সব সময়ই থাকে নূতন এক ধরনের উত্তেজনা। দুজনে গভীর আগ্রহ নিয়ে হরিণটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমাজান অরণ্যের গভীরে পৃথিবীর মানুষের চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া এই আদিবাসী মানুষেরা তখনো জানত না, পুরো পৃথিবীতে নূতন করে সভ্যতা গড়ে তোলার দায়িত্বটি তাদেরকেই নিতে হবে।
মস্তিষ্ক নামে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটির তারা কখনো অবমাননা করে নি।
মহাকাশযান টাইটুন
কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর ঝুঁকে বসেছিল মহাকাশযান টাইটুনের কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল। ক্যাপ্টেন রন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনো সমস্যা রাটুল?
না-ঠিক সমস্যা নয়। তবে
রাটুল বাক্যটা শেষ না করে থেমে গেল।
তবে কী?
যোগাযোগ এন্টেনাতে একটা সিগন্যাল আসছে।
কার সিগন্যাল?
সেইটাই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে পারছ না মানে? এবারে ক্যাপ্টেন রন প্রথমবারের মতো কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, কী বুঝতে পারছ না?
ডপলার শিফট দেখে মনে হচ্ছে আরেকটা মহাকাশযান এদিকে আসছে। কিন্তু সিগন্যালটা বুঝতে পারছি না। কোনো মাথামুণ্ডু নেই।
সম্ভবত এনক্রিপ্টেড। গোপনীয়তার জন্যে অনেক সময় করে।
উঁহু। কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল বলল, আমি আমাদের মেগা প্রসেসর দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি, তথ্যটাই দুর্বোধ্য।
দুর্বোধ্য?
হ্যাঁ। আমি শেষ পর্যন্ত সুপার কম্পিউটারে দিয়েছি, দেখি কিছু বের করতে পারে কি না।
ঠিক আছে। যদি কিছু জানতে পার আমাকে জানিও।
জানাব। নিশ্চয়ই জানাব।
ক্যাপ্টেন রন মহাকাশযান টাইটুনের যাত্রাপথ নির্দিষ্ট করার কাজে ব্যস্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে দুর্বোধ্য সিগন্যালের কথা ভুলে গিয়েছিল কিন্তু কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল একটু পরেই আবার তাকে সেটা মনে করিয়ে দিল। সে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, ক্যাপ্টেন রন, সুপার কম্পিউটারের বিশ্লেষণ শেষ হয়েছে।
শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ।
কী আছে সিগন্যালে?
একটা বিপদগ্রস্ত মহাকাশযান সাহায্যের জন্যে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।
ও। ক্যাপ্টেন রন ভুরু কুঁচকে বলল, সাহায্যের জন্যে সিগন্যাল দুর্বোধ্যভাবে কেন পাঠাচ্ছে? সহজ কোডিংয়ে কেন পাঠাচ্ছে না?
আসলে মহাকাশযানটা সহজ কোডিংয়েই পাঠাচ্ছে আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন রন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কমিউনিকেশন অফিসার রনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
এটা আমাদের কোনো মহাকাশযান নয়। এটা মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর মহাকাশযান।
ক্যাপ্টেন রন চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
আমি ঠিকই বলছি ক্যাপ্টেন। আপনি এলেই দেখতে পারবেন। সুপার কম্পিউটারের প্রথমবার অর্থ বের করতে সময় লেগেছে। এখন আর সময় লাগছে না। আমরা কি তার সাহায্যের আবেদনে সাড়া দেব?
দাঁড়াও আমি নিজে একবার দেখে নিই।
ক্যাপ্টেন রনের সাথে সাথে মহাকাশযানের অন্য কুরাও যোগাযোগ মডিউলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দূরের মহাকাশযান থেকে যে সিগন্যালটি পাঠানো হয়েছে সেটা এরকম :
বাঁচাও আমাদের বাঁচাও। বিধ্বস্ত শক্তি ক্ষেপণ কেন্দ্র।
নিঃশেষিত রসদ। ধ্বংসের মুখোমুখি মহাকাশযান।
বাঁচাও আমাদের বাঁচাও।
ক্যাপ্টেন রন সাহায্যবার্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা কেমন করে বুঝতে পারলে এটা মহাজাগতিক প্রাণীর সিগন্যাল।
পৃথিবীর কোনো মহাকাশযান থেকে এই সিগন্যাল পাঠালে আমাদের বিশ্লেষণ করতে কোনো সময় লাগত না। এটা আমাদের সিগন্যাল না।
এটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে আগে কখনো আমাদের কোনো মহাকাশযান গিয়েছে?
না যায় নি।
এই মহাকাশযানটা এখন আমাদের কাছ থেকে কত দূরে আছে?
মহাজাগতিক হিসেবে খুবই কাছে। আমরা এখন যে গতিতে যাচ্ছি তাতে এক সপ্তাহের ভেতর পৌঁছাতে পারব।
যদি এত কাছে আছে তা হলে সিগন্যালটা আগে কেন পেলাম না?
টাটুল বলল, সিগন্যালটা খুবই দুর্বল, সেজন্যে।
ক্যাপ্টেন রন অন্যমনস্কভাবে তার গাল চুলকাল। মহাকাশযানের কোডে পরিষ্কার লেখা আছে কোনো বিপদগ্রস্ত মহাকাশযান যদি সাহায্য চায় তা হলে সাথে সাথে সাহায্যের জন্যে ছুটে যেতে হবে। কিন্তু মহাকাশযানটি যদি মানুষের না হয়ে মহাজাগতিক কোনো প্রাণীর হয় তা হলে কী করতে হবে সেটা পরিষ্কার করে লেখা নেই। যে সিদ্ধান্তটা নেয়ার সেটা তাকেই নিতে হবে। ক্যাপ্টেন রন চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত ভাবল তারপর ঘুরে কমিউনিকেশন অফিসার রাটুলের দিকে তাকিয়ে বলল, রাটুল তুমি একটা উত্তর পাঠাও।
কী বলব সেখানে?
