অভিভাবক যখন অভিশাপ

১.

গত কয়েক সপ্তাহে আমার বেশ কিছু মন খারাপ করা অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে যিনি তার মেয়েকে নিয়ে সবসময়ই এক ধরনের আতঙ্কে থাকেন। আতঙ্কটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, তার কারণ মেয়েটি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। মেয়েটির বয়স বেশি নয়, জীবনের নানা ধরনের যে জটিলতা একজনকে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর একটা ব্যাপারের দিকে ঠেলে দেয়, মেয়েটির সেই বয়স হয়নি। মেয়েটি মাত্র স্কুলে পড়ে, এই বয়সে ছেলেমানুষি কল্পনা করেই সময় কেটে যাওয়ার কথা। মেয়েটির বেলায় তা ঘটেনি। কারণ, সে কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে সেটি নিয়ে তার বাবা-মা তার ওপর এমন চাপ দিয়েছেন যে, তার পক্ষে সে চাপ সহ্য করা সম্ভব হয়নি, হঠাৎ করে তার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। মা এখন মেয়েটিকে নিয়ে এক মানসিক ডাক্তার থেকে আরেক মানসিক ডাক্তারের কাছে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অবাক হয়ে আবিষ্কার করছেন, একটা কম বয়সী কিশোরী মেয়ের নিজের ভেতরে দুর্ভেদ্য একটা দেয়াল তুলে রেখেছে, সেই দেয়াল ভেদ করে কেউ এখন ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।

আমি আরেকটি মেয়ের কথা জানি যে তার মায়ের প্রচণ্ড চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ঠিক করল সে আর বাড়িতে থাকবে না, তাই একদিন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। এটি একটি ভয়ঙ্কর গল্প হতে পারত, শেষ পর্যন্ত হয়নি। কারণ মেয়েটিকে বহুদূরের একটা এলাকা থেকে সময়মতো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। মেয়েটি এখন কেমন আছে আমি জানি না।

মাত্র কয়েকদিন আগে আমার অফিসে একটা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবার পছন্দের ইউনিভার্সিটিতে ছেলেটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারেনি। তাই বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। ছেলেটি এখন আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মানুষের করুণার ওপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছে, টাকা ধার করে ফরম ফিলাপ করে কোনোভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলেটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে, সে এখন কী করবে। আমি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, তাকে বাস্তব এবং কার্যকর কোনো উপদেশ দেওয়ার মতো আমি কিছু খুঁজে পাইনি!

এগুলো হচ্ছে মাত্র গত কয়েক সপ্তাহের উদাহরণ। আমি যদি আরও আগের অভিজ্ঞতার কথা মনে করার চেষ্টা করি, তাহলে এ রকম অসংখ্য ঘটনার কথা বলতে পারব। বাবা-মায়ের নির্দয় ব্যবহারে মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার উদাহরণ যে রকম আছে, ঠিক সে রকম বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের নাম পাল্টে দ্বিতীয়বার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একেবারে নতুন করে একা একা নিজের জীবন শুরু করার উদাহরণও আছে।

কেউ যেন মনে না করে, আমি বলার চেষ্টা করছি আমাদের সব মা-বাবাই বুঝি এ রকম। আমি যে উদাহরণগুলো দিয়েছি সেগুলোর সংখ্যা আসলে খুবই কম। কিন্তু তারপরও এ রকম উদাহরণ যে কম হলেও আছে সেটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ। দুশ্চিন্তাটুকু একটু বেশি, কারণ যতই দিন যাচ্ছে আমাদের মনে হচ্ছে এ রকম উদাহরণের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক বাবা-মা কেন জানি খুব সহজ একটা বিষয় বুঝতে পারেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা যত ছোটই হোক, তারা পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তাদের নিজেদের বিচার-বুদ্ধি আছে এবং তাদের ওপর নিজেদের কোনো একটা সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দিলে তার ফল কখনও ভালো হতে পারে না।
কয়েক বছর আগে টেলিভিশনের একটা চ্যানেল আমাকে একটা নিয়মিত অনুষ্ঠানে কিছুদিনের জন্য উপস্থিত হতে রাজি করিয়েছিল। শুক্রবার সকালবেলা আমি কিছুক্ষণের জন্য টেলিভিশনে ‘লাইভ’ বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতাম। বাচ্চারা আমার কাছে তাদের প্রশ্নগুলো পাঠাত, আমাকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হতো। সে সময় আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, এ দেশের শিশু-কিশোরের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যে বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সেখানে তাদের বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ করার অধিকার আছে কিনা!

আমাকে খুব সাবধানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। আমি তাদেরকে বলতাম, তাদের বাবা-মায়ের বয়স যেহেতু বেশি, তাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও বেশি। সেই অভিজ্ঞতার কারণে তারা কিছু কিছু বিষয় জানেন, যেগুলো শিশু-কিশোররা এখনও জানে না। তাই তাদের বাবা-মায়ের যুক্তিগুলো তারা শুনতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনটা কীভাবে গড়ে তুলবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদেরই নিতে হবে। আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ের বেলাতেও তারা কী নিয়ে লেখাপড়া করতে চায়, সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিতে দিয়েছি। আমি মনে মনে আশা করি, সবারই জীবনে এই স্বাধীনতাটুকু থাকুক।

বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেমেয়ের একটা সুন্দর জীবন দেখতে চান। কিন্তু সেই সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখার জন্য তারা কতটুকু বাড়াবাড়ি করবেন, সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

বাবা-মায়েদের বাড়াবাড়ি কী পর্যায়ে যেতে পারে তার একটা উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুল-কলেজে এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন হয় (যখনই সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে কথা হয়, তখন কেউ না কেউ বলে, ‘কিন্তু আপনি কি জানেন, এখন সৃজনশীল প্রশ্নের গাইডবই বের হয়ে গেছে? আগে ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের পাঠ্যবই মুখস্থ করত, এখন ছেলেমেয়েদের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীল গাইডবইটাও মুখস্থ করতে হচ্ছে।’ আমি তাদের মনে করিয়ে দিই, এই গাইডবই মুখস্থ করে তারা কখনোই কোনো সত্যিকারের পরীক্ষার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারবে না! সত্যিকারের পরীক্ষায় কখনও কোনো প্রশ্ন এই গাইডবই থেকে আসবে না। ছাত্রছাত্রীরা যদি তাদের পাঠ্যবই, শুধু তাদের পাঠ্যবই আগাগোড়া মন দিয়ে পড়ে, তাহলেই তারা সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে)। যাই হোক যখন প্রথমবার সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, তখন হঠাৎ করে তার বিরুদ্ধে এক ধরনের লেখালেখি শুরু হয়ে গেল। আমরা যারা এই পদ্ধতিটার গুরুত্বটুকু ধরতে পেরেছিলাম, তারাও সবাই মিলে এর পক্ষে কথা বলতে শুধু করলাম। তখন হঠাৎ একটা বিচিত্র বিষয় আবিষ্কার করলাম, ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা যেভাবে হোক সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেলেন। ঠিক কী কারণ জানি না, সেটা করার জন্য তারা সবাই মিলে আমাকে ‘সাইজ’ করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন। দিন নেই, রাত নেই তারা আমাকে ফোন করেন, আমার সঙ্গে কথা বলেন, দল বেঁধে এখানে-সেখানে দেখা করেন, আমাকে নানা বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে কিছুদিনের মধ্যে আমি আসল ব্যাপারটি আবিষ্কার করলাম, তাদের যুক্তিটি খুবই চমকপ্রদ। তারা আমাকে বলেন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, এই পদ্ধতিটি খুবই ভালো। কিন্তু এই বছর আমার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে যাক, তারপর যা খুশি করেন আমাদের কোনো আপত্তি নেই!’

যেসব অভিভাবক আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন, তাদের মধ্যে একজনও নেই যার ছেলেমেয়ে সেই বছরের পরীক্ষার্থী নয়। দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, তাদের সব মাথাব্যথা শুধু নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমি তখন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সোচ্চার অভিভাবকরা আসলে খুব স্বার্থপর। তাদের নিজেদের সন্তানের ভালোমন্দের বাইরে তারা কখনও কিছু চিন্তা করেন না। স্বার্থপর মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেয়ে নিরানন্দ কাজ কিছু হতে পারে না। তাদের কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না।

২.

স্বার্থপর অভিভাবক থেকেও ভয়ঙ্কর এক ধরনের অভিভাবক আছেন। তাদের সঙ্গে সাধারণত আমার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর। এবারে একজন আমার অফিসে এসেছেন। তার সঙ্গে একজন কম বয়সী তরুণ, চেহারা দেখে অনুমান করতে পারলাম, সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় সে রকম একজন। বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং আমি তাদের সামনে বসার আমন্ত্রণ জানালাম। ভদ্রলোক আমাদের এলাকার মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। আমাকে জানালেন, তার সঙ্গের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি, তাকে ভর্তি করে দিতে হবে।

‘অমুক’ বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তখন তাকে আপনার বিভাগে ভর্তি করে দিতে হবে এ রকম অনুরোধ মাঝে মধ্যে শুনতে পাই; কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাতেই টিকতে পারেনি তাকে ভর্তি করে দিতে হবে, এই অনুরোধটি নতুন। আমি এ ধরনের অন্যায় কাজ করতে পারি, লোকজন সেটা বিশ্বাস করে জানতে পেরে অবশ্যই আমার খুব আশাভঙ্গ হলো, আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো; কিন্তু তারপরও আমাকে জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলতে হলো, এ রকম কিছু করা সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ যদি এটা করার চেষ্টাও করে, তারপরও সেটি করার উপায় নেই। মেধা তালিকায় যারা আছে তাদের একজন একজন করে ভর্তি করা ছাড়া আমাদের সিস্টেম আর কিছু করতে পারবে না।

ভদ্রলোক আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, হেসে হেসে বললেন, এ দেশে সবকিছু সম্ভব। আপনার দেশের একজন মানুষের জন্য আপনার এটা করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

বেশ কিছুক্ষণ এ ধরনের আলাপ চলল, আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকা এই কম বয়সী তরুণ এবং তার অভিভাবকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক পর্যায়ে আমাকে কঠিন হতে হলো, রূঢ় ভাষায় বলতে হলো যে এই ছেলেটি আপনার পাশে বসে বসে দেখছে তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা চলছে! আপনার সম্পর্কে এখন ছেলেটির কী ধারণা হচ্ছে? সে জানছে, তার অভিভাবক একজন ক্রিমিনাল, এসেছে আরেকজন ক্রিমিনালের কাছে?

ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ন এবং বিরক্ত হয়ে বিদায় নিলেন। আমার ভেতরটা সারাদিনের জন্য তেতো হয়ে গেল। এ ধরনের অভিভাবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাদের ছেলেমেয়েদের সামনে তারা অন্যায় কাজ করে ফেলেন, ছেলেমেয়েদের বোঝান কোনো কিছু পাওয়ার জন্য অন্যায় করতে হয়। সৎ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেটা পাওয়ার কথা সেটা পেলেই হলো। এ ব্যাপারে খুব ছেলেমানুষি একটা ব্যাপার আমার ভেতরে বেশ দাগ কেটেছে। আমি বইমেলায় বসে আছি, শত শত ছেলেমেয়ে ভিড় করে আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। যখন দেখলাম এটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, তখন আমি তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলাম। কিছুটা হলেও একটু শৃঙ্খলা ফিরে এলো, তারপরও যে হুটোপুটি নেই তা নয়। তখন হঠাৎ করে একজন ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এর বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিন।’ আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি সবার মতো লাইন ধরে এসেছ?’ মা ছেলেটিকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না, বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সে লাইন ধরে এসেছে।’ আমি আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি তুমি লাইনে ছিলে?’ ছেলেটি কিছু বলতে পারল না, মা আবার বললেন, সে লাইনেই ছিল, লাইন ভেঙে ঢোকেনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে এই ছোট বিষয় নিয়ে নাটক করার চেষ্টা না করে ছেলেটির বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে তাকে বললাম, ‘আমি দেখেছি, তুমি লাইন ভেঙে ঢুকেছ! কেন এটা করলে?’
ছেলেটির মুখ মুহূর্তে অপমানে ম্লান হয়ে গেল। তীব্র চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি করতে চাইনি। আমার মা আমাকে করিয়েছে।’

আমি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘এরপর থেকে মা করাতে চাইলেও করবে না, ঠিক আছে?’

শিশুটি চোখের পানি আটকে রেখে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার ধারণা, যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তখন তারা অন্যায় করতে জানে না। অন্যায় করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যখন তাদের সন্তানের সামনে অন্যায় করেন, সন্তানকে অন্যায় কাজ করতে শেখান, তখন তারা সেটা করতে শেখে। সুন্দর একটা মন ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যায়।

আমাদের দেশের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার কিছু কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা অভিভাবক এবং তাদের সন্তানদের এক জায়গায় নিয়ে আসে। অভিভাবকদের খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা থাকে, যখন পরীক্ষার্থীরা রাত জেগে ফাঁস করে আনা মেডিকেলের প্রশ্ন মুখস্থ করতে থাকে। ছেলেমেয়েরা জানে তাদের বাবা-মায়েরা কয়েক লাখ টাকা দিয়ে তাদেরকে ফাঁস করে আনা প্রশ্ন মুখস্থ করার সুযোগ দিয়েছে। সেটা নিয়ে তাদের বিবেক কোনো যন্ত্রণা দেয় কিনা আমার জানা নেই। টাকা দিয়ে তারা অনেক বড় অন্যায় করছে কিন্তু সেই বাবা-মা কীভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের চোখের দিকে তাকান, আমি জানি না। আমার খুব জানার ইচ্ছে!

এ রকম একটা মন খারাপ করা কুৎসিত বিষয় লিখতে আমার খুব খারাপ লাগছে; কিন্তু আমি সেটা মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। কারণ প্রতিদিনই আমার খাঁটি অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা গভীর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সন্তানদের বড় করছেন। সন্তানের শখ পূরণ করার জন্য নিজের সময় দিচ্ছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার উৎসবে বাবা-মায়েরা কষ্ট করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। গণিত, বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এ ধরনের অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য সন্তানদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ছবি আঁকার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছেন; ছেলেমেয়েদের দেশকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন, মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন। আমি হতদরিদ্র অশিক্ষিত বাবা-মায়েদের দেখেছি, যারা সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছেন। আমি জানি, আমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু যখন দেখি একটা তরুণ শুকনো মুখে আমাকে বলে, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি বলে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তখন আমার পরিচিত জগৎটি এলোমেলো হয়ে যায়। যখন শুনি বাবা-মায়ের প্রচণ্ড চাপে একটি মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে, আমি তখন আতঙ্কে শিউরে উঠি। আমার এই লেখাটি সে ধরনের কোনো অভিভাবকদের চোখে পড়বে কিনা জানি না। যদি পড়ে তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন আপনাদের সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। তাদেরকে তাদের নিজেদের স্বপ্ন দেখতে দিন। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। তাদেরকে জোর করে একটা প্রতিযোগিতা থেকে অন্য একটা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেবেন না। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে বাধ্য করবেন না। তারা যে কাজটুকু করতে আনন্দ পায় সেই কাজটুকু করতে দিন।

আমাদের একটি মাত্র জীবন, সেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশটুকু হচ্ছে শৈশব। তাদের শৈশবটিকে বিষাক্ত করে দেবেন না। তাদেরকে একটা আনন্দময় শৈশব নিয়ে বড় হতে দিন। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে হবে না, সবকিছুতে পুরস্কার পেতে হবে না, তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে হবে। তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে দিন।

যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের অন্যায় কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছেন তাদেরকে কী বলব আমি জানি না। তারা কীভাবে তাদের সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি এই গুরুতর অপরাধটি করো।’ এ রকম কোনো একজন অভিভাবক কি আমাকে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবেন?

অভিভাবকরা সন্তানদের ভালোবাসা দেবেন, তাদের জীবনে তারা কেন অভিশাপ হয়ে যাবেন?

অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পুরো দেশকে পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে, তখন আমরা একটি গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন মানুষের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম । মে মাসের ৫ তারিখ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার বাবাকে হত্যা করার পর আমাদের আশ্রয় দেওয়া গৃহস্বামীর মনে হলো, যে মানুষটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, তাঁর পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া বিপজ্জনক। তিন দিন পর বিকেলবেলা তিনি আমাদের পুরো পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ।

আমার মা ছোট ছোট দুটো নৌকা ভাড়া করে আমাদের ছয় ভাইবোনকে নিয়ে পুরোপুরি অনিশ্চিত পথে যাত্রা করলেন । যখন পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা, তখন পুরোপুরি আশ্রয়হীন হয়ে নৌকায় করে নদীতে ভেসে বেড়াতে কেমন লাগে, তখন আমাদের সেই অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল। একজন মানুষের যখন সারা পৃথিবীতে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না, তখন বুকের ভেতর যে অসহায় অনুভূতি হয় এবং জগৎ-সংসারের প্রতি যে অভিমানের জন্ম হয়, তার চেয়ে হূদয়বিদারক কোনো অনুভূতি আছে বলে আমার জানা নেই।

প্রায় ৪০ বছর পর খবরের কাগজ খুলে হঠাৎ করে আমি সেই অনুভূতিটি নতুন করেঅনুভব করছি। নিজ দেশে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আশ্রয়ের আশায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের দেশে আসছে। অসহায়-আতঙ্কে হকচকিত শিশু, আশ্রয়ের আশায় ব্যাকুল মা—হঠাৎ করে খবরের কাগজের ছবিতে আমি নিজেকে, নিজের ভাইবোনকেখুঁজে পেতে শুরু করেছি।ছবিগুলো অনেক নিষ্ঠুর, কারণ, বাংলাদেশ সরকার সদম্ভে ঘোষণা করেছে, কেউ এখানে আশ্রয় পাবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, আগরতলায়যত অধিবাসী ছিল, শরণার্থীর সংখ্যা ছিল তার থেকে বেশি। যদি পার্শ্ববর্তী দেশ সদম্ভে ঘোষণা দিত, সেই দেশে বাংলাদেশের কোনো অসহায় মানুষ আশ্রয় পাবেনা, তাহলে নিশ্চিতভাবেই১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৩০ লাখে থেমে না গিয়ে আরও কয়েক গুণ বেড়ে যেত।
পৃথিবীতে অনেক নিষ্ঠুরতা আছে, তার পরও আমরা পৃথিবীতে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকি। কারণ, আমরা জানি এখানে যতটুকু নিষ্ঠুরতা আছে, তার থেকে অনেক বেশি রয়েছে মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা। বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গারা যখন আমাদের দেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটেআসছে, আমরা অমানুষের মতো বলছি, এই দেশে তোমাদের স্থান নেই, তোমরা ফিরে যাও। আমার দেশ এ রকম অমানবিক, এ রকম নিষ্ঠুর—নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না।
একাত্তর সালে আশ্রয়হীন হয়ে যখন আমার মা তাঁর অসহায় সন্তানদের নিয়ে নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, তখন একজন হতদরিদ্র মানুষ আশ্রয় দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল। সেই ভয়ংকর বিপদে আশ্রয় পেয়েছিলাম বলে আমরা প্রাণে বেঁচেছি। আমি সেই কথাটিএক মুহূর্তের জন্য ভুলিনা। আমি জীবনে কখনো মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। আমি জানি, এই পৃথিবীটা এত সুন্দর, কারণ, মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে যাবে না।
তাহলে আমাদের সরকার কেমন করে এত নিষ্ঠুর হয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে? আমরা কেমন করে এত সহজে ১৯৭১-কে ভুলে গেলাম?

অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর

১.

যখন বয়স কম ছিল তখন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর একটা শখ ছিল, এখন আর সেই শখ নেই। পৃথিবীর নানা বিচিত্র দেশ থেকে নিজের সাদামাটা দেশটাকেই বেশি ভালো লাগে। তবে আমি কখনও বিষুব রেখা পার হইনি। তাই দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশের নক্ষত্ররাজি দেখতে কেমন লাগে সেটা নিয়ে একটা সূক্ষ্ম কৌতূহল ছিল।

আকাশের নক্ষত্রদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল একাত্তরে। বিনিদ্র রাতে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম তখন মনে হত সেগুলো বুঝি গভীর মমতা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে আরও নূতন নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় হবে; তাছাড়া রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্রটি দক্ষিণ গোলার্ধে একটা ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দেয়, সেটা দেখারও আগ্রহ ছিল।

তাই যখন অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাহিত্য সংসদ আমাকে মেলবোর্নে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আমি যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভীতু ধরনের মানুষ, একা ভ্রমণ করতে সাহস পাই না। তাই যখন আমার স্ত্রী সঙ্গে যেতে রাজি হল তখন শেষ পর্যন্ত প্লেনে চড়ে বসলাম।

মেলবোর্ন পৌঁছানোর পর একটি অত্যন্ত অভিজাত ধরনের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া কুকুর আমাদের সবকিছু শুঁকে যখন অনুমতি দিল যে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পা দিতে পারি তখন আমরা বের হয়ে এলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের প্রায় সব সদস্য এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। তারা আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন আমি খুব বড় একজন সাহিত্যিক এবং আমার সন্দেহ হতে শুরু করল যে আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি কি না!

বাংলা সাহিত্য সংসদ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটা সংগঠন। বিদেশের মাটিতে যারা থাকেন দেশের জন্যে তাদের ভিন্ন এক ধরনের মায়া থাকে। যারা কখনও দেশ ছেড়ে যাননি তারা আসলে কখনও দেশের জন্যে এই বিচিত্র মায়াটি অনুভব করতে পারবেন না।

দেশের প্রতি এই মমত্ববোধ থেকে বাংলা সাহিত্য সংসদ মেলবোর্ন শহরে নানা কিছুর আয়োজন করে থাকে; তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলা থেকে সাহিত্যিকদের নিয়ে আসা। তাদের আয়োজনে সুনীল-শীর্ষেন্দু–সমরেশ মজুমদারের মতো সাহিত্যিকেরা এসেছেন এবং সেই একই আয়োজনে আমিও চলে এসেছি। নিজের সাহস দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম!

দেশে আমাকে নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়, শিক্ষকতা করি, তাই কথা বলাই আমার কাজ। সেজন্যে বক্তৃতা দিতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যিক হিসেবে শত শত মানুষের সামনে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য নয়। কিন্তু সেটা কাকে বোঝাব!

সাহিত্য-সভাটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল। শিক্ষক হওয়ার কিছু বিশেষ সুবিধে আছে। সারা পৃথিবীতেই আমার ছাত্রছাত্রী। এখানেও তারা অনেকে আছে, সবাই দলবেঁধে চলে এল। বক্তব্যের শেষে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল, আয়োজকেরা সেটা নিয়ে একটু দুর্ভাবনায় ছিলেন।

এটি নূতন শুরু হয়েছে। রাজাকার টাইপের মানুষেরা দেশে সুবিধে করতে পারে না বিদেশে সভা-সমিতিতে এসে নাকি যা কিছু করে ফেলতে পারে। আমি আয়োজকদের অভয় দিলাম রাজাকার টাইপের মানুষদের কেমন করে সামলাতে হয় সেটি নিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ কবিতা পর্যন্ত লিখে গেছেন, “যখনি দাড়াঁবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে/পথ কুকুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”

কিন্তু সে রকম কিছুই হল না। সাহিত্য থেকে দর্শক-শ্রোতার বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষা নিয়ে, দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এগুলো আমারও প্রিয় বিষয়, দেশ নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের কথা দশজনকে বলতে আমার কখনও সমস্যা হয় না। (তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে যখন একজন দর্শক আমার কাছে জানতে চাইল আমি কেন গোঁফ রাখি, আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছু বলার আগেই আমার স্ত্রী যখন হলভরা মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল তখন আমার মুখ দেখানোর উপায় নেই!)

বাংলা সাহিত্য সংসদের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য-সভাটি ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার। কিন্তু আমরা সংসদের সদস্যদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সময় কাটিয়েছি। প্রতি রাতেই কারও বাসায় সবাই একত্র হয়েছে এবং আমরা বাঙালিরা যে কাজগুলো খুব ভালো পারি– খাওয়া এবং চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া– অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো করা হয়েছে।

যে মানুষগুলোকে আগে কখনও দেখিনি তাদের থেকে বিদায় নেবার সময় সবার চোখে পানি– এ রকম বিচিত্র ঘটনা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো মানুষের জীবনে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই। মাঝে মাঝেই মনে হয়, ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম, তা না হলে কত কিছু যে অজানা থেকে যেত!

২.

মেলবোর্ন শহর পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর। আমি সেখানে গিয়েছি ঢাকা শহর থেকে। যারা বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট দেন তারা ঢাকা শহরকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট দিয়েছেন।

(আসলে ঢাকা শহর দুই নম্বর। এক নম্বর বাসের অযোগ্য শহর হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কাস। সেখানে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মানুষ মারা হয়, যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত একটি শহর। এ রকম একটা শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সোজা কথা নয়। আমার ধারণা, যারা বাসের অযোগ্যতার সার্টিফিকেট দেন তারা মে মাসের ৫ তারিখে ঢাকা শহরে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দেখার সুযোগ পেলে প্রথম পুরষ্কারটা নির্ঘাত দামেস্কাসকে না দিয়ে ঢাকা শহরকে দিয়ে দিতেন।)

যে কয়দিন মেলবোর্নে ছিলাম তখন বোঝার চেষ্টা করেছি এই শহরটি কেন সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের পুরস্কার পেয়েছে। বাসযোগ্য শহর হতে হলে মানুষকে বাস করতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মেলবোর্নে পথেঘাটে মানুষই চোখে পড়েনি! পুরো দেশেই মানুষ মাত্র দুই কোটি (এবং এটি শুধু দেশ নয়, মহাদেশও বটে)। তাই চারদিক ফাঁকা। শহরে উচু বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট খেলনার মতো বাসা। বাসাগুলো ক্যালেন্ডারের ছবির মতোন। বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট ঠিক কী কী কারণে পেয়েছে জানা নেই, তবে বৈচিত্র্যে এই শহরটি অভিনব।

দক্ষিণ গোলার্ধ বলে এখানে সবকিছু উল্টো। আমাদের দেশে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শীত আসছে। সেখানে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসছে। তবে মনে হল গ্রীষ্ম আসার কোনো তাড়াহুড়া নেই। এখনও প্রচুর শীত। রাতে লেপমুড়ি দিয়ে হিটার জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। মেলবোর্ন শহরে একই দিনে কখনও প্রচণ্ড গরম। কখনও কনকনে শীত, কখনও বৃষ্টি, আবার কখনও উথালপাথাল হাওয়া। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মানুষজন নাকি চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বের হয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য (প্রায়) শহর থেকে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরে পা দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা চকমপ্রদ অভিজ্ঞতা। তবে বলে রাখি ঢাকা ফিরে আসার পর যখন প্লেন থেকে নেমেছি আগুনের তাপের মতো দুঃসহ গরমের একটা ঝাপটা অনুভব করেছি। হরতালের মাঝে বাসায় ফিরে এসেছি। এসে দেখি বাসায় পানি নেই। এর মাঝে হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকার মশাদের সে কী আনন্দ! আমাদের ঘিরে তাদের মহোৎসব! কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমার এতটুকু বিরক্তি অনুভব হল না। বরং মনে হল, আহা, ঢাকার মতো এ রকম ভালোবাসার শহর কয়টি আছে পৃথিবীতে?

৩.

আমেরিকা গেলে মানুষ যে রকম নায়েগ্রা ফলস না দেখে ফিরে আসে না, ঠিক সে রকম অস্ট্রেলিয়া গেলে মানুষ ক্যাঙ্গারু না দেখে ফিরে আসে না। যখন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম তখন আমাদের ক্যাঙ্গারু দেখার শখ পূরণ করিয়ে দিয়েছিল জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। (আবেদ চৌধুরী আর তার স্ত্রী টিউলিপ আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু। আমরা আমেরিকাতে একই ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ-ডি-এর জন্যে কাজ করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া এসে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়া যে কোনা হিসেবেই অপরাধ!)

ক্যানবেরা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে যেতে দেখলাম পথের দুই পাশে কাঙ্গারু। রাতের অন্ধকারে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা পড়েছে। জীবিত না হোক, তবুও তো ক্যাঙ্গারু– আমি এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু আবেদ চৌধুরী আমাদের জীবিত ক্যাঙ্গারু না দেখিয়ে ছাড়বে না।

তাই পরদিন কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে এক জায়গায় হাজির হল। সেখানে পথের দুই পাশে অসংখ্য ক্যাঙ্গারু। আমাদের দেশের এমপিরা যখন তাদের এলাকায় যান তখন স্কুলের হেডমাস্টাররা যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের ধরে এনে রাস্তার দুইপাশে রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখেন, ক্যাঙ্গারুরা ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যে রকম বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম, মনে হল তারাও সেই একই রকম বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!

ক্যাঙ্গারুর চলাফেরা খুব মজার। তাদের মতো লেজে ভর দিয়ে জোড়া পায়ে লাগিয়ে আর কোনো প্রাণি ছুটতে পারে না। তার থেকেও মজার হচ্ছে ক্যাঙ্গারু মায়ের পেটের থলেতে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার বসে থাকা। বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি এর থেকে আরামের কোনো জায়গা নেই।

ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। সবগুলো দেশের অ্যাম্বেসি কিংবা হাইকমিশন এখানে। এগুলোর পাশে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে অপূর্ব একটি বিল্ডিং। চাঁদ-তারা আঁকা লাল পতাকা দেখে বুঝতে পারলাম এটা তুরস্কের হাইকমিশন। টিউলিপ আমাদের বলল, এই জমিটুকু বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন তৈরি করার জন্যে ভিত্তিপ্রস্তরও বসিয়ে গিয়েছিলেন।

পরের বার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের আমলে বসানো ভিত্তিপ্রস্তরে যেন বিল্ডিং তোলার অপমান সহ্য করতে না হয় সে জন্যে জমিটুকু হাতছাড়া হতে দিয়েছে।

তথ্যটি বিচিত্র হলেও অবিশ্বাস্য নয়। দেশের তথ্য পাচার হয়ে বাইরে যেন চলে না যেতে পারে সেজন্যে এই সরকার একবার বিনি পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করে পুরো দেশের মানুষকে ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত করেছিল।

ক্যানবেরার অসংখ্য অ্যাম্বেসি এবং হাইকমিশনের মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ অ্যাম্বেসিটি একটা তাঁবুর মাঝে। তাদের পুরানো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সেই দেশের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করার জন্যে বিশাল একটা পতাকা উড়িয়ে তাঁবুর মাঝে নিজেদের অ্যাম্বেসি বসিয়ে রেখেছে। সরকার তাদের ঘাটায়নি, বছরের পর বছর সেভাইে রয়ে গেছে।

আমি তাদেরকে দেখে আমার নিজের দেশের আদিবাসীর কথা স্মরণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেনাবাহিনী কেন জাতিসংঘের লোভনীয় চাকুরী নিরবচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারে সেজন্যে এই দেশের আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই দেশে আদিবাসী বলে কিছু নেই। এর চাইতে মমত্বহীন কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মমত্বহীনতার স্বাদ অনেকদিন থেকে পেয়ে এসেছে। সাদা চামড়ার মানুষেরা প্রথম যখন এই দেশ দখল করেছে তখন তারা ফুর্তি করার জন্যে মানুষ যেভাবে পাখি শিকারে যায় তারা সেভাবে আদিবাসী শিকারে যেত। কেউ কোনো আদিবাসীর মাথা কেটে আনতে পারলে তাকে পুরষ্কার দেওয়া হত। মাত্র কিছুদিন আগেও আদিবাসী মায়ের বুক খালি করে আদিবাসী সন্তানদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

অতীতের এই নিষ্ঠুরতার জন্যে অস্ট্রেলিয়ার জনগণ আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে আদিবাসীদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এতদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার এই বিশাল ভূখণ্ডে সত্যিকার আদিবাসীদের কোনো চিহ্ন বলতে গেলে নেই। সারা পৃথিবীতে এ রকম নিষ্ঠুরতার উদাহরণ এত বেশি যে মনে হয় এটাই বুঝি নিয়ম। সবকিছু কেড়ে নিয়ে কোনো এক সময়ে ক্ষমা চেয়ে নিজেদের পিঠে নিজেরাই নৈতিকতার একটা সিল মেরে দেওয়া।

আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়া থাকে। আমরা মেলবোর্ন এসেছি শুনে অনেকেই দেখা করতে এসেছে। এক সময়ে তারা কমবয়সী ছাত্র কিংবা ছাত্রী ছিল। এখন তারা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, স্বামী আছে, স্ত্রী আছে, ফুটফুটে ছেলেমেয়ে আছে দেখে বড় ভালো লাগে। শুধুমাত্র আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কেউ শত শত কিলোমিটার দূর থেকে ড্রাইভ করে এসেছে, কেউ কেউ প্লেনে উড়ে এসেছে।

তাদের নিয়ে হাজারো রকমের স্মৃতিচারণ করতে করতে রাত পার হয়ে যাবার অবস্থা! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই ছিল মোটামুটি ভয়ংকর। এখন হঠাৎ করে সেগুলোকেই মনে হয় মজার। শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায় সে রকম অবস্থা।

আমরা যখন গিয়েছি তখন সবেমাত্র ইলেকশন শেষ হয়েছে। সেই দেশে সবাইকে ভোট দিতে হয়। ভোট না দিলে সত্তর ডলার জরিমানা। একজন বলল, ইলেকশনের খবর পেয়ে তার মা খুব ব্যস্ত হয়ে দেশ থেকে তাকে ফোন করে বলেছেন, বাবা ইলেকশনের দিন খবরদার ঘর থেকে বের হবি না, কখন কোথায় কী বিপদ হয়!

শুনে আমরা সবাই হেসেছি। কিন্তু তার মাঝেও বুকের মাঝে কোথায় যেন একটা ব্যথার ঝোলা অনুভব করেছি। আমাদের দেশেও ইলেকশন আসছে, কিন্তু সেটা নিয়ে আমাদের সবার মাঝে কী ভয়ানক একটা অনিশ্চয়তা, কী হয় সেটা ভেবে কী একটা অসহায় আতংক!

খুব অল্প সময়ের জন্যে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তাই আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের খুব বেশি সময় দিতে পারিনি। কিন্তু তার মাঝেই তারা সবাইকে নিয়ে দলবেঁধে সমুদ্রোপকূলে বনেজঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে চলে গেল। যত ধরনের বেড়ানো আছে তার মাঝে সবচেয়ে মজার বেড়ানো হচ্ছে যখন নিজেদের কিছু করতে হয় না, অন্যেরা সবকিছু করে দেয়। যারা সবকিছু করে দেয় তারা যদি ছাত্রছাত্রী হয় তাহলে তো কথাই নেই।

(মজার ব্যাপার হচ্ছে দেশে ফিরে আসার পর দেখি আমরা কখন কোথায় কী করেছি তার সবকিছু সবাই জানে। ফেসবুকের কল্যাণে কিছু ঘটার আগেই সেই ঘটনার কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এ রকম একটা কিছু যে হতে পারে আমরা কি অল্প কিছুদিন আগেও সেটা জানতাম? ভবিষ্যতে আরও কিছু কী ঘটতে পারে যেটা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারছি না!)

৪.

যারা এই লেখাটি পড়ছে তারা নিশ্চয়ই আবিষ্কার করে ফেলেছে আসলে এখানে অস্ট্রেলিয়ার কোনো কথা নেই, এখানে সব কথা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাঙালিদের কথা! আসলে কেউ যদি কয়েকদিনের জন্যে কোনো দেশে যায় তাহলে সেই দেশকে সত্যিকার অর্থে অনুভব করার কোনো সুযোগ থাকে না। একটা দেশকে অনুভব করতে হলে সেই দেশে দীর্ঘদিন থাকতে হয়। তখন সেই দেশের বাহ্যিক চকচকে দৃশ্যের পেছনে গ্লানিগুলো চোখে পড়ে, ব্যর্থতাগুলো দেখা যায়।

যারা সেই দেশে থাকেন তাদের কাছে একটা তথ্য পেয়েছি যেটা আমাকে অবাক করেছে। স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে এক ধরনের হতাশা। হতাশার মূল কারণ সেখানে যথেষ্ট ভালো শিক্ষক নেই। শিক্ষকের বিশেষ অভাব বিজ্ঞান, গণিত এসব বিষয়ে। সমস্যার সমাধান হবে সে রকম আশাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রছাত্রী নেই, প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয়গুলোই তুলে দেওয়া হচ্ছে!

শুনে মনে হয় হুবহু আমাদের দেশের কাহিনি। এত সম্পদ নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে, তাহলে আমরা কেন অভিযোগ করছি? শিক্ষার পিছনে জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ খরচ করে আমরা তো খুব খারাপ করিনি! আরেকটু বেশি হলে না যেন কী হত!

অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা দুই কোটি আর আমাদের দেশে স্কুলেই পড়ে তিন কোটি বাচ্চা-কাচ্চা। সরকার যদি লেখাপড়ার গুরুত্বটা বুঝে সেনাবাহিনীর বাজেট না বাড়িয়ে শিক্ষার বাজেট বাড়াত, তাহলে এই দেশে কী বিপ্লব ঘটে যেতে পারত কেউ কি কখনও কল্পনা করে দেখেছে?

৫.

শুরুতে বলেছিলাম বিষুব রেখা অতিক্রম করার একটা উদ্দেশ্য ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর উজ্জলতম নক্ষত্রটি দেখা। সেটা দেখে এসেছি– কী চমৎকার সেই নক্ষত্র। মনে হচ্ছে গভীর মমতা নিয়ে সেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

২৫.৯.১৩

আমরা যারা স্বার্থপর

আমি আজকে যেটা নিয়ে লিখছি সেটা নিয়ে লেখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা আমি বুঝতে পারছি না। আমার বুদ্ধি খুব বেশি সেটা কখনও-ই কেউ বলেনি (যাদের বুদ্ধি খুব বেশি, তারা যে খুব শান্তিতে থাকে তা-ও নয়)। তবে কিছু একটা লেখালেখি করে আমি সেটা পত্রপত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলতে পারি। সেজন্য আমি যেন দায়িত্বহীনের মতো কিছু লিখে না ফেলি, আমার সব সময় সেটা লক্ষ্য রাখতে হয়। আমার চেয়ে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেও অনেকে তাদের লেখা পত্রপত্রিকায় ছাপাতে পারেন না। তাঁরা মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে আমার কাছে সেই লেখাগুলো পাঠান। আমি পড়ি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

আজকাল লেখাগুলো শুধু যে কাগজে ছাপা হয় তা নয়, সেগুলো ইন্টারনেটেও প্রকাশ হয়। সেখানে একটা নূতন স্টাইল শুরু হয়েছে, প্রত্যেকটা লেখার পিছনে লেজের মতো করে পাঠকেরা তাদের মন্তব্য লিখতে পারেন। আমি এখন পর্যন্ত কখনও-ই আমার লেখার পিছনের লেজে লেখা পাঠকদের মন্তব্য পড়িনি। কখনও পড়ব না বলে ঠিক করে রেখেছি। পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই যে নিজের সম্পর্কে ভালো কিছু শুনতে চায় না। তাই সেই মন্তব্যগুলো পড়লে আমি হয়তো নিজের অজান্তেই এমনভাবে লিখতে শুরু করব যেন সবাই আমার লেখা পড়ে ভালো ভালো মন্তব্য করে।

আমি সেটা চাই না, আমার যেটা লিখতে ইচ্ছে করে আমি সেটা লিখতে চাই। আমার সব কথাই যে সবার জন্যেই সত্যি হবে সেটা তো কেউ বলেনি। আমার কথাটা সবাইকে মেনে নিতে হবে, সেটাও আমি বলছি না, শুনতে নিশ্চয়ই সমস্যা নেই।

আজকে আমি যাদের নিয়ে লিখছি তাঁরা সবাই আমার সহকর্মী। তাঁদের সঙ্গে আমার উঠাবসা। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার লেখাটি পড়ে তাঁরা হয়তো একটু ক্ষুব্ধ হবেন। খানিকটা আহত বোধ করবেন, তাই আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

কয়েকদিন আগে আমার টেলিফোনে একটা এসএসএম এসেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সব শিক্ষকদের একটা মানব বন্ধনে যোগ দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। যদিও এসএসএমটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে পাঠানো হয়েছে কিন্তু এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রোগ্রাম নয়, এটি ইউনিভার্সিটি ফেডারেশনের প্রোগ্রাম, অর্থাৎ বাংলাদেশের সব পাবলিক ইউনিভার্সিটির সব শিক্ষক সমিতির সম্মিলিত একটি প্রোগ্রাম।

মানববন্ধনে দুটি দাবির কথা বলা হয়েছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে আলাদা বেতন স্কেল, দ্বিতীয়টি তাদের শিক্ষকতা জীবন বাড়িয়ে ৬৭ বছর করে দেওয়া! আমি এই দুটি দাবি নিয়ে আমার নিজের কথাগুলো বলতে চাই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কত? প্রকৃত সংখ্যাটি বলা রুচিহীন কাজ হবে, তাই অন্যভাবে বলি। আমি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক, আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন কোথাও চাকরি পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, আমি তখন তাদের জিজ্ঞেস করি, “তোমার বেতন আমার থেকে বেশি তো?”

তারা একটু লজ্জা পায় কিন্তু প্রায় সব সময়েই মাথা নেড়ে জানায় যে তাদের বেতন আমার থেকে বেশি! আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক, যতদূর জানি আমার বেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন। সত্যি মিথ্যা জানি না। শুনেছি সচিবালয়ের একজন মাঝারি আমলা তার গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার বেতন থেকে বেশি টাকা পান।

আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একবার গিয়েছিলাম, সেখানকার লেকচারাররা সবাই নিজের গাড়ি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের বেতন থেকে আনুমানিক চার গুণ বেশি! সেই দেশিটা সুঁই থেকে গাড়ি সবকিছুই নিজেরা তৈরি করে, তাই সে দেশে বেঁচে থাকার খরচ আমাদের থেকে কম।

অনেকদিন আগে আমি একবার পত্রিকায় লিখেছিলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের বেতন একজন গাড়ির ড্রাইভারের বেতন থেকে কম। মনে আছে পরের দিন একজন লেকচারার শুকনো মুখে আমার কাছে ছুটে এসেছিল, হাহাকার করে বলেছি, “স্যার, আপনার লেখা পড়ে আমার বিয়ে ভেঙে গেছে।”

তবে কেউ যেন ভুল না বুঝেন, বিয়ের বাজারে কদর কমে যাবে জেনেও কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ছাত্র এবং ছাত্রীরা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চায়। সম্ভবত এটাই হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি! তবে এই শক্তি কতদিন থাকবে আমি জানি না। একজন ছাত্র বা ছাত্রী সবার চাইতে ভালো পরীক্ষায় ফলাফল নিয়েও আজকাল আর নিশ্চিত হতে পারে না সে কি আসলেই শিক্ষক হতে পারবে কিনা। নিজের সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দলবাজি করে এমন শিক্ষকদের পাশে তাদের ঘুরঘুর করতে হয়।

নিয়োগ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যেদের পকেটে নিজেদের প্রার্থী থাকে। তারা সরাসরি একে অন্যের সঙ্গে দরদাম করেন। বলেন, “আমার একজনকে নেন, তাহলে আমি আপনার একজনকে নিতে দেব।” বাইরে ছাত্রনেতারা বসে থাকে, মন্ত্রীরা ফোন করে, সাংসদেরা হুমকি দেয়। তাই পত্রিকায় একজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও হালি হিসেবে শিক্ষক নিতে হয়। যারা সত্যিকারের ভালো মেধাবী শিক্ষক, তারা শেষ পর্যন্ত আরও ভালো জায়গায় চলে যায়, অপদার্থরা থেকে যায়। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপদার্থ শিক্ষকের আড্ডাখানা হয়ে যায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিয়ম খুবই উদার, বয়স হলেই লেকচারাররা দেখতে দেখতে প্রফেসর হয়ে যায়।

যাই হোক, আমি অবশ্যি শিক্ষকদের বেতন নিয়ে কথা বলতে বসেছি, তারা কি পদার্থ না অপদার্থ সেটা নিয়ে কথা বলতে বসিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এক সময় খুব সম্মানিত মানুষ ছিলেন, এখন আর সে রকম সম্মানী মানুষ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বললেই চোখের সামনে একজন জ্ঞানতাপস গবেষক এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের চেহারা ফুটে না উঠে কুটিল-কৌশলী-দলবাজ-রাজনৈতিক মানুষের চেহারা ফুটে উঠে।

যে চেহারাই ফুটুক, এই বেচারাদের সংসার খরচ চালাতে হয় খানিকটা ঠাট বজায় রাখতে হয়। সেজন্যে তাদের একটা সম্মানজনক বেতন দরকার। খুব উচ্চমহলে সেটা নিয়ে দেন দরবার করার পর একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটা মিলিয়ন ডলার উপদেশ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “আপনাদের বেতন বাড়ানোর কোনো রাস্তা নেই। পরীক্ষার খাতা-ফাতা দেখার সময় বেশি বেশি টাকা বিল করে কোনোভাবে পুষিয়ে নেন।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সে মিলিয়ন ডলার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তারা পরীক্ষার খাতা দেখার জন্যে টাকা নেন, পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার জন্যে টাকা নেন, ভাইভা নেওয়ার জন্যে টাকা নেন। পৃথিবীর সব দেশে পরীক্ষার খাতা একবার দেখা হয়, এই দেশে সেটা দুইবার দেখা হয়, কোনো কোনো সময় তিনবার!