বল আমরা আসছি।
কন্ট্রোল প্যানেল ঘিরে মহাকাশযানের কুরা দাঁড়িয়েছিল ক্যাপ্টেন রন তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই এস। কীভাবে তাদের সাহায্য করা যায় সেটা নিয়ে একটু কথা বলি।
মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুমে বড় টেবিলটা ঘিরে সবাই বসেছে। ক্যাপ্টেন রন সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই শুনেছ আমরা বিপদগ্রস্ত মহাকাশযানটিকে সাহায্য করার জন্যে যাচ্ছি। ঠিক কীভাবে সাহায্য করব আমি সেটা নিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলতে চাই।
ইঞ্জিনিয়ার শুরা বলল, তাদের সমস্যাটা কী সেটা না জানা পর্যন্ত আমরা তো কোনো পরিকল্পনা করতে পারছি না।
ক্যাপ্টেন রন মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ। আমরা প্রথমেই জানতে চাইব তাদের সমস্যাটা কী।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ লানা বলল, মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযানের নিশ্চয়ই নিজস্ব তথ্যকেন্দ্র আছে। আমাদের তথ্যকেন্দ্রের সাথে সেই তথ্যকেন্দ্রের তথ্য বিনিময় করা দরকার। আমাদের জানা উচিত তাদের সভ্যতা কোন ধরনের।
জীববিজ্ঞানী কায়াল মাথা নাড়ল, বলল, আমার আর তর সইছে না। আমি প্রাণীগুলোকে দেখতে চাই। ঠিক কীভাবে প্রাণের বিকাশ হয়েছে আমি বুঝতে চাই। এটাও কি জিনমকেন্দ্রিক? কার্বনভিত্তিক নাকি সিলিকনভিত্তিক।
ক্যাপ্টেন রন জীববিজ্ঞানী কায়ালকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি তোমার কৌতূহল মেটানোর অনেক সুযোগ পাবে। আগে বাস্তব সমস্যাগুলোর কথা বলি। আমাদের কী কী ঝুঁকি আছে?
যেহেতু প্রাণীগুলো সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, নিরাপত্তার জন্যে অবশ্যই কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। আমাদের একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে নিতে হবে। সবার আগে দরকার…
মহাকাশযানের সকল ক্রু, ইঞ্জিনিয়ার আর বিজ্ঞানীরা অস্থির গলায় কথা বলতে থাকে। সবার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা, মানবজাতির ইতিহাসে যেটা ঘটে নি সেটা প্রথমবারের মতো ঘটতে যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ প্রথমবারের মতো একটা মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ আলোচনার পর যখন সবাই নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ ক্যাপ্টেন রন আবিষ্কার করে বড় টেবিলের এক কোনায় গালে হাত দিয়ে পদার্থবিজ্ঞানী খ্রাউস বসে আছে। ক্যাপ্টেন রন তার দিকে তাকিয়ে বলল, উস তুমি কিছু বলবে?
নাহ্। খ্রাউস মাথা নাড়ল, আমার বলার কিছু নেই।
আমরা একটা মহাজাগতিক প্রাণীকে দেখতে পাব সেটা নিয়ে তোমার কোনো আগ্রহ নেই?
এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, আমরা ছাড়া আরো কত মহাজাগতিক প্রাণী আছে-আগে হোক পরে হোক তাদের সাথে আমাদের দেখা হবেই।।
আমরা আগামী এক সপ্তাহের মাঝে প্রথমবারের মতো এই মহাজাগতিক প্রাণীদের দেখতে পাব। কত কী হতে পারে-নিরাপত্তার ব্যাপারে তোমার কোনো বক্তব্য আছে?
নাহ্! শুধু
শুধু কী?
তাদের ডান হাত কি ডান দিকে না বাম দিকে সেটা জানা থাকলে ভালো হত।
কন্ট্রোল ঘরে বসে থাকা সবাই ঘুরে খ্রাউসের দিকে তাকাল। মানুষটি ঠাট্টা করে কিছু বলছে কি না কেউ বুঝতে পারল না। জীববিজ্ঞানী কায়াল বলল, এই প্রাণীগুলো কী রকম আমাদের জানা নেই। তাদের হাত-পা আছে না অক্টোপাসের মতো শুঁড় আছে আমরা কিছুই জানি না। ডান হাত বাম হাত থাকবে তোমাকে কে বলেছে?
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ লানা বলল, তুমি এরকম হেঁয়ালি করে কেন কথা বলছ? ডান হাত আবার বাম দিকে কেমন করে হয়?
ইঞ্জিনিয়ার শুরা হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমাদের বিজ্ঞানী খ্রাউস সব সময় সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করে। কাজেই মহাজাগতিক প্রাণী নিয়েও ঠাট্টা করবে এতে অবাক হবার কী আছে?
খ্রাউস দুর্বল গলায় বলল, আমি আসলে ঠাট্টা করছিলাম না।
ক্যাপ্টেন রন বলল, এর মাঝে ডান বামের ব্যাপারটা কেমন করে আসছে? একটা মহাজাগতিক প্রাণীকে ডান বা বাম কেমন করে বোঝাবে? ডান মানে কী? বাম মানে কী?
খ্রাউস বলল, ডান বাম বোঝানো কঠিন নয়। একটা নিউট্রন থেকে যখন বেটা বের হয় তখন স্পিনের সাথে যে সম্পর্ক থাকে সেটা দিয়ে বাম ডান বোঝানো যায়। প্রকৃতি স্পষ্টভাবে জানে বাম মানে কী ডান মানে কী-
ক্যাপ্টেন রন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জানা থাকলে ভালো। আমার সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার কাছে ডান আর বামের কোনো পার্থক্য নেই। যারা ডান হাত দিয়ে কাজ করে আর যারা বাম হাত দিয়ে কাজ করে তারা সবাই আমার কাছে সমান।
খ্রাউস বলল, আমি সেটা বলছিলাম না। আমরা যখন তথ্য বিনিময় করব তখন যদি পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করি তা হলেই আমরা ডান বা বাম বলতে কী বুঝি সেটা বুঝে যাব। আমি বলছিলাম সেখান থেকে–
ক্যাপ্টেন রন হাত নেড়ে খ্রাউসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি লানাকে বল তথ্যকেন্দ্র থেকে যেন পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করা হয়।
লানা হতাশার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি যখন এই মহাকাশযানে যোগ দিয়েছিলাম তখন ভেবেছিলাম আর বুঝি পদার্থবিজ্ঞান আমাকে উৎপাত করবে না। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা আমাকে কী কষ্ট দিয়েছে জানো?
খ্রাউস অপরাধীর মতো বলল, আসলে বিষয়টা এত খারাপ না। স্কুল-কলেজে ঠিক করে পড়ায় না তো সেজন্যে কেউ পছন্দ করে না। যাই হোক আমি যেটা বলছিলাম–
খ্রাউস কী বলছিল সেটা কেউ শুনতে চাইল না। সবারই অনেক কাজ, কারো এখন পদার্থবিজ্ঞানের হেঁয়ালি শোনার সময় নেই।
.