আমি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পড়াই, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম সবসময় তক্কে তক্কে থাকতাম কীভাবে লেখাপড়া না করেই কাজ চালিয়ে দেওয়া যায়। আজকালকার ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা উন্নতি হয়নি। তারাও তক্কে তক্কে থাকে কীভাবে পড়াশোনা না করে ছাত্রজীবনটা ম্যানেজ করে ফেলা যায়। তাদেরকে জোর করে লেখাপড়া করানোর অমোঘ অস্ত্র হচ্ছে ঘন ঘন ক্লাস টেস্ট নেওয়া, আমি সেটা করি এবং আমার ধরনটা মুখে স্বীকার না করলেও আমার ছাত্রছাত্রীরা সে জন্যে কখনও আমাকে ক্ষমা করেনি।

খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি যে এখন নাকি ক্লাস টেস্ট নিলেও টাকা পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নানা ধরনের কমিটিতে থেকে কাজ করতে হয়। আজকাল দেখছি কমিটিতে বসে মিটিং করলেই একটা পেটমোটা খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়! আমি অপেক্ষা করে আছি কোনোদিন শুনতে পাব ক্লাস নিলেই এখন হাতে টাকার খাম ধরিয়ে দেওয়া হবে। এটাই শুধু বাকি আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাকা উপার্জনের সবচেয়ে সম্মানজনক এবং অনৈতিক পদ্ধতিটি হচ্ছে ভর্তিপরীক্ষা নামক প্রক্রিয়া থেকে টাকা উপার্জন। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একবার ভর্তিপরীক্ষার পর একেকজন শিক্ষক কত টাকা করে উপার্জন করেন তার তালিকাটি এক নজর দেখা উচিত। আমি বহুদিন থেকে সাংবাদিকদের বলে আসছি ভর্তিপরীক্ষা শেষ হবার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কে কোন কাজটুকু করার বিনিময়ে কত টাকা আয় করেছেন সেটা যেন প্রকাশ করে দেন। এটি একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ তথ্য হতে পারত।

আমার ধারণা আমাদের দেশের সাংবাদিকদের এখনও শিক্ষকদের জন্যে এক ধরনের সম্মানবোধ এবং মমতা আছে। তাই এই তথ্যগুলো কখনও প্রকাশ হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এত বড় সম্মানী মানুষেরা অল্প কিছু টাকা-পয়সার জন্যে এত ধরনের তুচ্ছ কাজ করেন, তার কারণ একটাই, তাদেরকে খুব অল্প বেতন এবং তার চাইতেও কম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে সম্ভবত তাদের আর কোনো উপায় নেই। তাই তারা যদি নিজেদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করেন, পথে নেমে দাবি-দাওয়া পেশ করেন ,তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।

আমি মনে করি তাদের দাবিটি খুবই যৌক্তিক কিন্তু তারপরও আমি কিন্তু সেই মানব বন্ধনে যোগ দিইনি। কেন যোগ দিইনি সেটি বলার জন্যে আমার এই বিশাল গৌরচন্দ্রিকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম হতে পারে কিন্তু তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ভাইস চ্যান্সেলররা, এই দেশের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। রিটায়ার করার পর তারা নানা দেশের হাই কমিশনার অ্যাম্বেসেডর হন। তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন। রাষ্ট্রের সব বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে তারা সদস্য থাকেন।

প্রশ্ন ফাঁস হবার পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থা লাইনে আনার জন্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে মিটিং ডেকেছিলেন আমি সেখানে বসে ডানে বামে যেদিকেই তাকিয়েছি সেদিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের দেখেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষদের দেখিনি। সেখানে কথাবার্তা যা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই বলেছেন। স্কুল-কলেজের লেখাপাড়ার সমস্যার কথা যখন আলোচনা হয়েছে সেটাও আলোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, যাদের প্রকৃত বাস্তব সমস্যা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

যারা এই দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন সেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যেন একটা গুরুত্বহীন জনগোষ্ঠী। তাদের কথা কে বলবে? কোথায় বলবে?

আমি মাঝে মাঝে একেবারে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি। তাদের জগৎটি প্রায় পরাবাস্তব জগতের মতো। যেভাবে তাদের দিন কাটাতে হয়, ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হয় সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ভোটার লিস্ট থেকে শুরু করে গ্রামে কতগুলো স্যানিটারি লেট্রিন আছে সেটাও তাদের করতে হয়। তারা কি যথেষ্ট বেতন পান? সেই বেতন নিয়ে তারা কি সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন? যদি না পারেন তাহলে তাদের বেতন বাড়ানোর কথা কে বলবে? কার কাছে বলবে? তাদের কথা কে শুনবে?

আমি বিশ্বাস করি তাদের কথাও আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বলতে হবে, কারণ আমরা একেবারে উপরের মহলে কথা বলার সুযোগ পাই, তারা পায় না। তাই আমি যখন হঠাৎ করে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের আলাদা একটা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করছেন, তখন আমার কেন জানি মনে হয় তারা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা বলছেন। দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়টুকু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঘাড়েই পড়েছে, তাদের দাবিটি হওয়া উচিত ছিল সকল শিক্ষকদের জন্যে। মানববন্ধন করা উচিত ছিল বাংলাদেমের সকল শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে নয়।

সত্যি কথা বরতে কী, আলাদা বেতন স্কেলে যদি শুরু করতে হয় তাহলে প্রথমে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দিয়েই শুরু করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দেশের শিক্ষার মান বাড়াতে চাই, হাই ফাই নূতন বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে হবে না, ভালো প্রাইমারি স্কুল দিয়েই করতে হবে।

অবশ্যি বলাবাহুল্য, এই পুরো দাবিটা আসলে এক ধরনের নিষ্ঠুর কৌতুকের মতো, আমরা সবাই জানি কখনও-ই এটা হবে না, ক্ষমতাশালী আমলারা গলা টিপে শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের দাবিটাকে শেষ করে দেবেন। শিক্ষক বললে যে মানুষগুলোর ছবি তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই মানুষগুলোর জন্যে তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়ার আগে রাস্তাঘাট তৈরি হবে, ব্রিজ তৈরি হবে, কলকারখানা হবে, এয়ারপোর্ট হবে, যুদ্ধজাহাজ হবে, ক্যান্টনমেন্ট হবে। দাবিটার আগে প্লেন হবে, বন্দর হবে, শুধু শিক্ষকদের বেতনটুকু হবে না। তাদেরকে সম্মানজনকভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে না।

কেমন করে হবে? বাংলাদেশ সরকার সারা পৃথিবীর সামনে অঙ্গীকার করেছিল যে এই দেশেরি জিডিপির শতকরা ৬ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ করবে। সেই অঙ্গীকার সরকার রাখেনি, এখন জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ হয়।

আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পিছনে এত কম টাকা খরচ করে না। সত্যি কথা বলতে কী, এত কম টাকা খরচ করার পরও আমরা যে কোনো এক ধরনের শিক্ষা পাচ্ছি সেটাই মনে হয় আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।

বাংলাদেশে যদি শুধুমাত্র একটা দাবি করতে হয় তাহলে সেটি হতে হবে এই বিষয়টি নিয়ে, দরকার হলে সব কিছু বন্ধ করে শিক্ষার জন্যে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।

শিক্ষকদের দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে তাদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করে দিতে হবে। আমি এর সরাসরি বিরুদ্ধে। অল্প কিছুদিন আগেও সেটা ছিল ৬০ বৎসর, কীভাবে কীভাবে সেটা জানি ৬৫ করিয়ে নেওয়া হল। সেটাতে এখনও অভ্যস্ত হইনি। এখন হঠাৎ করে দাবি উঠেছে সেটাকে ৬৭ করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী অন্য সবাইকে দাবি করে সেটা আদায় করতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত, তাদের কারও কাছ থেকে সেটা আদায় করতে হয় না, নিজেরা নিজেরাই সেটা নিজেদের জন্যে করে ফেলে। যতদূর জানি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেটা এর মাঝে করেও ফেলেছে। অন্যদের তাহলে দাবি তুলে সেটা আদায় করতে হবে কেন? নিজেরা নিজেরা করে ফেললেই পারে।

পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে পুরানোদের সরে গিয়ে নূতনদের জায়গা করে দিতে হয়। বুড়ো অধ্যাপকেরা যদি সরতে রাজি না হন, বছরের পর বছর নিজের চেয়ারটা জোর করে আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন তাহলে নূতনেরা কেমন করে দায়িত্ব নেবেন? যারা চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাদের কয়জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে তারা নিজেদের কাজকর্ম গবেষণা দিয়ে এই জায়গায় পৌঁছেছেন?

যারা সত্যিকারের ভালো অধ্যাপক তাদের সাহায্যটুকু নেওয়ার জন্যে একশ একটা উপায় বের করা যায়। সে জন্যে তাদের চাকরির বয়স ৬৭ করতে হয় না।

যখন শুনতে পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করার একটা পাঁয়তারা চলছে তখন আমার একজন অধ্যাপক বন্ধু আমাকে বিষয়টা বুঝিয়েছিল। সে বলেছিল, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক অমুক প্রফেসরের রিটায়ার করার সময় এসেছে, অবসরের বয়স ৬৭ করা না হলে তারা বিদায় হয়ে যাবে, ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স আর করতে পারবে না। পলিটিক্সের জন্যে তাদেরকে রাখতেই হবে, সেই জন্যে তাড়াহুড়ো করে চাকরির বয়স ৬৭ পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”

আমার অধ্যাপক বন্ধু আরও ভবিষ্যৎবাণী করল, বলল, “অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয় এখন বয়সসীমা ৬৭ করবে না, কারণ সেটা করা হলে অমুক অমুক প্রফেসরদের বিদায় করা যাবে না। তারা বিদায় হবার পর এটা ৬৭ করা হবে, কারণ তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। ভাইস চ্যান্সেলরদের বয়স কম, তাদের কোনো তাড়াহুড়া নেই!”

আমি বিশ্ববিদ্যালয় জটিল পলিটিক্স বুঝি না, তাই আমার অধ্যাপক বন্ধুর ভবিষ্য বাণীর মাঝে কতটুকু যুক্তি এবং কতটুকু টিটকারি ধরতে পারিনি। ভবিষ্যৎবাণীটুকু মিলে গেলে বুঝতে পারব, দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।

আপাতত আমি বলতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬৭ করে ফেলাটুকু হবে নেহায়েত স্বার্থপরের কাজ। শুধুমাত্র নিজেদের জন্যে আলাদা বেতন স্কেল দাবি করে যে স্বার্থপরের কাজ করেছি, নূতন প্রজন্মকে জায়গা করে না দিয়ে জোর করে চেয়ারটা ধরে রেখে সেই স্বার্থপরতাটুকু ষোল কলায় পূর্ণ করার আমি ঘোরতর বিরোধী।

আমার কথা কাউকে মানতে হবে না, শুনতে দোষ কী?

আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দেশে তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সারা দেশে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দুইজনের বেশি নেই বিষয়টি সংবাদপত্র খুব ফলাও করে প্রচার করেছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর অনেক বক্তব্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমি একমত নই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ার মতো যোগ্যতা ষোল কোটি মানুষের দেশে বলতে গেলে কারও-ই নেই– এ ব্যাপারটিতে তিনি যা বলেছেন আমি মোটামুটিভাবে তাঁর সাথে একমত।

আমি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখিনি, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্যে কী কী যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার খুঁটিনাটিও জানি না কিন্তু শুধুমাত্র কমন সেন্স ব্যবহার করে খুব জোর গলায় বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার যোগ্যতা এই দেশে অনেক ছেলেমেয়েরই আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের পড়ার মতো যোগ্যতা রাখে।

আমি যদি তাদের খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে তার দায়-দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের নয়, শিক্ষাব্যবস্থারও নয়, তার দায়-দায়িত্ব যারা খুঁজে বের করার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদের। আমরা সবাই জানি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তার ভেতরে থেকেও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিজেদের আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে, হাজার প্রতিবন্ধকতা দিয়েও তাদের ঠেকিয়ে রাখা যায় না। তাই আমি যখন পত্রপত্রিকায় দেখি সারা বাংলাদেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রছাত্রী দুইজনের বেশি নেই, আমি অত্যন্ত বিচলিত হই, আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীদের সারাদেশের সামনে হেয় করার এই দায়িত্বহীন প্রচারণা দেখে আমি ব্যথিত হই।

আমি মনে করি, পুরো বিষয়টি ঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করার জন্যে হাই কোর্ট থেকে একবার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল– আমি তখন তাদের ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি সেবার ভয়ংকর এক ধরনের আতংক নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের প্রতিটি কোনো কোনো গাইড বই থেকে নেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন করার কাজটি সহজ নয়– মান যাচাই করার পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন হয় এক রকম, ভর্তিপরীক্ষার জন্যে ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন হয় সম্পূর্ণ অন্য রকম। ছেঁকে নেওয়ার প্রশ্ন নিয়ে মান যাচাই করার চেষ্টা করা কোনোভাবেই সঠিক নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে যত খুশি সমালোচনা করা যেতে পারে কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের দক্ষতা নিয়ে বা মান নিয়ে সমালোচনা করলে সতর্কভাবে করতে হবে। তাদেরকে দায়িত্বহীনের মতো হতাশার পথে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

আমরা যারা পড়াই, প্রশ্ন করি, পরীক্ষা নিই– তারা সবাই জানি ইচ্ছে করলেই এমনভাবে প্রশ্ন করা সম্ভব ছাত্রছাত্রীরা যে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। ছাত্রছাত্রীদের আটকানো যদি আমাদের উদ্দেশ্য হয় কাজটি পানির মতো সহজ। আমরা কি সেটাই করতে চাই! আমরা, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার মান নিয়ে এত বড় বড় কথা বলি, সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান কোথায় সেটি নিয়ে যদি উল্টো ছাত্রছাত্রীরা আমাদের প্রশ্ন করে বসে, আমরা কি তার উত্তর দিতে পারব? আমরা তখন কোথায় গিয়ে আমাদের মুখ লুকাব?

ভর্তিপরীক্ষার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমাদের ভেতরে খুব আগ্রহ কী সম্মানবোধ কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। সংবাদপত্রগুলোকে আমি বহুদিন থেকে অনুরোধ করে আসছি তারা যেন একবার এই ভর্তিপ্রক্রিয়ায় (কিংবা ভর্তি-বাণিজ্য যেটাই বলি) ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কত টাকা আদায় করা হয়, তার ভেতর থেকে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করার জন্যে নানা কাজে কত টাকা খরচ হয় এবং কত টাকা সম্মানী হিসেবে শিক্ষকেরা ভাগাভাগি করে নেন তার একটা তালিকা প্রকাশ করেন, তাহলে ভর্তিপরীক্ষা নামের এই ভয়ংকর অমানবিক এবং চূড়ান্ত অস্বচ্ছ বিষয়টা সবার সামনে পরিস্কার হয়ে যাবে।

সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিতভাবে একটা ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার কথা বহুদিন থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। প্রকাশ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তার বিরোধিতা করে না, কিন্তু ঠিক সময়টিতে কেউ তার উদ্যোগ নেয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গত বছর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কাস পার্টি, যুব ইউনিয়ন, জাসদ এ রকম বামপন্থী দলগুলো তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সেটি বিএনপি-জামায়াতের হাতে তুলে দেয় (যারা এই বাক্যটি পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় আরও একবার বাক্যটা পড়ার অনুরোধ করছি)। পরীক্ষার দিন হরতাল ডাকা হবে এ রকম হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেওয়া হয়!

রাজনৈতিক দলগুলো যা-ই ভাবুক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ভর্তিপ্রক্রিয়াতে যত টাকাই উপার্জন করেন না কেন, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের নিয়ে যতই অহংকার করুক না কেন, আমি মনে করি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়া হচ্ছে এই দেশের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার নামে অমানবিক যন্ত্রণা (এবং নূতন যোগ হওয়া ‘অপমান’) বন্ধ করার একমাত্র উপায়।

এ ধরনের একটি প্রক্রিয়া কাজ করানোর জন্যে যা যা করা প্রয়োজন তার প্রত্যেকটা ধাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়েছে এবং কাজে লাগানো হয়েছে। প্রযুক্তিগত প্রত্যেকটা বিষয় সমাধান করা হয়েছে। (অর্থ উপার্জন কমে যাবে বলে যারা বলেন এটা করা সম্ভব না তাদেরকেও ভরসা দিয়ে বলা যায় তারা এই নূতন পদ্ধতিতেও যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারবেন!)

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত, তাই তারা কারও কথা শুনতে বাধ্য নয়। এতদিনে আমি টের পেয়ে গেছি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনও-ই নিজে থেকে এই ব্যাপারে এগিয়ে আসবে না!

আমার জানামতে, এখন একটি মাত্র পথ খোলা আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস- চ্যান্সেলরদের ডেকে একটি নির্দেশ দেন যে, সামনের বছর থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নিতে হবে, তাহলেই সেটি সম্ভব। তা না হলে সম্ভব নয়, ছাত্রছাত্রীদের বছরের পর বছর যন্ত্রণা কষ্ট আর অপমান সহ্য করে যেতে হবে।

আমাদের ভাইস চ্যান্সেলরা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন মানেন না, শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনতে রাজি নন, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অবাধ্য হওয়ার সাহস মনে হয় তাদের কারও-ই হবে না।

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে

 

স্বাধীনতা দিবস আসছে তাই মনটা ভালো ছিল, হঠাৎ করে দেখি মনটা ভালো নেই। স্বাধীনতা দিবসে লক্ষ মানুষ নিয়ে আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইব, এখন শুনছি সেই গান গাওয়ার জন্যে টাকা দিচ্ছে জামাতে ইসলামীর নিজেদের ইসলামী ব্যাংক।যে গানটির একটি কথা মুখে উচ্চারণ করার জন্য এই দেশের মানুষকে যারা চোখ বন্ধ করে জবাই করেছে তাদের দল এখন এই গানটি গাওয়ার জন্য টাকা দিবে আর সেই টাকা নিয়ে আমাদের গানটি গাইতে হবে, আমাদের কী এতোই অবস্থা খারাপ হয়েছে?

উদীচীকে দুই হাতে স্যালুট তারা বলে দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের টাকা দিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে তারা সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গাইবে না। আমাদের ভালোবাসার এই গানটির সম্মান রক্ষা করার জন্যে তাদের এই ভূমিকার কথা দেশের মানুষ অনেক শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখবে। আমি এখন পর্যন্ত যত তরুণ তরুণী কিশোর কিশোরীর সাথে কথা বলেছি তারা সবাই বলেছে অনেক আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে তারা এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটির জন্যে অপেক্ষা করছিল এখন তারা আর নিজের ভেতর উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছে না। আমাদের তরুণ প্রজন্ম কোনটি সঠিক কোনটি ভুল অনুভব করতে পারে দেখে আমি খুব আশান্বিত হয়েছি।

স্বাধীনতা দিবস আসছে এখন আমি মন খারাপ করা কথা বলতে চাই না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মত এতো সুন্দর একটি সঙ্গীত আর কোন দেশের আছে কী না আমার জানা নেই।

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম তাদের কাছে এই গানটির একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আবেদন আছে, তার একটি একটি চরণ যখন আমরা শুনি আমাদের চোখ ভিজে আসে। এটি যদি শুধু একটি গান হতো তাহলে সবাই নিজের মত করে গাইতে পারত, কিন্তু এখন এটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত তাই এটি এখন আর নিজের মত করে গাইতে পারব না। এটি শুদ্ধ ভাবে গাইতে হবে। আমি লক্ষ্য করেছি অনেক বড় অনুষ্ঠানেও এটি পুরোপুরি শুদ্ধভাবে গাওয়া হয় না, এক দুটি লাইন বাড়তি যোগ করে দেয়া হয়। গানটি কীভাবে গাইতে হবে শেখানোর জন্যে স্কুলের ছেলে মেয়েদের পাঠ্য বইয়ে সেটি লিখে দেয়া হয়েছে, আশা করছি এই প্রজন্ম যখন বড় হবে তখন তারা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটিকে ভালোবাসার সাথে সাথে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সঠিক ভাবে গাইবে।

এই লেখার সাথে আমি জাতীয় সঙ্গীতটি যেভাবে গাইতে হবে সেটি যুক্ত করে দিচ্ছি, খবরের কাগজ হলে কেটে সবাই যেন তার পকেটে রেখে দেয়। কপি করে অন্যকে দেয়। (আমার পকেটে সব সময় এর কপি থাকে!) ইন্টারনেট হলে এক কপি প্রিন্ট করে নিয়ে নেয়, নিজে রাখে, অন্যকে দেয়।

গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের পূর্ণপাঠ

আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ,
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস,
আমার প্রাণে
ও মা, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি,
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।

ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে-
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি
আমি কী দেখেছি মধুর হাসি।
সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।

কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো-
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে-

মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন
ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি।

সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।

শেষ করার আগে সরকারের কাছে অনুরোধ ইসলামী ব্যাংকের দেয়া টাকাটা যেন তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়-আমরা আমাদের প্রিয় জাতীয় সঙ্গীতটি ভালোবাসা দিয়ে মর্যাদা দিয়ে সম্মান দিয়ে গাইতে চাই। আমাদের আশাহত করবেন না- দোহাই আপনাদের।

 আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ (জুলাই ১৯, ২০১৩)

হুমায়ূন আহমেদ আমার বড় ভাই। তাকে নিয়ে নৈর্ব্যক্তিকভাবে কিছু লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যেটাই লিখি তার মাঝে ব্যক্তিগত কথা চলে আসবে। আশা করছি পাঠকেরা সেজন্য আমাকে ক্ষমা করবেন।

হুমায়ূন আহমেদ এই দেশের একজন বিখ্যাত মানুষ ছিল, বিখ্যাত মানুষেরা সবসময় দূরের মানুষ হয়। সাধারণ মানুষের কাছে তাদের পৌঁছানোর সুযোগ থাকে না। হুমায়ূন আহমেদ মনে হয় একমাত্র ব্যতিক্রম কম বয়সী তরুণেরা তার বই থেকে বই পড়া শিখেছে, যুবকেরা বৃষ্টি আর জোছনাকে ভালোবাসতে শিখেছে। তরুণীরা অবলীলায় প্রেমে পড়তে শিখেছে। সাধরণ মানুষেরা তার নাটক দেখে কখনো হেসে ব্যাকুল কিংবা কেঁদে আকুল হয়েছে।

(হুমায়ূন আহমেদ কঠিন বুদ্ধিজীবীদেরও নিরাশ করেনি, সে কীভাবে অপসাহিত্য রচনা করে সাহিত্য জগেক দূষিত করে দিচ্ছে তাদের সেটা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দিয়েছে।) হুমায়ূন আহমেদ শুধু বিখ্যাত হয়ে শেষ করে দেয়নি, সে অসম্ভব জনপ্রিয় একজন মানুষ ছিল। আমিও সেটা জানতাম, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কতো বিশাল ছিল সেটা আমি নিজেও কখনো কল্পনা করতে পারিনি। তার পরিমাপটা পেয়েছি সে চলে যাবার পর। (আমি জানি এটি এক ধরনের ছেলেমানুষী, কিন্তু মৃত্যু কথাটি কেন জানি বলতে পারি না। লিখতে পারি না।)

ছেলেবেলায় বাবা-মা আর ছয় ভাইবোন নিয়ে আমাদের যে সংসারটি ছিল সেটি ছিল প্রায় রূপকথার একটি সংসার। একাত্তরে বাবাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলার পর প্রথমবার আমরা সত্যিকারের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলাম। সেই দুঃসময়ে আমার মা কীভাবে বুক আগলে আমাদের রক্ষা করেছিলেন সেটি এখনো আমার কাছে রহস্যের মতো। পুরো সময়টা আমরা রীতিমত যুদ্ধ করে টিকে রইলাম। কেউ যদি সেই কাহিনীটুকু লিখে ফেলে সেটা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মতো হয়ে যাবে। তখন লেখাপড়া শেষ করার জন্য প্রথমে আমি তারপর হুমায়ূন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদ আগে, আমি তার অনেক পরে দেশে ফিরে এসেছি। হুমায়ূন আহমেদের আগেই সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি ছিল, ফিরে এসে সে যখন লেখালেখির পাশাপাশি টেলিভিশনের নাটক লেখা শুরু করল হঠাত্ করে তার জনপ্রিয়তা হয়ে গেলো আকাশছোঁয়া। দেশে ফিরে এসে প্রথমবার বই মেলায় গিয়ে তার জনপ্রিয়তার একটা নমুনা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম!

এতোদিনে আমাদের ভাইবোনেরা বড় হয়েছে, সবারই নিজেদের সংসার হয়েছে। বাবা নেই, মা আছেন, সবাইকে নিয়ে আবার নতুন এক ধরনের পরিবার। হুমায়ূন আহমেদের হাতে টাকা আসছে, সে খরচও করছে সেভাবে। ভাইবোন, তাদের স্বামী-স্ত্রী, ছেলেমেয়ে-সবাইকে নিয়ে সে দিল্লী না হয় নেপাল চলে যাচ্ছে। ঈদের দিন সবাই মিলে হৈ চৈ করছে। সবকিছু কেউ যদি গুছিয়ে লিখে ফেলে আবার সেটি একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। এবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস।

এক সময় আমাদের সেই হাসিখুশী জীবনে আবার বিপর্যয় নেমে এলো। তিন মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে আমার ভাবী আর হুমায়ূন আহমেদের বিয়ে ভেঙ্গে গেল। কেন ভেঙ্গে গেল, কীভাবে ভেঙ্গে গেল সেটি গোপন কোনো বিষয় নয়। দেশের সবাই সেটি জানে। আমি তখন একদিন হুমায়ূন আহমেদের সাথে দেখা করে তাকে বললাম, দেখো তুমি তো এ দেশের একজন খুব বিখ্যাত মানুষ, তোমার যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত তোমাকে দেখতে চলে আসেন। তোমার তুলনায় ভাবী তার ছেলেমেয়ে নিয়ে খুব অসহায়, তার কেউ নেই। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি টিংকুভাবীর সাথে থাকি? তোমার তো আর আমার সাহায্যের দরকার নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাবীর হয়তো সাহায্যের দরকার।

হুমায়ূন আহমেদ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে, তুই টিংকুর সাথে থাক।

সেই থেকে আমরা টিংকু ভাবীর সাথে ছিলাম, তার জন্য সেরকম কিছু করতে পারিনি, শুধু হয়তো মানসিকভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। ভাইয়ের স্ত্রী না হয়েও যেন আমাদের পরিবারের একজন হয়ে থাকতে পারে সবাই মিলে সেই চেষ্টা করেছি। খুব স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে হুমায়ূন আহমেদের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল। মায়ের কাছ থেকে তার খবর নিই। বেশিরভাগ সময় অবশ্যি খবরের কাগজেই তার খবর পেয়ে যাই। সে অনেক বিখ্যাত, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, তার জীবন অনেক বিচিত্র, সেই জীবনের কিছু কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে তার উপর যে অভিমান হয়নি তা নয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেনে নিয়েছি। পরিবর্তিত জীবনে তার চারপাশে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, তার অনেক বন্ধ,ু তার অনেক ক্ষমতা, তার এই নতুন জীবনে আমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি।

গত বছর এরকম সময়ে হঠাত্ করে মনে হল এখন তার পাশে আমার থাকা প্রয়োজন। ক্যান্সারের চিকিত্সা করার জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছে, সবকিছু ভালোভাবে হয়েছে। শেষ অপারেশনটি করার আগে দেশ থেকে ঘুরে গেল, সুস্থ সবল একজন মানুষ। যখন অপারেশন হয় প্রতি রাতে ফোন করে খোঁজ নিয়েছি, সফল অপারেশন করে ক্যান্সারমুক্ত সুস্থ একজন মানুষ বাসায় তার আপনজনের কাছে ফিরে গেছে, এখন শুধু দেশে ফিরে আসার অপেক্ষা। তারপর হঠাত্ করে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল, সার্জারী পরবর্তীতে অবিশ্বাস্য একটি জটিলতার কারণে তাকে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে হল। আমি আর আমার স্ত্রী চব্বিশ ঘন্টার নোটিশে নিউইয়র্কে হাজির হলাম। ব্রুকলিন নামের শহরে আমার ছেলেমেয়েরা আমাদের জন্য একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করে রেখেছে। সেখানে জিনিসপত্র রেখে বেলভিউ হাসপাতালে ছুটে গেলাম। প্রকাশক মাজহার আমাদের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে গেলেন, সেখানে তার স্ত্রী শাওনের সাথে দেখা হল। উঁচু বিছানায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে রেখেছে। তাকে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা একটু ভালো হলে তাকে জাগিয়ে তোলা হবে।

আমরা প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে হাসপাতালে যাই, সারাদিন সেখানে অপেক্ষা করি, গভীর রাতে ব্রুকলিনে ফিরে আসি। হুমায়ূন আহমেদকে আর জাগিয়ে তোলা হয় না। আমি এতো আশা করে দেশ থেকে ছুটে এসেছি তার হাত ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলব, অভিমানের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মুহূর্তে সেই দূরত্ব দূর হয়ে যাবে, কিন্তু সেই সুযোগটা পাই না। ইনটেনসিভ কেয়ারের ডাক্তারদের সাথে পরিচয় হয়েছে, ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, এতোদিনে তারা বিছানায় অসহায়ভাবে শুয়ে থাকা মানুষটির গুরুত্বের কথাও জেনে গেছে। তারা আমাকে বলল, হুমায়ূন আহমেদ ঘুমিয়ে থাকলেও তারা তোমাদের কথা শুনতে পায়। তার সাথে কথা বলো। তাই যখন আশেপাশে কেউ না থাকে তখন আমি তার সাথে কথা বলি। আমি তাকে বলি দেশের সব মানুষ, সব আপনজন তার ভালো হয়ে ওঠার জন্য দোয়া করছে। আমি তাকে মায়ের কথা বলি, ভাইবোনদের কথা বলি, ছেলেমেয়ের কথা বলি। সে যখন ভালো হয়ে যাবে তখন তার এই চেতন-অচেতন রহস্যময় জগতের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে কী অসাধারণ বই লিখতে পারবে তার কথা বলি। তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হলেও এটা যে স্বপ্ন নয় আমি তাকে মনে করিয়ে দিই, দেশ থেকে চলে এসে তখন আমি যে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি এটা যে সত্যি, সেটা তাকে বিশ্বাস করতে বলি।

ঘুমন্ত হুমায়ূন আহমেদ আমার কথা শুনতে পারছে কী না সেটা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি সে শুনছে, কারণ তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।

আমি অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকি।

একদিন হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিপাশা তার বাবাকে দেখতে এলো। যে কারণেই হোক বহুকাল তারা বাবার কাছে যেতে পারেনি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সে যখন গভীর মমতায় তার বাবার কপালে হাত রেখে তাকে ডাকল, কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে কথা বলল, আমরা দেখলাম আবার তার দুই চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন, মনে হয় সে জন্যই এই দুঃখগুলো দিতেও কখনো কার্পণ্য করেননি।

১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মত আমি হাসপাতালে গিয়েছি, ভোর বেলা হঠাত্ করে আমার মা আমাকে ফোন করলেন। ফোন ধরতেই আমার মা হাহাকার করে বললেন, আমার খুব অস্থির লাগছে। কী হয়েছে বল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হবে, কিছুই হয়নি। প্রত্যেকদিন যেরকম হাসপাতালে আসি আজকেও এসেছি। সবকিছু অন্যদিনের মতো, কোনো পার্থক্য নেই। আমার মায়ের অস্থিরতা তবুও যায় না, অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করে ফোনটা রেখেছি, ঠিক সাথে সাথে আমার কাছে খবর এলো আমি যেন এই মুহূর্তে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যাই। হুমায়ূন আহমেদ মারা যাচ্ছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তথ্য কেমন করে পাঠানো সম্ভব তার সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমি জানি। কিন্তু পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে একজন মা কেমন করে তার সন্তানের মৃত্যুক্ষণ নিজে থেকে বুঝে ফেলতে পারে আমার কাছে তার ব্যাখ্যা নেই।

আমি দ্রুত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের কেবিনে সকল ডাক্তার ভিড় করেছে, তার চিকিত্সার দায়িত্বে থাকা ড. মিলারও আছেন। আমাদের দেখে অন্যদের বললেন, আপনজনদের কাছে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এখন তাকে চলে যেতে দিতে হবে।

আমার স্ত্রী ইয়াসমিন আমাকে বলল, আমার মাকে খবরটা দিতে হবে। ১৯৭১ সালে আমি আমার মাকে আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে তার সারাটা জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতোদিন পর আবার আমি নিষ্ঠুরের মতো তাকে তার সন্তানের আসন্ন মৃত্যুর কথা বলব? আমি অবুঝের মতো বললাম, আমি পারব না। ইয়াসমীন তখন সেই নিষ্ঠুর দায়িত্বটি পালন করল, মুহূর্তে দেশে আমার মা, ভাইবোন সব আপনজনের হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সব স্বপ্ন, সব আশা এক ফুত্কারে নিভে গেল।

কেবিনের ভেতর উঁচু বিছানায় শুয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তার কাছে শাওন দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে ডেকে হুমায়ূন আহমেদকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে চাইছে। আমরা বোধশক্তিহীন মানুষের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে তরুণ ডাক্তার এতোদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে এসেছে সে বিষণ্ন গলায় আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল, বলল, আর খুব বেশি সময় নেই।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কী কষ্ট পাচ্ছে? তরুণ ডাক্তার বলল, না, কষ্ট পাচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেমন করে জান? সে বলল, আমরা জানি, তাকে আমরা যে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি তাতে তার কষ্ট হবার কথা নয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এরকম অবস্থা থেকে যখন কেউ ফিরে আসে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার এখন কেমন লাগছে? সে বলল, স্বপ্ন দেখার মতো। পুরো বিষয়টা তার কাছে মনে হচ্ছে একটা স্বপ্নের মতো।

একটু পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যদি কোনো জাদুমন্ত্র বলে হঠাত্ সে জ্ঞান ফিরে পায়, হঠাত্ সে বেঁচে উঠে তাহলে কী সে আবার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে বেঁচে থাকবে? তরুণ ডাক্তার বলল, এখন যদি জেগে উঠে তাহলে হবে, একটু পরে আর হবে না। তার ব্লাডপ্রেশার দ্রুত কমছে, তার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমছে, মস্তিষ্কের নিউরন সেল ধীরে ধীরে মারা যেতে শুরু করেছে।

আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কমবয়সী তরুণী একজন নার্স তার মাথার কাছে সবগুলো যন্ত্রপাতির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ মুহূর্তটি যেন কষ্টহীন হয় তার নিশ্চয়তা দেয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশে ঘিরে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো এতোদিন তাকে বাঁচিয়ে রেখে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে, একটি একটি যন্ত্র দেখাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে তার জীবনের চিহ্নগুলো মুছে যেতে শুরু করেছে। ব্লাড প্রেশার যখন আরো কমে এসেছে আমি তখন তরুণ ডাক্তারকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, এখন? এখন যদি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে উঠে তাহলে কী হবে? ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল, যদি এখন অলৌকিকভাবে তোমার ভাই জেগে উঠে সে আর আগের মানুষটি থাকবে না। তার মস্তিষ্কের মাঝে অনেক নিউরণ সেল মারা গেছে।

আমি নিঃশব্দে হুমায়ূন আহমেদকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় জানালাম। তার দেহটিতে এখনো জীবনের চিহ্ন আছে, কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটি শুয়ে আছে সে আর অসম্ভব সৃষ্টিশীল অসাধারণ প্রতিভাবান হুমায়ূন আহমেদ নয়। যে মস্তিষ্কটি তাকে অসম্ভব একজন সৃষ্টিশীল মানুষ করে রেখেছিল তার কাছে সেই মস্তিষ্কটি আর নেই। সেটি হারিয়ে গেছে।

তরুণ ডাক্তার একটু পর ফিসফিস করে বলল, এখন তার হূত্স্পন্দন অনিয়মিত হতে থাকবে। সত্যি সত্যি তার হূত্স্পন্দন অনিয়মিত হতে থাকলো। ডাক্তার একটু পর বলল, আর মাত্র কয়েক মিনিট।

আমি বোধশক্তিহীন মানুষের মত দাঁড়িয়েছিলাম। এবারে একটু কাছে গিয়ে তাকে ধরে রাখলাম। যে যন্ত্রটিতে এতোদিন তার হূত্স্পন্দন স্পন্দিত হয়ে এসেছে সেটা শেষবার একটা ঝাঁকুনি দিয়ে চিরদিনের মতো থেমে গেল। মনিটরে শুধু একটি সরল রেখা, আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর একটি সরল রেখা। হুমায়ূন আহমেদের দেহটা আমি ধরে রেখেছি, কিন্তু মানুষটি চলে গেছে।

ছোট একটি ঘরের ভেতর কী অচিন্তনীয় বেদনা এসে জমা হতে পারে আমি হতবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

আমি আর ইয়াসমিন ঢাকা ফিরেছি বাইশ তারিখ ভোরে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার আগেই অসংখ্য টেলিভিশন ক্যামেরা আমাদের ঘিরে ধরল। আমি নতুন করে বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদের জন্য শুধু তার আপনজনেরা নয়, পুরো দেশ শোকাহত।

এর পরের কয়েকদিনের ঘটনা আমি যেটুকু জানি এই দেশের মানুষ তার থেকে অনেক ভালো করে জানে। একজন লেখকের জন্য একটা জাতি এভাবে ব্যাকুল হতে পারে আমি নিজের চোখে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। কোথায় কবর দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্তটি শুধু আপনজনদের বিষয় থাকল না, হঠাত্ করে সেটি সারা দেশের সব মানুষের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। টেলিভিশনের সব চ্যানেল একান্তই একটা পারিবারিক বিষয় চব্বিশ ঘন্টা দেখিয়ে গেছে এতোদিন পরও আমার সেটা বিশ্বাস হয় না। পরে আমি অনেককে প্রশ্ন করে বুঝতে চেয়েছি এটা কী একটা স্বাভাবিক বিষয় নাকি মিডিয়ার তৈরি করা একটা কৃত্রিম হাইপ। সবাই বলেছে এটি হাইপ ছিল না, দেশের সব মানুষ সারাদিন সারারাত নিজের আগ্রহে টেলিভিশনের সামনে বসেছিল। একজন লেখকের জন্য এতো তীব্র ভালোবাসা মনে হয় শুধু এই দেশের মানুষের পক্ষেই সম্ভব।

হুমায়ূন আহমেদ কি শুধু জনপ্রিয় লেখক নাকি তার লেখালেখির সাহিত্য-মর্যাদাও আছে সেটি বিদগ্ধ মানুষের একটি প্রিয় আলোচনার বিষয়। আমি সেটি নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। কারো কাছে মনে হতে পারে দশ প্রজন্মের এক হাজার লোক একটি সাহিত্যকর্ম উপভোগ করলে সেটি সফল সাহিত্য! আবার কেউ মনে করতেই পারে তার দশ প্রজন্মের পাঠকের প্রয়োজন নেই, এক প্রজন্মের এক হাজার মানুষ পড়লেই সে সফল। কার ধারণা সঠিক সেটি কে বলবে? আমি নিজেও যেহেতু অল্পবিস্তর লেখালেখি করি তাই আমি জানি একজন লেখক কখনোই সাহিত্য সমালোচকের মন জয় করার জন্যে লিখেন না, তারা লিখেন মনের আনন্দে। যদি পাঠকেরা সেই লেখা গ্রহণ করে সেটি বাড়তি পাওয়া। হুমায়ুন আহমেদের লেখা শুধু যে পাঠকেরা গ্রহণ করছিল তা নয়, তার লেখা কয়েক প্রজন্মের পাঠক তৈরি করেছিল। বড় বড় সাহিত্য সমালোচকেরা তার লেখাকে আড়ালে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন কিন্তু ঈদ সংখ্যার আগে একটি লেখার জন্যে তার পিছনে ঘুরঘুর করেছেন- সেটি আমাদের সবার জন্যে একটি বড় কৌতুকের বিষয় ছিল। কয়েকদিন আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনী সংস্থার কর্ণধারের সাথে কথা হচ্ছিল, কথার ফাঁকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাদের কাছে কি হুমায়ূন আহমেদের কোনো বই আছে?”

প্রশ্নটি শুনে ভদ্রলোকের মুখটি কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। দুর্বল গলায় বললেন, হুমায়ূন আহমেদ যখন প্রথম লিখতে শুরু করেছে তখন সে তার একটা উপন্যাসের পান্ডুলিপি নিয়ে তাদের প্রকাশনীতে এসেছিল। তাদের প্রকাশনীতে বড় বড় জ্ঞানীগুণী মানুষ নিয়ে রিভিউ কমিটি ছিল, পান্ডুলিপি পড়ে রিভিউ কমিটি সুপারিশ করলেই শুধুমাত্র বইটি ছাপা হতো। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটি পড়ে রিভিউ কমিটি সেটাকে ছাপানোর অযোগ্য বলে বাতিল করে দিল। প্রকাশনীটি তাই সেই পান্ডুলিপি না ছাপিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে ফিরিয়ে দিয়েছিল!

গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনীটির কর্ণধারের মুখ দেখে আমি টের পেয়েছিলাম তিনি তার প্রকাশনীর রিভিউ কমিটির সেই জ্ঞানী-গুণী সদস্যদের কোনোদিন ক্ষমা করেননি। করার কথা নয়।

হুমায়ূন আহমেদ তিন শতাধিক বই লিখেছে, তার উপরেও গত বছরে সম্ভবত প্রায় সমান সংখ্যক বই লেখা হয়েছে। কতো বিচিত্র সেই বইয়ের বিষয়বস্তু। তার জন্য গভীর ভালোবাসা থেকে লেখা বই যেরকম আছে ঠিক সেরকম শুধুমাত্র টু-পাইস কামাই করার জন্যে লেখা বইয়েরও অভাব নেই। লেখক হিসেবে আমাদের পরিবারের কারো নাম দিয়ে গোপনে বই প্রকাশ করার চেষ্টা হয়েছে, শেষ মুহূর্তে থামানো হয়েছে এরকম ঘটনাও জানি। হুমায়ূন আহমেদ চলে যাবার পর মানুষের তীব্র ভালোবাসার কারণে ইন্টারনেটে নানা ধরনের আবেগের ছড়াছড়ি ছিল, সে কারণে মানুষজন গ্রেপ্তার পর্যন্ত হয়েছে, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে ছাড়াও পেয়েছে। তার মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা আছে, কাজেই কোনো কোনো বই যে বিতর্ক জন্ম দেবে তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। তাই আমি যখন দেখি কোনো বইয়ের বিরুদ্ধে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা বিবৃতি দিচ্ছেন, সেই বই নিষিদ্ধ করার জন্যে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে, আমি একটুও অবাক হই না। শুধু মাঝে মাঝে ভাবি হুমায়ূন আহমেদ যদি বেঁচে থাকতো তাহলে এই বিচিত্র কর্মকান্ড দেখে তার কী প্রতিক্রিয়া হতো?

কেউ যেন মনে না করে তাকে নিয়ে শুধু রাগ দুঃখ ক্ষোভ কিংবা ব্যবসা হচ্ছে, আমাদের চোখের আড়ালে তার জন্যে গভীর ভালোবাসার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগত্ রয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী ইয়াসমীন যখন হুমায়ূন আহমেদের পাশে থাকার জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম তখন একজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সে হুমায়ূন আহমেদের সেবা করার জন্যে তার কেবিনে বসে থাকতো। শেষ কয়েক সপ্তাহ যখন তাকে অচেতন করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো তখনো এই ছেলেটি সারারাত হাসপাতালে থাকতো। হুমায়ূন আহমেদ যখন আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখনো সে আমাদের সাথে ছিল। সেই দিন রাতে এক ধরনের ঘোর লাগা অবস্থায় আমরা যখন নিউইয়র্ক শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি তখনো এই ছেলেটি নিঃশব্দে আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটে গেছে।

দেশে ফিরে এসে মাঝে মাঝে তার সাথে যোগাযোগ হয়। শেষবার যখন তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে সে বলেছে এখনো মঝে মাঝে সে বেলভিউ হাসপাতালে গিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বসে থাকে।

কেন বসে থাকে আমি জানি না। আমার ধারণা সে নিজেও জানে না। শুধু এইটুকু জানি এই ধরনের অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। মনে হয় এই ভালোবাসাটুকুই হচ্ছে জীবন।

 আমেরিকা নিয়ে এক ডজন

আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে, অন্যরা পি.এইচ.ডি. করতে। এরা সবাই এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে জীবন হিসেবে বেছে নিলে পি.এইচ.ডি. করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি নিজেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার এই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেছে নেওয়ার আগে কোথায় কী ধরণের প্রোগ্রাম, কোন প্রফেসর কী গবেষণা করেন, তাদের র‌্যাংকিং কী রকম এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। আমার মনে আছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক করেছিলাম তার প্যাডের কাগজটি দেখে (না, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না)।

যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকাতে আঠারো বছর ছিলাম, এরপরেও অনেকবার যেতে হয়েছে, তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোনো বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র-ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো। আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল এরকম :

০১.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বা সহজ কথায় আমেরিকা) পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্যে সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু তাদের দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে সব দেশে হানাহানি খুনোখনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমিরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্যে সেটি চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়, তাই থাকার জন্যে, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্যে আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।

০২.
আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথে ঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পরে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।

০৩.
পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয়, সবার নামের দুটো অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্য এবং শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবুর রহমান) সেটা তারা জানে না। খেয়ালি বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা জানে না। একটু ঘনিষ্ঠ হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছু দিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদেরকে মোহাম্মদ বলে ডাকছে! তাই ঘনিষ্ঠদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায়, সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বরে দেওয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD লেখা খুবই বিপজ্জনক, তারা সেটাকে ডাক্তারি ডিগ্রি মনে করে সবসময়ই নামের পিছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

০৪.
যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায়, তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু তারা যখন খরচ করতে যায়, তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখামাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমড়ি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকেট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিমের কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সন্তানের পরিবারের জন্য সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা যারা এই দেশে বনানী গুলশানের হাইফাই দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ, এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে।) কাজেই অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে মনে মনে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।

আমেরিকায় কেনাকাটার আরেকটা বিষয় হচ্ছে ‘টিপস’, এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বখশিশ। কিন্তু বখশিশ শব্দটায় তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননার ছাপ রয়েছে। টিপস শব্দটিতে তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননা নেই। আমেরিকার মূলধারায় প্রায় সব তরুণ-তরুণী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে বড় হয়েছে। তখন তাদের বেতন বলতে গেলে ছিলই না এবং খদ্দেরদের টিপসটাই ছিল তাদের বেতন। সে দেশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, নাপিত বা ক্যাব ড্রাইভারকে টিপস দিতে হয়। হতচ্ছাড়া কিপটে মানুষদের হাত গলে ১০% টিপসও বের হতে চায় না, দয়াজদিল মানুষেরা দেয় ২০% আর মাঝঅমাঝি পরিমাণ হচ্ছে ১৫%।
কাজেই বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে কোথাও খেলে গেলে মেনুতে খাবারের দামটা দেখে আগেভাগেই তার সাথে ১৫% থেকে ২০% যোগ করে রাখাটা জরুরি।

০৫.
আমরা হাত দিয়ে ডাল-ভাত-সবজি-মাছ-মাংস মাখিয়ে মাখিয়ে খাই। আমেরিকা গিয়েও বাসার ভেতরে নিজে রান্না করে সবকিছু হাত দিয়ে খাওয়া যাবে। বাইরে হ্যামবার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা পিৎজা (উচ্চারণটা পিজ্জা নয়, পিৎজা) হাত দিয়ে খেতে পারলেও বেশিরভাগ খাবার ছুরি-কাটা ব্যবহার করে খেতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে খাবার জন্য চামচ দেওয়া হয়। ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু ডাইনিং টেবিলে চামচ নেই, শুধু ছুরি আর কাটা। কোন হাতে ছুরি, কোন হাতে কাটা ধরতে হয় সেরকম নানা ধরণের নিয়ম কানুন রয়েছে। সেই নিয়ম আবার ইউরোপে একরকম, আমেরিকায় অন্যরকম। কিন্তু মূল বিষয়টা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষ ডান হাতে কাজ করে এবং কাটাকাটি করতে একটু জোর লাগে, তাই ছুরিটা থাকবে ডান হাতে (এবং খাওয়ার প্রক্রিয়াতে সেটা কখনো মুখে ঢোকানো যাবে না, প্রয়োজনে আমি ডাইনিং টেবিলে অন্যের ছুরি ব্যবহার করতে দেখেছি।) এটাই নিয়ম। আমেরিকাতে কাটার জন্য কোনো নিয়ম নেই। যারা ডান হাতে কাজ করে অভ্যস্ত তারা ছুরি দিয়ে কাটাকাটি শেষ করে প্লেটে ছুরিটা রেখে ডান হাতে কাটাকা তুলে নিয়ে খায়। শুনেছি বিশুদ্ধ এরিস্টোক্রেট (বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভ্রান্ত। শব্দটি এরিস্টোক্রেসি পুরোটা ফুটে উঠে না, তাই আসল শব্দটাই ব্যবহার করতে হলো!) মানুষেরা মরে গেলেও ডান হাতে মুখে খাবার তুলে না। এই নিয়মগুলো কে করেছে এবং কেন এই নিয়মেই খেতে হবে, অন্য নিয়মে কেন খাওয়া যাবে না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে অনেক আমেরিকানরা কিন্তু চপ স্টিক (দুই টুকরো কাঠি) দিয়ে খেতে পারে। আমার ধারণা একবার চপ স্টিক দিয়ে খেতে শিখে গেলে খাওয়ার জন্য এটা খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি।

আমার কিছু আমেরিকান বন্ধু আমাদের দেখাদেখি হাতে খেতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আঙুল দিয়ে খাবার মাখিয়ে মুখ পযন্ত নিয়ে গেলেও মুখে সেই খাবার ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। পাঁচটা আঙুল মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে সেখানে খাবারটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে- কাজটা মোটামুটি অসম্ভব। যারা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, তাদেরকে বলে দেওয়া যায় আমরা কিন্তু মুখের ভেতর আঙুল ঢোকাই না, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবারটা মুখে ঢুকিয়ে দেই। অত্যন্ত দক্ষ একটা পদ্ধতি।

০৬.
খাবারের কথা বলতে হলেই পানীয়ের ব্যাপারটা তার সাথে সাথে চলে আসে। আমেরিকায় ট্যাপেয় পানি বিশুদ্ধ, তাই পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। শুনেছি নিউ ইয়র্কের মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে বিশাল আকারের সফট ড্রিংক বেআইনি করে দেওয়া হয়েছে! তবে এলকোহল জাতীয় পানীয় (সোজা বাংলায় মদ) নিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা যায়। যারা এটা খেতে চায় না, আমেরিকানরা কখনোই তাদেরকে সেটা খেতে জোরাজুরি করবে না। তবে মদ খাওয়া বাঙালিদের কথা আলাদা, তারা নিজেরা সেটা খায় বলে অন্যদের খাওয়ানোর জন্য বাড়াবাড়িতে ব্যস্ত থাকে। বাঙালিদের আসরে তারা অন্য বাঙালিদের জোর করে, তাদের চাপ দেয় এবং না খেলে তাকে নিয়ে টিটকারি-ঠাট্টা তামাশা করে। এর কারণটা কী, আমি এখনো বের করতে পারিনি।

০৭.
খাবার এবং পানীয়ের কথা বলা হলেই এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে টয়লেটের কথা বলা উচিত। লোকচক্ষুর আড়ালে এর খুটিনাটি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে কিন্তু ছাপার অক্ষরে কিছু লিখে ফেলাটা শোভন হবে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়টা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, আমরা যেভাবে শিখেছি!

০৮.
ডাইনিং টেবিল আর টয়লেটের পরে নিশ্চয়ই বাথরুমের ব্যাপারটা আসার কথা। নিজের বাসায় নিরিবিলি বাথরুমের মাঝে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমেরিকার গণ বাথরুমের মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমাকে আগে থেকে কেউ সতর্ক করে দেয়নি, তাই প্রথমবার যখন আমার ডর্মিটরির গণবাথরুমে একজন আমার সামনে জামা-কাপড় খুলে পুরোপুরি ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিল, সেই আতঙ্কের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না! এরপর অনেকদিন পার হয়েছে, আমি অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়েছি কিন্তু গণ-বাথরুমে উদাস মুখে শরীরে একটা সূতা ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দৃশ্যে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারিনি। এই জন্মে সেটা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।

ছেলেরা ছেলেদের সামনে এবং মেয়েরা মেয়েদের সামনে জামা-কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলতে কোনো লজ্জা অনুভব করে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে আমি কোনোদিন বুঝতে পারব না!

০৯.
আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে, তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিনস পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাসে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা, মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কখনো আমার স্যুট-টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না! আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমায় সেরকম জাযগায় যেতে হচ্ছে না।)

১০.
আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে, তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক। পান চিবুতে চিবুতে এদিক-সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেয়ালের কোনাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্য!) শুধু পানের পিক নয়, চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে কেউ অন্যায় মনে করে না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠার আগে এই অভ্যাসগুরো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে।)

একটা বড়সরো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারাল অনুষ্ঠানে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়।) তবে পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি, ঢেকুর এরকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায়, তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো। সেটা হচ্ছে- থ্যাংক ইউ। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ অনুভব করি, তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।

১১.
আমেরিকাতে তরুণ-তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না। কারণ তাহলে অন্যরা সেটাকে বিশেষ এক ধরণের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা-কাচ্চারা সেটা পড়ে ফেলে বলে খবর পেয়েছি –তাই এই বিষয়টাকে আর বিস্তৃত করা গেল না!)

১২.
আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটা বলার জন্য উপরের কথাগুলো একটি ভনিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবারে আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, সেটা একটা কৌতুকের মতো)। তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে, তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না। আমি আশায় আশায় থাকি, যে কোনোদিন এই দেশের সরকার একটি দুটি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে, আমার খুব ইচ্ছে তারা অত্যন্ত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক, এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।

আমাদের দেশ থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়ে সেখানে থেকে যায়, তাদেরকে আসলে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ কখনো ভুলতে পারে না যে, তারা এই দরিদ্র দেশটির মূলন্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিদানে তারা দেশকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকাকে (বা সেরকম কোনো একটা দেশকে) সেবা করে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে।

আরেক ভাগ মানুষ এই অপরাধ বোধ থেকে বের হওয়ার জন্য অত্যন্ত বিচিত্র একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। সেটা হচ্ছে- সবকিছুর জন্য নিজের দেশটিকেই দায়ী করা। তারা প্রতি মুহূর্তে দেশকে গালাগাল দেয়। তারা বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেয়, এই পোড়া দেশে জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণোর সুযোগ নেই, তাদের মেধা কিংবা প্রতিভা ব্যবহারের সুযোগ নেই, এই দেশে জন্ম হওয়াটাই অনেক বড় ভুল হয়েছিল। এখন আমেরিকাতে আসন গেড়ে সেই ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিজের দেশটি কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তার সমস্ত পরিসংখ্যান তাদের নখদর্পণে। দেশের অবিবেচক মানুষ কীভাবে রাজনীতি করে, হরতাল দিয়ে, সন্ত্রাস করে দুর্নীতি করে পুরো দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, সেটা তারা শুধু নিজেদের মাঝে নয়, বাইরের সবার সাথেও আলোচনা করে সময় কাটায়।

আমার যে ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে, তাদের এই স্বার্থপর অংশ থেকে সতর্ক থাকতে বলেছি। সম্ভব হলে একশ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছি। পৃথিবীতে যত রকম অনুভূতি আছে, তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে সেরা জিনিসটি হচ্ছে মাতৃভূমি। মাতৃভূমিটি যখন সবকিছুতে আদর্শ হয়ে উঠবে শুধু তখন থাকে ভালোবাসব আর যখন সেটা দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হবে তখন তাকে ভালোবাসব না, সেটা হতে পারে না। যে সব তেভাগারা নিজের দেশকে ভালোবাসার সেই মধুর অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি, আমি আজকাল তাদের জন্য করুণাও অনুভব করি না।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি ছিলাম সেখানকার একমাত্র বাংলাদেশি (দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে যে ছাত্রীটি এসেছিল, ঝটপট তাকেই আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম!)। এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাঙালি আছে, খাঁটি বাঙালি।

মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসী হওয়ার পর বাংলাদেশের সেই মানুষগুলোই হয়ে উঠে পরিবারের মানুষও, হয়ে উঠে আপনজন। সুখে-দুঃখে তারা পাশে থাকে, যখন দেশকে তীব্রভাবে মনে পড়ে তখন এই দেশের মানুষগুলোই তাদের সান্ত্বনা দেয়।

তখন কিন্তু একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুখে-দুঃখে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়েই সময় কাটাবে, নাকি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষগুলোর সাথেও একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? যারা শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গেই গল্প-গুজব, আড্ডা, রাজনীতি কিংবা অনেক সময় দলাদলি করে সময় কাটায়, তারা কিন্তু অনেক বিশাল একটা ক্যানভাসে নিজের জীবনটাকে বিস্তৃত করার একটা চমৎকার সুযোগ হারায়। একটা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা পৃথিবীর গণ্ডির মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কিন্তু অনেক বড় সুযোগ। কেউ যখন প্রথমবার আবিষ্কার করে গায়ের রং, মুখের ভাষা, ধর্ম, কালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সবাই যে হুবহু একই রকম মানুষ, সেটি অসাধারণ একটি অনুভূতি।

কাজেই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বারবার করে বলেছি, তারা যেন নিজের দেশের মানুষের পাশাপাশি আমেরিকার মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভিন্ন কালচারের বৈচিত্রের সৌর্ন্দয্যটা যেন উপভোগ করে। তারা যেন হাইকিং করে, জগিং করে, ক্যাম্পিং করে, হাজার হাজার মাইল ড্রাইভে করে ঘুরে বেড়ায়, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে বনেট খুলে ঠিক করে ফেলতে শিখে, তারা যেন তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে, সমুদ্রের নিচে স্কুবা ড্রাইভিং করে, ছবি আঁকতে শিখে, গান গাইতে শিখে, মিউজিয়ামে যায়, অপেরা দেখে, কনসার্টে যায় এক কথায় যে বৈচিত্রময় কাজগুলো কখনো করার সুযোগ পায়নি, সেইগুলো করে জীবনটাকে উপভোগ করে। (কেউ কী বিশ্বাস করবে আমার মতো একজন মানুষ পর্বতারোহণের ট্রেনিং নিয়ে আইস এক্স আর ক্লাইমিং রোপ হাতে তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে বরফের ওপর ক্যাম্প করে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি? পর্বতের চূড়ায় উঠে উল্লাসিত হয়েছি?)

কোনো কিছু থেকে কী সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে? আগে ছিল না, এখন আছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাজী নাফিসের ঘটনাটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের চেলাচামুণ্ডারা সেই দেশে আজকাল খুবই সক্রিয়। আমেরিকার সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তারা শুধু নিজেরা থাকে না, তাদের আগে পিছনের কয়েক প্রজন্মকে সেই দেশে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দেশটিকে তারা মনে করে কাফেরদের দেশ। ভিন্ন ধর্মের জন্য অবজ্ঞা দেখিয়ে যখন কেউ কাফেরদের দেশে থাকার কলাকৌশল শেখাতে এগিয়ে আসবে, তাদের থেকে সাবধান। ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন কালচার মানে খারাপ ধর্ম আর খারাপ কালচার নয়। ভিন্ন মানে বৈচিত্র আর বৈচিত্র হচ্ছে সৌন্দর্য্য। এটা যত তাড়াতাড়ি জানা যায়, ততই ভালো। যারা জানে না, তারা নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়। তাদের থেকে সাবধান।

আর সেই দেশে দীর্ঘ দিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে তখন কী করতে হবে?

তখন তারা আবার এই দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে দেশ মাতৃকাও ঠিক সেরকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে।

আমি বাড়িয়ে বলছি না –আমি এটা জানি।

ইতিহাসের ইতিহাস

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সবসময়েই আমার বুকের মাঝে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা কাজ করে। মাঝে মাঝেই পথেঘাটে রেল স্টেশনে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমার হয়তো একজন মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হয়, টুকটাক কথার পর হঠাৎ করে সেই মানুষটি বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা!” আমি তখন সব সময়েই দ্বিতীয়বার তাঁর হাত স্পর্শ করি এবং সেই মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষটির মাঝে আমি টগবগে তেজস্বী একজন তরুণকে খুঁজে পাই। আমি জানি সেই তরুণটি কিন্তু নিজের জীবনকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা সবাই জানি কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসের ভেতর আত্মসমর্পণ করেছিল, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিল তারা কিন্তু তখন সেটি জানত না। তারা সবাই কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করার জন্যেই গিয়েছিল। তাই সবসময়েই আমি মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির হাত স্পর্শ করে বলি, “থ্যাংকুু! আমাদেরকে একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে।”

মাঝে মাঝে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর সাথে আমার দেখা হয়, সে লাজুক মুখে আমাকে বলে, “আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা”, আমি তখন আবার তার মুখের দিকে তাকাই। তার লাজুক মুখের পিছনে তখন আমি তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব আর গৌরবের আলোটুকু খুঁজে পাই। আমি তখন তার বাবার খোঁজ-খবর নিই। বেশিরভাগ সময় আবিষ্কার করি তিনি আর বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকেন তাহলে আমি সেই তরুণ কিংবা তরুণীকে বলি তাঁর কাছে আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে।

একাত্তর সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, দেশ স্বাধীন হবার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে তখন আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তারাও ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে। কমবয়সী তরুণ কিন্তু এর মাঝে তাদের ভেতর কী বিস্ময়কর দেশের জন্যে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমি তাদের দেখি এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাই!

একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি, পিরোজপুরে মাঠে দুইএকদিন লেফট রাইট করা ছাড়া খুব লাভ হয়নি। আমার বাবাকে মেরে ফেলার পর পুরো পরিবারকে নিয়ে একেবারে বনের পশুর মতো দীর্ঘদিন দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। একটু স্থিতু হয়ে যখন বর্ড়ার পার হবার পরিকল্পনা করছি, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র তের দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেল– আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হল না। এই নিয়ে আমার ভেতরে বহুদিন একটা দুঃখবোধ কাজ করত এবং আমার বয়সী মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আমি হিংসায় জর্জরিত হতাম।

খুবই ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সেই (হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী) হিংসাটুকু গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে শিখেছি দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক য্ত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকি মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে কিন্তু আর কখনওই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাঁদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তাঁরাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়। (তাই আমি যখন দেখি, অল্প কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বের করে ফেলছে, তখন আমার মনে হয় গলায় আঙুল ঢুকিয়ে তাদের উপর হড় হড় করে বমি করে দিই!)

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভেতরে এখন গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি সব সময়ে চেষ্টা করে এসেছি নূতন প্রজন্মের ভেতর সেই অনুভূতিটুকু সঞ্চারিত করতে, যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পৌঁছে দিতে। একটি সময় ছিল যখন এই দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ত, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো হত, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হত– তখন এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর যে গভীর অভিমান জমা হয়েছিল আমি সেই কথা কখনও ভুলতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমরা সেই সময়টি পেছনে ফেলে এসেছি। এই দেশের মাটিতে আমরা আর কখনও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করতে চাই না।

তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে। এ কে খন্দকার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ষোলই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম তৈরি করে নূতনভাবে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং আমাদের তরুণেরা সেটা আগ্রহে গ্রহণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভালোবাসা এদেশে আবার নূতন করে প্রচারিত হয়েছে।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছেন। মনে আছে তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পথটুকু আমি গাড়িতে তাঁর পাশে বসে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এ রকম একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশে বসে আছি চিন্তা করেই আমি শিহরিত হয়েছিলাম। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলেছিলেন, তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমরা তাঁদের নিয়ে আমাদের একটা খোলা চত্বরে তাঁদের হাতে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম। এতদিনে গাছগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে অনেক বড় হয়েছে, আমরা সেই চত্বরটিকে ‘সেক্টর কমান্ডারস চত্বর’ বলে ডাকি।

সে কারণে যখন আমি দেখি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে তীব্র ভাষায় শুধু সমালোচনা নয় অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সেটি আমাকে তীব্রভাবে আহত করে। যারা তাঁকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করছেন, তারা কি বুঝতে পারছেন না এভাবে আসলে আমরা শুধু আমাদের নিজেদেরকেই না, আমরা মুক্তিযুদ্ধকেও অপমান করছি? তাঁর অবদানকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করছি? খবরের কাগজে দেখেছি বার্ধ্যকের কথা বলে তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, কাউকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না তাঁকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা, বিতর্ক এবং অপমানই হচ্ছে মূল কারণ। আমরা আমাদের দেশে একজন মানুষকে তাঁর নিজের মত প্রকাশের জন্যে এভাবে অসম্মান করব আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।

২.

এটি অবশ্য কেউ অস্বীকার করবে না যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমাদের সবারই কম বেশি মন খারাপ হয়েছে। আমরা সবাই আশা করেছিলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, সেটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু তিনি যেটুকু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তার থেকে বেশি ইতিহাসকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি একজন সৈনিক, তাঁর বিশ্লেষণ হয়েছে সৈনিকের চোখে, ইতিহাসবিদ সাধারণ মানুষ কিংবা রাজনৈতিক মানুষের সাথে তাঁর বিশ্লেষণ মিলবে তার গ্যারান্টি কোথায়?

সবচেয়ে বড় কথা এই বইয়ে তিনি যা লিখেছেন সেখানে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাগুলো ছাড়া অন্য সব কথাই কিন্তু আমরা সবাই অন্য জায়গায় শুনেছি। আমার দুঃখ হয় অন্য মানুষের মুখে আগে শুনে থাকা কথাগুলোর জন্যে আজকে তাঁর মতো একজন মানুষকে এত অসম্মান করা হল।

আমি মোটেই বইটি নিয়ে আলোচনা করব না, শুধু বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় নিয়ে করা বলব। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার লিখেছেন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণটি শেষ করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। হুবহু এই বিষয়টি লিখেছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইটিতে। তিনি অবশ্য ‘জয় পাকিস্তান’ লিখেননি, তিনি লিখেছিলেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’। পরবর্তী কোনো একটি সংস্করণে তিনি বই থেকে এই কথাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন, আমি ধরে নিচ্ছি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর এই তথ্যটি ভুল ছিল, তিনি ভুল সংশোধন করেছেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার যেহেতু দাবি করেননি তিনি নিজের কানে বঙ্গবন্ধুকে জয় পাকিস্তান বলতে শুনেছেন তাই আমি ধরে নিচ্ছি বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান যেখান থেকে এই তথ্যটি পেয়েছেন তিনিও সম্ভবত একই জায়গায় সেটি পেয়েছেন। এই বিচিত্র তথ্যসূত্রটি কী! আমার মনে হয় এর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন সৈয়দ বদরুল আহসান, ডেইলি স্টার পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণটি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচার করা হয়, তখন স্থানীয় পত্রিকাগুলো তাদের দেশের মানুষ কেন বিচলিত না হয় সে জন্যে বক্তৃতার শেষে এই কথাটুকু জুড়ে দিয়েছিল। সেই কথাটিই এখনও নানাজনের কথায় চলে এসেছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে। তিনি লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধের পরও তিনি একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। আমি ইতিহাসবিদ নই, আমি নির্মোহভাবে চিন্তা করতে পারি না কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ আছে, ছোটদের জন্যে ২২ পৃষ্ঠার একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্যে আমাকে অনেক বই পড়তে হয়েছিল! আমি পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার সিদ্দিক সালিকের বইয়ে দেখেছি তিনি লিখেছেন, পঁচিশে মার্চ রাতে খুবই ক্ষীণভাবে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল। ঘোষণাটি কোথা থেকে এসেছিল তার একটি ব্যাখ্যা তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের বইটিতে ( ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ , পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭) দেওয়া আছে। ট্রান্সমিটার বানানোতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন বলেই হয়তো পাকিস্তান মিলিটারির হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

যাই হোক, আমি আগেই বলেছি আমি আসলে এই বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে বসিনি। অনেকেই সেটা লিখছেন। সবচেয়ে বড় কথা, একাত্তরে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক দুটি শব্দ ছিল, এতদিন পর দুটি শব্দকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে কি বাংলাদেশের জন্ম হত?

৩.

আগেই বলেছি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়– আমার মতো অনেকেরই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মতো যে সব মানুষের এক ধরনের ছেলেমানুষী উচ্ছাস রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি মনে কষ্ট পেয়েছে। তবে আমার ধারণা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের, যে ভাষায় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমার ধারণা তিনি নিজেও নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে কথাগুলো ইতিহাসের সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছি সেই কথাগুলো তো বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর জন্যে আরও অনেকেই আগে এভাবে বলেছে– তাহলে এই বইয়ে সেটি লিখে কার লাভ হল?

আমিও ভাবছিলাম, কার লাভ হল, এখন হঠাৎ করে উপলব্ধি করেছি যে লাভ হয়েছে বইয়ের প্রকাশকের! বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা এবং তারা একটু পরে পরে বইটির বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটির বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খুবই স্থূলভাবে বলা যায়, এটি করে বই বিক্রি হচ্ছে, একজন সেই বই কিনছে, সেই বই পড়ছে আর মন খারাপ করছে আর ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর ক্যাশ বাক্সে একটু করে অর্থ যুক্ত হচ্ছে। আমি যদি একজন প্রকাশক হতাম তাহলে কি শুধুমাত্র কিছু অর্থ উপার্জন করার জন্যে এ রকম একটি বই প্রকাশ করে এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষটিকে এ রকম অসম্মানের দিকে ঠেলে দিতাম? কিছুতেই দিতাম না।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তাঁর মত প্রকাশ করার জন্য ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়ে বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্টে পেতে পারে বলে তিনি বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্যে সময় নেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে– একজন মানুষকে অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত অর্থ উপার্জন পৃথিবীর একমাত্র পথ নয়।

বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি খচখচ করছিল, বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের উপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতূহলটি মেটানোর জন্যে আমি ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম, তাদের কাছে অনুরোধ করলাম তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কি আমি এক নজর দেখতে পারি? তারা একটু ইতস্তত করে আমাকে জানালেন, সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তাদের কাছে নেই। কিছু আছে। তবে তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত সে রকম সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে।

আমি লেখালেখি করি, তাই এই উত্তর শুনে আমি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল এই বইটি কেমন করে লেখা হয়েছে কিংবা ‘প্রস্তুত’ করা হয়েছে সেটা খুব কৌতূহলউদ্দীপক একটা বিষয় হতে পারে। বই লেখা আর বই প্রস্তুত করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমরা কি ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর কাছ থেকে এই বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেতে পারি। আমাদের মনের সান্ত্বনার জন্য?

আমরা সবাই জানি এই বইটি লেখার জন্যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব দেবেন না আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে, খন্দকার মুশতাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী বলা হচ্ছে সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম।

কিন্তু সবার কাছে আমার একটি খুব সোজা একটি প্রশ্ন। এই বইটি লেখার দায়ভার কি শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কি খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন সেটি কেমন কথা? আমরা কি কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি?

হুবহু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে এবং আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই ঘটনাটি মনে আছে। ২০০৭ সাল ‘প্রথম আলো’র রম্য সাপ্তাহিকী ‘আলপিন’-এ একটা অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সেই নিরীহ কার্টুনটিকে একটা ইসলামবিরোধী রূপ দিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে দেয় এবং আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। শুধু তাই নয়, এটা প্রকাশ করার অপরাধে ‘আলপিন’-এর সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করা হল।

এখানেই শেষ নয় আমরা দেখলাম ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেলেন। (আমার ধারণা ছিল সংবাদপত্র আদর্শ এবং নীতির কাছে কখনও মাথা নত করে না, সেদিন আমার সেই ধারণাটিতে চোট খেয়েছিল।)

এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নাটকীয় ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম কোনো কিছু বিতর্কিত বা আপত্তিকর ছাপানো হলে লেখকের সাথে সাথে প্রকাশকদেরও সেই দায় গ্রহণ করতে হয়। আগে গ্রহণ করেছে।

আমার খুব ইচ্ছে আমাদের সবার কাছে সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের দায়ভার প্রকাশক খানিকটা হলেও গ্রহণ করে তাঁকে যেন তাঁর সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেয়।

ঈদ: এখন এবং তখন

১.
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন টেলিভিশন বলে কিছু ছিল না। তাই ঈদটি ছিল মাত্র একদিনের, সকালে শুরু হয়ে রাতে শেষ হয়ে যেত। এখন অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেল, মাত্র একদিনের ঈদে তাদের পোষানোর কথা না, তাই ঈদকে টেনে অনেক লম্বা করা হয়েছে। ‘ঈদের প্রথম দিন’, ‘ঈদের দ্বিতীয় দিন’ এভাবে চলতেই থাকে এবং প্রায় সপ্তাহখানেক পরেও আবিষ্কার করি ঈদ-উৎসব চলছে!

আনন্দকে টেনে লম্বা করার মাঝে দোষের কিছু নেই। কাজেই আমার ধারণা, ঈদ-উৎসবকে এভাবে সপ্তাহ বা দশ দিন করে ফেলার ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ঈদের উৎসবকে টেনে লম্বা করার কোনো উপায় ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, দিন শেষ হয়ে অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমাদের মনে দুঃখের অন্ধকার নেমে আসত এবং এত আনন্দের ঈদটি শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা চিন্তা করে আমরা রীতিমতো হাহাকার করতে থাকতাম।

আমার জানামতে, ঈদকে একটু লম্বা করে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত টেনে নেওয়ার প্রথম চেষ্টা করেছিল আমাদের বড় ভাই, হুমায়ূন আহমেদ। ঈদের অনেক আগেই সে ঘোষণা দিল, এখন থেকে ঈদের রাতে বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। কাজেই ঈদের আনন্দটা যে শুধুমাত্র ঈদের রাতে অনেকক্ষণ টেনে নেওয়া হল তাই নয়, ঈদের অনেক আগে থেকেই বিচিত্রানুষ্ঠানের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক এসবের রিহার্সেলের মাঝে এই আনন্দ শুরু হয়ে গেল। (টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ইচ্ছে করলে ঈদ-উৎসব ‘ঈদের আগের রাত’, ‘ঈদের আগের রাতের আগের রাত’ সেভাবেও ঠেলে দিতে পারে এবং আমি আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি সেটা বেশ ভালো কাজ করার কথা!)

ঈদের রাতে বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করার কারণে আমাদের ভাই-বোনদের ঈদ-উৎসবটি সব সময়েই একটা ভিন্ন মাত্রায় চলে যেত। অন্যেরা নূতন জামা পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খেয়েদেয়ে ঈদ শেষ করে ফেলত; আমরা তার সাথে নাচ, গান, কবিতা, নাটক এইসব যোগ করে সেটাকে আরও চমকপ্রদ করে ফেলতাম।

কেউ যেন মনে না করে এগুলো শুধু আমাদের পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান হত– মোটেও তা নয়। বাসায় বারান্দায় স্টেজ বানিয়ে পর্দা ফেলে রীতিমতো হুলুস্থূল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা হত। কোনো রকম প্রচার করা হত না, তারপরও অনুষ্ঠান শুরু করার সাথে সাথে এই এলাকার সবাই দর্শক হিসেবে চলে আসত এবং তারা ধৈর্য ধরে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করত। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সবকিছু পরিচালনা করত হুমায়ূন আহমেদ। শুধু যে পরিচালনা করত তা নয়, সে খুব সুন্দর অভিনয়ও করতে পারত।

ঈদের পরদিন আমরা সবাই মন খারাপ করে ঘুম থেকে উঠতাম। তবে সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হত আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলের। অবধারিতভাবে সব দর্শক মিলে পা দিয়ে মাতিয়ে ঈদের রাতে তার চমৎকার ফুলের বাগানটা তছনছ করে দিত। তবে সে জন্যে কখনও এই অনুষ্ঠান বন্ধ থাকেনি।

ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, কিন্তু যখন ছোট ছিলাম তখন কখনও-ই ধর্মীয় অংশটুকু চোখে পড়েনি– শুধুমাত্র আনন্দ আর উৎসবরের অংশটুকু চোখে পড়েছে। তবে মনে আছে, একবার ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি, নামাজের সময় খোতবা পড়া হচ্ছে, হঠাৎ একজন মানুষের ক্রুদ্ধ গালি-গালাজ শুনে তাকিয়ে দেখি ঈদের জামাতের পাশে একজন বিশালদেহী মানুষ লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি, দীর্ঘ পাঞ্জাবি পরনে আঙুল তুলে আমাদের অভিশাপ দিয়ে বলছে, আমাদের ক্ষমার অযোগ্য গুনাহের কারণে আমরা সবাই জাহান্নামে যাব!

আমি রীতিমতো আতঁকে উঠেছিলাম। বড়দের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, ঈদের চাঁদ উঠেছে কী উঠেনি সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে এবং মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক ভাগ আজকে ঈদ করছে, অন্যভাগ আগামীকাল। এই বিশালদেহী মানুষটি আগামীকাল ঈদ করার দলে। তার ধারণা, একদিন আগে ঈদ করে আমরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছি এবং তাই আমাদের রক্ষা করার জন্যে শেষ চেষ্টা করতে এসেছে!

যাই হোক, ঈদের জামাতে যারা ছিল তারা ব্যাপারটাকে সহজভাবেই নিল, তাই কোনো গোলমাল হল না। কিন্তু মাঝে মাঝেই গোলমাল লেগে যেত। এখন চাঁদ দেখার কমিটি হয়, তারা সবাই মিলে একটা ঘোষণা দেয়, তাই আগের মতো কোন দিন ঈদ হবে সেটা নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি থাকে না। তবে মজার ব্যাপার হল, তারপরও প্রতি বছর দেখি আমাদের দেশের কোথাও ঈদ উদযাপন করা হয় সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে– ব্যাপারটা কেন ঘটে এখনও আমি বুঝতে পারিনি।

এখানে বলে রাখা ভালো, চাঁদ পৃথিবীকে ঘিরে কীভাবে ঘুরছে সেটি এখন এত সুক্ষ্মভাবে জানা সম্ভব যে কেউ আকাশের দিকে না তাকিয়েই বলে দিতে পারে চাঁদটি আকাশের কোন জায়গায় কোন অবস্থায় আছে। (স্বীকার করছি এ কারণে ঈদের চাঁদ খুঁজে বের করার পুরো আনন্দটি মাটি হয়ে যাবার আশংকা আছে!)

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেশের মানুষের কাপড়-জামা খুব বেশি ছিল না। বেশিরভাগ মানুষ বছরে একবারই নূতন জামা-কাপড় কিনত আর সেটা হত ঈদের সময়। প্রতি ঈদে আমরা নূতন জামা-কাপড় পেতাম তা-ও নয়– কোনো কোনো ঈদে কেউ কেউ পেত, তাতেই আমরা মহাখুশি ছিলাম। একবার ঈদে আমাকে জুতো কিনে দেওয়া হল, ঈদের আগে সেই জুতো পরা ঠিক হবে না, কিন্তু পায়ে দিয়ে দেখতেও ইচ্ছে করে। জুতো পায়ে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে ময়লা হয়ে যাবে, তাই সেই জুতো পরে আমি বিছানায় হাঁটাহাঁটি করি! মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেটা দেখে কেউ অবাকও হয় না।

তখন লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের কালজয়ী বইগুলো আমরা পড়ছি, বাংলায় অনুবাদ করেছেন জাহানারা ইমাম, আমাদের সবায় প্রিয় বই ‘ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির’। (আমাদের শৈশবের এই প্রিয় বইগুলো যে জাহানারা ইমাম অনুবাদ করেছিলেন সেটি আমি জেনেছি বড় হয়ে, জাহানারা ইমাম মারা যাবার পর। এটা নিয়ে আমার ভেতরে খুব একটা আফসোস রয়ে গেছে। জাহানারা ইমাম আমার খুব প্রিয় মানুষ। আমেরিকায় থাকার সময় তাঁর খুব কাছাকাছি থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল, কত কিছু নিয়ে গল্প করেছি, কিন্তু তাকে কখনও ধন্যবাদ দিতে পারিনি এই অসাধারণ বইগুলো অনুবাদ করার জন্যে)।

যাই হোক, ‘ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির’ পড়ে আমরা জানতে পারলাম, ক্রিসমাসে শুধু যে নূতন কাপড় উপহার দেওয়া যায় তা নয়– অন্য কিছুও উপহার দেওয়া যায়। তাই একবার আমরা সব ভাই-বোনেরা মিলে ঠিক করলাম, ঈদে আমরা নূতন কাপড় পাই আর না পাই, আমরা নিজেরাই একে অন্যকে উপহার দিব! অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে ছোট ছোট উপহার দিয়ে ঈদের দিনে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলায় আবিষ্কার করেছিলাম, উপহার পাওয়ার থেকেও অনেক বেশি আনন্দ উপহার দেওয়াতে। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তারা ইচ্ছে করলেই ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখতে পারে।

তারপর দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেলাম। একসময় আবিষ্কার করেছি যে আমি দেশের বাইরে। আমার ছোট ছোট দুটি ছেলেমেয়ে আমেরিকার মাটিতে, তাদের হাজার রকম আনন্দ, কিন্তু ঈদ ব্যাপারটি তারা সত্যিকারভাবে কখনও দেখেনি! আমার ছেলেমেয়ে সত্যিকার অর্থে প্রথম ঈদ দেখেছে আমরা দেশে ফিরে আসার পর।

আঠারো বৎসর আগে যখন দেশ ছেড়ে গিয়েছিলাম তখন সবাই মিলে শুধুমাত্র টিকে থাকার সংগ্রাম করছি। যখন ফিরে এলাম তখন মোটামুটিভাবে সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ ততদিনে ‘হুমায়ূন আহমেদ’ হয়ে গেছে। সেই শৈশবে সে যে রকম আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ করত– এখন সে আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে সেই আনন্দ করে।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ‘সেলামি কালচার’ ছিল না, ফিরে এসে দেখি ‘সেলামি কালচার’ শুরু হয়ে গেছে। সালাম করলেই টাকা! বড় ভাই একটা নিয়ম করে দিয়েছে, যার যত বয়স তার দ্বিগুণ টাকা সেলামি দেওয়া হবে। একবার আমার বোনের মেয়ে, ঈদে ঢাকা নেই, তার বয়স সাত। কাজেই ঈদের সেলামি হিসেবে তাকে মানি অর্ডার করে সাত দ্বিগুণে চৌদ্দ টাকা পাঠিয়ে দিল। পিয়ন সেই টাকা পৌঁছে দিতে গিয়ে খুবই অবাক-– একজন মানুষ কেমন করে এত যন্ত্রণা করে মানি অর্ডারে মাত্র চৌদ্দ টাকা পাঠায়? কেন পাঠায়?

আমরা তখন বড় হয়ে গেছি, আমাদের পরের প্রজন্ম ছোট ছোট শিশু, ঈদের দিনে এখন তাদের দেখে আমরা আনন্দ পাই। ভাইবোন সবার বেশিরভাগই মেয়ে, ঈদের আনন্দ তাদের মনে হয় একটু বেশি। ঈদের আগের রাতে সবাই মিলে হাতে মেহেদি দেয়– আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই ছবি আকঁতে পারে, কাজেই হাতে মেহেদি দেওয়া যে রীতিমতো শিল্পকর্ম হয়ে যাবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। হাতে মেহেদি দিয়ে সেই মেহেদি হাতে নিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, ভোরবেলা দেখা হয় কার মেহেদির রঙ কত তীব্র হয়েছে। সেটা দেখেই তাদের আনন্দ।

ঈদের সারাটি দিন সবাই নানা কাজে ব্যস্ত, রাত্রিবেলা সবাই আমরা মায়ের কাছে হাজির হই। হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটে। বাসায় ফিরে যাবার আগে হুমায়ূন আহমেদ পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে টেবিলে রেখে বলে, এখন লটারি করে দেখা যাবে কে টাকাটা পায়। ছোট ছোট কাগজে সবার নাম লেখা হয়, কাজে সাহায্য করার মানুষ, গাড়ির ড্রাইভার কেউ বাকি থাকে না। তারপর একটি একটি করে সেই কাগজের টুকরোগুলো তোলা হয়। শেষ পর্যন্ত যার নামটা থেকে যায় সেই হচ্ছে বিজয়ী! এ রকম উত্তেজনার লটারি আমার জন্মে খুব বেশি দেখিনি!

এরপর আরও অনেক দিন কেটে গেছে, যারা ছোট ছোট শিশু ছিল তারাও বড় হয়ে যাচ্ছে। কারও কারও বিয়ে হয়েছে। তাদের বাচ্চারা এখন ঈদের আনন্দ করে, আর আমরা তাকিয়ে দেখি।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন লেখালেখি বা সাহিত্যের পুরো বিষয়টি ছিল কলকাতা-কেন্দ্রিক। পূজার সময় শারদীয় সংখ্যা বের হত আর আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করতাম। বলা যেতে পারে, আমাদের চোখের সামনে ‘ঈদ সংখ্যা’ নামে বিষয়টি শুরু হয়েছে এবং আজকাল সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে ঈদ সংখ্যার জন্যে অপেক্ষা করেন।

আমরা যারা অল্পবিস্তর লেখালেখি করে একটু পরিচিতি পেয়েছি ঈদের আগে আমাদের ঈদ সংখ্যায় লেখার জন্যে চাপ আসতে থাকে। পুরোটা যে সাহিত্যের জন্যে ভালোবাসার কারণে তা নয়, এর মাঝে বাণিজ্যের অংশটা প্রবল বলে আজকাল উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। টেলিভিশনে ঈদের নাটকের ফাঁকে ফাঁকে যে রকম বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, ঈদ সংখ্যার লেখার ফাঁকে ফাঁকে যে বিজ্ঞাপন থাকে সেটা কি সবাই লক্ষ্য করেছে!

ছেলেবেলায় ঈদের আগে যত্ন করে নিজের হাতে অনেক ঈদ কার্ড তৈরি করেছি, বেশিরভাগই ছোট বাচ্চাদের দেওয়ার জন্যে। তারাও আমাকে ঈদ কার্ড তৈরি করে দিয়েছে। আমার মনে হয় নিজের হাতে তৈরি করা ঈদ কার্ড পাওয়ার আনন্দ খুব বেশি মানুষের হয়নি, সেই হিসেবে আমি খুব সৌভাগ্যবান। এই দেশের ছোট ছোট বাচ্চারা এখনও নিয়মিতভাবে নিজের হাতে ঈদ কার্ড তৈরি করে আমাকে পাঠায়।

তবে যে বিষয়টি আগে একেবারেই ছিল না এখন প্রবলভাবে হয়েছে সেটি হচ্ছে, ঈদ উপলক্ষে পাঠানো এসএমএস। অন্যদের কথা জানি না, আমার ‘ঈদ এসএমএস’ পড়ে শেষ করতে কয়েকদিন লেগে যায়!

২.

এই লেখাটি যখন ছাপা হবে তখন ঈদ সবেমাত্র শেষ হয়েছে, তাই সবার জন্যে রইল ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদের শুভেচ্ছা কথাটি লিখতে গিয়েও আমি থমকে দাঁড়িয়েছি, আমি কি সবাইকে এই শুভেচ্ছাটি দিতে পারব! প্রতিদিন খবরের কাগজ অবরুদ্ধ গাজার স্বজনহারা ফুটফুটে শিশুদের আতঙ্কিত ছবি ছাপা হচ্ছে। (যখন এটি লিখছি তখন এক হাজারের বেশি মানুষকে ইজরায়েলি সৈন্যরা হত্যা করে ফেলেছে!) আমি যদি সেই শিশুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই তাহলে তারা কি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না?