পরবর্তী ছয় দিনও কেউ ব্রাউসের কথা শোনার সময় পেল না। মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত, তাদের জন্যে তথ্য বিনিময় করাও খুব সহজ ছিল না। তারপরেও তার চেষ্টা করা হল। মহাজাগতিক প্রাণীটি সিলিকনভিত্তিক, বুদ্ধিমত্তা মানুষের মতো মস্তিষ্কে কেন্দ্রীভূত নয়, সেটা পরিব্যাপ্ত। মহাকাশযানের ইঞ্জিনে সমস্যা হয়েছে-এক ধরনের জ্বালানি সংকট রয়েছে। খ্রাউসের একান্ত ইচ্ছার কারণে পদার্থবিজ্ঞানেরও কিছু তথ্য বিনিময় করা হয়েছে। বিজ্ঞানে তারা মানুষ থেকে খানিকটা পিছিয়ে আছে দশ মাত্রার স্ট্রিং থিওরির সমাধান করেছে কিন্তু চৌদ্দ মাত্রার অবতল থিওরি এখনো সমাধান করতে পারে নি।
সপ্তম দিনে যখন মহাকাশযান টাইটুনের ক্রুরা প্রথমবার সরাসরি মহাকাশযানটিকে দেখতে পেল তখন তাদের উত্তেজনার কোনো সীমা ছিল না। আকৃতিটা অত্যন্ত বিচিত্র, পৃথিবীর কোনো কিছুর সাথে তার কোনো মিল নেই। পৃথিবীর প্রযুক্তিতে কোনো কিছু তৈরি করতে হলে তার মাঝে জ্যামিতিক কিছু আকার থাকে–এই মহাকাশযানে সেরকম কিছু। নেই, মনে হয় পুরোটাই বুঝি একটু একটু করে নিজে থেকে গড়ে উঠেছে। মহাকাশযানটির ইঞ্জিন বিধ্বস্ত তাই সেটি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, নির্দিষ্ট একটা গতিতে অসহায়ভাবে এগিয়ে আসছে।
ক্যাপ্টেন রন মহাকাশযান টাইটুনকে মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযানটির গতিপথের সাথে একই সরলরেখায় উপস্থিত করে। তারপর খুব ধীরে ধীরে তার গতিপথ কমিয়ে আনতে থাকে-যখন দুটো মহাকাশযান একটি অন্যটিকে স্পর্শ করবে তখন একটি মহাকাশযানের তুলনায় অন্যটির গতিবেগ হবে শূন্য। মহাকাশে ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশযানের একত্রিত হওয়ার এটি একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি।
কন্ট্রোল প্যানেলে সবাই এসে ভিড় করেছে, সবার ভেতরেই এক ধরনের উত্তেজনা। খুব ধীরে ধীরে মহাকাশযান দুটো একটি আরেকটির দিকে এগিয়ে আসছে আর কিছুক্ষণের ভেতরেই মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এরকম সময়ে কন্ট্রোল প্যানেলে একটা সংকেত ধরা পড়ল, ক্যাপ্টেন রন জিজ্ঞেস করল, কী পাঠিয়েছে?
রাটুল বলল, সামনের মহাকাশযান থেকে একটা বার্তা।
কী বলেছে বার্তায়?
রাটুল পড়ে শোনাল, তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তোমাদের প্রতি ভালবাসা। তোমাদের প্রতি শুভেচ্ছা। তোমাদের প্রতি কাজামিনু।
কাজামিনু? কাজামিনু অর্থ কী?
সুপার কম্পিউটার এটা অনুবাদ করতে পারে নি। মানুষের ভাষায় এটা নেই। নিশ্চয়ই। কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা বা শুভেচ্ছার মতো একটা শুভ কামনা।
ক্যাপ্টেন রন বলল, ঠিক আছে। আমরাও তাদের জন্যে একটা বার্তা পাঠাই। তাদেরকে বল, পৃথিবীর মানবজাতির পক্ষ থেকে শুভ কামনা। এই মিলনমেলায়–
খ্রাউস হঠাৎ বাধা দিয়ে বলল, না।
ক্যাপ্টেন রন অবাক হয়ে বলল, না? না কেন?
খ্রাউস অস্থির গলায় বলল, ভালবাসা শুভ কামনার অনেক সময় আছে। একটু পরেও সেটা পাঠানো যাবে। এখন যেটা দরকার সেটা পাঠাও।
এখন কী দরকার?
তাদের কাছে একটা বার্তা পাঠিয়ে বল তারা যেন তাদের ডান দিকের লাইটটা জ্বালায়।
ডানদিক?
হ্যাঁ।
কেন ডানদিক?
তোমাকে সেটা পরে বলছি-আমাদের হাতে এখন সময় নেই। আমরা একে অপরকে স্পর্শ করার আগেই একটা জিনিস জানা দরকার। ডান বলতে তারা কী বোঝায় সেটা জানা দরকার।
ক্যাপ্টেন রন একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু আমরা ডান বলতে কী বোঝাই সেটা কি তারা জানে?
জানে। আমরা পদার্থবিজ্ঞানের তথ্য বিনিময় করেছি। প্যারিটি ভায়োলেশন থেকে সেটা জানা সম্ভব। তারা জানে-আমি সেটা নিশ্চিত করেছি।
কমিউনিকেশন অফিসার রাটুল ক্যাপ্টেন রনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী করব ক্যাপ্টেন?
ঠিক আছে আগে ব্রাউসের বার্তাটা পাঠাও। বল, তারা যেন তাদের ডান দিকের বাতিটি জ্বালায়।
রাটুল ক্ষীপ্র হাতে একটা কি-বোর্ডে কথাগুলো লিখে সুপার কম্পিউটারে পাঠাল। সুপার কম্পিউটার সেই তথ্যটি মহাজাগতিক প্রাণীদের উপযোগী করে সাজিয়ে নিয়ে মূল এন্টেনা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই বার্তাটি মহাজাগতিক প্রাণীদের মহাকাশযান গ্রহণ করে। খ্রাউস অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে এবং অন্যেরা খানিকটা কৌতুকভরে এগিয়ে আসা মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মহাকাশযানটির ডান বা বাম কোনো দিকেই বাতি জ্বলল না, তার বদলে কন্ট্রোল প্যানেলে নূতন একটি বার্তা এসে হাজির হল। সেখানে লেখা, তোমরা কেন ডান দিকে বাতি জ্বালাতে বলছ? আমাদের জ্বালানি সংকট। বাতি জ্বালিয়ে জ্বালানি অপচয় করতে চাই না।
ক্যাপ্টেন রন খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বলল, খ্রাউস, তোমার কথামতো আমরা চেষ্টা করেছি। তারা এখন তোমার সাথে এই খেলাটি খেলতে চাইছে না!
খ্রাউস উত্তেজিত মুখে বলল, কিন্তু এই খেলা তাদের খেলতে হবে। খেলতেই হবে– তা না হলে আমরা কিছুতেই তাদের স্পর্শ করতে পারব না! তাদের আবার বল। যেভারে হোক সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে হলেও ডান দিকের একটা বাতি জ্বালাতে হবে! জ্বালাতেই হবে।
ক্যাপ্টেন রন একটু অবাক হয়ে ব্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ সে একটু অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে। সে কমিউনিকেশন অফিসার রাটুলের দিকে তাকিয়ে বলল, রাটুল আরেকটা বার্তা পাঠাও।
কী পাঠাব?