তাদের চোখের সেই নিরব অভিশাপ থেকে নির্বিকার পৃথিবীর নির্বিকার মানুষ কখনও কি মুক্তি পাবে?

২৭.৭.১৪

এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)

১.

কাক কাকের গোশত খায় না- কিন্তু এবারে মনে হয় একটু খেতেই হবে। আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি না। কিন্তু এবারে মনে হয় করতেই হবে। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতো শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি, এই মুহূর্তে দয়া করে ১৫ দিনের জন্য দম নেওয়া হচ্ছে, তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।

আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভেতর কী সমস্যা, সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ; ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন, তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তার পরও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাঁদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন, সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে, সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হয়। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে, যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্র-পত্রিকার ইলেট্রনিক ভার্সন রয়েছে, সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠকরা আবার ভুল বানান ও অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! তাই সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্য ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মধ্যে আটকে রাখা গুরুতর অন্যায়। স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই; কিন্তু আমার ধারণা, দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এই কাজটি করছেন, আমার এই লেখা তাঁদের চোখে পড়বে কি না আমি জানি না। যদি পড়ে, তাহলে তাঁদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাঁদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। ১৫ দিন পর তাঁরা আবার যখন তাঁদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তাঁরা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন। তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা)?’ তখন তাঁরা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাঁকে আমরা দুই চোখে দেখতে পারি না। তাই তাঁকে আমরা তাঁর অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাঁকে আমরা বের হতে দিই না।’

আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি, তাতে আমার ধারণা, তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’

‘হ্যাঁ, জেলখানায় যে রকম কেউ বের হতে পারে না, সে রকম। তাঁকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’

বাক্যালাপের এ রকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’

‘তাদের আবার বলার কি আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গেছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেই নাই।’ বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’

শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ, উচিত শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে, তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয়, তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’

আমার ধারণা, শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা আলোচনার এ পর্যায়ে এক ধরনের আহত ও আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাদের বাবার (কিংবা মা) দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমার খুব জানার ইচ্ছে এবং আমি খুবই কৃতজ্ঞ হতাম যদি এই শিক্ষকদের কেউ আমাকে জানাতেন এ ধরনের একটা কথোপকথনের পর তাঁদের ছেলেমেয়েরা কী বলেছে?

২.

পৃথিবীর যেকোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী ও গুণী মানুষ, সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্ত বুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের একজন নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে, তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘আন্দোলন’। মনে হয়, আন্দোলন বলা হলেই পুরো বিষয়টাকে ন্যায়সংগত, প্রগতিশীল, সত্যের জন্য সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা গেল, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংগ্রামী সব নেতাকে আলোচনার জন্য তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোনো একজন মানুষকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখা হলে কাউকেই কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না, বরং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাঁদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান। সোজা কথায় এত বড় একটা অনৈতিক ও বেআইনি বিষয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়।

এ দেশে বিষয়টা অবশ্যি নতুন নয়, কাউকে জিম্মি করে কোনো একটা দাবি আদায় করে নেওয়া এ দেশের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যারা ভদ্রতা করে এটা করে না, তাদের মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি নিজের কানে এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘এমনিতে কাজ হবে না, গিয়ে ঘেরাও করো, রাস্তাঘাটে কিছু ভাঙচুর করো, তখন কর্তৃপক্ষের টনক লড়বে।’ তাই দাবি আদায়ের জন্য কাউকে জিম্মি করে ফেলা যে একটি বেআইনি কিংবা অত্যন্ত অমানবিক কাজ হতে পারে, সেটা কেউ মনে পর্যন্ত করে না।

শুধু যে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় এ ধরনের বেআইনি কাজকে নিজের অজান্তেই গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন তা নয়, আমাদের দেশের পত্র-পত্রিকাও তাঁদের কাজকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছে। তারা দুই পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের বক্তব্য দিতে দিচ্ছে, পত্রিকার পাশাপাশি পৃষ্ঠায় তাঁদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি, সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি সেটা দাবি করব না। আমি বহুকাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি। তাই একটা জিনিস জেনেছি, প্রকাশ্যে যে কথাগুলো বলা হয়, সেগুলো সব সময় পুরো কথা নয়, আসল কথা নয়। প্রকাশ্য কথার পেছনে অপ্রকাশ্য কথা থাকে, গোপন এজেন্ডা থাকে। অনেক সময় দেখা গেছে সেগুলোই মূল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অবরোধের ব্যাপারে কোনটা সত্যিকার কথা সেটা জানি না, তবে অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে, শাস্তি হবে। কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনকে তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে সেটা কোন দেশের বিচার?

১৫ দিন পর কী হবে আমরা জানি না। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুব ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হলো। কোনো একজন মানুষকে পছন্দ না হলে তাঁকে সরানোর জন্য কয়েকজন (কিংবা অনেকজন) মানুষ একত্র হয়ে তাঁকে একটা ঘরে আটকে ফেলতে পারবেন- এর জন্য কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, দেশের আইন তাঁদের স্পর্শ করবে না। যেসব শিক্ষক অপছন্দের মানুষকে ঘরের ভেতর আটকে ফেলার কালচার চালু করলেন, তাঁদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভাইস চ্যান্সেলর হবেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব খুব কঠিন দায়িত্ব। নিশ্চিতভাবেই তখন তাঁরা সবাইকে সমানভাবে খুশি করতে পারবেন না। তখন তাঁদের যখন অন্য শিক্ষকরা ঘরের মধ্যে বন্দি করে ফেলবেন, তখন তাঁরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন কি না জানার ইচ্ছে করে।

৩.

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন মনে হয় সেটা কারো মনে নেই। অনেকেরই ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিটি বুঝি তার নিজের সুখ-সুবিধার জন্য। নিজেদের ‘অধিকার’ আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় তাতেও কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, এ রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকরা তাঁদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন, সে রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভালো নয়, সারা দেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এই গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না।

৪.

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক এ রকম সময়ে মিলিটারি সরকার গ্রেপ্তার করে নিয়েছিল। তাঁর লেখা বইয়ে আমি পড়েছি, চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেওয়া হতো। তাই আমরা জানি, তাঁর জেল খাটার অভিজ্ঞতা ও মিলিটারি অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো রকমই আছে। আপাতত শিক্ষকদের চার দিনের রিমান্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন, ১৫ দিন পর যখন আবার শিক্ষকরা তাঁকে তাঁদের জেলখানা রিমান্ডে নিয়ে যাবেন, আমি আশা করছি তিনি যেন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করতে পারেন।

ছয় বছর আগে তাঁকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন আমি আর আমার স্ত্রী তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দিতে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ১৫ দিন পর যখন শিক্ষকরা তাঁকে ঘরে আটকে ফেলবেন, তখন হয়তো আমাদের আবার তাঁর বাসায় গিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দেওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি তাঁদের এবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
সূত্র: http://www.kalerkantho.com/national/2013/08/30/3859

এক দুই এবং তিন

১.

আমার ধারণা গত কয়েক সপ্তাহে এই দেশের সকল মানুষের বিশাল একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্যদের কথা জানি না, অনেক বিষয়ে আমার নিজেরই চোখ খুলে গেছে। যে বিষয়গুলো আগে আলাদা করে চোখে পড়েনি, আজকাল তার অনেক কিছুই চোখে পড়তে শুরু করেছে।

তবে রাজনীতি এখনও আমার কাছে অনেক জটিল বিষয়, অনেক কিছুই কমন সেন্সে মিলে না, তাই সবকিছু বুঝতে পারি না। তারপরেও আমি এই জটিল এবং দুর্বোধ্য বিষয়টাকে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছি এবং এই মূহুর্তে আমি মাত্র তিনটি মাপকাঠি দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নিজের কাছে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কাছে মাপকাঠিগুলো এ রকম–

প্রথমটি অবশ্যই বাংলাদেশকে নিয়ে। আজকাল মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় অনেকেই বুঝি বাংলাদেশের আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছেন। অনেকের ধারণা, গাছে পেকে যাবার পর আম যেভাবে টুপ করে নিচে এসে পড়ে, বাংলাদেশটাও বুঝি সেভাবে কেটে কেটে ঝাল মরিচ দিয়ে কিংবা চটকে চটকে দুধ দিয়ে কিংবা চিপে চিপে রস বের করে শুকিয়ে আমসত্ত বানিয়ে খেতে পারবে।

ব্যাপারটা মোটেও সে রকম নয়। বাংলাদেশটা আমরা পেয়েছি রীতিমতো একটা যুদ্ধ করে। আর সেটাও রাজায় রাজায় যুদ্ধ ছিল না, সেটা ছিল গণমানুষের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এই দেশের মানুষেরা যেভাবে প্রাণ দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই।

তাই যারা প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে এই দেশটা এনে দিয়েছে তারা যে স্বপ্ন দেখেছিল সেটাই হচ্ছে বাংলাদেশ। তাই এই দেশের রাজনীতি হোক, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান হোক, কোনো কিছুই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাইরে হতে পারবে না। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যারা এটিকে অস্বীকার করে তাদের এই দেশে রাজনীতি করা দূরে থাকুক, এই দেশের মাটিতে পা রাখার অধিকার নেই।

অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের বুকের ভেতরে এক ধরনের তীব্র আবেগ রয়েছে, কিন্তু কেউ যেন মনে না করে এটা শুধুমাত্র একটা অর্থহীন আবেগ। আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎটুকুও রয়েছে এই মুক্তিযুদ্ধে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল তখন এই দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হয়েছিল। এখন বাংলাদেশকে কেউ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে না।

পাশের দেশ ভারত এখন সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্কা দেবার সাহস রাখে। অমর্ত্য সেন সেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে বলেছেন, আমরা অনেক দিক দিয়ে ভারত থেকে এগিয়ে। বাংলাদেশের সাফল্যের রহস্যটি বোঝার জন্যে রীতিমতো একাডেমিক গবেষণা করা হয়। আর সেই গবেষণার ফলাফল আমাদের কাছে অবাক করা বিষয় নয়, আমরা সেটা বহুদিন থেকে জানি।

একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা আত্মবিশ্বাসী একটা জাতির পরিচয়; অন্যটি হচ্ছে হাজার বছর থেকে ঘরের ভেতর আটকে রাখা মেয়েদের ঘরের বাইরে এসে সবার সঙ্গে কাজ করতে দেওয়ার সুযোগ। কেউ কি লক্ষ্য করেছে, জামায়াতে ইসলামী আর হেফাজতে ইসলামের প্রধান অ্যালার্জি ঠিক এই দুটি বিষয়ে? যে দুটি শক্তি নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই, ঠিক সেই দুটি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা আমাদের পিছনে ঠেলে দিতে চায়?

কেউ যেন মনে না করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, আদর্শ, চেতনা এই বিষয়গুলো শুধু এক ধরনের আবেগ এবং মোটামুটি একটা বিমূর্ত বিষয়। আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুলো অনেক যত্ন করে তুলে ধরা হয়েছিল (কারও যদি কৌতূহল হয় তাহলে তারা বাহাত্তরের সংবিধানটি পড়ে দেখতে পারেন)। একটু একটু করে যখন সেই সংবিধানের কাটাছেঁড়া করা হয়েছে, প্রতিবার আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আবার আমরা একদিন সেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।

তাই যখন আমরা শুনতে পাই কেউ ঘোষণা করছে, বাহাত্তরের সংবিধানে এই দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি, তখন আমি অবাক হয়ে যাই। না, মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হই না, আমি অবাক হই রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা দেখে। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কখনও রাজনীতি করতে পারবে না। কেউ যদি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে তাহলে বুঝতে হবে এই মানুষটির আর যে ক্ষমতাই থাকুক বাংলাদেশের মানুষকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে তার রাজনৈতিক দলের সম্পদ নয়, তার দলের বোঝা, তার দলের জঞ্জাল।

গত কয়েক সপ্তাহে আমি সেসব বিষয় জানতে পেরেছি তার একটা আমার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতি কিছু বিদেশি কূটনীতিকদের অসম্মানজনক ব্যবহার। বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্যের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমি একদিন বিদেশ ত্যাগ করে নিজের দেশে চলে এসেছিলাম। এখন সেই আমার দেশেই সেই বিদেশি কূটনীতিকদের অপমান সহ্য করতে হয়! আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না যে তাদের একটা দল বিজয় দিবসে আমাদের স্মৃতিসৌধে যায়নি।

আমি যতদূর জানি, আমাদের বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের সাহায্যের ওপর সেভাবে নির্ভর করে না। এখনও এদেশে নিশ্চয়ই অনেক টাকা-পয়সা আসে এবং সেগুলো আসে বিভিন্ন এনজিও-এর কাছে। আমি এ রকম একটা এনজিও-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরদের একজন সদস্য হিসেবে তাদের বড় কর্মকর্তার বেতন ঠিক করে দিয়েছিলাম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর হিসেবে আমি তখন যত বেতন পাই সেই বেতনটি ছিল তার চার থেকে পাঁচ গুণ।

কাজেই এনজিও-এর কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই ভালোই থাকেন এবং যে দেশ থেকে তাদের বেতন-ভাতা আসে সেই দেশের প্রতি তাদের নিশ্চয়ই এক ধরনের কৃতজ্ঞতা থাকে। কাজেই সেই দেশের এজেন্ডাগুলো নিশ্চয়ই সোজাসুজি কিংবা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়নের একটা চাপ থাকে। তাই তারা তাদের নির্ধারিত কাজ ছাড়াও বাড়তি কাজ করেন। এই দেশের মানুষকে ফ্রি উপদেশ দেন।

সেটি সমস্যা নয়, আমরা সবাই উপদেশ দিতে পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দেশটি ভয়ংকর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত। মানুষকে পুড়িয়ে মারার হোলি উৎসব চলছে। রেললাইন তুলে ফেলে ট্রেন ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা কেটে ফেলা হচ্ছে। পুলিশকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আমাদের এনজিও কর্মকর্তারা এই ভয়ংকর সন্ত্রাস বন্ধ করার কথা বললেন না, তারা সরকারকে নির্বাচন বন্ধ করার উপদেশ দিলেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্যে এই দেশে ভয়ংকর সন্ত্রাস চলছিল, তাই প্রকারান্তরে তারা সন্ত্রাসেরই পক্ষ নিলেন।

এই ব্যাপারটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি জানি আমাদের দেশের এনজিওগুলো অসাধারণ কাজ করে। আমি তাদের অনেকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য। তারা মাঝে মাঝে আমাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছে, বিদেশিদের টাকা দিয়ে চলছে এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেটে ফেলার সময় হয়েছে।

আমার শ্রমটুকু হয়তো দেওয়া উচিত দীনহীন দুর্বল প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবকদের। তারা নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তারা যতই দুর্বল হোক, তারা আমার দেশের প্রতিষ্ঠান। যারা আমার দেশকে অপমান করে, তাদের কাছ থেকে তারা কোনো টাকা নেয় না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই এক ধরনের গৌরব আছে।

এই দেশের রাজনীতিতে আমার চাওয়া খুবই কম। যে দলটি দেশ চালাবে সে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাসী। একই সঙ্গে যে দলটি বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেটিও হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। শুধু এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের সকল মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। সরকার পরিবর্তন হলেও কারও মনে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা থাকবে না। একটি ভিন্ন দল দেশকে চালানোর দায়িত্ব পাবে, কিন্তু দেশটুকু অগ্রসর হবে একই গতিতে।

অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাস করে না, তার এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।

দ্বিতীয় মাপকাঠিটি নিয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষজনের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার। গত কয়েকদিন এই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে আঘাত নেমে এসেছে, তার চাইতে লজ্জা এবং অপমানের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি, তাই এই দেশে আমার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আছে, আমার তো একটি হিন্দু পরিবারেও জন্ম হতে পারত। আমি কোথায় জন্ম নেব সেখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই।

একটি শিশু ঘটনাক্রমে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে বলে তার জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না, আমরা কেমন করে সেটি ঘটতে দিলাম? খবরের কাগজে যখন একজন ভীত মায়ের কোলে একজন শিুশুর অসহায় মুখটি দেখি, আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হয়, এর জন্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আমরাই দায়ী।

যারা এটি করে তাদের মস্তিস্ক কীভাবে কাজ করে আমার জানা নেই। এর মাঝে শুধু যে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আছে তা নয়, একটা হিন্দু পরিবারকে কোনোভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করতে পারলে তার জায়গাটা দখল করে নেওয়ার সুযোগ আছে। সেই ব্যাপারটিতে শুধু জামাত-বিএনপি আছে তা নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছবিও ছাপা হয়।

কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া না হয় কিংবা যতক্ষণ পর্যন্ত এ রকম ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে সেই বিষয়টা নিশ্চিত করা না হয়, এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আমাদের ক্ষমা করবেন না। শুধুমাত্র পুলিশ-র‌্যাব দিয়ে বাড়ি পাহারা দিয়ে তাদেরকে রক্ষা করার পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। আসলে সেই এলাকার মানুষজনকেও দায়িত্ব নিতে হবে। আগে একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনগুলো এগুলো করত; এখন সেটি আর ঘটতে দেখি না। এখন আমরা ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটতে দিই; তারপর সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় শহরে একটা মানব বন্ধন বা একটা সেমিনার করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলি।

আমাদের আরও এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা-ভাবনারও পরিবর্তন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ কী ভাবছে সেটা বোঝার জন্যে তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হত। এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো হওয়ার কারণে কাজটা সহজ হয়েছে। কে কী ভাবছে সেটা নেটওয়ার্কে তাদের কথাবার্তা, মন্তব্য দেখে বোঝা যায়।

আমরা এক ধরনের আতংক নিয়ে লক্ষ্য করেছি, আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষিত মার্জিত রুচিশীল অনেক মানুষের ভেতরটাও আসলে কুৎসিত সাম্প্রদায়িক ভাবনা দিয়ে অন্ধকার হয়ে আছে। আমার উনিশশ একাত্তর সালের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। একটা অসহায় হিন্দু পরিবার প্রাণ বাচাঁনোর জন্য ছুটে যাচ্ছে। আমার মা তাদের একটু অর্থসাহায্য করার চেষ্টা করলেন। আমরা যে পরিবারের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি তাদের একজন আমার মাকে বললেন, “বির্ধমী মানুষকে সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হবে না। যদি সাহায্য করতেই চান তাহলে একজন বিপদগ্রস্ত মুসলমানকে সাহায্য করেন।” শুনে শুধু আমার মা নন, আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেলাম!

সেই তেতাল্লিশ বছর আগের এই দেশের কিছু কিছু মানুষের চিন্তা-ভাবনার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়তো নিজে নিজে কোনো কিছুরই পরিবর্তন হয় না, পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হয়। আমাদের দেশে যেন ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মানুষের সংখ্যা বাড়তে না থাকে সেজন্যে আমাদের হয়তো দীর্ঘ সময়ের একটা পরিকল্পনা করতে হবে।

স্কুলের বাচ্চাদের জীবনটা শুরু করতে হবে সকল ধর্মের জন্যে ভালোবাসার কথা শুনে। শিল্পী-সাহিত্যিক-কবিদের হয়তো বলতে হবে মানুষের কথা, মানুষে মানুষে যে কোনো ভেদাভেদ নেই সেই সত্যটির কথা। টেলিভিশনে নাটক লিখতে হবে, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, একজন মানুষ নিজে অসাম্প্রদায়িক হলেই চলবে না, দায়িত্ব নিতে হবে তার আশেপাশে যারা আছে সবাইকে অসাম্প্রদায়িকতার সৌন্দর্যটুকু বোঝানোর।

তাই আমি এখন অত্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব এই দেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দেওয়া যেন তারাও এই দেশটিকে তাদের নিজের দেশ বলে ভাবতে পারে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ না হলে ক্ষতি নেই, পদ্মা সেতু না হলেও ক্ষতি নেই, যানজটমুক্ত বাংলাদেশ না হলেও ক্ষতি নেই, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রবাহ না হলেও ক্ষতি নেই যদি এই সরকার (কিংবা অন্য যে কোনো সরকার) এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অন্য ধর্মাবলম্বী সকল মানুষদের একটি নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার দেশ উপহার দিতে পারে।

আমার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের উপর বিশ্বাস এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গীকারের পর তৃতীয় মাপমাঠিটি হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম নৈতিকতা। যে মানুষটি রাজনীতি করবে তাকে সৎ হতে হবে এবং এর মাঝে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এবারে নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকাগুলো তাদের নিজেদের দেওয়া হিসাবগুলোই হুবহু ছাপিয়ে দিয়েছিল। আর সেটা নিয়ে শুধু সারাদেশ নয়, সামাজিক নেটওয়ার্কের কল্যাণে সারা পৃথিবীতেই বিশাল একটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

যারা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তারা প্রথমে তথ্যগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারপর নানাভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু খুব একটা লাভ হয়নি। সাধারণ মানুষ বুঝতে ভুল করে না। সবচেয়ে বড় কথা, যাদেরকে সবাই সৎ মানুষ বলে জানে তাদের সম্পদ তো হঠাৎ করে বেড়ে যায়নি, তাদেরকে তো কিছু ব্যাখ্যাও করতে হয়নি। তাই আসলে কী ঘটেছে সবাই বুঝে গেছে।

কিছুদিন আগে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সময় অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কোথাও নির্বাচিত হতে পারেননি। এটাকে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের ফর্মুলা দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও সত্যি কথাটি হচ্ছে, সাধারণ মানুষ তাদের ভোট দেয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, যোগাযোগ এ রকম ব্যাপারগুলোতে সরকার যথেষ্ট ভালো কাজ করলেও কেন তাদের কেউ ভোট দিল না সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল।

আমার কোনো গোপন সূত্র নেই কিন্তু পরিচিত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলে মোটামুটিভাবে বোঝা গেছে, সাধারণ মানুষ তাদের আশেপাশে যেসব ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দেখেছে– দৈনদিন জীবনে তাদের কারণে যে সব হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছে– দুর্নীতি-চাঁদাবাজির শিকার হতে হয়েছে– সেগুলো তাদের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। একটা পদ্মা সেতু এবং হাজারটা হল-মার্ক কেলেংকারি আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করেছে, একটি বিশ্বজিৎ হত্যা তার থেকে বেশি ক্ষতি করেছে।

দুর্নীতি কিংবা অসততার কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা রাজনীতি করে তাদের সৎ হতেই হবে। এটি নূতন পৃথিবী, কোনো কিছুই আর গোপন থাকে না। কে দুর্নীতিবাজ, কে সন্ত্রাসী, কে গডফাদার– সামাজিক নেটওয়ার্ক দিয়ে সেটা মূহুর্তের মাঝে সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে যায়। কাজেই আমাদের আগামী বাংলাদেশে আমরা আর দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা দেখতে চাই না।

২.

আমি কী চাই সেটা আমি নিজেকে বলতে পারি, যারা আমার পরিচিত তাদেরকে বলতে পারি, যারা আমার কথা শুনতে চায় তাদেরকে জোর করে শোনাতে পারি। কিন্তু যাদের কাছে আমরা সেটা চাই, সেই রাজনীতিবিদরা কি আমাদের সেটা দেবে? তারা কী আমাদের চাওয়া-পাওয়াকে কোনো গুরুত্ব দেয়?

দেওয়ার কথা নয়। ভুল হোক শুদ্ধ হোক, তাদের অনেক আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পৌঁছেছে। আমরা দিল্লির নির্বাচনে দেখেছি ‘আম আদমী পার্টি’ নামে একটা তরুণদের রাজনৈতিক দল সব হিসেব ওলটপালট করে ক্ষমতায় চলে এসেছে। যেহেতু বাংলাদেশে বিশাল একটা তরুণের দল আছে, অনেক হিসেবে তার ভারতবর্ষের তরুণদের থেকে বেশি রাজনীতিসচেতন– তাই তারা চাইলেও কি এই দেশের রাজনীতির জগতেও একটা ওলটপালট করে ফেলার ক্ষমতা রাখে না?

আমাদের এত কষ্টের, এত ভালোবাসায় দেশকে আমরা যেভাবে চাই যদি সেভাবে গড়ে তোলা না হয় তাহলে কি এই দেশেও নূতন একটা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে না যার চালক হবে নূতন প্রজন্ম? আগামী এক, দুই, পাঁচ বছরে না হোক– তার পরেও কি হতে পারে না?

তাদের তো হারানোর কিছু নেই, দেওয়ার অনেক কিছু আছে।

১৫.১.২০১৪

একজন অনয়ের গল্প

০১.

ঘুম থেকে উঠেই আমার মনে পড়ল, আজকের দিনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সেটা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমার সকাল সাড়ে এগারোটার সময় একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে। ঢাকা শহরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে কতটুকু সময় লাগবে তার কোনো বাধা-ধরা নিয়ম নেই। এ সম্পর্কে একজন একটা থিওরি দিয়েছে, সেটা এরকম- ঢাকা শহরে গাড়ি করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। রিকশায় গেলে দুই ঘণ্টা আর হেঁটে গেলে সময়টাকে এক ঘণ্টায় নামিয়ে আনা যায়।

আমি গাড়ি করে যাব, তাই আমার তিন ঘণ্টা হাতে নিয়ে বের হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি আশাবাদী মানুষ, তাই দেড় ঘণ্টা সময় নিয়েই বের হয়ে গেলাম। আমার ভাগ্য ভালো, পথে নানারকম ছোট বড় মাঝারি সরল এবং জটিল ট্রাফিক জ্যাম অত্রিক্রম করে আমি ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।

আমার গন্তব্য ছিল সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুল। আমি আগে কখনও আসিনি কিন্তু জায়গাটা খোঁজে পেতে সেরকম সমস্যা হলো না। পৌঁছে দেখি অন্যরা সবাই চলে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যারা একটু দূর থেকে এসেছে তাদের কেউ কেউ ভোর সাতটায় রওনা দিয়েছে, তারা সবাই এই ঘটনাটি নিজের চোখে দেখতে চায়।

আমি পৌঁছানো মাত্রই সেখানে একটা উত্তেজনা শুরু হলো। কারণ আমি জানতে পারলাম, আমি নাকি প্রধান অতিথি। (আমাদের দেশের এই প্রধান অতিথি এবং অ-প্রধান বা নগণ্য অতিথির কালচারটা আমি ভালো করে বুঝতে পারি না। আশা করছি, ধীরে ধীরে এটা উঠে যাবে। এক সময় সব অতিথিই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেওয়া হবে।) আমাকে ঢাউস একটা ফুলের তোড়া দেওয়া হলো এবং আট দশ বছরের অনেক ছেলেরা আমাকে ঘিরে ধরলো। তাদের হাতে ছোট বড় মাঝারি কাগজের টুকরো। কিছু কিছু কাগজের টুকরোর অবস্থা রীতিমত শোচনীয়- মনে হয়, রাস্তা থেকে তুলে এনেছে! সবারই অটোগ্রাফের দরকার, যাদের হাতে কাগজ নেই তারা তাদের হাতটাই বাড়িয়ে দিল। সরাসরি হাতের তালুতে অটোগ্রাফ দিতে হবে। (এটি নতুন পদ্ধতি এবং খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শরু করেছে!) আমি বাচ্চাগুলোর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, আগে কাজটা করতে এসেছি সেটা সেরে ফেলি, তারপর সবাইকে অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে। আমি তাদের কথা দিলাম, তাদের সবাইকে অটোগ্রাফ না দিয়ে আমি যাব না।

ছোট বাচ্চারা মোটেও রাজনৈতিক নেতাদের মতো না। তারা আমার কথা বিশ্বাস করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। এই বয়সী বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি-হুটোপুটি থেকে সুন্দর দৃশ্য খুব বেশি নেই।

আমি তখন যে কাজটি করতে এসেছি, সেই কাজটি করতে এগিয়ে গেলাম। আমার মনে হয়, আমি কী কাজ করতে এসেছি, এখন সেটি বলার সময় হয়েছে।

এই স্কুলে অনয় নামে একটি ছোট ছেলে লেখাপড়া করে। অন্য বাচ্চাদের মতোই লেখাপড়ায় আগ্রহ কিন্তু হঠাৎ করে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার কারণ এই ছেলেটি অন্য দশটি ছেলের মতো নিজের পায়ে ছোটাছুটি করতে পারে না, তাকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত নিচের তলায় ক্লাশরুম থাকায় তার কোনো সমস্যা হয়নি। সিক্সে ওঠার পর ক্লাসরুম দোতলায়, হঠাৎ করে তার ক্লাশে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের এরকম ছেলেমেয়ে আছে এবং যারা তাদের সেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে চান, তারা সবাই এই কাহিনীর সাথে পরিচিত। হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন, শুধু ক্লাশরুম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না বলে একদিন তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।

যখন এই দেশের শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়, তখন অনেকের সাথে আমিও সেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। আমরা সবাই মিলে খুব আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে এই শিক্ষানীতিতে একীভূত (Inclusive) শিক্ষা নামে একটা শব্দ ঢুকিয়েছিলাম। যার অর্থ এই দেশের সব ধরণের ছেলেমেয়ে একই সাথে পড়াশোনা করতে পারবে। শারীরিক প্রতিবন্ধী নামে একটা ভয়ঙ্কর শব্দ আবিষ্কার করে বিশেষ ধরণের ছেলেমেয়েদের শরীরে এই সিল মেরে দিয়ে আমরা তাদেরকে আলাদা স্কুলে পাঠিয়ে দিতাম। এই শিক্ষানীতি সেই প্রক্রিয়াটিকে বাতিল করে সবার জন্যই একই ধরণের শিক্ষার ব্যবস্থাটি চালু করে দিয়েছিল। আমি যতদূর জানি, এ ব্যাপারে একটা আইনও আছে। কিন্তু সেই আইনের অবস্থা ট্রাফিক আইনের মতো, কেউ সেটা মানে না। যদি কোনো অসহায় বাবা-মা হুইল চেয়ারে আটকে থাকা তার ছেলে কিংবা মেয়ের লেখাপড়ার জন্য এই আইনটির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন কোনো লাভ হয় না। ‘উটকো একটা ঝামেলা’ ঘাড়ে যেন নিতে না হয় তার জন্য তারা নানারকম ফন্দি-ফিকির বের করেন। ভর্তি করার আগে তাদের টেস্ট নেওয়া হয়, সেই টেস্টে তাদের ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। এই গল্পগুলো আমি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে সেরকম ছেলেমেয়ের বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি।

সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের ছাত্র অনয়ের কপালেও এরকম একটা কিছু ঘটতে শুরু করল। এতোদিন একতলায় ক্লাশ হয়েছে কোনো সমস্যা হয়নি। দোতলায় ক্লাশটা চলে যাওয়ার পর অনয় আর তার বাবা-মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঠিক তখন একটা চমৎকার ঘটনা ঘটল। বি-স্ক্যান (B-SCAN: Bangladeshi System Change Advocacy Network) নামের একটা সংগঠন এই ব্যাপারটা জানতে পারল।

আমার মনে হয়, বি-স্ক্যান সম্পর্কে দুই একটা কথা বলা দরকার। অনেকদিন আগে সাবরিনা সুলতানা নামে একটা মেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সেই এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবক এই সংগঠনে কাজ করে। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করাই হচ্ছে এই সংগঠটার মূল কাজ। সাবরিনা খুব সুন্দর লিখতে পারে, ব্লগে সে অসাধারণ কিছু লেখা লিখে অনেক তরুণদের এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। আমার প্রথম যেদিন সাবরিনার সঙ্গে দেখা হলো, আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কারণ সে হুইল চেয়ারে আটকা পড়ে আছে। একটা হাতের এক দুইটা আঙুল ছাড়া আর কিছুই সে ব্যবহার করতে পারে না। আমি আমার সমস্ত শরীর হাত-পা ব্যবহার করে যেটুকু কাজ করতে পারি, সে শুধু এক দুটি আঙুল ব্যবহার করেই তার থেকে বেশি কাজ করতে পারে দেখে ‘প্রতিবন্ধী’ মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে গিয়েছে। আমি এখন প্রতিবন্ধী বলে এই কুৎসিত শব্দটি ব্যবহার করি না। আমার কাছে তারা বিশেষ (Spacial) মানুষ।

সাবরিনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি তাকে আমার ‘নেতা’ হিসেবে মেনে নিয়েছি। সে আমাকে কিছু একটা করতে বললে আমি সেটা করার চেষ্টা করি। সে আমাকে আজ সাড়ে এগারোটায় এই স্কুলে আসতে বলেছে। আমি তাই চলে এসেছি।

সাবরিনা চট্টগ্রাম থাকে। তার জন্য ঢাকা আসা রীতিমত একটা বিশাল অ্যাডভেঞ্চার। তার সবকিছুর জন্য এই অ্যাডভেঞ্চার করতে হয় না। কারণ বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব ঢাকা থাকে। সালমা-সাবরিনা একটা অসাধারণ জুটি, তাদের কাজের কোনো তুলনা নেই। এই স্কুলের ছেলেটাকে কীভাবে লেখাপড়া করার সুযোগ দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করতে লাগল এবং তার যে সমাধান বের করল, তার কোনো তুলনা নেই। ঠিক করা হলো স্কুলের দোতলায় ওঠার জন্য একটা লিফট বসানো হবে।

আমি জানি, সবাই চমকে উঠেছে। একটা স্কুলে লিফট বসানো নিশ্চয়ই সোজা কথা নয়, এটা তো লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের ব্যাপার। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের সাধারণ একটা স্কুলে একটা লিফট বসানোর সুযোগ কোথায়? কিন্তু এসব কিছুই সমস্যা নয়। কারণ যে লিফটটি বসানো হবে, সেটা ম্যানুয়েল লিফট। এটা চালাতে ইলেকট্রিসিটি লাগবে না, একজন হাত দিয়ে হ্যান্ডেলের মতো একটা জিনিষ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপরে তুলে নিতে পারবে, নিচে নামিয়ে আনতে পারবে। যিনি সেই ম্যানুয়েল লিফট ডিজাইন করেছেন, তার নাম মহিউদ্দিন বাবুল। এটি তার প্রথম ডিজাইন নয়। সাভারের সিআরপি এর জন্য তিনি আগেও এটা তৈরি করেছেন। এই লিফটটি বসানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিয়েছেন, অনয়ের বাবা ছেলের লেখাপড়ার জন্য খরচটা বহন করেছেন। আজকে সেই ম্যানুয়েল লিফটটি উদ্বোধন করা হবে এবং আমি সেটা নিজের চোখে দেখার জন্য ছুটে এসেছি।

মহিউদ্দিন বাবুল নামে যিনি এই লিফট তৈরি করেছেন তার সঙ্গে পরিচয় হলো। ঘটনাক্রমে তিনিও হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। শৈশবে গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন। সাবরিনা-সালমা জুটি চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মাঝে অনয় নামের যে শিশুটির জন্য দজ্ঞযজ্ঞ, সেও চলে এলো। এখন বাকি আছে এই ম্যানুয়েল লিফটটা উদ্বোধন করা।

আমরা সবাই মিলে রওনা দিলাম। নিচতলায় স্কুলের বারান্দায় ওঠার জন্য এবং একটা বারান্দা থেকে অন্য বারান্দায় যাওয়ার জন্য দুটো র্যা ম্প (Ramp –ঢালু পথ) তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো তৈরি করে দিয়েছে কানাডার টরন্টো শহরের একটি সংগঠন। আমাদের সাথে এই স্কুলের ছোট ছোট ছেলেদের বিশাল একটা বাহিনী, তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই।

লিফটের সামনে হাজির হওয়ার পর আমি আবিষ্কার করলাম, আমার জন্য ছোট একটা বিষ্ময় অপেক্ষা করছে। ফিতা কেটে আমাকেই এই লিফটের উদ্বোধন করতে হবে। সালমা-সাবরিনার কিংবা লিফট ডিজাইনার মহিউদ্দিন বাবুলের এটি উদ্বোধন করে দেওয়ার অধিকার আমার থেকে একশত গুণ বেশি, কিন্তু কিছু করার নেই। ঘটনাটি সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। আমি এক ধরণের আনন্দ মেশানো বিষ্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম অনেক সাংবাদিক, টেলিভিশনের ক্রু চলে এসেছেন। এই অসাধারণ ঘটনাটি আমাদের সাথে সাথে দেশের অনেক মানুষ দেখতে পাবে!

অনয় আর হেডমাস্টারকে নিয়ে আমি লিফটের ভেতর ঢুকে গেলাম, সামনে একটা ফিতা লাগানো হয়েছে। সেটা কেটে দেওয়ার পর একটা গগন বিদারী চিৎকার দেওয়া হলো। যে সকল অনুষ্ঠানে ছোট ছোট বাচ্চা থাকে, সেখানে অত্যন্ত চমকপ্রদ গগন বিদারী চিৎকার দেওয়া সম্ভব।

উদ্বোধনের পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, অনয়কে নিয়ে এই লিফটে করে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি জবুথবু ধরণের মানুষ, ভুল কিছু করে ফেলে মাঝ পথে আটকা পড়ে যাই কী না কিংবা উপর থেকে নিচে ফেলে দেই কী না, সেটা নিয়ে নিজের ভেতর দুর্ভাবনা ছিল। তাই আরেকজন সঙ্গে ওঠে গেলেন। তারপর হ্যান্ডেলটা ঘোরানো শুরু করতেই এই ম্যানুয়েল লিফটটা তরতর করে উপরে ওঠতে শুরু করল। দেখতে দেখতে আমরা দোতলায় ওঠে গেলাম। অন্য বাচ্চারা এর মাঝে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সবাই মিলে একটা আনন্দোল্লাসের মাঝে অনয়ের হুইল চেয়ারটা ঠেলে তার ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়া হলো।

আমার হিসেবে বাংলাদেশে একটা ইতিহাস রচিত হলো।

০২.

আমি জানি অনেকের মনেই একটা প্রশ্ন উশখুশ করছে, এই ম্যানুয়েল লিফটটা তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে? আমি জানি শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যাবে, একটা ভালো ল্যাপটপ কিনতে যত টাকা খরচ হয়, এই লিফটটা তৈরি করতে সেরকম খরচ পড়েছে- মাত্র নব্বই হাজার টাকা। যার অর্থ একটা স্কুলে এরকম একটা লিফট বসানোর জন্য কাউকে বিদেশি অনুদানের জন্য বসে থাকতে হবে না। বড় বড় করপোরেশনের কাছে হাত পাততে হবে । কয়েকজন মিলেই এটা তৈরি করে ফেলতে পারবে। আমার ধারণা মোটামুটি বড় একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে তাদের স্কুলে এরকম ম্যানুয়েল লিফট বসিয়ে ফেলতে পারবে।

সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছে, এই ঘটনাটি নিয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। হওয়ার কারণও আছে। পৃথিবীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে কোনো দেশের শতকরা পনেরো ভাগ হচ্ছে কোনো না কোনো ধরণের ‘প্রতিবন্ধী’ (কুৎসিত শব্দটা আবার ব্যবহার করতে হলো!), তার মাঝে একটা অংশকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। যারা হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে, তারা যেন যে কোনো বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতে পারে, বাথরুমে যেতে পারে,অর্থাৎ তাদের প্রবেশ গম্যতা থাকে, তার জন্য দেশে আইন আছে। অন্য অনেক আইনের মতো এই আইনটিও এখনও সেভাবে মানা শুরু হয়নি। আমরা আশা করছি, সেটা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাঝে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের ঘটনাটি আমাদের নতুন একটা আশা দিয়েছে। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে এরকম অসংখ্য ছেলেমেয়েকে এই দেশের অনেক স্কুল ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের আর ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এরকম একটা খবর পেলে বি-স্ক্যানের মতো সংগঠনের সাথে সাথে সবাই মিলে সেই স্কুলের ওপর চড়াও হতে পারবে, তাদেরকে বাধ্য করা যেতে পারে একটা ছোট শিশুর লেখাপড়া যেন তারা নিশ্চিত করে। এরকম একটা শিশুকে স্কুলে নেওয়া হলে কারো কারো একটু বাড়ি ‘ঝামেলা’ হতে পারে, কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিতে পারি, এই ছোট একটুখানি ঝামেলা সহ্য করার পরিবর্তে সবাই যে আনন্দটুকু পাবে, সেই আনন্দের কোনো তুলনা নেই। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তারা চেষ্টা করে দেখতে পারে।

০৩.

এই প্রসঙ্গে শেষ কথাটুকু বলে দেওয়া যাক। পৃথিবীতে যতোভাবে আনন্দ পাওয়া সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে তীব্রভাবে সেটি পাওয়া যায় যখন অন্যের জন্য কিছু একটা করা হয়। সিদ্বেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলে গিয়ে আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি। বি-স্ক্যানের স্বেচ্ছাসেবকেরা সেখানে হাজির ছিল, তাদের আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।

আমি দেশের তরুণদের এই কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই, শুধু নিজের জন্য বেঁচে থেকে কোনো আনন্দ নেই, বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ আনন্দ পেতে হলে অন্যের জন্য কিছু একটা করতে হয়। তাই যারা বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ আনন্দটি কী, সেটা জানতে চায় তাদেরকে বি-স্ক্যান বা এরকম অন্য কোনো একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু একটা করার জন্য অনুরোধ করছি।

আমি এটা নিশ্চিতভাবে জানি, আমি অনয়ের মুখের হাসিটি নিজের চোখে দেখেছি।

০৪.

ফিরে আসার আগে আমি সব শিশুদের অটোগ্রাফ দিয়ে এসেছিলাম। তাদেরকে যে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথাটি রেখে এসেছিলাম!

একজন সাধাসিধে মা

১.

আমার মা সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ খুব ভোর বেলা মারা গেছেন। আমার বাবা যখন মারা গেছেন তখন তার কাছে কোনো আপনজন ছিলো না, একটা নদীর তীরে জেটিতে দাড়া করিয়ে পাকিস্তান মিলিটারী গুলি করে তাকে হত্যা করে তাঁর দেহটা নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আমার মা যখন মারা যান তখন তার সব আপনজন – ছেলে মেয়ে ভাই বোন নাতি নাত্নীরা সবাই তার পাশে ছিল। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার মায়ের বয়স মাত্র ৪১, তারপর আমার মা তার সন্তানদের এবং তার আপনজনদের জন্যে আরো ৪৩ বছর বেঁচে ছিলেন।

আমার মায়ের মৃত্যুটি একান্তভাবেই একটি পারিবারিক ঘটনা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি এক ধরণের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি তার অসুস্থতার খবরটিও পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরটি সব পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। যদি খবরের শিরোনাম হতো, “হুমায়ূন আহমেদের মায়ের জীবনাবসান”, আমি সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরে নিতাম। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখেছি আমার মা’কে তার নিজের নামে পরিচয় দিয়ে লিখেছে, “আয়েশা ফয়েজের জীবনাবসান”। আমি জানতাম না এই দেশের মানুষ আমার মা’কে তার নিজের নামে চেনে। সেজন্যে আমি আজকে এই লেখাটি লিখতে বসেছি – মনে হয়েছে যদি সত্যিই দেশের মানুষ তাকে তাঁর পরিচয় দিয়েই চেনে তাহলে হয়তো অনেকেই আমার একেবারে সাদাসিধে মায়ের জীবনের একটি দুটি ঘটনা শুনতে আপত্তি করবেন না।

মাঝে মাঝেই আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, “আপনি আমেরিকার এতো সুন্দর জীবন ছেড়ে দেশে কেন চলে এলেন?” নানাভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিজের দেশে ফিরে আসতে যে কোনো কারণ লাগে না – বরং উল্টোটাই সত্যি, দেশ ত্যাগী হওয়ার পিছনে ভালো কারন থাকা দরকার সেটা কাকে বোঝাব? প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ই-মেইল ইন্টারনেট আবিষ্কার হয়নি, ডজন হিসেবে টিভি চ্যানেল ছিলো না, টেলিফোন অনেক মূল্যবান বিষয় ছিল, মায়ের ফোন ছিল না থাকলেও আমার তাকে নিয়মিত ফোন করার সামর্থ্য ছিল না। যোগাযোগ ছিলো চিঠিতে – চিঠি লিখলে সেটা দেশে আসতে লাগতো দশ দিন, উত্তর আসতে লাগতো আরো দশ দিন। মেল বক্সে দেশ থেকে আসা একটা চিঠি যে কী অবিশ্বাস্য আনন্দের বিষয় ছিল সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

সেই সময়ে আমার মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন। আমি জানি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে প্রতি সপ্তাহে আমার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। আমার মা তার গুটি গুটি হাতের লেখায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাসার খবর দিয়েছেন, ভাইবোনদের খবর দিয়েছেন, আত্নীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন, এমন কী দেশের খবরও দিয়েছেন। আমার প্রবাস জীবনে দেশ কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আমার মায়ের চিঠির কারনে।

কয়েক বছর পর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা এসেছিল, তখন আমার মা প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি লিখতেন – একটি আমাকে আরেকটি আমার ভাইকে।

আমার মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো বাঁচিয়ে রাখিনি – এখন চিন্তা করে খুব দুঃখ হয়। যদি চিঠিগুলো থাকতো তাহলে সেটি কী অসাধারণ দলীল হতো আমি সেটি চিন্তাও করতে পারি না।

আমার মা খুবই সাধারণ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন – অন্তত আমরা সবাই তাই জানতাম। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন আমাদের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পরনের কাপড় নেই, তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই আমার মায়ের একটা সংগ্রামী নূতন রুপ আবিষ্কার করলাম। আমরা ভাইবোনেরা সবাই লেখাপড়া করছি – কিছুতেই লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না তাই বাবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স আর পেনশনের অল্প কিছু টাকার উপর ভরসা করে ঢাকায় স্থায়ী হলেন। কী ভয়ংকর সেই সময়, এখন চিন্তা করলেও আমার ভয় হয়! বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের জন্যে আমার মা একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন। আমি পত্রিকায় কার্টুন আঁকি – গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করি, এভাবে কোনোমতে টিকে আছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাশ করে একটা চাকরী পাবে সবাই সেই আশায় আছি। এরকম সময় আমি একদিন হঠাৎ করে বলাকা সিনেমা হলের নিচে একটা বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলী আবিষ্কার করলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম তিনশ টাকা! (এখনকার টাকায় সেটি নিশ্চয়ই দশ বারো হাজার টাকার সমান হবে!) এতো টাকা আমি তখনো একসাথে হয়তো ছুয়েও দেখিনি। এই বইয়ের সেট আমার ধরা ছোয়ার বাইরে। তবু আমি বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখি, লোভে আমার জিভে পানি এসে যায়।

যাই হোক বিকালবেলা বাসায় ফিরে এসেছি, ভাইবোনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি তখন মানিক গ্রন্থাবলীর সেটটার কথাই শুধু ঘুরে ফিরে বলছি, কী অপূর্ব সেই বইগুলো, দেখে কেমন লোভ হয় কিছুই বলতে বাকী রাখি নি। আমার মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কতো দাম?” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তিনশ টাকা।” আমার মা বললেন, “আমি তোকে তিনশ টাকা দিচ্ছি, তুই কিনে নিয়ে আয়।”

আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের পরিবারের তখন যে অবস্থা তখন প্রত্যেকটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করা হয়। তার মাঝে আমার মা আমাকে তিনশ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন এরকম ভয়ংকর একটা বিলাসিতার জন্যে? “মানিক গ্রন্থাবলী” কিনে আনার জন্যে? টাকাটা কোথা থেকে দিচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে বই কিনে ফেলার পর সংসারের কোন চাকাটা অচল হয়ে পড়বে আমার সেইসব জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো! আমি তার কিছুই করিনি। মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম, ভয়ে বুক ধুকধুক করছে, এর মাঝে যদি কেউ সেই বইগুলো কিনে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে?

বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখলাম বইগুলো তখনো আছে। আমি টাকা দিয়ে লোভীর মতো মানিক গ্রন্থাবলীর পুরো সেট ঘাড়ে তুলে নিলাম। আহা কী আনন্দ!

বাসার সবাই বই পড়ে, তাই সেই আনন্দ শুধু আমার একার নয়, সবার। কেউ তখন বাসায় এলে বিচিত্র একটা দৃশ্য আবিষ্কার করতো, ঘরের একেক কোনায় একেকজন বসে, শুয়ে, আধাশোয়া হয়ে, কাত হয়ে, সোজা হয়ে মানিক গ্রন্থাবলী পড়ছে!

তারপর বড় হয়েছি, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক কিছু কিনতে হয়, অন্য অনেকের মতো আমিও কিনেছি। আমেরিকা থাকতে শো রুম থেকে নূতন গাড়ী কিনে ড্রাইভ করে বাসায় এসেছি, ঝকঝকে নূতন বাড়ীও কিনেছি – কিন্তু সেই মানিক গ্রন্থাবলী কেনার মত আনন্দ আর কখনো পাইনি, আমি জানি কখনো পাব না। এটি আমার জীবনের ঘটনা, যারা আমার মায়ের কাছাকাছি এসেছে তাদের সবার জীবনে এরকম ঘটনা আছে। কাউকে কিছু কিনে দিয়েছেন, কাউকে অর্থ সাহায্য করেছেন, কাউকে চিকিৎসা করিয়েছেন, কাউকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন কিংবা কাউকে শুধু আদর করেছেন, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।

আমরা যখন আমেরিকা থাকি তখন একবার তাঁকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলাম। আমেরিকা দেখে আমার মা খুবই অবাক, তাঁর শুধু একটাই প্রশ্ন, “মানুষ জন কোথায় গেল?” আমরা তাঁকে বোঝাই, মানুষ জন কোথাও যায়নি – যাদের দেখছেন তারাই আমেরিকার মানুষ! আমরা যখন বাসায় থাকি না তখন মাঝে মাঝে আমার মা হাঁটতে বের হন, রাস্তা ধরে এদিক সেদিক হেঁটে আসেন। একদিন হেঁটে এসে আমাদের বললেন, “তোরা কখনো বলিস নি, এখানে একটা কবরস্থান আছে। কী সুন্দর কবরস্থান, কবরের উপর কতো ফুল। আমি সেই কবরগুলো জেয়ারত করে এসেছি।”

আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “হায় হায়! আপনি জানেন কী করেছেন?”
মা বললেন, “কী করেছি?”
আমি বললাম, “ওটা কুকুর বেড়ালের কবর। আপনি কুকুর বেড়ালের কবর জেয়ারত করে ফেলেছেন!”
এই দেশে কবরস্থানে কুকুর, বেড়ালকে কবর দেয়া হয়, শুনে মা চোখ লপালে তুললেন আর আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম।

দেশে থাকতে মা কতো রকম কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকেন, আমেরিকায় তার কোনো কাজ কর্ম নেই। আমার ছেলে মেয়েরা ছোট তাদের বাংলা পড়তে শেখান। তখন নূতন পার্সোনাল কম্পিউটার বের হয়েছে, বাসায় একটা আছে, আমি সেখানে বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করেছি। একদিন মা’কে বাংলা লেখা শিখিয়ে দিলাম। আমার মা তখন কম্পিউটারে বাংলায় দেশে ছেলে মেয়ে নাতী নাত্নীর কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলেন। কম্পিউটারে বাংলায় লেখা মায়ের চিঠি দেখে দেশে সবাই হতবাক হয়ে গেল!

এতো কিছু করেও মায়ের অনেক অবসর। আমার স্ত্রী তখন মা’কে বলল, “আপনার এতো ঘটনাবহুল একটা জীবন, আপনি বসে বসে সেই জীবনীটুকু লিখে ফেলেন না কেন?” আমার মা একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত লিখতে রাজী হলেন। তারপর বসে বসে তাঁর বৈচিত্রময় জীবনীটুকু লিখে ফেলেন, আমি কম্পিউটারে সেটা টাইপ করে দিলাম। মা দেশে যাবার সময় তার হাতে পুরো পান্ডুলিপিটা দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করলেই কোনো প্রকাশককে দিয়ে সেটা প্রকাশ করানো যেতো কিন্তু কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা দেশে বাক্সবন্দী হয়ে থাকল। আমরা আমার মায়ের লেখা আত্মজীবনীর কথা ভুলেই গেলাম।

তারপর বহুদিন কেটে গেছে, আমি দেশে ফিরে এসেছি তখন হঠাৎ করে উইয়ে কাটা অবস্থায় এই পান্ডুলিপি নূতন করে আবিষ্কৃত হল, আমি তখন উদ্যোগ নিয়ে সময় প্রকাশনীকে সেটি দিয়েছি ছাপানোর জন্যে। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে নিল। যখন বইয়ের ছাপা শেষ, বাঁধাই হচ্ছে তখন হঠাৎ করে আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ। কী কারণে তার ধারণা হল তিনি বুঝি আর বাঁচবেন না, আমি তখন সিলেটে, আমাকে ফোন করে বললেন, “বাবা, যদি তোদের সাথে কখনো ভুল করে থাকি, মনে কষ্ট রাখিস না। আমাকে মাফ করে দিস।”

শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা, মা’কে মাফ করে দেবো মানে? আমি তখনই সময় প্রকাশনীর সত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদকে ফোন করে জিগ্যেস করলাম আমার মায়ের বইয়ের কি অবস্থা। ফরিদ জানালেন বই বাঁধাই হচ্ছে। আমি বললাম এই মুহুর্তে দুটি বই বাঁধাই করে আমার মার হাতে দিয়ে আসতে হবে। আমি জানি একজন লেখকের জীবনের প্রথম বইয়ের থেকে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই। ফরিদ ছুটতে ছুটতে বই নিয়ে আমার মায়ের হাতে তুলে দিল এবং সাথে সাথে মায়ের সব অসুস্থতা দূর হয়ে গেল! আমার মা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেন। শুধু ডাক্তাররা চিকিৎসা করে কে বলেছে, আমিও চিকিৎসা করতে পারি। আমার মা খুবই আন্তরিকভাবে এই বইটি লিখেছিলেন, যারাই বইটি পড়েছে তাদের সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। একজন মানুষ জীবনে কতোভাবে কষ্ট পেতে পারে, এই বইটি পড়লে সেটি বোঝা যায়।

হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর আমার মা আবার নতুন করে যে কষ্ট পেয়েছিলেন সেই কষ্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন আমরা কেউ ভাবিনি। সেই কষ্ট ভুলে থাকার জন্যে আমার মা বসে বসে তার কাছে চিঠি লেখার মত করে অনেক কিছু লিখেছেন। পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছে আছে, হয়তো এটাও কোনো প্রকাশককে দিয়ে কখনো প্রকাশ করিয়ে দেব।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুটি আমার মা’কে খুব বড় একটা আঘাত দিয়েছে, সত্যিকারভাবে আমার মা কখনোই সেই আঘাত থেকে বের হতে পারেননি। আমরা টের পেতাম তার মনটি ভেঙে গেছে, একজনের মন ভেঙে গেলে তাকে জোর করে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আমরাও পারিনি, গত ২৭ তারিখ আমার মা তার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের কাছে চলে গেছেন। সে সম্ভবত আমার বাবাকে নিয়ে আমার মায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল। তারা তখন একজন আরেকজনকে কী বলেছিল আমার খুব জানার কৌতূহল হয়।

২.
খবরের কাগজে আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ ছাপানোর সময় অনেকেই তাকে রত্নগর্ভা বলে সম্বোধন করেছে। এই বিশেষণটি পড়ে আমি দুই কারণে একটু অস্বস্তি বোধ করেছি। এক: এটি সত্যি হলে আমাদের ভাইবোনের সবারই ছোটবড় মাঝারি রত্ন হয়ে ওঠার একটা চাপ থাকে, কাজটি সহজ নয়! দুই: এই বিশেষণটি সত্যি হলে বোঝানো হয় আমার মায়ের নিজের কোনো অবদান নেই, তার একমাত্র অবদান হচ্ছে তিনি ছোট-বড়-মাঝারি ‘রত্ন’ জন্ম দিয়েছেন!
কিন্তু আমি জানি রত্নগর্ভা হিসেবে নয়, আসলে আমার মা একজন খুব সাদাসিধে মা হিসেবেই অনেক বড় অবদান রেখেছেন। আমার মা যেভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের পুরো পরিবারটিকে রক্ষা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। যদি বুক আগলে আমাদের রক্ষা না করতেন তাহলে আমরা কেউই টিকে থাকতে পারতাম না।

কীভাবে কীভাবে জানি আমার মায়ের একটা পরিচিতি হয়েছে, তিনি অসুস্থ হলে টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়, তিনি মারা গেলে খবরের কাগজে কালো বর্ডার দিয়ে খবর ছাপা হয়। কিন্তু আমি আমার মা’কে দেখে বুঝেছি এই বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আমার মায়ের মত অসংখ্য মা আছেন যারা যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছিলেন এবং যারা নিজের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ঠিক আমার মায়ের মত সংগ্রাম করেছিলেন। তাদের কথা কেউ জানে না, তাদের কথা কেউ বলে না। আমার মনে হয় আমাদের বাংলাদেশ যে পৃথিবীর অন্য দশটা দেশ থেকে ভিন্ন তার একটা বড় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পর এই দেশে অনেক মা ঘর থেকে বের হয়ে সংগ্রাম শুরু করেছেন। বেঁচে থাকার জন্যে সেই সংগ্রামের কথা কতোজন জানে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের দেশের সেই মায়েদের যুদ্ধ তাঁদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমরা কী সেটা মনে রাখি?

একদিন যখন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে তখন আমরা কী বাংলাদেশের সেই অসংখ্য মায়েদের কথা স্মরণ রাখব? যে সাদাসিধে মায়েরা সন্তানদের রক্ষা করার জন্যে সিংহীর সাহস নিয়ে কঠিন পৃথিবীর মুখোমুখি হয়েছিলেন? বুক আগলে তাদের রক্ষা করেছিলেন?

আমি আজকে আমার নিজের মায়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের এরকম অসংখ্য মা’দের কাছে একটুখানি ভালোবাসা পৌঁছে দিতে চাই। একটুখানি শ্রদ্ধা পৌঁছে দিতে চাই।

০৮.১০.২০১৪

একটি অসাধারণ আত্মজীবনী

মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় আমাদের কতো বড় সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মত একজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। ঠিক যেই সময়টিতে দরকার হয়েছিল তখন যদি তাঁর মত একজন মানুষের জন্ম না হতো তাহলে কী হতো? তাহলে কি বাঙালীরা নিজের একটা দেশের স্বপ্ন দেখতে পারতো? সেই দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে পারতো? অকাতরে প্রাণ দিতে পারতো? যদি আমরা নিজের একটি দেশ না পেতাম, এখনো পাকিস্তান নামের সেই বিদঘুটে দেশটির অংশ হিসেবে থাকতাম তাহলে আমাদের কী হতো সেই কথা চিন্তা করে আমি আতংকে শিউরে শিউরে উঠি।

এই মানুষটিকে পচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক মহামানবকে নিজের দেশ কিংবা দেশের মানুষের জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেই হত্যাকারীরা দায়িত্ব শেষ করেনি, এই দেশের ইতিহাস থেকে তার চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্যে একুশটি বছর এমন কোনো কাজ নেই যেটি করা হয়নি। যে মানুষটির কারণে আমরা আমাদের দেশটি পেয়েছি সেই দেশের রেডিও টেলিভিশনে কোনোদিন তার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। আমার মনে আছে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, “চলো আমরা একটা টেলিভিশন কিনে আনি, এখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে টেলিভিশনে দেখাবে!” শুধুমাত্র তাকে দেখার জন্যে আমরা একটা টেলিভিশন কিনে এনেছিলাম!

আমরা আমাদের চোখের সামনে বাংলাদেশকে জন্ম নিতে দেখেছি, আমরা এই দেশের ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ। আমাদের চোখের সামনে বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। শৈশব কৈশোরে তাঁর সবকিছুর গুরুত্ব সবসময় বুঝতে পারিনি, এখন বড় হয়ে যখন পিছনে ফিরে তাকাই কখনো বিস্মিত হই, কখনো রোমাঞ্চিত হই, কখনো হতচকিত হয়ে যাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে একজন মানুষ হিসেবে অনুভব করার অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেছে ২০১২ সালে, যখন তার নিজের হাতে লেখা “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটি হাতে পেয়েছি। আমি যখন নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীটি পড়ছিলাম তখন আমার বার বার মনে হয়েছিল, বছরের হিসেবে আমাদের বঙ্গবন্ধু তো নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে খুব একটা কম সময় জেলে ছিলেন না, অবদান হিসেবে তাঁর অবদান তো নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে খুব একটা কম নয়, তাহলে তিনি কেন তাঁর মতো করে নিজের আত্মজীবনী লিখে গেলেন না – আমরা কেন সেটি পড়ে রোমাঞ্চিত হবার সুযোগ পেলাম না। তাই শেষ পর্যন্ত যখন বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা আবিষ্কৃত হল, সেটি প্রকাশিত হল, আমার আনন্দের সীমা ছিল না।

শিশু কিশোরেরা যেভাবে রুদ্ধশ্বাসে ডিটেকটিভ বই পড়ে আমি ঠিক সেভাবে রুদ্ধশ্বাসে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীটি পড়েছি। আমি মনে করি এই বইটি আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। যারা দেশকে ভালোবাসে তাদের সবাইকে এই বইটি পড়তে হবে। যারা দেশের ইতিহাস জানতে চায় তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা রাজনীতি করে তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা রাজনীতি করতে চায় তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা দেশ শাসন করে তাদেরকে এই বই পড়তে হবে, যারা দেশ শাসন করতে চায় তাদেরকেও এই বই পড়তে হবে। এই বইটি পড়লেই শুধুমাত্র একজন মানুষ বুঝতে পারবে কীভাবে একজন মানুষ একটি জাতি হয়ে উঠে, একটি জাতি কীভাবে দেশ হয়ে উঠে।

২.

বইটিতে অসংখ্য বিষয় আছে – যেমন ধরা যাক বাঙালিদের কথা। তিনি বাঙালিদের কীভাবে দেখেছেন? বইয়ের অনেক জায়গায় তাদের কথা বলা আছে আমার পছন্দের একটা অংশ যখন তাদেরকে পাকিস্তানিদের সাথে তুলনা করেছেন (পৃষ্টা ২১৪) “প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।” বাঙালির চরিত্রের নিখুত ব্যাখ্যাও করেছেন অন্য জায়গায় (পৃষ্ঠা ৪৭) “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশী হয়না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুন থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। … যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।” বাঙালিদের নিয়ে এর চাইতে খাটি মূল্যায়ন আমার চোখে আর কখনো পড়েনি!

এই বাঙালিদের জন্যে তার বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে কয়েক ঘন্টা থেকে দাড়িয়ে আছে, তাকে ধরে নিজের কুড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছে, বলেছে, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা নেও, আমার তো কিছু নাই।” বঙ্গবন্ধু সেই পয়সা না নিয়ে উল্টা তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। সেই হতদরিদ্র মহিলার বাড়ী থেকে বের হবার পর, বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২৫৬) “নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিলো, যখন তার বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।” আমরা সবাই জানি বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা কখনো ভঙ্গ করেন নি।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এই পুরো বইটার একটা বড় অংশ হচ্ছে কীভাবে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লিগের গুন্ডা আর পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেল খাটছেন। পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছেন কিন্তু দেশ বিভাগের পরপরই খুবই দ্রুত মুসলিম লীগের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন আর এই মুসলিম লীগ সরকার তার উপর নির্যাতন করছে, বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেল খানায় আটকে রাখছে। এক জায়গায় বর্ণনা আছে মাওলানা ভাষানীকে নিয়ে শোভাযাত্রা করছেন তখন পুলিশ আক্রমন করেছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৩২) “আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে একপাশের নর্দমায় পড়ে গেলাম। … আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। কেউ বলে গুলি লেগেছে, কেউ বলে গ্যাসের ডাইরেক্ট আঘাত, কেউ বলে কেটে গেছে পড়ে যেয়ে।” তারপর কীভাবে তাকে ধরাধরি করে পার্টির অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো তার বর্ণনা আছে। সেখানে একটু চিকিৎসা করে বেদনায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হল। কিন্তু গভীর রাতে পুলিশ এলো তাদের গ্রেফতার করতে। মাওলানা ভাসানী খবর দিয়েছিলেন যেন কোনভাবে গ্রেফতার না হন তাই লিখছেন, “আমার শরীরে ভীষন বেদনা, জ্বর উঠেছে, নড়তে পারছি না। কি করি, তবুও উঠতে হল এবং কি করে ভাগব তাই ভাবছিলাম। … তিনতলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিনতলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতর ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম।” আমরা হলিউডের ছবিতে এরকম দৃশ্য দেখে অবিশ্বাসের হাসি হেসে থাকি – কিন্তু এটা হলিউডের ছবি নয়; বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনের ঘটনা, নিজের হাতে লেখা।

একবার পাকিস্তান থেকে দিল্লী হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় ফিরে আসছেন, তিনি জানেন তাকে গ্রেফতার করা হবে, তিনিও প্রস্তুত আছেন, তার ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৫) “আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই।” কারণ (পৃষ্ঠা ১৪৬) “কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না।” (এই বইয়ে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু সবসময় হাচিনা লিখেছেন) এরপর পুলিশের চোখে ধূলা দেয়ার জন্যে ট্রেনে, ষ্টেশনে কি করেছেন তার চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৬) ‘‘সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না।” বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌছাতে পেরেছিলেন, অল্প কিছুদিন স্ত্রী পুত্র কন্যার সাথে কাটাতে পেরেছিলেন। যখন যাবার সময় হয়েছে তখন লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৬৪) “ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।” বঙ্গবন্ধু যখন এই বাক্যটি লিখেছিলেন তখন কী তিনি জানতেন তাঁর জন্যে একদিন এটি কত বড় একটি সত্য হয়ে দাড়াবে!

জেলখানায় থাকতে থাকতে তাঁর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, অনেক কষ্টে একবার ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসে সকালবেলা বিছানায় বসে স্ত্রীর সাথে গল্প করছেন, তার ছেলেমেয়ে নিচে বসে খেলছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৯) ‘‘হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’, ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ ’’ বঙ্গবন্ধু তখন বিছানা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, “আমি তো তোমারও আব্বা।” তাঁর ছেলে তাকে চেনে না, তাই কাছে আসতে চাইত না। এই প্রথমবার বাবার গলা ধরে পড়ে রইল। লেখক সাহিত্যিকেরা বানিয়ে বানিয়ে কত কী লিখে পাঠকদের মন দুর্বল করে ফেলে, কিন্তু এ রকম সত্যি ঘটনা কি তারা লিখতে পারবে?

ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে, দুই বছর থেকে বেশি সময় বিনা বিচারে জেলে আটকা পড়ে আছেন, তখন ঠিক করলেন মুক্তির জন্যে আমরণ অনশন করবেন। খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাঁকে এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। অনশন শুরু করার দুইদিনের ভেতর খুব শরীর খারাপ হলে তাদের হাসপাতালে পাঠানো হল। চারদিন পর তাদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর নাকে ঘা হয়ে গেছে, রক্ত আসে যন্ত্রণায় ছটফট করেন। যখন বুঝতে পারলেন আর বেশিদিন বাঁচবেন না, গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনিয়ে বাবা, স্ত্রী এবং তাঁর দুই রাজনৈতিক নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানিকে চিঠি লিখলেন, কারণ তখন বুঝে গেছেন কয়েকদিন পর আর লেখার শক্তি থাকবে না।

বঙ্গবন্ধু অনশনে কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। চিঠি চারটি ঠিক জায়গায় পৌছানোর ব্যবস্থা করেছেন। লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৪) “আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মূহুর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্যে স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম আমার দিন ফুরিয়ে গেছে।… ডেপুটি জেলর সাহেব বললেন, ‘কাউকে খবর দিতে হবে কি না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম করবেন?’ বললাম, ‘দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না।’ আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল।….” এভাবে আরও দুদিন কেটে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৫), “২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি।….”

বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিছু শেষ পর্যন্ত অনশনে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়নি, এই জীবন-বাজি ধরা আন্দোলনের কাছে সরকার মাথা নত করে তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

পুরো বইটিতে এরকম অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা আছে। কীভাবে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছেন তার নিখুঁত বর্ণনা আছে। ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, বাধা বিপত্তি, ভয়ংকর অর্থকষ্ট, পুলিশের নির্যাতন, বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছুকে সামাল দিয়ে কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হয় সেটি এর চাইতে সুন্দর করে আর কোনো বইয়ে লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। মাঝে মাঝে যে হাস্যরস বা কৌতুক নেই তা নয়। রাতের বেলা নৌকা করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন, তখন ডাকাত পড়েছে। এলাকার সবাই বঙ্গবন্ধুকে চেনে, তাঁকে ভালোবাসে, ডাকাতেরা যখন জানতে পারল নৌকায় বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন তারা ডাকাতী না করেই মাঝিকে এক ঘা দিয়ে বলল, “শালা, আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়”। ঘুম থেকে উঠে ঘটনাটা শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, (পৃষ্ঠা ১২৫) “বোধ হয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে!”

আরেকবার জনসভায় মাওলানা ভাসানিকে নিয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছেন, পুলিশ তখন ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়েছে, কেউ আর বক্তৃতা করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু তেজস্বী মানুষ, বললেন (পৃষ্ঠা ১২৮) “মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করব।” মাওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন– “১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না, তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন, আল্লাহ আমিন।” মাওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন। মাইক্রোফোন সামনেই আছে। আধঘণ্টা চিৎকার করে মোনাজাত করলেন, কিছুই বাকি রাখলেন না, যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার ও সেপাইরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগল। আধা ঘণ্টা মোনাজাতে পুরা বক্তৃতা করে মাওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগওয়ালারা বেয়াকুফ হয়ে গেল!” পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে এতোদিন পরেও আমরা হেসে কুটি কুটি হই।

৩.

এই অসাধারণ বইটি সম্পর্কে লিখে শেষ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমি বই থেকে নানা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কিছু কথা তুলে দিই। যেহেতু তিনি আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, তাই তার রাজনীতি নিয়ে কথাগুলো সবচেয়ে সুন্দর। রাজনীতিটা কখনও দলবাজি হিসেবে দেখেননি। লিখেছেন (পৃষ্ঠা ২৩৯) ‘‘ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।” আমলাতন্ত্র দুই চোখে দেখতে পারতেন না, তাই বলেছেন (পৃষ্ঠা ২৩৫) “রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।” আবার একই সাথে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেছেন (পৃষ্ঠা ২৭৩) ‘‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই।” বামপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ২৩৪) ‘‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না।” আমাদের দেশে বামপন্থী রাজনীতি কেন কখনও বেশি সুবিধে করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু সেটি অর্ধশত বছরেরও আগে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বামপন্থী বন্ধুদের উল্লেখ করে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ১০৯) ‘‘জনসাধারণ চলছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।” অতিপ্রগতিবাদীদের সম্পর্কেও তাঁর কথাটা তখনও সত্যি ছিল এখনও সত্যি! বঙ্গবন্ধু বলেছেন (পৃষ্ঠা ২৪৫) ‘‘অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে চায় ঐক্য। কিন্তু দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, চেষ্টা করে সেজন্যে!”

তবে বঙ্গবন্ধুর কাছে রাজনীতির বিষয়টি ছিল খুবই স্পষ্ট, সেটি ছিল একটা মহৎ কাজ। বার বার বলেছেন (পৃষ্ঠা ১২৮) “যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা জীবনে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই।” রাজনীতি করে তাঁর জীবনে এক ধরনের পূর্ণতা এসেছিল, কারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে লিখছেন (পৃষ্ঠা ২৫৭) “আমার ধারণা হয়েছিল মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্যে জীবন দিতেও পারে।” বঙ্গবন্ধু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, একবার নয় বারবার।

৪.

এই লেখার শুরুতে আমি বলেছিলাম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি সবার পড়া উচিত – যারা দেশ চালাচ্ছে তাদেরও। আমার কেন জানি মনে হয় যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের সবাই এই বইটি পড়েননি – কিংবা তার চাইতেও দুঃখের ব্যাপার হয়তো বইটি পড়েছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো বিশ্বাস করেননি। আমার এরকম মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে এই বইয়ে সবচেয়ে বেশীবার যে কথাটি লেখা হয়েছে সেটি হচ্ছে (পৃষ্ঠা ১২৬) “শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।” কিংবা (পৃষ্ঠা ১২০) “বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।”

শক্তিশালী বিরোধী দল দূরে থাকুক আমরা কি এই দেশে কোনো বিরোধী দল দেখতে পাচ্ছি? দেশে আসলে কোনো বিরোধী দল নেই, একটা গৃহপালিত বিরোধী দল আছে, তাদের থাকা না থাকাতে কিছু আসে যায় না। জামায়াতে ইসলামীর সাথে রাজনীতি করে এবং বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে বলে আমি মনে করি এই দেশে বিএনপির রাজনীতি করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এখন বাকি আছে সংবাদমাধ্যম, যতই দিন যাচ্ছে আমরা দেখছি সংবাদমাধ্যমকে কেমন জানি গলা টিপে ধরা হচ্ছে। মন্ত্রীরা কারণে অকারণে আজকাল সাংবাদিকদের গালাগাল করেন, ভয়ভীতি দেখান। গণজাগরণ মঞ্চ যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করল তখন তাদেরকেও দুই টুকরো করে দেওয়া হল। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে আমি যখন চেঁচামেচি করছিলাম তখন আমাকে নানাভাবে উপদেশ দেয়া হয়েছিল আমি যেন সরকারকে বিপদে না ফেলি।

বঙ্গবন্ধু বারবার বলেছেন সরকারকে ঠিক রাখতে হলে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। আমি এই দেশে তাই একটা বিরোধী দল খুঁজে বেড়াই। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটা বিরোধী দল।

সেটি কোথায়?

১১.০৮.২০১৪

একটি ছোট প্রশ্ন (জানুয়ারি ০২, ২০১৩)

কয়েক দিন আগে আমার ৬০ নম্বর জন্মদিন গিয়েছে। বয়সের জন্য ৬০ সংখ্যাটি যথেষ্ট বড়—আমি সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই সেটা টের পেয়েছি। আমাকে অবাক করে দেওয়ার জন্য আমার ছাত্রছাত্রী আর সহকর্মীরা মিলে গোপনে ৬০ পাউন্ডের বিশাল একটা কেক নিয়ে এসেছে। কেকের সাইজ দেখে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা—রীতিমতো বিছানার মতো বিশাল! তবে যেটা দেখে আসলেই আমি ভিরমি খেয়েছি, সেটা হচ্ছে, জন্মদিন উপলক্ষে কেককে ঘিরে লাগানো ৬০টি মোমবাতি। সেই মোমবাতিগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে এবং ৬০টি মোমবাতির আলোয় চারদিকে রীতিমতো দিনের মতো আলো। তখন আমি টের পেলাম, ৬০ অনেক বড় সংখ্যা—একসঙ্গে ৬০টি মোমবাতি জ্বালালে দিনের মতো আলো হয়ে যায়।

মনে আছে, সেদিন বাসায় ফিরে এসে আমি আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি, সাদা চুল, তার থেকেও সাদা গোঁফ। আমি রীতিমতো একজন বয়স্ক মানুষ। তবে মজার কথা হচ্ছে, আমার নিজেকে কেন জানি একেবারেই বয়স্ক মনে হয় না। মনে হয়, এই সেদিন মাত্র আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম। কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবতাম, কত রকমারি জিনিস নিয়ে চিন্তা করতাম—এত দিন পর দেখি, এখনো সেই বিচিত্র বিষয় নিয়ে ভাবি, মাথার মধ্যে এখনো সেই রকমারি জিনিস খেলা করে। শুধু একটা ব্যাপারে একটু পার্থক্য। যখন বয়স কম ছিল, তখন অনেক বিষয়ে নিজের ভেতরে আবছা একটা ধারণা ছিল, এখন তার অনেকগুলোই স্পষ্ট। মনে হয়, কম বয়সের সঙ্গে বেশি বয়সের এখানেই পার্থক্য।
তাই আজকাল মাঝেমধ্যেই মনে হয়, মাথার মধ্যে যে চিন্তাগুলো স্পষ্ট হতে আমার জীবনের এতগুলো বছর লেগে গেছে, সেগুলো আজকালকার তরুণদের আগে-ভাগে জানিয়ে দিয়ে তাদের চিন্তার জগতে একটা শর্ট সার্কিট করে দিলে কেমন হয়? কেউ যদি আমাকে সেই দায়িত্ব দেয়, তাহলে আমি কোনটা দিয়ে শুরু করব?
আমার মনে হয়, আমি শুরু করব বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য নিয়ে। একটা বয়সে আমার মনে হতো, আমার নিজের সবকিছু বুঝি সঠিক। যে আমার থেকে ভিন্ন, সে বুঝি সঠিক নয়। আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম, জীবনটা গণিত নয়, আমার থেকে ভিন্ন হয়েও একজন সঠিক হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, জীবনের প্রশ্নের একটি মাত্র সঠিক উত্তর নেই, অনেক সঠিক উত্তর হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস নিয়ে একসঙ্গে অনেকে যে সঠিক হতে পারে, সেটা যেদিন আমি আবিষ্কার করেছিলাম, আমি তখন খুব অবাক হয়েছিলাম।

আমাদের দেশে এখন হঠাৎ এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যখন ভাবে নিজের ধর্মটাই একমাত্র সঠিক ধর্ম, তখন বিষয়টা অনেক বিপজ্জনক হতে পারে। কিছুদিন আগে রামুতে যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে আগুন দেওয়া হলো, তখন যেভাবে তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত ছিল, সেভাবে কি প্রতিবাদ হয়েছে? বাংলাদেশের প্রতিটা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রীদের কি এই ঘটনার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করা উচিত ছিল না? তারা কি সেই প্রতিবাদটুকু করেছে? আমার তো চোখে পড়েনি। কেন তারা করেনি?

কোনো তরুণ ছাত্র বা ছাত্রী, যে আমার এই লেখাটি পড়ছে, তাকে আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলে? তুমি কি জানো, ফেসবুকে ‘লাইক’ দেওয়া আসলে সত্যিকারের প্রতিবাদ না?

তোমার জীবনে যদি খুব বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় আর সবাই যদি ফেসবুকে লাইক দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করে দিল, তখন তোমার কেমন লাগবে?

৩১-১২-১২

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক। অধ্যাপক,
কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2013-1-2

একটি ডিজিটাল বিপর্যয় (এপ্রিল ১৫, ২০১২)

 

বর্তমান সরকার একটা বড় কাজ করেছে—এই দেশের সব মানুষকে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি শিখিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম শব্দটা নিয়ে একটু বিভ্রান্তি ছিল, এখন সেই বিভ্রান্তি নেই। তবে ডিজিটাল সাফল্যের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ডিজিটাল বিপর্যয় হয়ে কিছু একটা যে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে না তা নয়। সর্বশেষ বুমেরাংটি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আবেদন। পদ্ধতিটা নতুন নয়—আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমরা প্রথমবার এটি শুরু করেছিলাম—এখন বিষয়টি প্রায় রুটিনমাফিক সবাই ব্যবহার করে। কাজেই পিএসসি তাদের বিসিএস আবেদনের জন্য এটি ব্যবহার করেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই—কিন্তু এটি যেভাবে দেশে একটি বিপর্যয়ের জন্ম দিয়েছে তাতে অবাক হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়ে গেছে।
বিষয়টি ঘটেছে এভাবে: প্রার্থীদের আবেদনের শেষ সময় ছিল ৭ এপ্রিল ২০১২ তারিখের দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত। কাজেই কোনো প্রার্থী যদি একেবারে শেষ মুহূর্তেও (রাত ১১টা বেজে ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড) আবেদন করেন তাহলে তাঁর আবেদনটি প্রক্রিয়া করতে হবে। সেটি করা হয়নি।
কেন করা হয়নি সেটি আমি আগেই অনুমান করতে পেরেছি, এই প্রতিবেদনটি লেখার আগে বিভিন্ন জায়গায় কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি। ডিজিটাল পদ্ধতির ওপর সবার অনেক বিশ্বাস, তাই আমরা সব সময়ই দেখেছি একেবারে শেষ মুহূর্তে অসংখ্য আবেদনকারী আবেদন করে বসে থাকে। কেন অনেক সময় হাতে রেখে তারা ধীরেসুস্থে আবেদন না করে একেবারে শেষ মুহূর্তের জন্য বসে থাকে সেটি নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন কিন্তু আমাদের এই সমস্যার কার্যকর সমাধান করতে হয়। যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার জন্য শেষ মুহূর্তের বিপুল সংখ্যক আবেদনকারীর আবেদন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রক্রিয়া করা না গেলেও আমরা সেটি নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না—কারণ কারা ঠিক সময়ের ভেতর আবেদন করেছে তার নিখুঁত হিসাব আমাদের কাছে থাকে। (যারা একটু টেকনিক্যাল কথা শুনতে আপত্তি করবেন না তাদের বলা যায় টাকা জমা দেওয়ার জন্য সবাইকে পিন নম্বর দেওয়া হয়—যাদের কাছে সেই পিন নম্বরটি আছে তারা যে পিএসসির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে আবেদন করেছেন তার একেবারে আইনসম্মত প্রমাণ আছে।) কাজেই বেঁধে দেওয়া সময় পার হলেও যারা ঠিক সময়ের মধ্যে আবেদন করেছে তাদের আবেদন পরেও প্রক্রিয়া করা যায়, কিন্তু পিএসসি সেই সুযোগটি নেয়নি। চমৎকার কার্যকর একটি ডিজিটাল-প্রক্রিয়া—যেটি অন্য সবাই সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য ব্যবহার করেছে, তারা সেই একই প্রক্রিয়া দিয়ে মানুষের জীবনে একটা বিপর্যয় ঘটিয়ে দিয়েছে। আমি আইন খুব ভালো বুঝি না—কিন্তু এটুকু জানি, আইন কখনোই কমন সেন্সের বিপরীত হয় না এবং সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য তৈরি হয় না। কাজেই পিএসসি নিশ্চিতভাবেই আইনসংগত কাজ করেনি। আমার দুশ্চিন্তা অবশ্য অন্য জায়গায়—দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরা যদি এ ধরনের একটি সহজ বিষয় বুঝতে না পারেন তাহলে আমরা কাদের ওপর ভরসা করব? এই বুমেরাংটি আমরা নিজেদের চোখে ছুটে আসতে দেখছি—আমাদের চোখের আড়ালে এ রকম বুমেরাং কি আরও ফিরে এসেছে?
যেহেতু এই প্রক্রিয়াটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে টেলিটকের সাহায্য নিয়ে প্রথমবার করা হয়েছিল, তাই আমি নৈতিকভাবে খানিকটা চাপ অনুভব করে টেলিটকের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, সব তথ্য তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে এবং অনুমতি দেওয়া হলে তারা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার আবেদনকারীর আবেদন প্রক্রিয়া করে ফেলতে পারবে। আমার ধারণা, বিষয়টিকে হাইকোর্ট-রিট-মামলা এ রকম পর্যায়ে যেতে না দিয়ে কমন সেন্স ব্যবহার করে সমাধান করে ফেলা সবচেয়ে সহজ।
যেহেতু পিএসসি নিয়ে কথা হচ্ছে, এই সুযোগে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা বলে ফেলি। কোনো একটি বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে আমি ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলাম এবং আমার বগিতে অনেক পরীক্ষার্থী বসে ছিল। সবার হাতে এক ধরনের গাইড বই এবং সবাই গুনগুন করে সেই গাইড বই মুখস্থ করতে করতে যাচ্ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে সেই গাইড বইটি এক নজর দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম—সবাই নানা রকম তথ্য মুখস্থ করে যাচ্ছে। তথ্য মুখস্থ রাখার ক্ষমতা কি বিসিএস পরীক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে?
আমরা যখন একেবারে প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদেরও কিছু মুখস্থ করতে না দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে দিচ্ছি, সেই সময় দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার্থীরা তথ্য মুখস্থ করে যাচ্ছে? তাদের মুখস্থবিদ্যার ক্ষমতা যাচাই না করে সৃজনশীল ক্ষমতা যাচাই করা কি এতই কঠিন? সেটি কি পিএসসির কেউ এখনো জানেন না?

এপ্রিল ১৫, ২০১২

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-04-15

একটি দুঃখের গল্প

মোবারক সাহেব একটা শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বে আছেন, অনেকদিন পর আজকে তার ভিতরে এক ধরনের আত্মতৃপ্তির বোধ কাজ করছে। তিনি সময়মতো তার বোর্ডের ফলাফল প্রকাশ করতে পেরেছেন। বাংলাদেশের মতো দেশে এটি খুব সহজ কাজ নয়, বাইরের মানুষ কখনও জানতে পারবে না সবকিছু ঠিকঠিকভাবে শেষ করতে সবাই মিলে কত পরিশ্রম করতে হয়।

তার বোর্ডে পাশের হার অন্য বোর্ড থেকে কম। তাতে অবশ্যি অবাক হবার কিছু নেই, ফলাফল প্রকাশ করার আগেই তিনি সেটা জানতেন। এখানে অনেক গরীব মানুষ, বাবা-মা লেখাপড়া জানে না, লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝে না। মাঝখানে বন্যায় বই পত্র সহ সবকিছু ভেসে গেল। হরতালে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। ইংরেজি প্রশ্নটাও মনে হয় একটু বেশি কঠিন হয়েছিল।

সবকিছু মিলিয়ে পাশের হার একটু কম হতেই পারে। আস্তে আস্তে পাশের হার বাড়বে, দেশ এগিয়ে যাবে। দেশের এত বড় একটা কাজে সাহায্য করার সুযোগ পেয়েছেন তাতেই মোবারক সাহেব খুশি।

কয়েকদিন পর মোবারক সাহেবকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডেকে পাঠানো হল, কী জন্যে ডাকা হয়েছে সেটা অনুমান করতে পারলেন না। খারাপ কিছু হওয়ার কোনো কারণ নেই। তারপরেও তার ভেতরটা কেন জানি খচখচ করতে লাগল। সারারাত জার্নি করে সকালে ঢাকা পৌচেছেন। ঢাকায় ছোট শালির বাসায় উঠেছেন সবাই। তারা খুব যত্ন করল, তবুও তার ভেতরে কেমন যেন অশান্তি খচখচ করতে লাগল।

মন্ত্রণালয়ে আগে সবাই তাকে খুব সমাদর করত, এবারে কেমন যেন সবাই দূরে দূরে থাকল। তাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। শেষে একজন তাকে ডেকে পাঠাল, বয়স মোবারক সাহেব থেকে অনেক কম কিন্তু এই সরকার আসার পর প্রমোশনের পর প্রমোশন পেয়ে ধাই ধাই করে উপরে উঠে গেছেন। মোবারক সাহেব বসার আগেই মানুষটি খেঁকিয়ে উঠল, “আপনি এইটা কী করেছেন?”

মোবারক সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “কী করেছি?”

“আপনার বোর্ডে সব ছাত্রদেরকে ফেল করিতে রেখেছেন, ব্যাপারটা কী? ছাত্রছাত্রীরা কি ফেল করার জন্যে লেখাপড়া করতে আসে? পেয়েছেন কী আপনি?”

মোবারক সাহেব এত অবাক হলেন যে অপমানিত বোধ করার সময় পেলেন না। সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন, একটা ছাত্রকে কখন পাশ করে কখন ফেল করে সেটা তার থেকে ভালো করে কেউ জানে না। একজন ছাত্রকে শিক্ষক কখনও পাশ করান না, কখনও ফেলও করান না। ছাত্র নিজে পাশ করে না হয় ফেল করে।

মোবারক সাহেব সামনে বসে থাকা কমবয়সী উদ্ধত বড় কর্তা রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, “আপনার কত বড় সাহস, আপনি এই সরকারকে অপদস্ত করার চেষ্টা করছেন? আপনি দেখানোর চেষ্টা করছেন এই সরকারের আমলে লেখাপড়া হয় না। অন্য সব বোর্ডে পাশের হার বেড়ে যাচ্ছে, আর আপনি আপনার বোর্ডে সবাইকে ফেল করিয়ে দিচ্ছেন? আপনি জানেন না এই সরকার শত ভাগ পাশ করানোর টার্গেট নিয়েছে? আপনার মতো মানুষের কারণে আমাদের মুখে চুনকালি পড়ছে? নিশ্চয়ই আপনি রাজাকারদের দলে।”

মোবারক সাহেব থ হয়ে বসে রইলেন, একটা কথাও বলতে পারলেন না। মাথা নিচু করে অফিস থেকে বের হয়ে এলেন।

বাসায় ফিরে আসার পর মোবারক সাহেবের স্ত্রী তাঁর মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? তোমার এ কী চেহারা হয়েছে?”

মোবারক সাহেব বললেন, “আমি চাকরি ছেড়ে দেব।”

মোবারক সাহেবের স্ত্রী চমকে উঠে বললেন, “কেন?”

“আমাকে বলেছে সবাইকে পাশ করাতে হবে। বলেছে কেউ ফেল করার জন্যে পরীক্ষা দেয় না, পাশ করার জন্যে পরীক্ষা দেয়। পাশ না করলে দোষ আমার।”

মোবারক সাহেবের স্ত্রী বুঝতে না পেরে বললেন, “কিন্তু এই লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে তুমি কেমন করে ঠিক করে লেখাপড়া করাবে?’’