লিখো যেভাবেই হোক তোমাদের ডান দিকের বাতিটি জ্বালাতে হবে। অত্যন্ত জরুরি।
রাটুল ক্ষীপ্র হাতে বার্তাটি পাঠিয়ে দেয় এবং কিছুক্ষণের মাঝেই একটা উত্তর চলে আসে, আমাদের অত্যন্ত জ্বালানি সংকট কিন্তু তোমাদের অনুরোধে আমরা আমাদের ডান দিকের একটা জিনন ল্যাম্প জ্বালাচ্ছি।
মহাকাশযানটি তখন এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে তার নকশাকাটা দেয়ালটিও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। তার গঠনটি এত বিচিত্র যে দেখে মনে হয় এটি বুঝি মহাকাশযান নয়, এটি বুঝি কোনো বিমূর্ত শিল্পীর হাতে গড়া বিশাল একটি ভাস্কর্য।
খ্রাউস চোখ বড় বড় করে মহাকাশযানটির দিকে তাকিয়ে ছিল, ভেতরকার উত্তেজনা হঠাৎ করে সবাইকে স্পর্শ করেছে। সবাই দেখল ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা মহাকাশযানটিতে একটা জিননের নিষ্প্রভ বাতি জ্বলে উঠল। আশ্চর্যের ব্যাপার সেটি মহাকাশযানটির ডান দিকে জ্বলে ওঠে নি সেটি জ্বলে উঠেছে বাম দিকে।
খ্রাউস মহাকাশযানের চেয়ারের হাতলটি খামচে ধরে চিৎকার করে উঠে বলল, থামাও! থামাও মহাকাশযান। থামাও!।
ক্যাপ্টেন রন অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে? কেন থামাব?
খ্রাউস হাত দিয়ে মহাকাশযানটা দেখিয়ে বলল, এটা প্রতি পদার্থের তৈরি।
ক্যাপ্টেন রন হতচকিতের মতো সামনে তাকিয়ে রইল, সে দেখতে পেল খুব ধীরে ধীরে দুটি মহাকাশযান এগিয়ে আসছে, আর কয়েক সেকেন্ডের ভেতরেই একটা আরেকটাকে স্পর্শ করবে। কোনোভাবেই সে এখন তার মহাকাশযানকে থামাতে পারবে না। দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই, সামনের মহাকাশযানটি প্রতি পদার্থের তৈরি। যখন একটি আরেকটিকে স্পর্শ করবে মুহূর্তের মাঝে দুটি মহাকাশযানই ভয়ংকর বিস্ফোরণে অদৃশ্য হয়ে যাবে, থাকবে শুধু অচিন্তনীয় শক্তি।
মহাকাশযানের সবাই স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে রইল। খ্রাউস ভেবেছিল সবাইকে বলবে, সেই বিংশ শতাব্দীতে রিচার্ড ফাইনম্যান কৌতুক করে বলেছিলেন যদি কখনো কোনো মহাজাগতিক মানুষ করমর্দন করার জন্যে ভুল হাত এগিয়ে দেয় তার সাথে করমর্দন কোরো না–সেই মানুষ সম্ভবত প্রতি পদার্থে তৈরি। কিন্তু কেউ খ্রাউসের সেই গলাটি শুনতে আগ্রহী হয় নি। পদার্থের বেলায় যেটি ডান দিক প্রতি পদার্থের বেলায় সেই ডান দিক উল্টো দিকে।
মহাকাশে পদার্থ ও প্রতি পদার্থের তৈরি দুটো মহাকাশযানের সংস্পর্শে বিস্ফোরণের কারণে যে শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল সেটি কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে দেখা গিয়েছিল।
সাহস
মহাকাশযানের অধিনায়ক জিজ্ঞেস করলেন, তুমি প্রস্তুত?
অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মহাকাশযানের ক্রু ইগর কাঁপা গলায় বলল, জি ক্যাপ্টেন, আমি প্রস্তুত।
তা হলে যাও, আশা করি শত্রুর সাথে এই যুদ্ধে তুমি জয়ী হবে।
ইগর তবু দাঁড়িয়ে থাকে, অগ্রসর হয় না। অধিনায়ক জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?
ভয় করছে। মহাজাগতিক এই প্রাণীর সাথে যুদ্ধ করতে যেতে আমার ভয় করছে ক্যাপ্টেন।
তোমার কোনো ভয় নাই ইগর। ক্যাপ্টেন তার হাতের রিমোট কন্ট্রোল স্পর্শ করে বললেন, তোমার ভয় আমি দূর করে দিচ্ছি।
রিমোট কন্ট্রোল স্পর্শ করে মহাকাশযানের অধিনায়ক ইগরের মস্তিষ্কে বিশেষ কম্পনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ পাঠাতে শুরু করলেন। একটু পরে জিজ্ঞেস করলেন, এখনো ভয় করছে?
ইগর মাথা নাড়ল, না ক্যাপ্টেন। এখন আর মোটেও ভয় করছে না।
তা হলে যাও, যুদ্ধ করতে যাও।
ইগর হঠাৎ ঘুরে মহাকাশযানের অধিনায়কের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কেন যুদ্ধ করতে যাব? তুমি নিজে কেন যাও না?
অধিনায়ক চমকে উঠে বললেন, কী বলছ তুমি?
আমি তোমাকে ভয় পাই নাকি? মোটেও ভয় পাই না! ইগর অস্ত্রটা মহাকাশযানের অধিনায়কের গলায় লাগিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন, তুমি যাও যুদ্ধ করতে। তা না হলে তোমার মাথা আমি ছাত করে দেব।
ক্যাপ্টেন কিছু বোঝার আগেই ইগর তাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয়। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে ক্যাপ্টেন বুঝতে পারল রিমোট কন্ট্রোলে ইগরের সাহসের বোতামে তিনি ভুল করে একটু বেশি জোরে চাপ দিয়ে ফেলেছেন। তার এখন বেশি সাহস হয়ে গেছে!