মোবারক সাহেব মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, না, লেখাপড়া করে পাশ করানোর কথা বলেনি।”

“তাহলে?”

“বলেছে খাতায় একটু আঁকিবুকি করলেই মার্ক দিতে হবে। পাশ করাতে হবে। যত বেশি পাশ সরকারের তত বেশি ক্রেডিট। তত বেশি সোনার বাংলা।”

মোবারক সাহেবের স্ত্রী তবুও বুঝতে পারলেন না। বললেন “কিন্তু….”

“এর মাঝে কোনো কিন্তু নাই। একজন মাস্টার হয়ে আমি এটা করতে পারব না। হাঁটুর বয়সী ছেলে বড় অফিসার হয়ে আমাকে ধমকাধমকি করে– আমার পক্ষে এই অপমান সহ্য করা সম্ভব নয়।”

মোবারক সাহেবের স্ত্রী তার স্বামীকে ভালো করে চিনেন, একবার মাথায় ঢুকে গেলে আসলেই চাকরি ছেড়ে ছুঁড়ে দিতে পারে। স্বামীর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “প্লিজ তুমি মাথা গরম কর না। চাকরি ছেড়ে দিলে আমরা খাব কী? থাকব কোথায়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার কী হবে? তুমি যেহেতু চাকরি করছ উপরের নির্দেশ তো মানতে হবে।”

মোবারক সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, “উপরের নির্দেশ লিখিত দেওয়ার সাহস নাই। শুধু মুখে বলে। আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি চাকরি ছেড়ে দেব।”

২.

মোবারক সাহেব অবশ্যি শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়লেন না, ছাড়া সম্ভব না। তাই তাদের সব সহকর্মীদের ডেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের কথা জানালেন, বললেন, ছেলেমেয়েরা ফেল করার জন্যে লেখাপড়া করে না, পাশ করার জন্যে লেখাপড়া করে। ছেলেমেয়েরা যেহেতু পাশ করার জন্যে লেখাপড়া করে, তাই কেউ যদি নিচে থেকে পাশ করতে না পারে তাহলে তাকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। এটা সরকারের দায়িত্ব। তারা সরকারি কর্মচারি, তাদের দায়িত্ব সরকারের ইচ্ছা পূরণ করা।

মোবারক সাহেবের কর্মীরা বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, তারা পুরো ব্যাপারটা বুঝে গেলেন, তারপর কাজশুরু করে দিলেন। পরীক্ষার সাথে যুক্ত সবাইকে নিয়ে মিটিংয়ের পর মিটিং করতে লাগলেন, ডিসিদের সাথে কথা বললেন, স্কুলের হেড মাস্টারদের ডেকে পাঠালেন, পরীক্ষাকদের ডেকে পাঠালেন।

মোটামুটি কোনো ঝামেলা ছাড়াই সবাইকে সরকারের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দেওয়া হল। ছাত্রছাত্রীরা যেহেতু পাশ করার জন্যে লেখাপড়া করতে এসেছে তাই তাদের পাশ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে। শুধু একটা মিটিংয়ে খিটখিটে বুড়ো মতো একজন মানুষ ঝামেলা শুরু করল, তেড়িয়া হয়ে বলল, “আমি ঠিক বুঝবার পারলাম না। পোলাপান পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলেও তাগো পাশ করাইতে হবে?”

যিনি মিটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “কিছু না লিখা মানে কী? পরীক্ষার খাতায় সবাই কিছু না কিছু লিখে।”

“উল্টাপাল্টা ছাতা মাতা যাই লিখে তাতেই নম্বর?”

“এখন সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা। সৃজনশীল মানে বুঝেন তো? নিজের মতো করে লেখা– একটু ভুলত্রুটি তো হতেই পারে, দোষ তো ছেলেমেয়েদের না। দোষ সিস্টেমের, ছেলেমেয়েদের ভিকটিমাইজ করে লাভ কী? তাই বলছি উদারভাবে মার্ক দিবেন। বুঝেছেন?”

খিটখিটে বুড়ো বলল, “না, বুঝি নাই। পাশ মার্ক না পাইলে আমি পাশ করাবার পারুম না।”

মিটিংয়ের দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি এবার রেগে উঠলেন, বললেন, “আপনি কি চান আপনাকে পরীক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেই? সরকারের এককটা শুভ উদ্যোগকে এ রকম নেগেটিভভাবে দেখছেন কেন?”

খিটখিটে বুড়ো টেবিলে থেকে তার ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা শুরু করল। মিটিংয়ের পরিচালক আরও রেগে উঠলেন, বললেন, “কী হল? আপনি কই যান?”

“আমি মাস্টার মানুষ। নিজের হাতে ছেলেমেয়েদের সর্বনাশশ করবার পারুম না। আপনার করেন। আল্লাহ যেন আপনাদের মাপ কইরে দেয়।”

খিটখিটে বুড়োটা চলে যাবার পর মিটিংয়ের পরিচালক মেঘ স্বরে বললেন, “কে? কে এই বেয়াদপ মানুষটা? কত বড় বেয়াদব।”

একজন বলল, “মডেল স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক।”

“কী রকম শিক্ষক?”

“খুব ভালো। তবে ঘাড় ত্যাড়া, প্রাইভেট পড়ালে লাখ টাকা কামাতে পারে, পড়ায় না। তাই নিয়ে বউয়ের সাথে রাত দিন ঝগড়া। সংসারে অশান্তি…”

“কত বড় সাহস। আমাকে জ্ঞান দেয়। নিশ্চয়ই রাজাকার।”

“জে না। মুক্তিযোদ্ধা ছিল।”

“এই রকম মুক্তিযোদ্ধা আমার অনেক দেখা আছে।”

মিটিংয়ের পরিচালক গজ গজ করতে লাগলেন।

তবে ‘ঘাড় ত্যাড়া’ শিক্ষক খুব বেশী পাওয়া গেল না, বিষয়টা নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও প্রায় সবাই এই নূতন পদ্ধতি মিনে নিলেন, ছাত্রছাত্রীদের যেভাবে সম্ভব পাশ করাতে হবে।

৩.

সবুজ মুখে সিগারেটটা চেপে রেখে তার চুলে জেল দিচ্ছিল, তখন তার মা ঘরে এসে ঢুকলেন, মাকে দেখে সবুজ তাড়াতাড়ি তার সিগারেটটা হাত দিয়ে ধরে পিছনে লুকিয়ে ফেলল। মা দেখেও না দেখার ভান করলেন, বললেন, “বাবা, তোর পরীক্ষা তো এসে গেল। একটু বই নিয়ে বসবি না?”

সবুজ উদাস মুখে বলল, “নাহ্ আম্মু। ঠিক করেছি এই বছর পরীক্ষা দিব না।”

“কেন? পরীক্ষা দিবি না কেন?

সবুজ বিরক্ত হয়ে বলল, “পরীক্ষা দিতে হলে লেখাপড়া করতে হয়। আমি কোনো লেখাপড়া করি নাই। ইন্টারের সিলেবাস কত বড় তুমি জান?”

মা ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তোর বাবা শুনলে খুব রাগ করবে।”

সবুজ আরও বিরক্ত হয়ে বলল, “বাবার শোনার দরকার কী? থাকে সউদি আরবে, মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে তার দায়িত্ব শেষ। আমি পরীক্ষা দিলাম কি না দিলাম তাতে বাবার কী আসে যায়?”

মা আরেকটু কাছে এসে ছেলের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “প্লিজ বাবা, প্লিজ! পরীক্ষাটা দে।”

সবুজ মায়ের হাত সরিয়ে বলল, ‘‘আহ্ মা! তুমি বড় বিরক্ত কর। যাও দেখি।”

মা কাতর গলায় বললেন, ‘‘বাবা, আমি তো বলি নাই তোর পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন ফাইভ পেতে হবে। শুধু বলেছি পরীক্ষাটা দে।”

“পরীক্ষা দিলে ফেল করব।”

“তবু পরীক্ষাটা দে।”

“আমার কোনো বইপত্র পর্যন্ত নাই। কোনো কোচিং করি না।”

“তোকে সব বই কিনে দেব।”

“কিন্তু খাতায় আমি কী লিখব? আউল ফাউল জিনিস?”

“যা ইচ্ছে তাই লিখবি বাবা। তবু পরীক্ষাটা দে। তোর বাবাকে বলতে পারব তুই পরীক্ষা দিয়েছিস। রেজাল্ট খারাপ হলে কিছু একটা বলা যাবে।”

শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে সবুজ পরীক্ষা দিতে রাজি হল। তবে এক শর্তে সে কোনো লেখাপড়া করতে পারবে না।

৪.

রনি রাত নয়টার সময় বাসায় ফিরে এল, তখন তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নাই। প্রথমে কোচিং, তারপর গণিত স্যারের কাছে প্রাইভেট, তারপর ফিজিক্স স্যারের কাছে ব্যাচে পড়া। বাসায় ফিরে আসতে প্রত্যেকদিনই দেরি হয়। স্যারেরা সাজেশন দিয়েছে আজকে রাত জেগে মুখস্ত করতে হবে, চিন্তা করেই রনির মনটা খারাপ হয়ে গেল।

মা রনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আয় বাপ, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আর। মুখটা শুকিয়ে দেখি এতটুকু হয়ে গেছে।”

রনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার ইচ্ছা ছিল বাংলা কিংবা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার। সেটা যদি না হয় তাহলে সাংবাদিকতা পড়া, ঘাড়ে ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক হয়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে সব সময়েই সে এ রকম একটা স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু রনির বাবা-মা তার স্বপ্নকে কোনো দাম দেননি, জোর করে তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়িয়েছেন, তাকে জোর করে ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন।

বাধ্য হয়ে সে গণিত পড়ছে, ফিজিক্স পড়ছে, কেমেস্ট্রি পড়ছে। বুঝতে খুব কষ্ট হয়, তাই সে সবকিছু মুখস্ত করে ফেলার চেষ্টা করে। মুখস্ত করতে কী কষ্ট! রাত্রিবেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে তখন সে একা একা বই মুখস্ত করে। মনে মনে ভাবে, তাদের জীবনটা এত কষ্টের কেমন করে হল!

খাবার টেবিলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “রনি, তোমার পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন হচ্ছে?”

রনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্যি কথাটাই বলল, “ভালো না আব্বু।”

বাবা ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন ভালো না?”

“আমার সায়েন্স বুঝতে কষ্ট হয়। তাই না বুঝে সবকিছু মুখস্ত করতে হয়।”

“লেখাপড়া করলে তো একটু আধটু মুখস্ত করতেই হয়।”

“একটু আধটু নয় আব্বু, পুরো বই মুখস্ত করতে হয়। আমার সায়েন্স নেওয়াটা ভুল হয়েছে– তোমরা জোর করে সায়েন্সে ঢুকিয়ে দিলে।”

মা রনির প্লেটে মুরগির একটা রান তুলে দিয়ে বললেন, “কোনো চিন্তা করিস না বাবা, দেখিস তোর পরীক্ষা খুব ভালো হবে। নির্ঘাত গোল্ডেন ফাইভ।”

রনি দুর্বলভাবে হাসল, বলল, “গোল্ডেন ফাইভ না আরও কিছু। শুধু কোনোভাবে টেনে টুনে পাশ করলেই আমি খুশি।”

৫.

প্রিয়াংকা পড়ার টেবিলে বসে তার বইটির দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু এই মূহূর্তে সত্যিকার অর্থে সে কিছু দেখছিল না। পাশে তার মা হাতে কয়েকটা কাগজ নিয়ে দাড়িয়েছিলেন, প্রিয়াংকাকে বললেন, “মা। একবার দেখ।”

প্রিয়াংকা কঠিন গলায় বলল, ‘‘না। দেখব না।”

“দেখ মা। সবাই দেখছে, তুই কেন দেখবি না?”

“না মা। তুমি আমাকে দেখতে বল না। আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দিব না।”

মা বললেন, “সবার পরীক্ষা ভালো হবে, গোল্ডেন ফাইভ পাবে, শুধু তুই পাবি না। তখন তুই মন খারাপ করবি।”

“করলে করব। কিন্তু আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখব না। দেখব না দেখব না দেখব না। আমাকে তুমি অন্যায় কাজ করতে বল না।”

“এটা তো অন্যায় না মা। সবাই সেটা করে সেটা অন্যায় হবে কেমন করে? এটাই তো নিয়ম।”

“আমি এই নিয়ম মানি না।”

প্রিয়াংকা দুই হাত দিয়ে তার চোখ বন্ধ করে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ল। মা দেখলেন তার দুই হাতের ফাঁক দিয়ে চোখের পানি ফোটা ফোটা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

পৃথিবীর সব ছেলেমেয়ে এক রকম, কিন্তু তার মেয়েটি কেন অন্যরকম হয়ে জন্ম নিল? মা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো হাতে নিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন।

৬.

পরীক্ষার হলে সবুজ প্রথম এক দুইদিন প্রশ্নটা একটু পড়ার চেষ্টা করলেও শেষের দিকে সেটাও ছেড়ে দিল, প্রশ্ন পড়ে সে আগা-মাথা কিছুই বুঝে না, তাহলে শুধু শুধু পড়ে কী লাভ? শুধু মাকে খুশি করার জন্যে সে পরীক্ষা দিতে এসেছে। তাই পরীক্ষার খাতায় সে যা মনে আসে তাই লিখে এল। কোনো মাথা-মুণ্ডু নেই সেই রকম অবান্তর কথা। পরীক্ষার প্রশ্নে যে শব্দগুলো আছে সেই সব শব্দ দিয়ে তৈরি একটা দুইটা বাক্য, কখনও আস্ত প্যারাগ্রাফ। যে পরীক্ষার খাতা দেখবে তার কাছে যেন মনে হয় আসলেই বুঝি পরীক্ষার উত্তর লিখছে। এক ধরনের তামাশা বলা যায়।

রনির পরীক্ষা যত খারাপ হবে বলে ভেবেছিল তত খারাপ হল না। প্রশ্নগুলো ফাঁস হয়েছিল বলে রক্ষা কিন্তু তবুও খুব লাভ হয়নি, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর সে প্রাণপণে মুখস্ত করে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এত কিছু তার মনে থাকে না। তবুও সে লিখে এসেছে, হিসেব করে দেখেছে টেনেটুনে জিপিএ ফোর হয়ে যাবে। তার জন্যে জিপিএ ফোর অনেক।

প্রিয়াংকার জন্যে পরীক্ষাগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সে ভালো স্কুলে পড়ে তার ক্লাশের সবাই ভালো ছাত্রী। সবাই ফাঁস হয়ে আসা প্রশ্নগুলো দেখে এসেছে। প্রশ্নটা হাতে পেয়েই সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছে, শুধু সে নিঃশ্বব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। সবাই যখন টানা মুখস্ত লিখে যাচ্ছে, সে তখন চিন্তা করে করে লিখেছে। মনটা ভালো নেই, ভোরে উৎসাহ নেই, তা না হলে পরীক্ষা আরও ভালো হত। পরীক্ষার উত্তর দিতে দিতে মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসে। নিজেকে বুঝিয়ে শান্ত করে সে দাঁতে দাঁত চেপে পরীক্ষা দিচ্ছে।

প্রশ্নটা হাতে নিয়ে তার চোখে পানি এসে যায়, এত বড় একটা অন্যায় কিন্তু দেশে কোনো প্রতিবাদ নেই। মন্ত্রী বলছেন, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, এগুলো সাজেশন। সাজেশন? প্রিয়াংকার ইচ্ছা করে টেবিলে মাথা কুটে রক্ত বের করে ফেলে। খোদা তাকে কেন এমন একটা দেশে জন্ম দিল? কেন?

৭.

পরীক্ষার ফল বের হয়েছে. সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। শুধু সবুজের পরীক্ষা নিয়ে কেনো দুর্ভাবনা নেই, তার নিজের ফলাফল জানারও কোনো আগ্রহ নেই। সৌদি আরবে বাবাকে কিছু একটা জানাতে হবে, পরীক্ষার আগে ডেঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, তাই ভালো করে পরীক্ষা দিতে পারেনি, এ রকম একটা গল্প বলা যাবে।

দুপুরের দিকে সবুজের একজন বন্ধু তাকে ফোন করে জানাল সবুজ নিশ্চয়ই পরীক্ষায় পাশ করেছে, কারণ তার কলেজে শত ভাগ পাশ! তার এই বন্ধু একটু ঠাট্টা তামাশা বেশি করে, তাই ইয়ার্কি করছে ভেবে সবুজ ফোন রেখে দিলেও তার ভেতরটা খচ খচ করতে লাগল। সে সাহস করে মোবাইলে খোঁজ নিয়ে দেখে সে সত্যিই পাশ করে ফেলেছে, জিপিএ খুবই খারাপ কিছু পাশ!

সবুজ একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল এবং সেই চিৎকার শুনে মা ভয় পেয়ে ছুটে এলেন। সবুজ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘আম্মু আমি পাশ করেছি।’

মায়ের মুখ একশ ওয়াট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল, ছেলে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আমি জানতাম তুই পাশ করবি! তোর মতো ছেলে কয়টা আছে, একেবারে না পড়ে পরীক্ষা দিয়ে তুই পাশ করে ফেলেছিস, একটু যদি পড়তি তাহলে কী হত চিন্তা করতে পারিস?”

সবুজ আসলেই চিন্তা করতে পারে না, সে কেমন করে পাশ করেছে সেটাও বুঝতে পারে না। নিশ্চয়ই পরীক্ষার খাতায় সে যেগুলো লিখেছিল সেগুলো খুবই সৃজনশীল লেখা ছিল, সে জন্যেই তাকে পাশ করিয়ে দিয়েছে।

মা ছেলের হাতে সৌদি আরবে থাকা বাবার পাঠানো টাকা থেকে এক হাজার টাকা বের করে দিয়ে বললেন, “যা বাবা, মিষ্টি কিনে আন।”

সবুজ মিষ্টি কিনতে গিয়ে দেখে সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে গেছে, শেষ পর্যন্ত কিছু নিমকি কিনে আনল। পাশ করলে শুধু মিষ্টি খেতে হবে কে বলেছে? মাঝে মাঝে নোনতা জিনিসও খাওয়া যায়।

রনি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে। আব্বু আম্মু খুব খুশি কিন্তু রনি নিজে হিসাব মিলাতে পারছে না, সে অনেকবার হিসাব করে দেখেছে, সেখানে কিছুতেই জিপিএ ফাইভ হওয়ার কথা না। কিন্তু হয়ে গেছে– সে নিজের চোখে দেখেছে।

বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “দেখেছিস? আমি বলেছিলাম না তুই পারবি! এই দেখ তুই পেরেছিস।”

আম্মু বললেন, “মানত করেছিলাম পাগলা বাবার মাজারে এক হাজার টাকা দিব। এক্ষুনি টাকাটা পাঠাতে হবে।”

শুধু ছোট বোনটা ঠোট উল্টে বলল, ‘‘গোল্ডেন ফাইভ এমন কী ব্যাপার, সবাই পায়!”

আম্মু ঠমক দিয়ে বললেন, “চুপ কর পাজি মেয়ে। তুই এমন হিংসুটে হলি কেমন করে?”

রাতে ঘুমানোর সময় রনির মনে হতে লাগল আসলে এতদিন সে নিজের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখেছে। সে আসলে অসম্ভব প্রতিভাবান। বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবীদের একজন– এখন ইচ্ছা করলে সে বাংলাদেশের যে কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভতি হতে পারবে। সে ইচ্ছা করলে ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে, না হলে ডাক্তার হতে পারবে। বিশাল একটা ইঞ্জিনিয়ার না হয় বড় একজন ডাক্তার হয়ে সে তার মতো আরেকজন মেধাবী মেয়েকে বিয়ে করবে! ফুটফুটে চোহারার সুন্দরী একটা মেয়ে।

রনি বিছানায় এপাশ ও পাশ করে, আনন্দে চোখে খুম আসতে চায় না।

প্রিয়াংকার গোল্ডেন ফাইভ হয়নি। ফিজিক্সে একটুর জন্যে ছুটে গেছে। তার ক্লাশের সব মেয়ের গোল্ডেন ফাইভ হয়েছে। হাবাগোবা যে মেয়েটা কিছু পারে না যে সব সময় প্রিয়াংকার কাছে পড়া বুঝতে আসত সেও গোল্ডেন পেয়েছে। শুধু সে পায়নি। ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন না দেখলে এ রকম তো হতেই পারে। প্রশ্ন তো যথেষ্ট কঠিন হয়েছিল। এই প্রশ্নে জিপিএ ফাইভ তোলা তো সোজা কথা নয়।

প্রিয়াংকা স্কুলের সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। অন্যরা সবাই চেঁচামেচি করছে। হঠাৎ করে দরজা খুলে টেলিভিশন ক্যামেরা হাতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এসে ঢুকল। একজন ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করে বলল, “তোমরা কী খুশি?”

সবাই চিৎকার করে বলল, “হ্যাঁ খুশি।”

“তাহলে আনন্দ করছ না কেন?”

সবগুলো মেয়ে তখন আনন্দে চিৎকার করতে লাগল, একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতে লাগল, লাফাতে লাগল নাচতে লাগল।

শুধু প্রিয়াংকা একা চুপচাপ সিঁড়িতে বসে রইল।

১০

সবুজ একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। এই নিয়ে পত্র পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লেখালেখি হয়ে, কাউকে লেখাপড়া করতে হয় না, ক্লাশে যেতে হয় না, প্রতি সেমিস্টারে গ্রেড চলে আসে। কয়েক বছর নিয়মিত টাকা দিয়ে গেলেই সার্টিফিকেট। সবুজ একটা বিবিএর সার্টিফিকেট নিয়ে নেবে।

রনি যতগুলো সম্ভব সবগুলো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে, কোথাও টিকতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কী, কোথাও পাশ করতে পারেনি। প্রথম দিকে বাবা মা উৎসাহ আর সাহস দিয়েছেন, শেষের দিকে তারা প্রথমে হতাশ, তারপর বিরক্ত এবং শেষে কেমন যেন ক্ষেপে উঠলেন।

একদিন খাবার টেবিলে বাবা বলেই বসলেন, “তুই কী রকম ছাত্র? ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়া তো দুরের কথা– কোথাও পাশ পর্যন্ত করতে পারিস না?”

রনি দুর্বল গলায় বলল, “আমি তো চেষ্টা করছি!”

“এই চেষ্টার নমুনা…’’ বাবা হুংকার দিলেন, “এই গোল্ডেন ফাইভ? এর জন্যে আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোদের জন্যে পরিশ্রম করি? সামান্য একটা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাস না?”

রনি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘‘আমি কী করব?”

“দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে– দূর হয়ে যা।”

রনি খাবার টেবিল থেকে উঠে গেল। রাত্রিবেলা বাথরুমে রাখা এক বোতল হারপিক খেয়ে ফেলল। মাঝরাতে হাসপাতালে দৌঁড়াদৌড়ি। জানে বেঁচে গেল কিন্তু ভেতরটা ঝলসে গিয়ে খুব খারাপ অবস্থা।

প্রিয়াংকা খুব শক্ত মেয়ে ছিল, কিন্তু একসময় সেও ভেঙ্গে পড়ল। একদিন হাউ মাউ করে কেদেঁ তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দাও, এই দেশে আমি আর থাকতে পারছি না।”

মা অবাক হয়ে বললেন, “সে কী, তুই না তোর দেশকে এত ভালোবাসিস। সব সময় বলেছিস দেশের জন্যে কিছু একটা করবি?”

“হ্যাঁ মা বলেছিলাম।”

“তোর না দেশ নিয়ে এত স্বপ্ন ছিল?”

“ছিল মা। এখন আর কোনো স্বপ্ন নাই।’’

মা অবাক হয়ে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন– এই মেয়েটির চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই?

১১.

গল্পটা এখানে শেষ। এটা কাল্পনিক গল্প, নামগুলো বানানো কিন্তু ঘটনাগুলো সত্যি। প্রিয়াংকার ই-মেইলটা আমার কাছে আছে। যাদের দায়িত্বে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তারা কি জানেন এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এখন কী ভয়ংকর অবস্থা? শতভাগ পাশ করিয়ে দেওয়ার এই মহাপরিকল্পনায় সবচেয়ে এগিয়ে মাদ্রাসা– তারা ৯৫% পাশ করিয়েছে।

৯৫%? আমাকে চোখ কচলে দুইবার দেখতে হয়েছে বিশ্বাস করার জন্যে। মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী নিজে এই সংখ্যাটি বিশ্বাস করেন?

ঢাকা বোর্ড ৮৫%, যশোর বোর্ড ৬০%। যশোরের বাতাস কি বিষাক্ত? কেন এত কম ছেলেমেয়ে পাশ করল? আমি কি বাজি ধরে বলতে পারি না সামনের বছর এক লাফে যশোর বোর্ড এগিয়ে যাবে– যেভাবে সিলেট বোর্ড এগিয়ে গিয়েছিল? ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে কার জন্যে এই প্রহসন? দেশ ধ্বংস করার কার এই মহাপরিকল্পনা?

মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ালে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের হিসেবে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সেগুলো ছিল ‘সাজেশন’। আমি যখন প্রশ্ন ফাঁসের কথা বলেছি তখন সেটা নিশ্চয়ই ছিল “বিভ্রান্তি ছড়ানো”। আমার নিশ্চয়ই শাস্তি পাওনা হয়েছে।

আমি আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি আমার ভাগ্যে কী শাস্তি রয়েছে!

কিছু একটা করি

দশ বারো বছর আগের কথা। তখন জামাত-বিএনপি-হাওয়া ভবনের রমরমা রাজত্ব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন মানুষজনকে ভিসি-প্রোভিসি হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা লেখাপড়া নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নিজের দলের মানুষজনকে নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরণের তান্ডব চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের একমাত্র কাজ। “দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়” এরকম একটা কথা আছে তাই আমরা দাঁতে দাঁত কামড়ে কোনোমতে টিকে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম দূরে থাকুক, একটা সূতো পর্যন্ত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পারি না। তখন হঠাৎ একদিন আমি একটা বিষয় আবিষ্কার করলাম, আমি দেখলাম যখনই আমরা কয়েকজন শিক্ষক একত্র হই তখনই চারপাশে কী কী খারাপ খারাপ ব্যাপার ঘটছে সেটা নিয়ে কথা বলি, তারপর সবাই লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলি! সবার ভেতরেই এক ধরণের ক্ষোভ, মন খারাপ করা হতাশা, আমরা একে অন্যের সাথে সেটা দেয়া নেয়া করছি। তাতে ক্ষোভ, হতাশা আর মন খারাপটুকু আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমাদের সবার ভেতরেই বিদ্যাবুদ্ধি জ্ঞান নির্ভর এক ধরণের মানসিকতা আছে, কাজেই আমরা যখন একত্র হব তখন আমাদের এরকম বুদ্ধি ভিত্তিক মুক্ত চিন্তার বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিৎ। আমি তখন আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা একত্র হয়ে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। এটার নাম দেয়া হল “টুইসডে আড্ডা” এবং নানা ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এটা এখনো টিকে আছে। এখনো মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলা আমরা একত্র হই, কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলি। কথাবার্তা গুলো যদি লিখে রাখা হতো তাহলে সেগুলো অত্যন্ত চমকপ্রদ একটা সুখপাঠ্য বিষয় হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেকদিন পর আমার এই “টুইসডে আড্ডা”র জন্ম কাহিনী মনে পড়ে গেল তার কারণ হঠাৎ করে আমি লক্ষ্য করলাম আমি আবার একই বিষয় করে যাচ্ছি। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আমার ভেতরে ক্ষোভ এবং হতাশা, আমি দিনের পর দিন সেই ক্ষোভ আর হতাশার কথা লিখে যাচ্ছি। (একটু খানি হলেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেছে, ভবিষ্যতে যদি আর কখনো প্রশ্নপত্র ফাঁস না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায় আমার ধারণা আমরা অনেক খানি অর্জন করেছি বলে দাবী করতে পারব।) কিন্তু আমি আর ক্ষোভ এবং হতাশার কথা লিখতে চাই না, স্বপ্নের কথা লিখতে চাই।

গত ১১ তারিখ মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীর দফতরে এই দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটা সভা হয়েছে, এই সভার আলোচ্য বিষয় হিসেবে যদিও “প্রশ্নপত্র ফাঁস” কথাটি ব্যবহার করা হয়নি কিন্তু সবাই জানতো নিশ্চিতভাবেই এটা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনা হয়েছে এবং মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী সবার সামনে অঙ্গীকার করেছেন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাবার পর ভবিষ্যতে যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয় সে ব্যাপারে যেটুকু করা সম্ভব হয় সেটা করবেন। আমরা তাই আপাতত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছি।

১১ তারিখের সভায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিছু কিছু বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমি তার কয়েকটা এখানে সবার জন্যে তুলে ধরছিঃ

ক) আমাদের দেশে আর নূতন কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের দরকার নেই। ষোল কোটি মানুষের কোনো একটি দেশে হয়তো আরো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল কলেজ থাকা সম্ভব কিন্তু আমাদের দেশের জন্যে সেটি সত্যি নয় – তার কারণ এই দেশে এই মুহুর্তে নূতন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে পড়ানোর জন্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে, জেনে শুনে সেটার আরো সর্বনাশ করার কোনো অর্থ নেই।

খ) আজকাল পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাশের হার একেবারে আকাশ ছোঁয়া, বিষয়টা নিয়ে আমরা সবাই আনন্দ করতে পারতাম – এমনকি গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু আসলে আমরা সেটা নিয়ে আনন্দ কিংবা গর্ব করি না, মুখ বুঁজে হজম করি। তার কারণ যারা পরীক্ষার খাতা দেখেন তাদেরকে অলিখিত কিন্তু কঠিনভাবে মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয় সবাইকে শুধু উদারভাবে নয়, দুই হাতে মার্কস দিতে হবে। বিষয়টি এই দেশের সবাই জানে কিন্তু আমরা খুবই অবাক হলাম যখন টের পেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটি জানে না! যদি সত্যি তারা না জানেন তাহলে বিষয়টা আরো ভয়ঙ্কর, তার অর্থ এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় নির্দেশের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মত করে পরীক্ষা পাশের মচ্ছব বসিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা নানা কারনে হৃদয় বিদারক, যার সব বিষয়ে জিপিএ ফাইভ পাবার কথা না তাকেও যদি রীতিমত জোর করে জিপিএ ফাইভ দিয়ে দেওয়া হয় তখন তার নিজের সম্পর্কে একটা ভুল ধারনা হয়ে যায়। যখন এই অতিরঞ্জিত গ্রেড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া দূরে থাকুক পাশ পর্যন্ত করতে পারেনা তখন তারা খুব খারাপ ভাবে একটা ধাক্কা খায়। তাদের আত্মবিশ্বাস আত্মসম্মান একেবারে ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের এভাবে মানসিক নির্যাতনে ঠেলে দেয়ার কোন মানে হয় না।

গ) আমরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করছি মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে এক ধরনের সাম্প্রদায়ীকরন করা হচ্ছে। বইয়ের বিষয় বস্তু, বইয়ের ছবিতে এক ধরনের কৃত্রিম বিভাজন নিয়ে আসা হচ্ছে। সাধারন ছেলেমেয়ের ছবি নেই, সব টুপি পরা ছেলে হিজাব পরা মেয়ে। এ ধরণের সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে মন্ত্রণালয় জানে না এবং এনসিটিবি নিজেদের উদ্যোগে সেগুলো করে ফেলছে – এটি হচ্ছে সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার। আমরা আমাদের শিক্ষানীতিতে খুব উচ্চ কন্ঠে বলব এই দেশটা সকলের জন্যে, কিন্তু পাঠ্যবইগুলো ছাপাব দেশ সম্পর্কে খুব ভিন্ন একটা ধারনা দেবার জন্যে সেটা তো হতে পারে না।

ঘ) স্কুল পরিচালনা কমিটি গুলোতে যোগ্য লোকের খুব অভাব। সরকারী দলের অনুসারী কিংবা ক্ষমতাশালী লোকজন এই কমিটির সভাপতি হিসেবে থেকে স্কুলের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। নিয়োগ নিয়ে ভয়ঙ্কর এক ধরনের বাণিজ্য হচ্ছে এবং শিক্ষক হিসেবে যোগ্য নয় এরকম মানুষজন দূর্নীতি করে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছে। একটা স্কুলে যদি ভালো শিক্ষক না থাকে তাহলে সেই স্কুলের আর থাকল টা কী?

ঙ) পৃথিবীর সব দেশে একটা স্কুল যে এলাকায় থাকে সেই এলাকার ছেলেমেয়েরা সেই স্কুলটিতে পড়ার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সেটি ঘটেনি, এখানে যে স্কুলগুলোর ভালো স্কুল হিসেবে সুনাম আছে সবাই সেখানে পড়ার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেই স্কুলে পড়ানোর জন্যে বাবা মায়েরা হন্যে হয়ে পড়েন, এমন কোনো কাজ নেই যেটা করেন না। অথচ প্রত্যেকটা স্কুল যদি একটা নির্দিষ্ট এলাকার ছেলেমেয়ের জন্যে নির্দিষ্ট করা থাকতো তখন অন্য কোনো উপায় না দেখে সবাই তার এলাকার স্কুলটাকে ভালো করে তোলার চেষ্টা করতো। সারা দেশে তখন একটি দুটি ভালো স্কুল না থেকে অসংখ্য ভালো স্কুল গড়ে উঠতো।

চ) আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখন পরীক্ষার চাপে রীতিমত জর্জরিত। উচু ক্লাশে ওঠার পর পরীক্ষার ব্যাপারটি ঠিক আছে কিন্তু নিচু ক্লাশগুলো থেকে পরীক্ষা পুরোপুরি তুলে দেয়া হোক যেন বাচ্চারা পরীক্ষার ভয়ে আতংকিত হয়ে লেখাপড়া না করে শেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে। (এই প্রস্তাবটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে – লেখাপড়া ঠিক ভাবে করানো হচ্ছে কী না সেটি যাচাই করার জন্যে পরীক্ষার একটা ভূমিকা থাকে, কিন্তু আমাদের দেশে সেটা বাড়াবাড়ি একটা পর্যায়ে চলে গেছে! বিশেষ করে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার কারনে পরীক্ষাগুলোর আর কোনো গুরুত্ব নেই।)

এখানে আধ ডজন প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে, এ ছাড়াও আরো নানা ধরনের প্রস্তাব ছিল। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে সবগুলো প্রস্তাব খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। যদি এগুলো সত্যি সত্যি কার্যকর করা হয় আমার ধারনা এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হবে।

২।

আমাদের দেশের জ্ঞানী গুণী মানুষেরা শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে হলেই দুটো ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতার কথা মনে করিয়ে দেন। তার একটি হচ্ছে গাইড বুক অন্যটি হচ্ছে কোচিং সেন্টার। কিন্তু এই দেশের সব মানুষ কী জানে মুখে গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে কথা বললেও দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো যে শিক্ষা সংক্রান্ত পাতা এর নামে পুরোপুরি গাইড বইয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে? গাইড বই যেরকম ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে শেখায় এই পত্রিকাগুলোও সেরকম প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে শেখায়। গাইড বই যেরকম টাকা দিয়ে কিনতে হয় এই পত্রিকাগুলোও টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ব্যাপারটা কতো গুরুতর দেখার জন্যে আমি আজকের (১লা আষাঢ়, বর্ষার প্রথম দিন, ভেবেছিলাম সব পত্র পত্রিকা তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় কদম ফুলের ছবি দিয়ে বর্ষাকে স্বাগত জানাবে! জানায়নি, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা সবকিছুকে তুচ্ছ করে ফেলেছে।) একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হাতে নিয়েছি। পড়াশোনা সংক্রান্ত অংশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিজ্ঞানের প্রশ্ন হিসাবে শূণ্যস্থান পূরণ করার জন্যে প্রথম প্রশ্নটি এরকমঃ “আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ____ ছড়িয়ে আছে।” আমাকে শূণ্যস্থানটি পূরণ করতে দেয়া হলে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম, আমাদের চারপাশে অনেক কিছু ছড়িয়ে থাকতে পারে যার প্রত্যেকটি শুদ্ধ উত্তর হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার “গাইড বই” ঠিক প্রশ্নটির নিচেই উত্তর লিখে দিয়েছে, “রোগজীবানু”! ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা করার জন্যে প্রশ্নগুলো দেওয়া হয় নি তাহলে উত্তরটি অন্য কোথাও থাকতো – শুণ্যস্থান পূরণ করে ছাত্রছাত্রীরা পরে মিলিয়ে দেখতো শুদ্ধ হয়েছে কী না। প্রশ্নের ঠিক নিচে উত্তর লেখা আছে – চিন্তা করার সুযোগ নেই – মুখস্ত করার জন্যে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের ২৫টি এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ১৭টি প্রশ্ন ঠিক এরকম। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের প্রশ্নগুলো বহু নির্বাচনী এবং সেখানেও একই ব্যাপার। প্রশ্নের সাথেই উত্তর, নিজেকে যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আমাকে সবাই অভিযোগ করেছে যে দেশে সৃজনশীল পরীক্ষারও গাইড বই বের হয়ে গেছে। আমি এখনো নিজের চোখে সেটা দেখিনি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার শিক্ষাপাতায় এই প্রথম সৃজনশীল প্রশ্নের গাইড বই কী রকম হয় সেটা দেখার অভিজ্ঞতা হল। ৬ষ্ট শ্রেণীর ইংরেজীর একটি প্রশ্ন এরকমঃ What are computers must from? অনেকে মনে করতে পারেন ছাপার ভুলে এরকম বিদঘুটে একটা ইংরেজী বাক্য লেখা হয়ে গেছে। আসলে ছাপার ভুল নয়, কারন উত্তরটাও সাথে সাথে দেওয়া হয়েছেঃ Computers are must from word processing to nuclear weapon। যিনি লিখেছেন তিনি এটাকে শুদ্ধ জেনেই লিখেছেন। পত্রিকা সেটা আরো গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।

গাইড বই সরকার থেকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে। যদি এটা সত্যিই বেআইনী হয়ে থাকে তাহলে পত্রিকাগুলো যখন গাইড বইয়ের দায়িত্ব পালন করে তখন সেটাকে কেন বেআইনী বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? (আমি জানি আমার নির্বোধের মত কথা শুনে সবাই অট্টহাসি হাসছেন, যে সংবাদপত্রগুলো আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাভাবনাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যায়, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলার সময় অন্য সব কিছুকে গুরুত্বহীন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে, উচু জায়গায় ভিনদেশী জাতীয় পতাকা উড়াতে গিয়ে তরুনেরা রুটিন মাফিক ইলেকট্রিক শক খেয়ে মারা যাবার পরও এই রাষ্ট্রবিরোধী কাজগুলোকে উৎসাহ দিয়ে যায় – সেই সংবাদপত্রগুলো গাইড বই হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা নিশ্চয়ই অনেক বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ!)

৩।

আমি নিশ্চিত ভাবে জানি পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রো রেল নয় রুপপুর পারমানবিক শক্তি কেন্দ্র কিংবা রামপালের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয় – এই দেশের ছেলেমেয়েদের সত্যিকারের লেখাপড়াই শুধুমাত্র দেশের সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবে। জিডিপি এর ৬ শতাংশ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে করা হবে সেরকম অঙ্গীকার করা হলেও বাংলাদেশ সরকার তার জিডিপি এর মাত্র ২.২ শতাংশ শিক্ষার জন্যে খরচ করে। এই হিসেবে বাকী পৃথিবী যদি বাংলাদেশকে অশিক্ষিত অসভ্য এবং বর্বর দেশ হিসেবে গালাগাল করে আমাদের সেটা মাথা পেতে নিতে হবে। অনেক চেচামেচি করেও শিক্ষা খাতে বাড়তি টাকা আনা যাচ্ছেনা সেজন্যে আমরা মাঝে মাঝেই চিন্তা করি ব্যক্তি উদ্যোগ কিংবা স্বেচ্ছাশ্রমে আমাদের কিছু করার আছে কী না। এ ব্যাপারে আমি সবচেয়ে বড় উৎসাহ পেয়েছি রাগিব হাসান নামে আলাবামা ইউনিভার্সিটির একজন তরুণ শিক্ষকের কাছ থেকে। ব্যাপারটি ঘটেছে এভাবেঃ

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে ব্রেইল বই দরকার যে বইগুলো স্পর্শ করে পড়া যায়। বছরের শুরুতে সবাই নূতন বই পেলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা নূতন দূরে থাকুক কোনো বইই পায় না! তাদের কাতর অনুরোধ শুনতে কেউ রাজী নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের পাঠ্যবইগুলো ছাপিয়ে দেওয়া যায় কী না সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা শুরু হলে এনসিটিবি থেকে পাঠ্যবইগুলোর ইলেকট্রনিক সফট কপি চাওয়া হলে তারা কোনো সাহায্য করতে পারল না। তাদের ওয়েব সাইটে সব পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ কপি রয়েছে কিন্তু সেগুলো থেকে ব্রেইল বই ছাপানো সম্ভব না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হাল ছেড়ে দেয় কিন্তু রাগিব হাসানের মত নূতন প্রজন্মের তরুণেরা হাল ছাড়ে না। সে নেটওয়ার্কে সারা পৃথিবীর সব বাংলাদেশী তরুণদের অনুরোধ করল বাংলা পাঠ্যবইগুলো টাইপ করে দিতে। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মাঝে সবাই মিলে সেই বইগুলো টাইপ করে দিল। বছরের পর বছর কাতর অনুনয় বিনুনয় করে এনসিটিবি থেকে যেটি পাওয়া সম্ভব হয় নি, বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ তরুণীরা অল্প কয়েকদিনে সেটা উপহার দিয়ে দিল! এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম crowd sourcing – এটাও আমি রাগিব হাসানের কাছ থেকে শিখেছি। অসংখ্য মানুষ মিলে আপাতত দৃষ্টিতে অসম্ভব একটা কাজ করে ফেলা!

এর পর থেকে আমার মাথার মাঝে অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ তরুণীরা দেশের জন্য কিছু করতে চায়, তাদের এই ভালোবাসা আর আগ্রহকে ব্যবহার করে আমরা কী শিক্ষার জন্যে নূতন কিছু করতে পারি না? প্রতি বছর যে পাঠ্য বইগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো এখনো দায়সারা, সেই বইগুলো কী নূতন করে লেখা যায় না? বিজ্ঞানের নানা এক্সপেরিমেন্ট এর বর্ণনা থাকে সেগুলো বাচ্চারা করার সুযোগ পায় না, অন্ততপক্ষে তার ভিত্তিগুলো কী তৈরী করা যায় না? কিংবা দেশের জন্যে সবচেয়ে যেটা জরুরী, গাইড বই এবং কোচিং সেন্টারকে চিরতরে দূর করে দেয়া যায় না? আইন করে সেগুলো বন্ধ করা হয়ত কঠিন কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালে পালটে দেয়া তো কঠিন কিছু নয়।

গাইড বই মানে কী? যারা সেটা জানেন না তারা সেটা গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকার শিক্ষা পাতাগুলো দেখলেই এখন জেনে যাবেন – বাজার থেকেও বই আকারে সেগুলো কেনা যায়। ছেলেমেয়েরা সেখান থেকে প্রশ্ন আর উত্তর মুখস্থ করে। (অনেকে কৈফিয়ত দেয়ার জন্যে বলে প্রশ্নটা কোন কাঠামোতে হয় সেটা দেখার জন্যে তারা গাইড বই পড়ে!) আমরা কী crowd sourcing করে সারা পৃথিবীর আগ্রহী তরুণদের থেকে চমৎকার কিছু প্রশ্ন তৈরী করিয়ে নিতে পারি না? সেগুলো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে পারি না? এই প্রশ্নগুলোর শেষে উত্তর দেয়া থাকবে না তাই তারা কখনোই সেগুলো মুখস্ত করতে পারবে না – কিন্তু ইচ্ছে করলেই পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যাচাই করে নিতে পারবে, কোথায় দুর্বলতা নিজেরাই বের করে নিতে পারবে। আমি শ খানেক প্রশ্নের কথা বলছি না – হাজার হাজার প্রশ্নের কথা বলছি।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার বিষয়টির খোঁজখবর নিতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি আমাদের শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয় সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরী করতে, যে কারণে সৃজনশীল গাইড (এবং গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা!) এতো জনপ্রিয়। শিক্ষকদের কেমন সমস্যা হয় সেটি আমি জেনেছি আমার বোনের মেয়ের কাছ থেকে, সে যখন ছোট তখন একদিন তার ধর্ম স্যার ক্লাশের সব মেয়েদের বললেন, “ধর্ম পরীক্ষার জন্য তোরা সবাই সৃজনশীল প্রশ্ন করে আনবি – যারটা ভালো হবে সেটা আমি নিব, পরীক্ষায় দিব।” বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মহা আনন্দে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরী করে নিয়ে এল, শিক্ষক সেখান থেকে বেছে বেছে নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরী করলেন। সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরী করতে শিক্ষকদের কালো ঘাম ছুটে যায় কিন্তু বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হয় না। তাই যদি crowd sourcing করে সারা পৃথিবীর সব তরুনদের তৈরী করা সব বিষয়ের অসাধারণ কিছু প্রশ্ন জমা করে রাখা যায় – তাহলে ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো দিয়ে নিজের জ্ঞানটুকু পোক্ত করতে পারবে, শুধু তাই নয় প্রয়োজনে শিক্ষকেরাও সেটা ব্যবহার করতে পারবেন। তাদের জন্যে আলাদা ব্যাবস্থাও করে দেয়া যাবে, বাজে প্রশ্নের অভিশাপ থেকে মুক্তিও পেয়ে যাবেন।

আমি খুব সৌভাগ্যবান কারণ আমি খুব উৎসাহী কিছু মানুষের আশেপাশে থাকি, অসংখ্য ভাবনা চিন্তা আমাদের মাথায় কাজ করে। বাংলাদেশের সব তরুণদের নিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাহায্য করা ঠিক এরকম একটা চিন্তা ভাবনা। যদি এরকম একটা উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কী দেশের তরুণেরা এগিয়ে আসবে না?

নিশ্চয়ই আসবে!

কেউ কি আমাকে বলবেন?

পরশুদিন আমাকে একটা মেয়ে ফোন করেছে। সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। মেয়েটি খুবই বিচলিত। কারণ সে জানতে পেরেছে- পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে। মেয়েটি বলল, আমরা এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করি আর কিছু মানুষ বাজার থেকে প্রশ্ন কিনে এনে পরীক্ষা দেয়, পরীক্ষায় ভালো করে, ভালো জায়গায় সুযোগ পায়। তাহলে এটাই কী নিয়ম- এই দেশটা দুর্বৃত্তদের? আমরা কিছু না?

আমি মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিলাম। বললাম- শিক্ষামন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটা নিশ্চয়ই সত্যি। আসলে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে ধোকা দিয়ে কিছু কিছু ছাত্রছাত্রীকে ঠকিয়ে কিছু মানুষ টাকা কামিয়ে নেয়। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর সেই প্রশ্নটি দেখিয়ে হৈচৈ করে। মেয়েটি বলল, ‘আমার কাছে যে প্রশ্ন আছে আমি আপনাকে এখনই পাঠিয়ে দিই। দু’দিন পর পরীক্ষা হয়ে গেলে আপনি মিলিয়ে নেবেন।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে।’ মেয়েটি সাথে সাথে আমাকে হাতে লেখা কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে দিল।

আজকে পরীক্ষা ছিল। সকাল থেকে আমি মনে মনে দোয়া করছি- যেন প্রশ্নগুলো মিলে না যায়, আমি মেয়েটিকে বলতে পারব- দেখেছ, আাসলে প্রশ্ন ফাঁস হয় না!

দুপুরে মেয়েটি ফোন করে জানালো- ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মিলে গেছে। আমাকে সে এক কপি প্রশ্ন পাঠিয়েছে।

p_3

p_4

আমি পরীক্ষার প্রশ্ন আর দু’দিন আগে পাওয়া হাতে লেখা প্রশ্ন একসাথে করে দিয়ে দিচ্ছি। কেউ বিশ্বাস না করলে নিজের চোখে মিলিয়ে নিতে পারবে। আমার ই-মেইলের তারিখ আর সময়টিও যুক্ত করে দিলাম। মেয়েটির ই-মেইল এড্রেস সরিয়ে দিলাম, যাতে সে যেন আবার উটকো ঝামেলায় না পড়ে।

মেয়েটি আমাকে বলেছে- স্যার, কিছু একটা করেন।

কেউ কি আমাকে বলতে পারবে, আমি কী করব? এই দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে আমাদের দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, আমরা সেটা নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখি। আমাদের ছেলেমেয়েরা এই স্বপ্নকে ধারণ করে, লেখাপড়া করে, তারপর দেখা যায়- এই দেশের সরকার একটা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা দিতে পারে না! আমি বিশ্বাস করতে রাজি না যে, আন্তরিকভাবে চাইলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সমস্যা হওয়া সম্ভব। আমি যে মেয়েটার কথা বলছি, সে আমাকে ফোন করার আগে পাগলের মতো সব জায়গায় ফোন করে তার অভিজ্ঞতাটি জানাতে চেষ্টা করেছে- কেউ শুনতে রাজি হয়নি।

একটা সমস্যা না দেখার ভান করলেই কি সমস্যাটা মিটে যায়? সমস্যা মেটাতে চাইলে সেটাকে সবার আগে স্বীকার করতে হয়। দেশের সর্বোচ্চ মহল এই সমস্যাটা স্বীকার করতেই রাজি না। তাহলে সমস্যাটা সমাধান হবে কেমন করে?

এই দেশের ছেলেমেয়েদের আমরা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখাতে চাই। ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুব্ধ এই হতাশ ছেলেমেয়েগুলোকে আমরা কেমন করে স্বপ্ন দেখাবো?

কেউ কি আমাকে বলবেন?

কয়েক টুকরো ভাবনা

গত কিছুদিন থেকে আমাকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে, “ওয়ার্ল্ড কাপে আপনি কোন দলকে সাপোর্ট করেন?” আমি তখন রীতিমতো সমস্যায় পড়ে যাই, সারা পৃথিবী যখন ওয়ার্ল্ড কাপের উত্তেজনায় ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, খবরের কাগজের মূল অংশই হচ্ছে ওয়ার্ল্ড কাপের খুঁটিনাটি তখন আমি যদি বলি আমার ওয়ার্ল্ড কাপে পছন্দের দল নেই তখন সবাই আমার দিকে কেমন জানি অন্যরকম চোখে তাকায়! সবারই ধারণা হয় আমার নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে।

ওয়ার্ল্ড কাপ বিষয়টাই আমার জন্যে হৃদয়বিদারক। টেলিভিশনে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখাচ্ছে, তখন আমাকেও দেখতে হয়। এমনিতে পছন্দের কোনো দল নেই কিন্তু খেলা দেখার সময় যে দলটা একটু দুর্বল তার জন্যে কেমন জানি মায়া হয় এবং নিজের অজান্তেই এক সময়ে তার পক্ষ নিয়ে নিই। অবধারিতভাবে আমার দুর্বল দলটি হেরে যায় এবং তখন আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কাজেই ওয়ার্ল্ড কাপ খেলাটি থেকে আমি এখনও কোনো আনন্দ পাইনি, অনেক দুঃখ পেয়েছি।

ছেলেবেলায় আমি প্রচুর ফুটবল খেলেছি, কখনও খেলার মাঠে ফুটবলে লাথি দেওয়ার জন্যে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি এবং তাতেই অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু আজকালকার ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই খুব ভাবনায় পড়ে যাই। যে কোনো খেলার মূল কথা হচ্ছে, যে দলটি ভালো খেলবে সে জিতবে। ওয়ার্ল্ড কাপে আমরা দেখি দুই দলই ভালো, কেউ কাউকে গোল দিতে পারছে না, তখন লটারি করে ঠিক করা হচ্ছে কে বিজয়ী! (খেলা শেষে পেনান্টি কিক দিয়ে জয়-পরাজয় ঠিক করা আসলে লটারি ছাড়া আর কিছু নয়।) পেনান্টি কিক দেবার বেলায় অনেক সময়েই দেখি গোলকিপার উল্টো দিকে ঝাঁপ দিয়েছে– কোন দিকে ঝাঁপ দিবে সিদ্ধান্তটি নিতে হয় কিক দেওয়ার আগে। কাজেই পুরোটাই কপালের উপর, পুরোটাই লটারি।

যে খেলার জয় পরাজয় ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, সেই খেলা কেমন করে সত্যিকারের খেলা হতে পারে সেটি আমি কখনও বুঝতে পারিনি। আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমি বুঝব বলে মনে হয় না।

তবে ওয়ার্ল্ড কাপের সময় বাংলাদেশের চেহারা দেখে আমি সবসময়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কোনো একটা বিচিত্র কারণে এই দেশের অনেক মানুষ মনে করে তারা যে দলটার সমর্থক সেই দলের দেশটির পতাকা টানাতে হবে। শুধু যে টানাতে হবে তা নয়, পতাকাটা হতে হবে অনেক বড়। পতাকা টানাতে গিয়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে তরুণেরা মারা গেছে, তার আপনজনের কেমন লেগেছে কল্পনাও করতে পারি না।

যশোরের ডিসি এই পতাকা দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছেন, স্বাধীন দেশে বিদেশি পতাকা এভাবে টানানো যাবে না, পতাকা নামাতে হবে। তার জন্যে অভিনন্দন, সারা দেশে অন্তত একজন মানুষ আছেন যিনি জানেন পতাকা এক টুকরো কাপড় নয়, পতাকাটা দেশের প্রতীক!

পৃথিবীর সব দেশে জাতীয় পতাকার সম্মান রাখার জন্যে নিয়ম-কানুন আছে, ইচ্ছেমতো কেউ বিদেশি পতাকা তুলে ফেলতে পারে না। বিদেশি পতাকার সঙ্গে নিজের দেশের পতাকাটা আরও বড় হতে হয়। আগে একেবারেই ছিল না, তবে আজকাল দেখছি প্রায় অনেক জায়গাতেই বিদেশি পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকাটাও আছে, দেখে ভালো লাগে। যদি এ রকম হত, যে কয়টি বিদেশি পতাকা আছে ঠিক সেই কয়টা কিংবা তার থেকে বেশি আমাদের লাল সবুজ পতাকা উড়ছে, তাহলে সেই দৃশ্য দেখে আমাদের বুকটা ভরে যেত।

আমাদের যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে তারা জানে আমাদের লাল সবুজ পতাকার লাল রংটি আসলে মোটেও লাল রংয়ের একটা কাপড় নয়, সেটি আসলে আমাদের আপনজনের বুকের রক্ত দিয়ে রাঙানো। এর মাঝে এক বিন্দু অতিরঞ্জন সেই! সেই জন্যে জাতীয় পতাকাটা আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।

২.

যারা ভাবছেন ‘ওয়ার্ল্ড কাপ’ নামক যে বিষয়টি নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই আমি সেটা নিয়েই লিখতে বসেছি, আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই। আমি আজকে আমার কিছু টুকরো টুকরো ভাবনার কথা লিখতে চাই। ভিন্ন ভিন্ন কিছু ভাবনা।

কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে আমাকে তাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হবার জন্যে অনুরোধ করলেন। ‘প্রধান অতিথি’, ‘মাঝারী অতিথি’, ‘দায়সারা অতিথি’, এই বিষয়গুলো আমার জন্যে বোঝা কঠিন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি এই বিভাজন নিয়েই প্রায় খুনোখুনি হবার অবস্থা ঘটতে দেখেছি! যাই হোক, এই প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণটি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করলাম, কারণ তাদের অনুষ্ঠানে তারা প্রায় দুইশ বাচ্চাকে নিয়ে আসবেন– তাদের সবাই হচ্ছে গৃহকর্মী, সোজা বাংলায় ‘বাসার কাজের মেয়ে’। এ রকমটি আগে কখনও ঘটেনি।

ঢাকা শহরে ঠিক সময়ে কোথাও পৌঁছানো অসম্ভব একটি ব্যাপার। বেশি সতর্ক হয়ে অনেক আগে রওনা দিয়ে অনেক আগে পৌঁছে গেছি, না হয় ঠিক সময়ে রওনা দিয়ে দেরি করে পৌঁছেছি। তবে সেদিন ভাগ্যের জোরে আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম এবং পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে স্টেজে তুলে দেওয়া হল।

মঞ্চে বসে আমি অনুষ্ঠানের দর্শক-শ্রোতাদের দেখতে পেলাম এবং আমার বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। যারা আমার সামনে বসে আছে তাদের বয়স দশ-বারো বছর কিংবা আরও কম। এই বয়সের শিশুদের মুখে এক ধরনের সারল্য থাকে, এক ধরনের নির্দোষ কমনীয়তা থাকে, তাদের সবার মুখে সেটা আছে। আমার সামনে যারা বসে আছে তাদের সবাই নিজের বাবা, মা, ভাই, বোনকে ছেড়ে একা একা অন্য একটা পরিবারের বাসায় কাজ করে। যে বয়সে স্কুলে যাবার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করার কথা, মা বাবার আদরে বড় হবার কথা, তখন তারা কাপড় কাচে, বাসন ধোয়, রান্না করে, ফাই-ফরমাশ খাটে।

আয়োজকরা আমাকে জানালেন, এদের অনেকেই জানে না তারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের দেশ কোথায়, বাবা-মা-পরিজন কোথায় থাকে। তরপরও তারা হচ্ছে এদেশের গৃহকর্মীদের বা কাজের মেয়েদের মাঝে সৌভাগ্যবানেরা। তারা যেসব পরিবারের সঙ্গে কাজ করে, তারা এই কাজের মেয়েদের এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, সময় করে লেখাপড়া করতে দিয়েছে, এই সংগঠনের সঙ্গে খানিকটা বিনোদনের জন্যে ঘর থেকে বের হতে দিয়েছে। সে জন্যে আজকে আমি তাদের দেখার সুযোগ পেয়েছি। অন্যদের আমরা কখনও দেখব না, তাদের কথা শুনব না।

আয়োজকেরা জানালেন, এই বাচ্চাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখিয়ে আনা হচ্ছে। আমাকে অনুরোধ করলেন তাদেরকে কিছু একটা বলতে– সম্ভব হলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমি শিক্ষক মানুষ, মাস্টারী করি, আমার কাজ কথা বলা, যে কোনো জায়গায় জানি আর না জানি কিছু একটা বলে ফেলতে পারি, কিন্তু আজকে এই মুহূর্তে আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমার বলার কিছু নেই। এই বাচ্চাগুলো যদি কোনো স্কুলের বাচ্চা হত, আমি তাদের স্বপ্নের কথা বলতে পারতাম, ভবিষ্যতের কথা বলতে পারতাম, কিন্তু যে বাচ্চা বাসায় কাজ করে তার জীবন কাটায়, তাকে আমি কী মিথ্যা স্বপ্ন দেখাব?

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের মতো মানুষের সামনে নূতন একটি দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে, সুন্দর ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়েছে, কিন্তু এই ছোট শিশুদের জীবনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার কি কিছু আছে? আমি কি তাদের কোনো আশার কথা বলতে পারব? কোনো স্বপ্নের কথা বলতে পারব?

সারা জীবনে যেটি কখনও হয়নি, আজকে আমার সেটি ঘটে গেল। আমি তাদের বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। অবান্তর একটি-দুটি কথা বলে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কি পড়তে পার?”

সবাই চিৎকার করে বলল, ‘‘পারি!”

কী অসাধারণ একটি ব্যাপার! এই প্রথমবার আমি উল্লাসিত হয়ে বললাম, ‘‘আমি তোমাদের সবার জন্যে একটা করে বই এনেছি! তোমরা আস, আমি তোমাদের একটা করে বই উপহার দিই।”

অনুষ্ঠানের সব শৃঙ্খলা ধসে গেল, বাচ্চাগুলো ছুটে এল, আয়োজকেরা তাদের লাইন করিয়ে দিলেন, আমি তাদের হাতে একটি একটি বই তুলে দিলাম। আহা, কী মায়াকাড়া চেহারা, কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর তাদেরকে দেবার মতো কিছু নেই। বাচ্চাগুলোর কিন্তু মুখে হাসি, তাদের কোনো অভিযোগ নেই, এই জীবন নিয়ে অভিযোগ করা যায় সেটি তারা জানেও না।

শুধু একজন আমার কাছে জানতে চাইল, “আমরা এখন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পারি। যদি আরও পড়তে চাই তাহলে কোথায় পড়ব?”

আমি তাকে আশ্বস্ত করে কিছু একটা উত্তর দিয়ে এসেছি, একটি মেয়ের লেখাপড়া হয়তো অনেক ভাবেই করা সম্ভব, কিন্তু তার মতো অন্যদের কে আশ্বস্ত করবে? আয়োজকেরা বাচ্চাদের দিয়ে একটা অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন, সেই অনুষ্ঠান দেখে কে বলবে তাদের জীবন কাটে বাসার কাজ করে! ছোট একটি শিশুকে একটুখানি সুযোগ দেওয়া হলে তারা কত কী করে ফেলতে পারে?

এই দেশের সব শিশুদের আমরা কখন সেই সুযোগ করে দেব?

৩.

ঢেঁকি স্বর্গে দেলেও ধান ভানে, কাজেই আমি কিছু একটা লিখতে বসেছি লেখাপড়া নিয়ে যদি কিছু না বলি সেটা কেমন করে হয়?

খবরের কাগজে দেখেছি সংসদে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন এই পাঁচ বছরে এই প্রথমবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। খবরটি পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানি, এই পাঁচ বছরে আরও অনেকবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।

আমার মতো আরও অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকেরাও জানে– তারা যখন খবরের কাগজ এই খবরটি পড়বে তখন তাদের কী মনে হবে? আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একটি সত্যকে অস্বীকার করছেন, নাকি তার থেকেও বেদনাদায়ক ব্যাপার, দেশের শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটির কথা কেউ তাকে জানায়নি? কোনটি বেশি বেদনাদায়ক?

আমরা সবাই প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে শুধু ইংরেজি এবং গণিতের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে– অথচ আমি নিজে খবরের কাগজে পদার্থ বিজ্ঞানের ফাঁস হয়ে যাওয়া চারটা প্রশ্ন সত্যিকার প্রশ্নের পাশাপাশি ছাপিয়েছিলাম। ফাঁস হয়ে যাওয়া অন্যান্য প্রশ্নগুলোও আমি ছাত্রদেরকে দিয়ে তদন্ত কমিটির হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম! হাতে প্রমাণ থাকার পরও তদন্ত কমিটি এই সত্যগুলোও উদ্ঘাটন করতে পারেনি– আমরা এখন তাদের কাছে খুব বেশি কিছু কি আশা করতে পারি?

৪.

এইচএসসির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে, এখন ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে বা শেষ হয়েছে। আমার মনে হয় এই দেশে ব্যবহারিক পরীক্ষার বিষয়টাও দেশের মানুষের জানা দরকার। আমি নিজেই লিখতে পারি কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয় যারা এই পরীক্ষা দেয় তাদের নিজেদের মুখে শোনা। একজনের ই-মেইল এ রকম–

“প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় আমাদের কোনো পরীক্ষা করতে হয় না। ফিজিক্সে আমরা বই দেখে কলেজে করা পরীক্ষার মানগুলো বসিয়ে দিই। কেমিস্ট্রি ফার্স্ট পেপারে পিওন বলে দেয় মান কী রকম হবে, একটু এদিক সেদিক করে লিখে দিই। সেকেন্ড পেপারে লবন শনাক্তকরণ থাকে, পিয়ন বলে দেয় কোনটা কী লবণ। আর সব পরীক্ষার বর্ণনাই লিখি বই, খাতা বা ফোনে তোলা ছবি দেখে। এজন্যে প্রতি পরীক্ষায় একশ টাকা দিতে হয়। চার বিষয় গুণ দুই পত্র = ৮০০ টাকা। কী ব্যবসা দেখছেন? পিওন না শুধু, শিক্ষকরাও জড়িত।”

একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন জানে তাদের শিক্ষকরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তখন সেই শিক্ষার কি আসলে কোনো গুরুত্ব আছে? বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৫ নম্বর থাকে। ১০০ এর ভেতর এই ২৫ মার্ক সরাসরি টাকা দিয়ে কেনা যায়, সবাই এটি জানে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, কেউ বাকি নেই, কিন্তু কেউ কিছু করে না। তারপরও আমরা শিক্ষা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলি, আমার দুঃখটা সেখানে।

৫.

আমি যখন ঢাকা যাই, তখন আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্যে মীরপুর ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাই। মীরপুরে পৌঁছানোর পর আমি যে রাস্তাটি ব্যবহার করি সেই বিহারি এলাকার ভেতর দিয়ে যায়, আমি সেটি আগে জানতাম না, এখন জানি।

বেশ রাতে আমি একদিন যাচ্ছি, দেখি রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড়। মানুষের ভীড় দেখেই বোঝা যায় ভীড়টির গতিপ্রকৃতি কী রকম, কখনও হয় নির্দোষ আনন্দোল্লাস, কখনও হয় ক্ষুব্ধ মানুষের জটলা। আমি বুঝতে পারলাম এই ভীড়টির ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে– ভীড় ঠেলে ক্ষুব্ধ মানুষের ভেতর দিয়ে আমি যখন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, আমার ড্রাইভার জানাল, এই ভীড়ের মাঝে মানুষজনের সঙ্গে কা বলছেন স্থানীয় এমপি। এর মাঝে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই, একজন এমপি তার এলাকায়, তার মানুষের সঙ্গে কথা বলতেই পারেন, তাদের ভেতরে কোনো ক্ষোভের জন্ম নিলে তাকেই তো সেটা প্রশামিত করার জন্যে আসতে হবে।

ঠিক তার কয়েকদিন পর শবেবরাতের রাত পার হয়ে যে ভোর এসেছে, সেই ভোরে বিহারিদের এলাকায় দশজন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হল। এর মাঝে মহিলা আছে, শিশু আছে, কিশোর-কিশোরী আছে।

সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি শবে বরাতের রাতে পরের বছরের জন্যে ভাগ্য বেটে দেওয়া হয়। বিহারি পল্লীর মোহাম্মদ ইয়াসিন নামের মানুষটি জানত না তার পরিবারের জন্যে কী ভয়ংকর নির্মম একটি ভাগ্য কয়েক ঘণ্টা আগে শবেবরাতের রাতে তাদের কপালে লিখে দেওয়া হয়েছিল।

আমি কারও নাম মনে রাখতে পারি না, কিন্তু পুড়িয়ে মারা মানুষগুলোর মাঝে লালু, ভুলু নামে দুজন জমজ শিশুর নাম আছে, সেই নামগুলো আমার স্মৃতির মাঝে গেঁথে গেছে– আমি মনে হয় সেটা কখনও ভুলতে পারব না।

এই নির্মম পৈশাচিকতাটি কেমন করে ঘটেছে বোঝার চেষ্টা করেছি, বুঝতে পারিনি। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এই এলাকায় যে এক ধরনের উত্তেজনা ছিল আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি, কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সেখানে দেখেছি, এই ভয়ংকর পৈশাচিক ঘটনার জন্যে ছয়জন বিহারিকেই ধরে নেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে এখানে খুব বড় ধরনের একটি অন্যায়, খুব বড় একটা অবিচার হতে যাচ্ছে। সেটি থামানোর কোনো পথ নেই।

আমরা সবাই জানি, ১৯৭১ সালে এই বিহারি সম্প্রদায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। এই পুরো এলাকার অসংখ্য বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরও ২০ জানুয়ারি এখানে জহির রায়হানসহ অনেকে খুন হয়েছেন, হারিয়ে গেছেন। এখনও সেই এলাকায় বধ্যভূমি খুঁজে পাওয়া যায়। বিহারিদের অনেকেই এখনও নিজেদের পাকিস্তানি মনে করে পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের এই বিহারিদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। গত চার দশক থেকে এই বিহারি সাম্প্রদায় এখানে ক্যাম্পে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।

চার দশক দীর্ঘ সময়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের সংখ্যা এখন খুব বেশি থাকার কথা নয়। এখন এখানে নূতন প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে। তারা এই দেশের মাটিতে জন্মেছে, এই দেশে সম্মান নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের সবার উপর দায়িত্ব এই মানুষগুলোকে আমাদের দেশে আমাদের সমাজে সম্পৃক্ত করে নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদেরকে গড়ে ওঠার অধিকার দেওয়া।

আমি নিশ্চিত, যারা নূতন প্রজন্ম তাদের নিশ্চয়ই পাকিস্তান যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই– পাকিস্তান নামক দেশটির এমন অবস্থা যে যারা পাকিস্তানের অধিবাসী তারাই এখন এই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে! সরকার হোক, মানবাধিকার কর্মী হোক, সবাই মিলে ক্যাম্পে রিফিউজি হিসেবে কয়েক যুগ থেকে বাস করা মানুষগুলোর জীবনে একটুখানি স্বস্তি, একটুখানি স্বপ্ন, একটুখানি আশা ফিরিয়ে দেওয়া উচি। পূর্বপুরুষের অপরাধের জন্যে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে– সেটি তো কোনোভাবে আমরা মেনে নিতে পারি না।

স্বাধীনতার আগে বিহারিদের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেকভাবে দেখা হত। তখন তারা বাংলা বলতে না। বাংলা না জেনেই তারা যেন এই দেশে জীবন কাটাতে পারে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে সেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমি এখন যখন বিহারি এলাকার ভেতর দিয়ে যাই, তখন দেখি তারা চমৎকার বাংলা বলতে পারে!

মিরপুরে তাদের এলাকার ভেতর দিয়ে দুই লেনের একটি রাস্তা গিয়েছে, দশ জন বিহারি শিশু-কিশোর-মহিলাকে পুড়িয়ে মারার পর একটি লেন সম্ভবত তারা প্রতিবাদ হিসেবে বন্ধ করে রেখেছে, সেখানে বাংলায় লেখা অনেক ব্যানার ঝুলছে। সেদিন যাবার সময় দেখলাম একটা লোকসভা হচ্ছে, বিহারি বক্তারা চমৎকার বাংলায় তাদের বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা আসলে পুরোপুরি আমাদের মানুষ হয়ে গিয়েছেন।

তাহলে কেন তাদের ভিনদেশি মানুষ হিসেবে আমাদের এই দেশে কষ্ট দিয়ে যাব? স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আমরা অনেক কষ্ট করেছি– আমরা সেই কষ্ট করেছি যেন পরের প্রজন্মকে কষ্ট করতে না হয়। কেন তাহলে আমরা নূতন প্রজন্মকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি?

০২-০৭-১৪

গাড়ির চতুর্থ চাকা

মে মাসের ১০ তারিখে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে আমাকে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি তখন অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা বক্তব্য দাঁড় করিয়েছিলাম। বক্তব্যটি যদিও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা নির্দিষ্ট বয়সের তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশে তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু সেখানে আমি যে কথাগুলো বলেছিলাম, আমার খুব ইচ্ছে সেই কথাগুলো অন্যদেরও বলি। আমার মনে হয় এই লেখায় সে কাজটি করার জন্যে খুব বড় একটা সুযোগ। আমি সুযোগটি গ্রহণ করছি, পাঠকেরা নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা

আজকের দিনটি তোমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি– একই সঙ্গে এটি সবচেয়ে আনন্দেরও একটি দিন। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে তোমাদের এই আনন্দের দিনটিতে আমি তোমাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে পারছি। আমাকে এই সুযোগটি দেওয়ার জন্যে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই।

তোমরা যে রকম তোমাদের জীবনের প্রথম সমাবর্তনে এসেছ আমিও ঠিক সে রকম আমার জীবনের প্রথম সমাবর্তন বক্তা হিসেবে এসেছি। সমাবর্তন নিয়ে তোমাদের মনের ভেতর যে রকম আগ্রহ এবং উদ্দীপনা– তোমাদের সামনে কয়েকটি কথা বলার জন্যে আমার ভেতরেও ঠিক একই আগ্রহ এবং উদ্দীপনা।

তোমাদের আমি কোনো উপদেশ দেব না, কোনো নীতিকথাও শোনাব না, আমি তোমাদের হয়তো কয়েকটি কথা স্মরণ করিয়ে দেব। তার পাশাপাশি আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে যে কয়টি সত্য উপলব্ধি করেছি তোমাদেরকে সেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করব। কয়েক যুগ পর তোমরা হয়তো নিজেরাই এই সত্যগুলো উপলব্ধি করবে। আমি মাঝখানের সেই দীর্ঘ সময়টুকু শর্টসার্কিট করে দিচ্ছি মাত্র– তার বেশি কিছু নয়।

তোমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনের পরের ধাপে পা দিতে যাচ্ছ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে আসার কারণে দেশের সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ায় কত খরচ হয় তার একটা ধারণা পেয়ে গেছে। সেই তুলনাটি থেকে তোমাদের ধারণা হতে পারে তোমরা বুঝি খুব অল্পখরচে একটা ডিগ্রি পেয়েছ– সেটি কিন্তু সত্যি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটকে তোমাদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে তোমাদের লেখাপড়ার খরচটুকু বের হয়ে আসবে এবং আমি বাজি ধরে বলতে পারি সেই পরিমাণটুকু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ থেকে কোনো অংশে কম নয়– বরং বেশি হলে আমি অবাক হব না।

তোমাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকু কার কাছ থেকে পেয়েছে? পেয়েছে এই দেশের চাষীদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে। আমি তোমাদের শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো তার নিজের সন্তানকে স্কুল-কলেজ শেষ করিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি, কিন্তু তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন তোমরাই ঠিক কর এই শিক্ষাটুকু দিয়ে কার জন্যে কী করবে!

কিছুদিন আগে খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদন চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে একটি সত্য নতুন করে জানিয়ে দিয়েছে। সত্যটি হল আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে এসেছে, আর এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে দেশের তিন ধরনের মানুষ। গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা– যার বেশিরভাগই হচ্ছে মেয়ে– অর্ধসহস্রাধিক (তখনও আমি জানতাম না সংখ্যাটি আসলে সহস্রাধিক হয়ে যাবে) সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের আমরা সাভারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি। প্রবাসী শ্রমিক– যারা আপনজনকে দেশে ফেলে নির্বান্ধব পরিবেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবং এই দেশের কৃষক যাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্যে আমরা আমাদের ভাষায় ‘চাষা’ নামক একটা শব্দ তৈরি করে রেখেছি।

আমি রীতিমত ধাক্কা খেয়েছি যখন আবিষ্কার করেছি– যারা এই দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমি তাদের কেউ নই, তাদের কারও সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই– আমি তাদের জন্যে কখনও কিছু করিনি। আমার মনে হয়েছে আমি বুঝি এই দেশের বোঝা, এই দেশের গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা আর মাঠেঘাটের চাষীরা আমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়েছে– প্রতিদানে আমি তাদের কিছু দিইনি।

আমি তখন নিজেকে বুঝিয়েছি, দেশের অর্থনীতিকে এখন গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিক এবং চাষীরা সচল রেখেছে, তারা একটি গাড়ির তিনটি চাকার মতো– গাড়িটি সত্যিকারভাবে ছুটতে পারবে যখন তার সঙ্গে চতুর্থ চাকাটি জুড়ে দেওয়া হবে। সেই চতুর্থ চাকা কোনটি?

তোমরা হচ্ছ সেই চতুর্থ চাকা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান আমাদের নতুন প্রজন্ম। আমি বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করে আছি তোমাদের মেধা, মনন এবং সৃজনশীলতা নিয়ে কখন তোমরা এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। কখন মানুষের শরীরের ঘাম অপসারিত হবে মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।

তোমরা কি জান, এটি তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়? তোমরা কি জান তোমাদের চোখে রয়েছে রঙিন চশমা, আমাদের চোখে যেটি একেবারেই সাদামাটা তোমাদের চোখে সেটিই বিচিত্র বর্ণে উজ্জ্বল? তোমরা কি জান এখন তোমাদের জীবন উপভোগ করার সময়?

তোমরা কি জান জীবন কীভাবে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়? তোমাদের সবারই নিশ্চয়ই এই বিষয়ে নিজের একটা ভাবনা আছে– আমি তোমাদের সঙ্গে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া আমার ভাবনাটুকু বিনিময় করি। নিজের জন্যে যখন কিছু একটা করি তখন অবশ্যই আমাদের এক ধরনের আনন্দ হয়। কিন্তু তার থেকে শতগুণ বেশি আনন্দ হয় যখন আমরা অন্যের জন্যে কিছু করি!

তোমাদের ভেতর যারা বন্যাপীড়িত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের হাতে একটুখানি ত্রাণ তুলে দিয়েছ তখন তাদের মুখে যে হাসিটুকু দেখেছ আমি জানি সেটি তুমি কখনও ভুলবে না। তুমি যখন রক্ত দিয়েছ সেই রক্তের ব্যাগ থেকে ফোঁটাফোঁটা রক্ত গিয়ে যখন একজন মূমূর্ষ বিবর্ণ রোগীর মুখে জীবনের স্পন্দন দিয়ে এসেছে, আমি জানি তুমি সেই আনন্দের কথা কখনও ভুলতে পারবে না। তুমি যখন তোমার ক্যাম্পাসের পথেঘাটে পাতাকুড়ানো হতদরিদ্র শিশুটিকে বারান্দায় বসিয়ে বর্ণপরিচয় করিয়েছ, তুমি নিশ্চয়ই সেই আনন্দটির কথাও কখনও ভুলতে পারনি। যখন গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করেছ তখন তাদের উজ্জল চোখের দৃষ্টি নিশ্চয়ই তুমি ভুলতে পারনি।

যারা এখনও সেই তীব্র আনন্দের স্বাদ উপভোগ করনি তাদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই– জীবনটিকে একেবারে কানায় কানায় উপভোগ করার এখনই সময়। অন্যের জন্যে কিছু করে জীবন উপভোগ করার এই পথটুকুর সন্ধান পেতে পেতে আমার অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল– আমি কিন্তু তোমাদের অনেক আগেই বলে দিয়েছি!

আমার এই দীর্ঘ জীবনে আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, অনেকের সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে, সবাইকে নিয়ে আমি অনেক কিছু করেছি। আমার এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমি খুব সোজাসাপ্টা একটা বিষয় আবিষ্কার করেছি; সেটি হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ দুই রকম! এক ধরনের মানুষের সবকিছুতে উৎসাহ, সবসময়ই তারা নতুন কিছু করার জন্যে ব্যস্ত। সবসময়ই তারা কিছু না কিছু করছে, একশ’টা জিনিস করতে গিয়ে তারা অনেক সময়েই ঘোট পাকিয়ে ফেলছে, সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে– তারপরও তাদের উৎসাহের কোনো অভাব নেই। অন্য ধরনের মানুষের কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই, তারা নিস্পৃহ, তাদের তাপ-উত্তাপ নেই। তারা নতুন কিছু করে না, তাই তাদের জীবনে ভুলও হয় না। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে উত্তেজনা নেই, উচ্ছ্বাস নেই।

আমি তোমাদের আরও একটি সত্যের সন্ধান দিয়ে যাই– এই পৃথিবী, দেশ কিংবা সমাজটাকে চালায় প্রথম গোষ্ঠী যাদের সবকিছুতে উৎসাহ! পৃথিবীর যত বড় কাজ সব করেছে এই উৎসাহী প্রজন্ম। তোমাদের ভেতর যারা এই উৎসাহীদের দলে আমি জানি তোমাদের অতিউৎসাহের কারণে অনেক সময় তোমাদের ক্ষতি হয়েছে, অনেক গুরুজন তোমাদের নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে নিষেধ করেছেন, ভূল সিদ্ধান্ত নিয়ে তোমরা অনেকবার বিপদে পড়েছ।

আমি তোমাদের আশ্বস্ত করতে চাই, দেখবে তোমরাই কিন্তু সবকিছুতে নেতৃত্ব দেবে, তোমার অঙ্গুলিহেলনে সবাই তোমাদের পিছনে এসে দাঁড়াবে। তোমাদের ভিতর যারা উৎসাহকে রাশ টেনে নামিয়ে সতর্কভাবে পা ফেলেছে, উৎসাহী বন্ধুদের একশ রকম কাজ দেখে বিরক্ত হচ্ছে, সমালোচনা করেছে তাদেরকে বলে রাখি– এই উৎসাহটুকুই কিন্তু সফল আর অসফল মানুষের মাঝখানে বিভাজন। তোমরা ঠিক কর মাপা উৎসাহ নিয়ে বিভাজনের নিচে দাঁড়াবে নাকি তীব্র উৎসাহের বান ডাকিয়ে বিভাজনের উপরে গিয়ে দাঁড়াবে।

আজ তোমাদের একটি ছাত্রজীবনের সমাপ্তি হয়েছে। মেধার মূল্যায়ন করতে গিয়ে তোমাদেরকে অসংখ্যবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে, সেই পরীক্ষায় তুমি তোমার সহপাঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছ, সেই প্রতিযোগিতায় তোমরা কেউ কেউ তোমাদের সহপাঠীদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছ।

আমি তোমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সত্যিকারের জীবন কিন্তু প্রতিযোগিতার জীবন নয়। যেখানে কিন্তু কাউকে ঠেলে পেছনে ফেলে তোমায় এগিয়ে যেতে হবে না। সত্যিকারের জীবন হচ্ছে সহযোগিতার। সত্যিকার জীবনে তুমি যখন সত্যিকারের কাজ করবে তখন একে অন্যের সঙ্গে পাশাপাশি থেকে সাহায্য করবে। সেখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই।

প্রতিযোগিতা শুধু একটি জায়গায় থাকে– সেটি হচ্ছে নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। তুমি এখন যা, দেখি তুমি এক বছর পর সেখান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পার কিনা।

তোমরা এই দেশের নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যাচ্ছ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালটি এখন তোমাদের হাতে। তোমরা কর্মজীবনে কী কর তার উপর নির্ভর করবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম। তাই তোমাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে হবে। বড় স্বপ্ন না দেখলে বড় কিছু অর্জন করা যায় না!

এই দেশটি তরুণদের দেশ। বায়ান্ন সালে তরুণেরা এই দেশে মাতৃভাষার জন্যে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে, একাত্তরে সেই তরুণেরাই মাতৃভূমির জন্যে যুদ্ধ করেছে, অকাতরে রক্ত দিয়েছে। আমাদের দেশটি এখন যখন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে আবার সেই তরুণেরাই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। তোমরা সেই তরুণদের প্রতিনিধি– তোমাদের দেখে আমি অনুপ্রাণিত হই, আমি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি।

তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা– ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখার জন্যে আমাকে নতুন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে!

আগস্ট ২, ২০১৩

গ্লানি মুক্তির বাংলাদেশ

গত সপ্তাহটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সপ্তাহ। একাত্তরের এই সপ্তাহে বাংলাদেশকে মুক্ত করার যুদ্ধটি শুরু হয়েছে। আকাশে যুদ্ধ বিমান, বোমা পড়ছে, শেলিং হচ্ছে, গুলির শব্দ। আকাশ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে হ্যান্ডবিল বিলি করা হচ্ছে, ভারতীয় বাহিনী সেখানে লিখেছে, মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ কর। আমরা বুঝতে পারছি আমাদের বিজয়ের মুহূর্তটি চলে আসছে, তারপরেও বুকের ভেতর শংকা, আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে এগিয়ে আসছে। গত নয় মাসে এই দেশে কতো মায়ের বুক খালি হয়েছে তার হিসাব নেই। মানুষের প্রাণের কোনো মূল্য নেই। যখন খুশী যাকে ইচ্ছা তাকে নির্যাতন করা যায়, হত্যা করা যায়। চারদিকে শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ। আগুনে পোড়া ঘরবাড়ি। বিধ্বস্ত জনপদ, মানুষের হাহাকার। তার মাঝে জায়ামাতে ইসলামীর তৈরি করা বদর বাহিনী খুঁজে খুঁজে এই দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের বাড়ি থেকে তুলে নিচ্ছে। তারা অত্যাচার করছে, চোখের ডাক্তারের চোখ তুলে নিচ্ছে, হূদরোগের ডাক্তারদের হূিপণ্ড বের করে আনছে, তারপর হত্যা করে মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলছে। দেশটি যেন কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তারা সেটি নিশ্চিত করতে চায়।

সেই হত্যাকারীদের বিচার করে বিচারের রায় হয়েছে। প্রথম রায় কার্যকর হয়েছে সেই একই সপ্তাহে, ডিসেম্বরের ১২ তারিখ। আমি ৪২ বছর থেকে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। শুধু আমি নই, আমার মত স্বজন হারানো অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করেছিল, নির্যাতিতেরা অপেক্ষা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষেরা অপেক্ষা করেছিল, আর অপেক্ষা করেছিল এই দেশের নতুন প্রজন্ম। আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, আমরা মুক্তিযুদ্ধকে তীব্র আবেগ দিয়ে অনুভব করি, আমি কখনো কল্পনা করিনি এই দেশের নতুন প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধকে ঠিক আমাদের মতই তীব্রভাবে অনুভব করবে। তাদের জন্মের আগে ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সেই অবর্ণনীয় কষ্ট আর অকল্পনীয় আনন্দ তারা এতো তীব্রভাবে অনুভব করতে পারে সেটি আমাদের জন্য এক অবিশ্বাস্য স্বপ্ন পূরণ।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছিল তাদেরকে নির্বাচিত করলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। এই দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম তাদের কথা বিশ্বাস করে বিপুল ভোটে তাদের নির্বাচিত করে এনেছিল। সরকার তাদের কথা রেখেছে, ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে বিচার করে বিচারের রায় দিয়ে রায় কার্যকর করতে শুরু করেছে। এই সরকারের কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, তাদের প্রতি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা এই দেশকে গ্লানিমুক্ত করার জন্য। এতোদিন যখন এই দেশের শিশুরা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করত, যারা এই দেশ চায়নি, যারা এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে তারা কেমন করে এই দেশে এখনো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়? কেমন করে রাজনীতি করে, মন্ত্রী হয়? যে পতাকাটি ধ্বংস করার জন্য হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেই পতাকা গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আমি কখনো তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। মাথা নিচু করে থেকেছি। আর আমার মাথা নিচু করে থাকতে হবে না, কেউ আর আমাকে এই প্রশ্ন করবে না। সেই প্রশ্নের উত্তর তারা পেয়ে গেছে, সত্যি কথা বলতে কী, সেই প্রশ্নের উত্তরটি তারাই আমাদের উপহার দিয়েছে।

২.

আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই বিচারের কাজটি যতোটুকু সহজ ছিল, এতোদিন পর সেটি আর সহজ থাকেনি। যুদ্ধাপরাধীর দল ক্যান্সারের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারী শাসনের আড়ালে শক্তি সঞ্চয় করেছে, অর্থ উপার্জন করেছে, সেই অর্থ দিয়ে অপপ্রচার করেছে, দেশে-বিদেশে বন্ধু খুঁজে বের করেছে। হুবহু তাদের মুখের কথাগুলো আমরা বিদেশি গণমাধ্যমে শুনতে পেয়েছি। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলো আমাদের সরকারকে শুধু মুখের কথা বলে বাধা দেয়নি, চোখ রাঙানি দিয়েছে। ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এতো বছর পরও তারা আবার সেই পাকিস্তানের পদলেহীদের পক্ষে। আমাদের অনেক সৌভাগ্য, এই প্রচণ্ড চাপেও আমাদের সরকার দিশেহারা হয়নি, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করেছে। নির্বাচন নিয়ে আমাদের দেশের সব পেশাদার বুদ্ধিজীবীর এখন প্রথম কাজ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এক হাত নিয়ে নেয়া। সেটা আমি বুঝতে পারি, কিন্তু যখন হরতাল-অবরোধ কার্যকর করার জন্য পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়, ট্রেনের লাইন উপড়ে ট্রেনকে লাইনচ্যুত করা হয়, বাস-ট্রাককে যাত্রীসহ পুড়িয়ে দেয়া হয়, রাস্তা কেটে এলাকা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তখনও এই বুদ্ধিজীবী, পত্রিকার সম্পাদকেরা তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর “অদূরদর্শিতা”কে দায়ী করেন তখন আমি একটা ধান্ধার মাঝে পড়ে যাই। এই কাজটি করে এই দেশের বড় বড় পত্রিকার বড় বড় সম্পাদকেরা যে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোকে এক ধরনের নৈতিক সমর্থন দিয়ে ফেলছেন সেটি কী তারা একবারও বুঝতে পারছেন না? যে ভয়ংকর তাণ্ডব দেখে তাদের আতংকিত হওয়ার কথা সেটা দেখে তারা এই সরকারের ব্যর্থতার “অকাট্য প্রমাণ” পেয়ে উল্লসিত হচ্ছেন এটি কেমন করে সম্ভব? আমি পেশাদার বুদ্ধিজীবী নই, বড় পত্রিকার সম্পাদক নই, বাজারে সত্য এবং মিথ্যার মাঝখানে কিংবা ন্যায় এবং অন্যায়ের মাঝখানে নিরপেক্ষ থাকার আমার কোনো চাপ নেই, তাই আমার যে কথাটি বলার ইচ্ছা করে সোজাসুজি বলতে পারি। নির্বাচন নিয়ে কী হবে সেটা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিষ্পত্তি করুক কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর না করার জন্য আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির হুমকিকে তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায় কার্যকর করার জন্য দেশের মানুষের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সেই প্রতিজ্ঞাটি বাস্তবায়ন করেছেন, সেজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা, তাঁর প্রতি অভিনন্দন। তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন নিশ্চয়ই তাঁর মেয়ের বুকের পাটা দেখে খুশী হতেন।

৩.