সিনাপ্সুঘুটিয়া
যন্ত্রটার নাম সিনাপ্সুঘুটিয়া–যে কোনো স্বাভাবিক মানুষই এই যন্ত্রের নাম শুনে আঁতকে উঠবে, এবং এই নামটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করলে তাদের দুই চারটা দাঁত ভেঙে যাবার অবস্থা হবে। কিন্তু মিয়া গিয়াসউদ্দিনের সেরকম কিছুই হল না, সে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। লেখাপড়া করলেও বিজ্ঞান খুব ভালোভাবে বোঝে। ইন্টারনেট থেকে সে কখনোই সুন্দরী নারীদের কেচ্ছাকাহিনী ডাউনলোড করে নাই-সুযোগ পেলেই বিজ্ঞানের জিনিসপত্র ডাউনলোড করে পড়েছে। কোন কমোজমে কয়টা জিন জিজ্ঞেস করলে সে বলে দিতে পারে, সব মিলিয়ে কয়টা কোয়ার্ক এবং আজব কোয়ার্ক কতটুকু আজব সেটাও সে বলে দিতে পারে। তাই সিনাপ্সুঘুটিয়া নাম দেখেই সে বুঝে ফেলল এটা মস্তিষ্কে ব্যবহার করার একটা যন্ত্র, বাইরে থেকে স্টিমুলেশান দিয়ে এই যন্ত্র মানুষের মাথায় সিনান্সকে ঘুঁটে ফেলতে পারবে–যার অর্থ তাকে বুঝিয়ে দিতে হল না।
সেইদিন বিকালেই সে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের পাতাটা নিয়ে তার বাবার সাথে কথা বলতে গেল। গিয়াসের বাবা রাশভারী ধরনের মানুষ, বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না, গিয়াসও পারতপক্ষে তার বাবার সামনে পড়তে চায় না। কিন্তু তার বাবা মোটামুটি টাকার কুমির এবং গিয়াসের টাকার দরকার হলে তার বাবার কাছে না গিয়ে উপায় নাই। বাবা তাকে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার গিয়াস?
বাবা তোমার সাথে একটা জরুরি কথা বলতে এসেছি।
কী কথা, তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
কোনো ভণিতা না করে গিয়াস সরাসরি কাজের কথায় চলে এল, বলল, বাবা আমি ঠিক করেছি একটা রেস্টুরেন্ট দেব। আমাকে কিছু ক্যাশ টাকা দিতে হবে।
ক্যাশ টাকা দিতে হবে? তোকে?
জি বাবা। আমি দুই বছর পরে তোমাকে সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব।
বাবা সোজা হয়ে বসে বললেন, তুই রেস্টুরেন্টের কী বুঝিস যে বলছিস দুই বছরে। সব টাকা তুলে ফেলবি?
বোঝার দরকার নাই বাবা, কারণ আমি ব্যবহার করব সিনাপ্সুঘুটিয়া।
বাবা বিদঘুটে শব্দটা শুনে চমকে উঠলেন, বললেন, সেটা আবার কী জিনিস?
আমাদের মস্তিষ্কের সিনাপ্সকে ঘুঁটে দেয়। আমাদের যা কিছু অনুভূতি সেগুলো সবই আসে মস্তিষ্ক থেকে। তাই অনুভূতিটা সরাসরি মস্তিষ্কে দিয়ে দেব।
সরাসরি মস্তিষ্কে দিয়ে দিবি?
জি বাবা। কেউ যখন খুব ভালো একটা কিছু খায় তখন তার ভালো লাগার অনুভূতিটা আসলে তো মুখে, জিবে হয় না হয় মস্তিষ্ণে! আমি রেস্টুরেন্টে সিনাপ্সুঘুটিয়া লাগিয়ে সেটা সেট করে রাখব সুস্বাদু মজার অনুভূতিতে। এখানে কাস্টমার যেটাই খাবে সেটাকেই মনে করবে সুস্বাদু। হু হু করে বিজনেস হবে। সারা দেশের মানুষ খেতে আসবে আমার রেস্টুরেন্টে।
বাবা কিছুক্ষণ শীতল চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন-তারপর তার কী মনে হল কে জানে, ড্রয়ার থেকে চেক বই বের করে খসখস করে বিশাল অঙ্কের একটা চেক লিখে। ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন।
.
প্রথম দিন যখন রেস্টুরেন্টটা খোলা হল সেদিন গিয়াস তার বাবাকে একটা টেবিলে নিয়ে বসাল। উপরে আলো-আঁধারি একটা আলো, সুন্দর ন্যাপকিন, ঝকঝকে থালা, পাতলা কাচের গ্লাসে ঠাণ্ডা পানি। গিয়াস মেনুটা তার বাবার হাতে দিয়ে বলল, বল বাবা, তুমি কী খেতে চাও।
কোনটা ভালো?
সবগুলোই ভালো।
ঠিক আছে, পরোটা আর শিককাবাব তার সাথে ইলিশ মাছের ভাজা আর একটু পোলাও, সাথে খাবার জন্যে লাচ্ছি।
খাবার পর একটু দই মিষ্টি দেব বাবা? দে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ধূমায়িত খাবার চলে এল। বাবা খুবই তৃপ্তি করে খেলেন, ঢেকুর তোলা বড় ধরনের অভদ্রতা জেনেও একটা বড়সড় ঢেকুর তুললেন। গিয়াস জিজ্ঞেস করল, কেমন লেগেছে বাবা?
বাবা ঢুলুঢুলু চোখে বললেন, আমি আমার জীবনে এর চাইতে সুস্বাদু খাবার খাই নাই। আমার ধারণা বেহেশত ছাড়া আর কোথাও এত সুস্বাদু খাবার পাওয়া যাবে না। তোর বাবুর্চিকে ডাক, আমি তার হাতে চুমু খেয়ে যাই।
গিয়াস হা হা করে হেসে বলল, বাবা এর সবই হচ্ছে সিনাপ্সুঘুটিয়ার গুণ। তুমি টের পাও নাই তোমার মাথার কাছে একটা সিনাপ্সুঘুটিয়া বসানো আছে, আমি সেটা সেট করে দিয়েছি সুস্বাদু স্কেলে। তুমি যেটাই খেয়েছ সেটাই তোমার মজা লেগেছে।
কিন্তু বাবুর্চি কি রাঁধে নাই?
গিয়াস বলল, আমার বাবুর্চি একজনের বয়স এগার অন্যজন সাড়ে বারো। সারা দিন পথেঘাটে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে বেড়ায়, রাত্রে এসে রাঁধে।
বলিস কী?
এরা রান্নার রও জানে না, প্লেটে খালি এটা-সেটা তুলে দেয়।
এটা-সেটা?
হ্যাঁ বাবা। তুমি ভেবেছ তুমি খেয়েছ পরোটা আর শিককাবাব পোলাও ইলিশ মাছ ভাজা হ্যানো ত্যানো! আসলে কী খেয়েছ জান?
কী?
খানিকটা খবরের কাগজ, একটা পুরোনো গামছার টুকরা, মোমবাতি, পোড়া মবিল, শেভিং ক্রিম আর কাপড় ধোঁয়ার সাবান।
বাবা চোখ কপালে তুলে বললেন, কী বলছিস তুই?
সত্যি বলছি বাবা। সিনাপ্সুঘুটিয়া অফ করে দিলেই তুমি বুঝবে। দেখতে চাও?
বাবা কাঁপা গলায় বললেন, দেখা।
গিয়াস তার সিনাপ্সুঘুটিয়া বন্ধ করে দিল এবং সাথে সাথে বাবা হড় হড় করে খবরের কাগজ, গামছার টুকরা, মোমবাতি, পোড়া মবিল, শেভিং ক্রিম আর কাপড় ধোয়ার সাবান বমি করে দিলেন।
.
গিয়াস যেরকম আশা করেছিল তার রেস্টুরেন্ট তার থেকে অনেক ভালো করে চলল। সে বাবাকে বলেছিল দুই বছর পরেই সে তার বাবাকে টাকাটা সুদে আসলে ফেরত দেবে, কিন্তু সে ছয় মাসের মাথাতেই পুরো টাকা ফিরিয়ে দিল। রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করে গিয়াস তার বাবার মতো টাকার কুমির না হলেও মোটামুটি টাকার গিরগিটি হয়ে গেল। তখন বাসা থেকে সবাই তাকে চাপ দিল বিয়ে করার জন্যে। প্রথমে দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করে শেষ পর্যন্ত সে বিয়ে করতে রাজি হল।
মেয়ের ব্যাপারে গিয়াস খুবই খুঁতখুঁতে। মেয়ের নাক পছন্দ হয় তো চুল পছন্দ হয় না। চুল পছন্দ হয় তো দাঁত পছন্দ হয় না। এমনকি ডান চোখ পছন্দ হয় তো বাম চোখ পছন্দ হয় না। সবাই যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন হঠাৎ করে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেল, যারা তাকে দেখেছে তাদের সবাই নাকি ট্যারা হয়ে গেছে। এই মেয়ে খুব সহজে সবার সামনে দেখা দেয় না-তাকে দেখতে হলে তার মায়ের একটা বুটিকের দোকানে গিয়ে দেখতে হয়।
খোঁজখবর নিয়ে গিয়াস বুটিকের দোকানে মেয়েকে দেখতে পেল এবং মেয়েকে এক নজর দেখে তার আর চোখের পলক পড়ে না। দুধে আলতায় গায়ের রঙ, রেশমের মতো চুল, চোখের মাঝে অতলান্তের গভীরতা, ঠোঁটগুলো ফুলের পাপড়ির মতো, ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতগুলো মুক্তার মতন ঝকঝক করছে। গিয়াস মেয়ের দিকে তাকাল, মেয়েটিও তার দিকে তাকিয়ে মোহিনী ভঙ্গিতে একটু হাসল, এবং সেই হাসি দেখে গিয়াসের বুকের ভেতর নড়েচড়ে গেল। গিয়াস ফিসফিস করে বলল, তুমি কি আমার হবে?
মেয়েটি চোখের ভুরুতে বিদ্যুৎ ছুটিয়ে বলল, কেন নয়?
.
কাজেই যথাসময়ে ধুমধাম করে বিয়ে হল। সুন্দরী বউ খুবই লাজুক, লম্বা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। সব অনুষ্ঠানের শেষে বাসর রাতে বউয়ের মুখের ঘোমটা তুলে গিয়াস ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, তার বউয়ের জায়গায় যে বসে আছে তার চেহারা পুরোপুরি বানরের মতো! গিয়াস তোতলাতে তোতলাতে বলল, তু-তু-তুমি?
হ্যাঁ আমি।
তুমি কে?
আমি তোমার বউ।
কিন্তু তোমাকে তো অন্যরকম দেখেছি। অপরূপ সুন্দরী!
আবার হয়ে যাব।
কীভাবে?
নূতন বউ তরমুজের বিচির মতো কালো দাঁত বের করে হেসে বলল, কাল সকালেই মায়ের দোকানের সিনাপ্সুঘুটিয়াটা বাসায় এনে লাগিয়ে দেব!
মিয়া গিয়াসউদ্দিন তোতলাতে তোতলাতে বলল, সি-সি-সি-? এতদিন যে যন্ত্রটার নাম সে অবলীলায় বলে এসেছে হঠাৎ করে সেই নামটা তার মুখেই আসতে চাইল না।
স্মৃতি
শপিংমল থেকে বের হয়েই রুমানা দেখল অনেক মানুষের ভিড়। মানুষগুলো কেন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে বোঝার জন্য সে একটু মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল। মানুষের ভিড়ে কিছু দেখা যায় না। মনে হল সামনে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি। শুধু পুলিশ নয় মিলিটারিও আছে–তারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে তারা মানুষগুলোকে সার্চ করছে।
রুমানার একটু তাড়াহুড়ো ছিল, এখন এই ঝামেলা থেকে কখন বের হতে পারবে কে জানে। পুলিশ আর মিলিটারি মিলে কী খুঁজছে সেটাই বা কে বলতে পারবে?
আসলে পুলিশ আর মিলিটারি আমাকে খুঁজছে। রুমানা কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কথাগুলো শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠে মানুষটার দিকে তাকাল। ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের হাসিখুশি চেহারার একজন মানুষ। মাথায় এলোমেলো চুল, চোখে কালো একটা সানগ্লাস। মানুষটা দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন, দুএকদিন শেভ করে নি বলে গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি কিন্তু সেজন্যে তাকে খারাপ লাগছে না। একটা নীল শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরে আছে, ফর্সা রঙে তাকে খুব মানিয়ে গেছে।
মানুষটা ঠাট্টা করছে কি না রুমানা বুঝতে পারল না, আমতা-আমতা করে বলল, আপনাকে খুঁজছে?
হ্যাঁ।
আপনি কী করেছেন?
মানুষটা একটু হেসে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলল, চোখগুলো খুব সুন্দর, কেমন জানি ঝকঝক করছে। সেটা ছাড়াও চোখের মাঝে অন্য কিছু একটা আছে যেটা রুমানা চট করে ধরতে পারল না। মানুষটা বলল, আমি আসলে কিছুই করি নি।
আপনি যদি কিছুই না করবেন তা হলে পুলিশ মিলিটারি খামোখা আপনাকে খুঁজছে কেন?
মানুষটা এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর নিচু গলায় বলল, আমি আসলে একজন এলিয়েন।
রুমানা কথাটা স্পষ্ট করে ধরতে পারল না, বলল, আপনি কী?
এলিয়েন। মানুষটা ব্যাখ্যা করে, মহাজাগতিক প্রাণী।
রুমানা কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কী হেসে ফেলবে নাকি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়বে, বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, এলিয়েন?
হ্যাঁ।
পৃথিবীতে বেড়াতে এসেছেন?
মানুষটা মাথা চুলকে বলল, অনেকটা সেরকম।
কেমন লাগছে পৃথিবীতে?
মানুষটা হেসে ফেলল, বলল, আপনি আসলে আমার কথা বিশ্বাস করেন নি, তাই না? ভাবছেন ঠাট্টা করছি।
খুব ভুল হয়েছে?
না ভুল হয় নাই। আসলে এটা তো বিশ্বাস করার ব্যাপার না। আমি নিজেই প্রথমে বিশ্বাস করি নি।
রুমানা ভুরু কুঁচকে বলল, আপনি নিজে? একটু আগে না আপনি বলেছিলেন আপনি এলিয়েন?
হ্যাঁ, সেটাও সত্যি। আমি আসলে সাজ্জাদ। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু একই সাথে একজন এলিয়েন।
রুমানা বলল, ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কোথা থেকে নিয়েছেন? মঙ্গল গ্রহে? মঙ্গল গ্রহের ডিগ্রি পৃথিবীতে একসেন্ট করে?
সাজ্জাদ নামের মানুষটা, কিংবা এলিয়েনটা শব্দ করে হাসল, বলল, আপনার গুড সেন্স অফ হিউমার।
কেন? এলিয়েনদের সেন্স অফ হিউমার থাকে না?
আসলে এলিয়েন নিয়ে মানুষের অনেক রকম মিস-কনসেপশন আছে। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা এলিয়েন হলেই সেটা দেখতে ভয়ংকর কিছু হবে।
রুমানা মাথা নাড়ল, বলল, ভয়ংকর না হলেও অন্য রকম হবে। এক্স ফাইলে দেখেছি। সাইজে ছোট, মাথাটা বড়, চোখগুলো এরকম টানা টানা। সবুজ রঙের_
সাজ্জাদ বলল, আমিও দেখেছি। ভেরি ইন্টারেস্টিং লুকিং।
কিন্তু আপনি বলছেন সেটা সত্যি না?
আসলে আমরা তো সব সময়েই কিছু একটা দেখি যেটা ধরা যায়, হেঁয়া যায়। তাই যেটা ধরা-ছোঁয়া যায় না-যেটা হয়তো এক ধরনের প্যাটার্ন, এক ধরনের ইনফরমেশান, সেটা আমরা কল্পনা করতে পারি না।
তার মানে এলিয়েনটা একটা প্যাটার্ন?
জিনিসটা আরো জটিল কিন্তু ধরে নেন অনেকটা সত্যি।
রুমানা ভুরু কুঁচকে বলল, কীসের প্যাটার্ন?
সাজ্জাদ বলল, কেউ যদি আপনাকে কয়েকটা তেঁতুলের বিচি দেয় আপনি সেটা দিয়ে একটা প্যাটার্ন বানাতে পারবেন না? কোনো একটা তারার মতো সাজালেন, কিংবা বৃত্তের মতো সাজালেন-
রুমানা মাথা নাড়ল, বলল, সেটা এলিয়েন হয়ে গেল?
উঁহু। সেটা হল না। আরেকটু শুনুন তা হলে বুঝবেন। তেঁতুলের বিচি তো আর বেশি দেয়া সম্ভব না তাই প্যাটার্নটা হবে খুব সিম্পল। খুব সহজ সরল। এখন যদি কেউ আপনাকে একটা মানুষের মস্তিষ্ক দেয়, দিয়ে বলে এটার সব নিউরন, তার সকল সম্ভাব্য সিনান্স কানেকশন দিয়ে তুমি একটা প্যাটার্ন সাজাও-তা হলে আপনি চিন্তা করতে পারবেন আপনি কী অসাধারণ প্যাটার্ন বানাতে পারবেন?
রুমানা বলল, শুনেই আমার গা ঘিনঘিন করছে। মানুষের মগজ ছিঃ!
সাজ্জাদ আবার হা হা করে হাসল, হেসে বলল, আসলে আমি মাথা কেটে মগজ বের করে হাত দিয়ে তার নিউরন ঘাঁটাঘাঁটি করার কথা বলছিলাম না! আমি অন্যভাবে বলছিলাম। যেমন-এখন আমি আপনার সাথে কথা বলছি, আপনার মস্তিষ্কে নূতন নূতন সিনান্স কানেকশন হচ্ছে। যখন আপনি একটা বই পড়েন তখন আপনার মস্তিষ্কে নূতন সিনান্স কানেকশন তৈরি করে। যখন আপনি সুন্দর একটা গান শোনেন সেটা আপনার মস্তিষ্কে নূতন সিনান্স কানেকশন তৈরি করে। বলা যায় একটা নূতন প্যাটার্ন তৈরি করে।
রুমানা ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে একটা গান আসলে একটা এলিয়েন?
উঁহু আমি ঠিক তা বলি নি। একটা গানের স্মৃতি কিংবা শৈশবের কোনো একটা ঘটনার স্মৃতি যেরকম মস্তিষ্কে থাকতে পারে সেরকম একটা এলিয়েনও মানুষের মস্তিষ্কে থাকতে পারে।
রুমানা কোনো কথা না বলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
সাজ্জাদ বলল, এলিয়েনের সুবিধেটুকু বুঝতে পারছেন? তার নিজের হাত পা নাক মুখের দরকার নেই। সে আমার হাত পা নাক মুখ ব্যবহার করতে পারে।
রুমানা মাথা নাড়ল, মানুষকে যখন জিনে ধরে তখন যেরকম হয়
সাজ্জাদ হাসল, জিনে ধরায় কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কি না আমি জানি না।
আপনার থিওরিটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে?
আছে। সাজ্জাদ হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ঋদি না থাকত তা হলে এইভাবে পুলিশ মিলিটারি ঘেরাও করে আমাকে খুঁজত?
তারা খবর পেল কেমন করে?
সায়েন্টিফিক কমিউনিটি তো আমাদের কথা জানে। অনেক দিন থেকে খুঁজছে। যে এলিয়েনটা আমার কাছে এসেছে তার ক্যারিয়ারটা ধরা পড়ে গিয়েছিল।
রুমানা বলল, যদি সত্যিই এটা হয়ে থাকে। তা হলে আপনি আমাকে এটা বলছেন কেন? আমি যদি আপনাকে ধরিয়ে দিই।
সাজ্জাদ হাসল, আপনি ধরিয়ে দেবেন না।
আপনি কেমন করে এত নিশ্চিত হলেন?
শুধু যে ধরিয়ে দেবেন না তা না। আপনি আসলে আমাকে সাহায্য করবেন যেন আমি ধরা না পড়ি।
রুমানা অবাক হয়ে বলল, আমি আপনাকে সাহায্য করব?
হ্যাঁ। সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, আপনি এলিয়েটাকে আপনার মস্তিষ্কে করে নিয়ে যাবেন। পুলিশ মিলিটারি মহিলাদের ছেড়ে দিচ্ছে। আপনাকেও ছেড়ে দেবে। ওদের কাছে খবর আছে যে এলিয়েনের ক্যারিয়ার একজন পুরুষ মানুষ।
রুমানার মুখ এবারে একটু শক্ত হয়ে গেল। বলল, দেখেন আপনার এই গল্প বলার স্টাইলটা বেশ মজার। কিন্তু সেটাকে বেশি টেনে নেবার চেষ্টা করবেন না।
সাজ্জাদ বলল, একটু আমার কথা শুনুন। শেষ কথাটা
রুমানা সাজ্জাদের দিকে তাকাল, কী শেষ কথা?
সাজ্জাদ ফিসফিস করে বলল, মানুষের চোখ আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ। দুজন যখন একজন আরেকজনের দিকে তাকায় তখন এই চোখের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের যোগাযোগ হতে পারে। এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কের সাথে আপনার মস্তিষ্কের যোগাযোগ হয়েছে। আমি আসলে আপনার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছি।
রুমানা বিস্ফারিত চোখে সাজ্জাদের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে অবাক হয়ে দেখল তার সামনে থেকে সবকিছু ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে শুধু দুটি চোখ দেখতে পাচ্ছে। ঝকঝকে ধারালো চোখ। সেই চোখ দুটো ধীরে ধীরে বিশাল এক শূন্যতায় রূপ নেয়। মনে হয় সেখানে কোনো আদি নেই কোনো অন্ত নেই যতদূর চোখ যায় এক বিশাল শূন্যতা। সেই ভয়াবহ শূন্যতায় বুকের ভেতর কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। হঠাৎ করে সেই মহাজাগতিক শূন্যতার মাঝে বিন্দু বিন্দু আলোর ছটা দেখা যায়, লাল নীল সবুজ- পরিচিত আলোর বাইরে বিচিত্র সব রঙ, সেই রঙ কেউ কখনো দেখে নি। আলোর বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে একটা রূপ নিতে থাকে। সেই বিচিত্র রূপ খুব ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করে। রুমানার মনে হয় তার সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত একটি অতিপ্রাকৃত দৃশ্য, সেটি নড়ছে। প্রথমে ধীরে তারপর তার গতি বাড়তে থাকে। পুরো দৃশ্যটি নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে, ঘুরতে থাকে, একসময় প্রচণ্ড বেগে পাক খেতে খেতে তার চেতনার মাঝে প্রবেশ করতে থাকে। রুমানার মনে হয় সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে। মনে হয় অতল অন্ধকারে ডুবে যাবে কিন্তু সে বুঝতে পারল কেউ একজন তাকে ধরে রেখেছে। খুব ধীরে ধীরে সেই ঘূর্ণায়মান নকশা, সেই বিচিত্র রঙের আলোর বিন্দু অদৃশ্য হয়ে যায়। প্রথমে আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতা তারপর ধীরে ধীরে সেখানে তার পরিচিত জগৎ ফিরে আসে। সে দেখে সাজ্জাদ তাকে ধরে রেখেছে।
রুমানা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকাল। শুকনো মুখে বলল, আমার কী হয়েছিল?
কিছু হয় নি।
হয়েছে। আপনি আমাকে হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করেছেন।
আমি কিছু করি নি। সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, বলল, আমি হিপনোটিজম জানি না।
আপনি কে? কী চান?
আমি কেউ না। আমি আসলে কিছু চাই না। সাজ্জাদ একটু হাসল, হেসে চোখে কালো চশমাটি পরে সে হেঁটে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল।
রুমানা তার মাথাটা একটু ঝাঁকাল, মনে হচ্ছে মাথাটা ভার ভার হয়ে যাচ্ছে। কী বিচিত্র একটা অভিজ্ঞতা, কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না। রুমানা এদিক-সেদিক তাকিয়ে সামনে হেঁটে যায়। কয়েকজন পুলিশ ভিড়ের মাঝে থেকে মহিলা, শিশু আর বৃদ্ধদের আলাদা করছে। তারা লাইন ধরে ধরে বের হয়ে যাচ্ছে। অন্যদের ডান পাশে একটা ছোট ঘেরা দেওয়া জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি সাজানো। বড় বড় মনিটর, সেই মনিটরের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কয়েকজন তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ কেউ বিদেশী, নিচু গলায় নিজেদের মাঝে কথা বলছে। পাশেই একটা অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খোলা, সেখানে নীল ওভার অন পরে কয়েকজন মানুষ অপেক্ষা করছে। তাদের ঘিরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু সেনাবাহিনীর মানুষ, মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন। হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
পারল না। ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে এলাম।
রুমানা চমকে উঠল, কে কথা বলে?
অবাক হবার কিছু নেই রুমানা। আমি। আমি কথা বলছি। রুমানা এদিক-সেদিক তাকাল, কেউ নেই তার কাছে। হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক তার মাঝে চেপে বসে।
ভয় পাওয়ার কিছু নেই রুমানা। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করব না। শুধু তোমার মস্তিষ্কে থাকব। যখন সময় হবে অন্য কোথাও চলে যাব।
রুমানা ফিসফিস করে বলল, কে? তুমি কে?
আমি আর তুমি আসলে একই অস্তিত্ব। তাই না? ভেবে দেখ।
রুমানার হঠাৎ করে শৈশবের স্মৃতি ভেসে আসে। অসংখ্য স্মৃতি। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে সেখানে একটা বন্য পশু পুড়ছে। অর্ধদগ্ধ মাংসের টুকরো টেনে নিচ্ছে সবাই। তার মা টেনে আনল একটু টুকরো। সে খাচ্ছে তার মায়ের সাথে পশুর মতোই। হঠাৎ করে মনে পড়ল বরফের হিমবাহের কথা। চারদিকে সাদা বরফ, তুষার পড়ছে, বাতাসের ঝাপটা, কে একজন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধারালো পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মানুষটার চোখের দিকে! ঘোড়ায় করে যাচ্ছে সে। তার চারপাশে হাজার হাজার ঘোড়সওয়ার। সবার হাতে ধারালো তরবারি। চিৎকার করছে অমানুষিক গলায়। তাকে বেঁধে রেখেছে। শীর্ণ অভূক্ত সে শুয়ে আছে মাটিতে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সে। গর্ত যন্ত্রণার চিৎকার। ছোট একটা বাচ্চার কান্না শুনতে পেল সে, জন্ম দিয়েছে একজন নবজাতকের। গুলি হচ্ছে বৃষ্টির মতো। রক্তাক্ত দেহে একজন কিশোর তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনুনয় করে বলছে তাকে বাঁচাতে। কত স্মৃতি, কত সহস্র স্মৃতি, কত লক্ষ বছরের। স্মৃতি!
কত দিন থেকে বেঁচে আছে সে?