১৯৭১ সালের পর আমি কখনো পাকিস্তানের কোনো জিনিস হাত দিয়ে স্পর্শ করিনি। অনেক টাকা বেঁচে যাবে জানার পরও যে প্লেন পাকিস্তানের ভূমি স্পর্শ করে যায় আমি কোনোদিন সেই প্লেনে উঠিনি। পাকিস্তানের উপর দিয়ে যখন কোনো প্লেনে উড়ে যাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই দেশটির ভূমি সীমার বাইরে না যাই ততক্ষণ নিজেকে অশুচি মনে হয়। পাকিস্তান দল যত ভালো ক্রিকেট খেলুক না কেন আমি তাদের কোনো খেলা দেখি না। (ষাটের দশকে টোকিও অলিম্পিকে স্বর্ণ বিজয়ী পাকিস্তান হকি টিমের একজন প্রাক্তন খেলোয়াড় পাকিস্তান মিলিটারীর অফিসার হিসেবে আমার বাবাকে একাত্তরে হত্যা করেছিল বলে আমি জানি)।

কেউ কেউ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, ইতিহাসের একটা বিশেষ সময়ে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর একটা সাময়িক কাজকর্মের জন্য সারাজীবন একটা দেশের সকল প্রজন্মকে দায়ী করা যায় না। কথাটি নিশ্চয়ই সত্যি, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। একাত্তরে আমি আমার নিজের চোখে পাকিস্তান নামের এই দেশটির মিলিটারীর যে নৃশংস বর্বরতা দেখেছি সেটি থেকে আমার কোনো মুক্তি নেই। দেশটি যদি নিজের এই নৃশংসতার দোষ স্বীকার করে নতজানু হয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতো তাহলে হয়তো আমার বুকের মাঝে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপ একটু কমানো যেতো। তারা সেটি করেনি, আমার বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা আগুনের উত্তাপও কমেনি।

আমি যে রূপ দেখে অভ্যস্ত, দীর্ঘদিন পর এই দেশটির রূপ আমাদের নতুন প্রজন্ম নতুন করে দেখার সুযোগ পেয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর করার পর প্রথমে তাদের একজন মন্ত্রী প্রতিবাদ করেছে, তারপর তাদের পার্লামেন্ট থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। নিন্দা প্রস্তাবের সময় আলোচনার বিষয়বস্তু অত্যন্ত চমকপ্রদ। তারা জোর গলায় বলেছে, কাদের মোল্লা হচ্ছে একজন ‘সাচ্চা পাকিস্তানী’ একাত্তরে সাচ্চা পাকিস্তানী থাকার জন্যেই তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। শাহবাগের তরুণ ছেলেমেয়েরা দিনের পর দিন এই কথাটি বলে শ্লোগান দিয়েছে: জামাতে ইসলাম: মেড ইন পাকিস্তান। যাদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল জামাতে ইসলাম একাত্তরে এই দেশে কী করেছিল, এখন তাদের কারো ভেতরে কী আর কোনো সন্দেহ আছে?

পাকিস্তান থেকে বক্তব্য দেয়ার সময় তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছে একাত্তরে “ঢাকা পতন” হওয়ার এতোদিন পর সেই পুরানো “ক্ষত” নতুন করে উন্মোচন করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার “ঢাকা পতন” কথাটি নিয়ে আপত্তি আছে, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মোটেও ঢাকার পতন হয়নি, পাকিস্তানের পতন হয়েছিল। ঢাকা কিংবা বাংলাদেশের সেদিন উত্থান হয়েছিল। “ক্ষত” কথাটি নিয়েও আমার গুরুতর আপত্তি আছে, এটি আমাদের জন্য ক্ষত নয়, এটি পাকিস্তানের জন্য “ক্ষত”—শুধু ক্ষত নয় এটি হচ্ছে দগদগে ঘা, চল্লিশ বছরে সেই ঘা শুকায়নি, শত বছরেও সেই ঘা শুকাবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানকে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে হবে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং সবশেষে পরাজয়ের এই দগদগে ঘা তাদের অবশ্যই লুকিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু আমাদের কেন সেটি লুকিয়ে রাখতে হবে? ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের সেই বিজয় দিবস আমাদের ক্ষত নয় সেটি আমাদের গৌরব, আমাদের অহংকার, আমরা শত সহস্রবার সেটি দেখতে চাই। তাই প্রত্যেক বছর এই বিজয় দিবস আমাদের কাছে আগের চাইতেও বেশি উদ্দীপনা নিয়ে ফিরে আসে।

পাকিস্তানের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই, যদি থাকতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের কিছু উপদেশ দিতাম। আমি তাদের বলতাম, তোমরা তোমাদের দগদগে ক্ষত দেখতে চাও না, খুব ভালো কথা, তোমরা চোখ বন্ধ করে থেকো। কিন্তু আমরা কী করব সেটি নিয়ে ধৃষ্টতা দেখাতে এসো না। ১৯৭১ সালে এই দেশ থেকে তোমাদের বিতাড়ন করে আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি, অনেক বিষয়ে আমরা সারা পৃথিবীর মডেল। একটু ধৈর্য ধর—যখন দেখবে আমরা ঠিক ঠিক ভাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে রায় কার্যকর করে সারা পৃথিবীকে দেখাব, কীভাবে সেটি করা যায়, তখন সেটিও সারা পৃথিবীর একটা মডেল হয়ে যাবে। আপাতত তোমরা নিজেদের নিয়ে মাথা ঘামাও। মিলিটারীর বি-টিম হয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যা করছে সেখান থেকে বের হতে পার কী না দেখো। লেখাপড়া করতে চাইলে মেয়েদের মাথায় গুলি যেন করতে না পারে সেটা খেয়াল করো। সারা পৃথিবীতে সন্ত্রাস রপ্তানি করার যে সুনামটুকু কুড়িয়েছ সেই সুনাম থেকে মুক্ত হতে পার কীনা দেখো।

পাকিস্তানের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই যদি থাকতো তাহলে এই তালিকাটি আমি আরো দীর্ঘ করে দিতাম!

কাদের মোল্লার পক্ষে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে যে নিন্দা প্রস্তাবটি নিয়েছে সেটি আমার কাছে এই রাষ্ট্রটির সাথে মানানসই একটি কাজ বলে মনে হয়েছে। এই দেশে তাদের যে অনুচরেরা আছে তাদের চেহারাটি মনে হয় বেশ ভালোভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম এর মাঝে ভয়ানকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে—আমি ঠিক এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই আশা করেছিলাম। তারা আমাকে নিরাশ করেনি।

৪.

১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ মানুুষের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমার গলায় কোনো সুর দেননি, আমার মাঝে মাঝে সেজন্য খুব দুঃখ হয়। আমার মনে হয়, যদি আমার গলায় একটু সুর থাকতো তাহলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি আমি না জানি কতো সুন্দর করে গাইতে পারতাম। যতো বেসুরো গলাতেই গাই না কেন এই গানের চরণগুলো উচ্চারণ করার সময় প্রতিবার আমার চোখ ভিজে আসে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেসুরো গলায় আমি যখন গানটি গাইছিলাম তখন একটি একটি করে চরণ গাওয়া হচ্ছিল। আর আমার মনে হচ্ছিল, ‘আহা আরো একটি লাইন শেষ হয়ে গেল! আমার মনে হচ্ছিল, আহা! যদি অনন্তকাল এই গানটি গাওয়া যেতো! যদি কোনোদিন এই গানটি শেষ না হতো।

জাতীয় সঙ্গীত শেষ হবার পর সাবধানে আমি আমার চোখ মুছেছি। আমাদের প্রজন্মের কাছে এটি তো শুধু একটি সঙ্গীত নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব, এটি আমাদের দুঃখ কষ্ট বেদনা। আমাদের আনন্দ আমাদের উল্লাস।

আমার পাশে কমবয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হবার পর আমাকে বলল, “স্যার, জানেন, যতবার আমি আমার সোনার বাংলা গান গাই আমার চোখে পানি চলে আসে!”

আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের নতুন প্রজন্ম কেমন করে আমাদের সকল স্বপ্ন, আমাদের সকল ভালোবাসা সকল মমতাকে এমনভাবে গ্রহণ করতে পারল?

 গ্লানিমুক্ত বাংলাদেশ (জুলাই ১৭, ২০১৩)

গত সোমবার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের রায় হওয়ার পর পুরো দেশে আশাভঙ্গের একটি দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেছে। তরুণ প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াটি ছিল সবচেয়ে তীব্র। প্রথমে ক্রোধ, তারপর ক্ষোভ আর দুঃখ এবং সব শেষে হতাশা। আমার সঙ্গে পরিচয় আছে এ রকম অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে তাদের সান্ত্বনা দিতে হয়েছে, উৎসাহ দিতে হয়েছে।

বিচারের রায় নিয়ে হতাশার কারণ কী? গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, এর প্রতিটি প্রমাণিত হয়েছে। সম্মানীত বিচারকরা পরিষ্কার করে বলেছেন, সর্বোচ্চ শাস্তিই তাঁর প্রাপ্য ছিল। শুধু বয়সের কারণে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের জেলা দেওয়া হয়েছে। ৯১ বছরের একজন যুদ্ধাপরাধীর পরবর্তী ৯০ বছর জেলে থাকা মৃত্যুদণ্ড থেকে কোনো অংশে কম নয়। তাহলে কেন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম এত হতাশ? কেন তাদের মনে হচ্ছে, তারা ন্যায়বিচার পায়নি?

কারণটি খুব সহজ। বাংলাদেশের ইতিহাসের যা কিছু অশুভ, তার প্রতীক হচ্ছেন গোলাম আযম। স্বাধীনতাযুদ্ধে

এ দেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন যে মানুষটি, রাজাকার, আলবদর আলশামস বাহিনী তৈরি করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আর প্ররোচনা করেছেন যে ব্যক্তি, তাঁর নাম গোলাম আযম। মুক্তিযুদ্ধের শেষে পরাজয় আসন্ন জেনে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই নতুন দেশটির বিরুদ্ধে প্রচারণা করা, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের পটপরিবর্তন হওয়ার পর দেশে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে ফিরে আসা, কূটকৌশলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে আবার জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্ব দেওয়া- এর কোনোটিই তো এ দেশের মানুষের অজানা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাঁচটি গণহত্যার একটিতে নেতৃত্ব দিয়েও তার জন্য বুকের ভেতর কোনো দুঃখ নেই, অনুতাপ নেই। বরং সদম্ভে ‘একাত্তরে কোনো ভুল করিনি’ বলে নতুন একটি প্রজন্মকে বাংলাদেশের আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো, মুক্তিযুদ্ধকে ঘৃণা করে, সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করে ষড়যন্ত্র করতে শেখানো, এর মূলে গোলাম আযম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সব অশুভ শক্তির প্রতীক গোলাম আযম। এ দেশের শিশুরা যখন একটি রাজাকারের ছবি আঁকার চেষ্টা করে, তারা যে মানুষটির চেহারা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, সেই মানুষটি হলেন গোলাম আযম। তাই এ দেশের মানুষের আশা ছিল, দেশের বিরুদ্ধে থাকা সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীর শাস্তিটিও হবে সর্বোচ্চ শাস্তি।

সেটি হয়নি। এই তরুণ প্রজন্মের মন খারাপ, কারণ তারা ইতিহাসের খাতায় লিখিয়ে যেতে পারল না, এ দেশে সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধীকে সবচেয়ে বড় শাস্তিটি পেতে হয়েছে। তাদের মন খারাপ তো হতেই পারে।

আমার পক্ষে সম্ভব হলে আমি দেশের সব তরুণের কাছে গিয়ে বলতাম, তোমরা মন খারাপ কোরো না। হতাশ হয়ো না। আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি, তারা জানি তখন কী ভয়ংকর একটা পরিবেশ ছিল। কিন্তু এর পরও এ দেশের মানুষ হতাশ হয়নি। তারা হতাশ হয়নি বলেই আমরা আমাদের দেশ পেয়েছি। একাত্তরের এই শিক্ষাটা সবাইকে নিতে হবে। রাগ হতে পারে, দুঃখ কিংবা ক্ষোভ হতে পারে; কিন্তু হতাশ হওয়া যাবে না। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেটাকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছেন, সেটি শুরু হয়েছে শুধু তরুণ প্রজন্মের কারণে। তারা তীব্রভাবে এটা চেয়েছিল বলেই ৪০ বছর পর হলেও আমরা গ্লানিমুক্ত হতে চলেছি। তরুণ প্রজন্ম যদি তীব্রভাবে চায় তাহলে এ দেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ হবে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চিরদিনের জন্য মুছে যাবে। তারা যদি চায় তাহলে হেফাজতে ইসলামের মতো সংগঠনগুলোর তীব্র নারী বিদ্বেষ থাকার পরও এ দেশের নারী-পুরুষ পাশাপাশি দেশটাকে গড়ে তুলতে পারবে। শুধু তাদের এটা চাইতে হবে।

আমি জানি, তাদের ভেতর আরো একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে। সেটি হচ্ছে, সরকার পরিবর্তন হলে কি যুদ্ধাপরাধীরা শাস্তি না পেয়েই বের হয়ে আসবে? বিষয়টি এত সহজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই সরকারের তিন-চতুর্থাংশ মেজরিটি নিয়ে তারা তো সংবিধানে একটা সংশোধনী করে যেতেই পারে, ভবিষ্যতে কোনোভাবেই যেন যুদ্ধাপরাধীরা মুক্ত হতে না পারে। হয়তো এখন আমাদের সেটাও দাবি করতে হবে।

যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়াটি আমি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করেছি। এ দেশের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানটি গোপন কিছু নয়। সেটি নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই, দোষ স্বীকার করা নেই, দুঃখ নেই, ক্ষমা ভিক্ষা নেই, তাহলে কেন মাথা উঁচু করে পাকিস্তানের জন্য আনুগত্যের কথা স্বীকার করে সত্যটি প্রকাশ করে দেওয়া হয় না? কেন মিথ্যাচার করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ট্রাইব্যুনালের সামনে মাথা নিচু করে শাস্তি গ্রহণ করতে হয়?

আমার তখন রাজশাহীর রহনপুরের সেই তরুণ মুক্তিযোদ্ধার কথা মনে পড়ে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসারের লেখা বইয়ে উল্লেখ আছে, একাত্তরের জুন মাসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর যখন বুকে অস্ত্র ধরে তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল, সে তখন গোলাম আযমের মতো মিথ্যাচার করে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেনি। নিচু হয়ে মাতৃভূমির মাটিকে শেষবার চুমু খেয়ে উঠে দাড়িয়ে বলেছিল, আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমার রক্ত আমার প্রিয় দেশটাকে স্বাধীন করবে।

এত রক্তে পাওয়া এই দেশ, এই দেশকে যুদ্ধাপরাধের গ্লানি থেকে মুক্ত করতেই হবে। একাত্তরে তরুণরা করেছিল, এখন আবার তরুণদেরই করতে হবে।

টিপাইমুখ: একটি প্রতিক্রিয়া (জানুয়ারি ০২, ২০১২)

১৯৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন ক্লেটন উইলিয়ামস নামে এক ব্যক্তি। ভদ্রলোক নির্বাচনে জিততে পারেননি, কিন্তু পৃথিবীর অনেক মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে তাঁর একটি উক্তির জন্য। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণ থেকে যদি রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় না থাকে, তাহলে চেষ্টা করা উচিত সেটা উপভোগ করা। (আমি যা-ই লিখি, ছোট বাচ্চারা নাকি সেটা পড়ে ফেলে—তাই ওপরের কথাগুলো লিখতে খুব খারাপ লাগছে।) ক্লেটন উইলিয়ামসের কথার মতো হুবহু একটা কথা ২৯ ডিসেম্বর ২০১১-এর প্রথম আলোয় পড়েছি। টিপাইমুখ সম্পর্কে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই, আমাদের কৌশল হওয়া উচিত এ থেকে আমরা কী সুবিধা নিতে পারব সেই চেষ্টা করা।’

এর কিছুদিন আগে গওহর রিজভী পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাটিতে নানা রকম ভণিতা ছিল, দেশ, দেশের স্বার্থ—এই সব বড় বড় কথা ছিল এবং পুরো লেখাটিতে পাঠকদের উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন আবেগের বশবর্তী হয়ে হঠকারী কাজকর্ম শুরু করে না দেয়। গওহর রিজভী সরকারের মানুষ, তাঁর লেখাটি পড়ে আমরা সবাই সরকারের ভূমিকাটা কী হবে, তা আঁচ করতে পেরেছিলাম।

আমি নদী বিশেষজ্ঞ নই, পানি বিশেষজ্ঞ নই, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার গত ৫৯ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর জটিল থেকে জটিলতম বিষয়টিও কমন সেন্স দিয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বুঝে ফেলা যায়। কাজেই বাংলাদেশের মানুষ টিপাইমুখের বিষয়টি শতকরা ৯০ ভাগ শুধু কমন সেন্স দিয়ে কিন্তু বুঝে ফেলেছে। বড় বড় বিশেষজ্ঞ কিউসেকের হিসাব, বর্ষা মৌসুম, শুষ্ক মৌসুম, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচব্যবস্থা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে থাকুন, আমরা সাধারণ মানুষ কিছু সাধারণ প্রশ্ন করি:

আমরা কি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করব, নাকি প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব? একেবারে ছোট শিশুটিও জানে পৃথিবীতে প্রযুক্তি এখনো প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় পৌঁছায়নি, কোনো ভূমিকম্প থামানো যায় না, কোনো ঘূর্ণিঝড় বন্ধ করা যায় না, পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ঢল আটকানো যায় না। ঠিক সে রকম একটা নদীকে বন্ধ করা যায় না, গতিপথ ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। নির্বোধ মানুষ যে চেষ্টা করে না তা নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই করা হয়েছে; কিন্তু সেটা মানুষের ওপর অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। ভবদহের কথা আমরা ভুলিনি, ফারাক্কা আমাদের চোখের সামনেই আছে। কাজেই গওহর রিজভী কিংবা মহিউদ্দিন আহমেদের মতো বিশেষজ্ঞরা যতই বলুন ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাঁধ তৈরি করে’ বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে ফেলতে হবে আমি সেই কথা বিশ্বাস করি না। আমাদের দেশে কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে বিশাল এলাকা পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অসংখ্য অসহায় আদিবাসী মানুষকে রাতারাতি গৃহহারা করা হয়েছিল। এখন সেই চেষ্টা করা হলে বাংলাদেশের মানুষ কোনো দিন সেটা হতে দিত না, কোনো সরকারের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাহস হতো না।
কাজেই বিশেষজ্ঞরা যতই বলতে থাকুন টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত শুভ উদ্যোগ, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। যারা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, আসলে তারা পৃথিবীর ভালো চায় না। তারা বাংলাদেশের মানুষ হোক, ভারত বা চীন যে দেশেরই হোক, তাদের ধিক্কার দিতে হবে। তারা হচ্ছে পৃথিবীর দুর্বৃত্ত।

গওহর রিজভী এবং মহিউদ্দিন আহমেদ দুজনই টিপাইমুখ বাঁধের সুফল নিয়ে ভালো ভালো কথা বলেছেন, তার বেশির ভাগ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তর্ক-বিতর্ক করতে থাকুন। আমি শুধু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই, সেটা হচ্ছে বন্যা। তাঁরা দুজনেই দাবি করেছেন এই বাঁধ দিয়ে বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। আমি সিলেটে থাকি, আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুরমা নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। আমি এখানে ১৭ বছর ধরে আছি, শুধু একবার (২০০৪ সালে) সুরমা নদীর পানি উপচে এসেছিল, আমি তো আর কখনো সুরমা নদীর পানিকে তীর ভেঙে আসতে দেখিনি! হাওর অঞ্চল তো প্রতিবছর পানিতে ডুবে যায়, ডুবে যাওয়ারই কথা, সেটাই হচ্ছে এর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। সেটা তো বন্যা নয়। তাহলে তাঁরা কোন বন্যাকে ঠেকানোর কথা বলছেন? যে বন্যার অস্তিত্ব নেই, সেই বন্যার প্রকোপ থামানোর কথা বললে আমরা যদি বিশেষজ্ঞদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাই কেউ আমাকে দোষ দিতে পারবে? এই বন্যা নিয়ে তাঁদের বিশেষজ্ঞ মতামত আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়—ঠিক সে রকম তাঁদের অন্যান্য বিশেষজ্ঞ মতামতও যে অর্থহীন নয়, সেই গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে?

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ভারত এই বাঁধ তৈরি করবেই’, তিনি তার বিরোধিতা করতেও রাজি নন। কোনো রকম চেষ্টা না করে পরাজয় স্বীকার করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার চেষ্টাকে এ মুহূর্তে তাঁর কাছে এবং সম্ভবত আরও অনেকের কাছে খুব কঠিন কাজ মনে হচ্ছে। সারা দেশে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন গড়ে তোলা এই মানুষগুলোর কাছে একটা অযৌক্তিক এবং অসম্ভব কাজ বলে মনে হচ্ছে। কাজেই তাঁরা এর জন্য চেষ্টা করতেও রাজি নন।

তাঁদের সবাইকে মনে করিয়ে দেওয়া যায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন এই দেশে গণহত্যা শুরু করেছিল তখন কোনো মানুষ যদি যুক্তিতর্ক দিয়ে বিবেচনা করত তাহলে তারা নিশ্চিতভাবেই ধরে নিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা একটা পুরোপুরি অবাস্তব বিষয়। মার্চ মাসে শুরু করে মে মাসের মাঝামাঝি পুরো দেশটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দখল করে নিয়েছিল। এখন যাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে তারা সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী অনুচর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো দেশ পাকিস্তানের পক্ষে, পৃথিবীর মুসলমান দেশগুলোও পাকিস্তানের পক্ষে, এক কোটি মানুষ দেশছাড়া, যারা দেশে আছে তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে, খুন করে সারা দেশে হাহাকার। দেশের কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র নেই, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই, পেশাদার বাহিনী বিশৃঙ্খল, যাঁরা নেতৃত্ব দেবেন তাঁদের মধ্যেও কোন্দল—এ রকম একটা পরিবেশ দিয়ে শুরু করে আমরা স্বাধীন একটা দেশ ছিনিয়ে আনতে পারব সেটা কি কেউ কল্পনা করেছিল? করেনি। কিন্তু তার পরও এই দেশের মানুষ দেশপ্রেমের যুক্তিহীন আবেগকে মূলধন করে এই দেশকে স্বাধীন করে ছেড়েছিল।

কাজেই যাঁরা এই দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা তাঁরা এই দেশের মানুষের ‘যুক্তিহীন’ আবেগকে খাটো করে দেখবেন না। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না, তার সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়। টিপাইমুখের বেলায়ও হুবহু একই কথা বলা যায়—দেশের মানুষের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করবেন না, তাদের সঙ্গে সহাবস্থান করুন।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-01-02

ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর (ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)

১.

বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের সব মানুষের মতো আমিও আটকা পড়েছি। প্রথমে হরতালে আটকা পড়েছিলাম। এখন অবরোধে আটকা পড়েছি। দুটোর মাঝে পার্থক্যটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। হরতাল শুরু হওয়ার আগেই গাড়ি পোড়ানো হত। অবরোধের আগেও পোড়ানো হয়। হরতালে গাড়ি পোড়ানোর সময় ভেতরে অনেক সময় যাত্রীরা থাকে। অবরোধেও তাই।

সিলেটে থাকি, আমার মা ঢাকা থাকেন। অন্য কোনো কাজ না থাকলেও শুধু মাকে দেখার জন্যে ঢাকা যাই। এখন যেহেতু ঢাকা যেতে পারছি না, দেখা করতে পারছি না, তাই টেলিফোনে কথা হয়।

আমার মা জানেন আমার বাসায় টেলিভিশন নেই। তাই টেলিভিশনে কী কী দেখানো হয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে জানান। ইদানিং আমার মা টেলিভিশন না দেখার জন্যে আমার উপর খুব বিরক্ত। মোটামুটি ষ্পষ্ট করে বললেন, “সারা দেশে কী তাণ্ডব হচ্ছে, কী নৃশংসতা হচ্ছে নিজের চোখে দেখবি না, পালিয়ে বেড়াবি, এটা হয় না। তোকে দেখতে হবে– এই দেশে কী হচ্ছে নিজের চোখে তোকে দেখতে হবে।”

তারপরও আমি টেলিভিশনে সেই ভয়াবহ ঘটনা দেখি না। ইন্টারনেটে খবর পড়ি। খবরের কাগজে ছবিগুলো দেখে দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেলি। গত কিছুদিন বাংলাদেশের খবরের কাগজে যে ছবি ছাপা হচ্ছে তার থেকে হৃদয়হীন নৃশংস অমানুষিক বর্বরতার ঘটনা এই দেশের মানুষ এত নিয়মিতভাবে দেখেছে বলে আমার জানা নেই।

কোনটা বেশি বড় নিষ্ঠুরতা আমি এখনও নিশ্চিত নই। একেবারে সাধারণ মানুষকে, স্কুলের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে পথচারী কিংবা মহিলাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা, নাকি যারা এটা করছে তাদের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ না করে চুপচাপ এই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সমর্থন করে যাওয়া?

‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ বলে একটা শব্দ চালু আছে। আমরা জানতাম সেটি এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীকে করে থাকে। এখন যেটাকে রাজনৈতিক সহিংসতা বলা হচ্ছে সেখানে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীর সংখ্যা খুব কম। বেশিরভাগ মানুষ সাধারণ মানুষ। আুগনে পুড়ে যাবার মতো ভয়ংকর আর কী হতে পারে? যারা মারা যাচ্ছেন তাদের আপনজনদের হাহাকার আর ক্ষোভের কথাটা আমি চিন্তাও করতে পারি না। যারা বেঁচে আছেন তাদের সেই অমানুষিক কষ্টের কথা কি বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব?

যারা রাজনীতি করেন তারা সবকিছু পরিসংখ্যান দিয়ে বিশ্লেষণ করে ফেলতে পারেন, আমরা পারি না। একটামাত্র মৃত্যু কিংবা একটামাত্র নিষ্ঠুরতার কথা আমাদের পীড়ন করতে থাকে– এতগুলো আমরা কেমন করে সহ্য করব?

আমরা সবাই গণআন্দোলনের কথা জানি, যখন নিয়মতান্ত্রিকভাবে আর কিছু করা যায় না তখন সাধারণ মানুষ পথে নেমে আসে। কিন্তু আন্দোলনের নামে এই নৃশংসতার কথা আমরা কি আগে কখনও দেখেছি! যারা মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তারা যখন বাড়ি ফিরে যায়, টেলিভিশনে সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো দেখে, তখন কি তাদের চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠে?

সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষগুলো যখন যন্ত্রণায় ছটফট করে, তাদের আপনজন যখন হতাশায়, ক্ষোভে, দুঃখে, ক্রোধে নিজেদের সংবরণ করতে পারে না– তখন কি এই মানুষগুলো উল্লসিত হয়ে ভাবে তারা তাদের গন্তব্যে আরও একটু পৌঁছে গেছে? তাদের নেতা-কর্মীরা কি ফোন করে তাদের অভিনন্দন জানান? যখন দেখা হয় তাদের পিঠ চাপড়ে দেন? আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে।

যখন থেকে দেশে এই নূতন ধরনের সন্ত্রাস শুরু হয়েছে তখন আরও একটি বিচিত্র বিষয় আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে। খবরের কাগজে প্রায়ই ছবি দেখতে শুরু করেছি, যেগুলো দেখে মনে হয় আমরা বুঝি নাটকের দৃশ্য দেখছি। সন্ত্রাসী এই কাজকর্মের এত নিখুঁত ছবি দেখে আমরা মাঝে মাঝে হকচকিয়ে যাই। দেখে মনে হয় সাংবাদিকেরা যেন ভালো করে ছবিগুলো তুলতে পারেন বুঝি সেজন্যেই তাদের সামনে অনেক যত্ন করে ঘটনাগুলো ঘটনা হচ্ছে।

বিশ্বজিৎ নামের সেই ছেলেটিকে যখন ছাত্রলীগের ছেলেরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করল তখন সাংবাদিকেরা এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় ধারণ করার জন্যে এত সময় না দিয়ে ছেলেটিকে যদি বাঁচানোর চেষ্টা করতেন তাহলে সে বেঁচে যেত কি না এই চিন্তাটি মাঝে মাঝেই আমার মাথায় উঁকি দেয়।

কেভিন কার্টার নামে একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে এই ফটোগ্রাফার তার একটি ছবির জন্যে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন। ছবিটি ছিল আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের সময়ের ছবি, একটি শীর্ণ শিশু নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে খাবারের সন্ধানে, অদূরে তাকে অনুসরণ করছে একটি শকুন। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার সেই ছবির জন্যে কেভিন কার্টার পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু একজন মানুষ হয়ে একটা শিশুকে রক্ষা না করে শকুনের সঙ্গে ছবি তোলার জন্যে সারা পৃথিবীতে তার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল– সম্ভবত সে জন্যেই তার কয়েক মাস পরে এই ফটোগ্রাফার আত্মহত্যা করেছিলেন।

একজন ফটোগ্রাফার চমকপ্রদ একটা ছবি তোলার জন্যে সবসময় চোখ-কান খোলা রাখেন। কিন্তু সেই ছবি তোলার সুযোগ করে দিয়ে যদি সন্ত্রাসীদের গোষ্ঠী সেই ফটোগ্রাফার, সেই পত্রিকা, পত্রিকার সম্পাদক সবাইকে ব্যবহার করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলে তাহলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে তারা দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, হত্যাকারীদের মানুষকে আতংকিত করে তোলার প্রক্রিয়াকে গায়ে পড়ে সাহায্য করছে না ?

২.

এই দেশে আজকাল মানুষের নিরাপত্তা নেই, যে কোনো মানুষ যে কোনো সময়ে আক্রান্ত হতে পারে। গত সপ্তাহে আমাদের ক্যাম্পাসে একসঙ্গে অনেকগুলো ককটেল ফুটল। একটা আমাদের বাসার বারান্দায়। যখন সেটি ফাটানো হয়েছে তখন আমার স্ত্রী তার কয়েক ফুট দূরে। মাঝখানে দেয়াল দরজা থাকার জন্যে বড় ধরনের কিছু ঘটেনি। কিছুক্ষণের ভেতরেই সবাই বাসা থেকে বের হয়ে এল।

দেখতে দেখতে শত শত ছাত্র। ভয় কিংবা আতংকের বদলে বরং একটা উৎসব উৎসব ভাব। খুব কাছেই মেয়েদের হল। ককটেলের শব্দ তারা খুব ভালোমতো পেয়েছে। টেলিফোনে আমাদের জানানো হল তাদের কয়েকজন বের হতে চায়। প্রক্টর, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক সবাই আছেন। তারা ভাবল বরং আমরাই মেয়েদের সাহস দিয়ে আসি!

মেয়েদের হলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সব মেয়েরা বের হয়ে আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। একজন বলল, “স্যার, খুব ভয় লাগছে।” আমি বললাম, “ভয় লাগার কী আছে? এদেশে জন্মেছ, একটু সহ্য কর।” মেয়েরা তখন বাধা দিয়ে বলল, “না না স্যার, আমাদের নিজেদের জন্যে একটুও ভয় লাগছে না। আপনার আর ম্যাডামের জন্যে ভয় লাগছে।”

যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে একদিন যেতে হবে এই ছেলেমেয়েদের ভালোবাসা ছেড়ে, কেমন করে যাব আমি জানি না। এরা আমাদের নূতন প্রজন্ম, ডিসেম্বর মাস এলে আমার এই দেশের তরুণ প্রজন্মের কথা মনে পড়ে। এই দেশটি তরুণ প্রজন্মের দেশ। তরুণ প্রজন্ম তীব্র আবেগ আর ভালোবাসায় এই দেশটির জন্ম দিয়েছিল। আবার তীব্র আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে এই দেশটিকে রক্ষা করবে, এই দেশটি গড়ে তুলবে।

সেদিন ভোরবেলা একটা টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক আমার অফিসে চলে এসেছেন ইন্টারভিউ নিতে। ডিসেম্বর মাসে তারা মুক্তিযুদ্ধের উপর অনুষ্ঠান করবেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার স্মৃতি জানতে চান, আমার কথা শুনতে চান।

আমি সেই টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক বীরত্ব আর অনেক বড় অর্জনের ইতিহাস, কিন্তু সেটা একই সঙ্গে অনেক বড় একটা আত্মত্যাগের ইতিহাস। আত্মত্যাগের এত বড় ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোথাও এভাবে আছে কি না আমার জানা নেই। এই মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা বাংলাদেশে একটি পরিবারও ছিল না যার কোনো একজন আপনজন কিংবা কাছাকাছি একজন মানুষ মারা যায়নি। দেশ যেদিন মুক্ত হয়েছিল সেই অবিশ্বাস্য আনন্দের পাশাপাশি অনুভূতিটি ছিল স্বজনহারানো একটি গভীর বেদনার অনুভূতি।

আমি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিককে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম আমাদের প্রজন্ম সম্ভবত সবচেয়ে সৌভাগ্যবান প্রজন্ম। ভয়ংকর দুঃসময়ে কীভাবে টিকে থাকতে হয় আমরা জানি। তার চাইতে বড় কথা, একাত্তরের সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে এই দেশের মানুষের সবচেয়ে সুন্দর রূপটি বের হয়ে এসেছিল। গভীর ভালোবাসায় মানুষ তখন একে অন্যের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।

আমাদের প্রজন্ম মানুষের সেই রূপটি দেখেছে। আমরা তাই কখনও মানুষের উপর বিশ্বাস হারাই না। আমরা জানি অতিসাধারণ অকিঞ্চিৎকর একজন মানুষের ভেতরে একজন অসাধারণ মানুষ লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজনের সময় তাকে বের করে আনা যায়। আমি জানি এটা হচ্ছে আমাদের শক্তি। জ্ঞানী-গুণী অল্প কয়জন সুশীল সমাজ আমাদের শক্তি নয়, অসংখ্য সাধারণ মানুষ আমাদের শক্তি। এই দেশে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ, আমাদের ভয় কী?

এই সাধারণ মানুষদের পথ দেখাবে নূতন প্রজন্ম। তাই আমি সবসময় তাদের মুখ চেয়ে থাকি, তারা কখনও আমাকে নিরাশ করে না। অল্প একটু সুযোগ দিলে তারা ম্যাজিক করে ফেলতে পারে, আমি সবিস্ময়ে সেটি দেখি। এই নূতন প্রজন্মকে আমি বারবার মনে করিয়ে দিতে চাই কখনও যেন তারা হতোদ্যম না হয়, কোনো কিছু নিয়ে তারা যেন হতাশ না হয়।

একাত্তরে অবিশ্বাস্য দানবের বিরুদ্ধে এই দেশের মানুষ বিজয় লাভ করছিল শুধু একটি কারণে, তারা তাদের মনের জোর হারায়নি। এখনও তাদের মনের জোর হারালে চলবে না। আমাদের চারপাশে আমরা যেটি দেখছি সবকিছু সাময়িক। আমাদের তরুণদের ভেতরে যে শক্তি আছে, তারা সবকিছু খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিতে পারবে, আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি।

ডিসেম্বর মাস এলে আমার সেই তরুণদের কথা, কিশোরদের কথা মনে পড়ে। আমার সেই কিশোর বন্ধুরা যারা অস্ত্রহাতে মুক্তিযুদ্ধ করে মারা গিয়েছিল। তারা এখনও কিশোর, এখনও তরুণ। তারা কোনোদিন বড় হবে না, আজীবন কিশোর থেকে যাবে। আমরা যারা বেঁচে আছি, আমাদের বয়স বাড়ছে, আমাদের চুল পাকছে, কিন্তু সারাটি জীবন পরিশ্রম করেও আমরা কি সেই কিশোর-তরুণদের এক ফোঁটা রক্তের ঋণ শোধ করতে পারব?

আমাদের নূতন প্রজন্ম পারবে। শত বাধা-বিপত্তি হরতাল-অবরোধ, সন্ত্রাস, অরাজকতা, ভায়োলেন্সের মাঝেও কিন্তু বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্যে একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল– সেই পাকিস্তানের এখন বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ পর্যন্ত নেই!

অমর্ত্য সেন স্পষ্ট করে বলেছেন মানুষের জীবনের মানের কথা চিন্তা করলে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ ভারত থেকেও বাংলাদেশের মানুষ অনেক ভালো আছে। খাদ্যশস্য বা স্বাস্থ্যসেবার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থাকে পৃথিবীর মানুষ এখন একটা বিস্ময় হিসেবে দেখে। সবচেয়ে বড় কথা এই দেশের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রজন্ম যখন দেশের দায়িত্ব নেবে তখন আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, কার সেই ক্ষমতা আছে?

এই মুহূর্তে খবরের কাগজ খুলে যখন একটি যন্ত্রণাকাতর শিশুর মুখ দেখি, একজন মায়ের কান্না দেখি, অগ্নিদগ্ধ একজন মানুষের হাহাকার দেখি তখন মনটা ভারী হয়ে যায়। এটি ডিসেম্বর মাস, এই মাসে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক সব দুঃখ-কষ্ট দূর করে আমাদের সেই তরুণ-কিশোর মুক্তিযোদ্ধার রক্তের ঋণ আমরা শোধ করব।

আমাদের তরুণ প্রজন্ম নিশ্চয়ই করবে।

তোমরা যারা শিবির করো (ডিসেম্বর ০৭, ২০১২)

বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমি আমার অফিসে যাচ্ছি, তখন বারান্দায় আমার দুজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হলো, তারা আমাকে কিছু বলল না কিন্তু তাদের দেখে আমার মনে হলো, তারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও?’ তারা মাথা নাড়ল, একজন কুণ্ঠিতভাবে আমার হাতে দুটি বই তুলে দিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে এই বই দুটি দিতে এসেছি।’ আমি বই দুটি নিলাম। বিজ্ঞানের ওপর চমৎকার দুটি বই, হাতে নিয়ে বললাম, ‘থ্যাংকু। সুন্দর পাবলিকেশন্স।’ তারপর বই দুটি খুললাম, ভেতরে লেখা ইসলামী ছাত্রশিবির।

মুহূর্তে আমার সারা শরীর শক্ত হয়ে গেল। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহ হয়ে এই দেশে যে ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, সে জন্য আমি তাদের কখনো ক্ষমা করিনি। আমি জেনেশুনে কখনো কোনো জামায়াতে ইসলামীর নেতার সঙ্গে হাত মেলাইনি। আমার যে আপনজনেরা মুক্তিযুদ্ধে মারা গিয়েছে, তাদের সম্মান দেখানোর জন্য এটি আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আমেরিকান এম্বাসির এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে যখন আবিষ্কার করেছি, সেখানে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরও ডাকা হয়েছে, আমি সেখান থেকে উঠে চলে এসেছিলাম। আমি আমার এই বিশ্বাসের কথা কখনো গোপন রাখিনি। কাজেই এই দুজন ছাত্র সেটা জানে না, তা হতে পারে না।

আমি ছাত্রদের বই দুটি ফেরত দিয়ে অত্যন্ত কঠিন গলায় বললাম, ‘জামায়াতে ইসলামীকে আমি কোন চোখে দেখি, তোমরা জানো না? তোমরা সেই দলের মানুষ হয়ে তোমাদের সংগঠনের বই আমাকে উপহার দিতে এসেছ? তোমরা আমাকে চেনো না?’

ছাত্র দুটির চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বদর বাহিনীর প্রধান হয়ে নিজামী আর মুজাহিদ কী করেছে, তাদের মনে করিয়ে দিলাম। গোলাম আযম যুদ্ধের সময় কী করেছে এবং বাংলাদেশের জন্মের পরও কীভাবে তারা বিরোধিতা করেছে, সেই কথা বললাম। আমার মতো শিক্ষকেরা জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের তৈরি বদর বাহিনীর হাতে কীভাবে মারা গিয়েছে, সেই ঘটনাগুলো বলে তাদের কাছে জানতে চাইলাম, কম বয়সী তরুণ হওয়ার পরও তারা কেমন করে যুদ্ধাপরাধীদের একটা সংগঠনের সদস্য হতে পারল?
একজন ছাত্র দুর্বল গলায় বলল, ‘স্যার, আমরা তো জামায়াতে ইসলামী করি না। আমরা ছাত্রশিবির করি।’

অনেক দিন আগের কথা, জামায়াতে ইসলামী আর ছাত্রশিবিরের মধ্যে পার্থক্যটুকু নিয়ে আমি তাদের কী বলেছিলাম, আমার এখন মনে নেই। শুধু মনে আছে, ছাত্র দুটি মাথা নিচু করে আমার কাছ থেকে ফিরে গিয়েছিল।

নানা কারণে এই ঘটনার কথা আমি ভুলতে পারি না। আমি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য লেখালেখি করি। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা একটি নতুন বাংলাদেশের সন্তান এবং তারা বড় হয়ে আমাদের দেশটাকে পাল্টে দেবে। আমি যখন সেই কথাটা তাদের বলি, আমার ধারণা, তারা আমার কথা বিশ্বাস করে। তাই তাদের অনেকেই আমার কাছে উৎসাহের কথা, অনুপ্রেরণা কিংবা স্বপ্নের কথা শুনতে আসে। শিবিরের এই দুটি ছেলে নিশ্চয়ই ভেবেছিল, তাদের এই চমৎকার বই দুটি আমাকে মুগ্ধ করবে, আমি উৎসাহসূচক কিছু বলব। অন্য দশজন তরুণের মতো তারাও এক ধরনের দাবি নিয়ে আমার কাছে এসেছিল, কিন্তু আমি তাদের আশা পূরণ করতে পারিনি। আমার ভয়ংকর রকমের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখে তারা নিশ্চয়ই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল—কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।

আমি তাদের কথাগুলোও ভুলতে পারি না। তারা আমাকে বলেছিল যে তারা জামায়াতে ইসলামী করে না, তারা শিবির করে। তাহলে তারা কি সত্যিই বিশ্বাস করে যে তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে ভিন্ন? ১৯৭১ সালে এই দেশে জামায়াতে ইসলামী যে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড করেছে, যে অমানুষিক নির্যাতন করেছে, যে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড করেছে, সেগুলো তাদের কোনোভাবে স্পর্শ করে না?

এই দুজন ছাত্র ছাড়া আর কখনোই কোনো জামায়াত বা শিবিরকর্মী আমার কাছে কথা বলতে আসেনি, তাই আমি কোনো দিন হয়তো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাব না।

২.
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই দীর্ঘ জীবনে আমি সবচেয়ে বিচিত্র, সবচেয়ে অবিশ্বাস্য বিষয় কী দেখেছি। আমি এতটুকু দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তার কারণ, যে বয়সটি হচ্ছে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার বয়স, সেই বয়সে তারা ভালোবাসে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকদের, যারা এই মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যে বয়সে একজন তরুণের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা অনুপ্রাণিত হয় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাকারীদের দিয়ে। যে বয়সে তাদের স্বপ্ন দেখার কথা দেশের বড় বড় লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, সাংবাদিককে নিয়ে, সেই বয়সে তারা আনুগত্য মেনে নিয়েছে সেই সব মানুষের, যারা আলবদর বাহিনী তৈরি করে একাত্তরে এই দেশের লেখক, শিল্পী, ডাক্তার, বিজ্ঞানী আর সাংবাদিকদের হত্যা করেছে! যে বয়সে তাদের একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করার কথা, ষোলোই ডিসেম্বরে স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার কথা, পয়লা বৈশাখে রাজপথে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা যে শুধু এই অবিশ্বাস্য আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখে তা নয়, তারা এগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। যে বয়সে তাদের মুক্তচিন্তা শেখার কথা, গান গাওয়ার কথা, নাটক করার কথা, আদর্শ নিয়ে ভাবালুতায় ডুবে যাওয়ার কথা, সেই সময় তারা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে রাখতে শেখে, সাম্প্রদায়িক হতে শেখে, ধর্মান্ধ হতে শেখে। যে বয়সে ছেলে আর মেয়ের ভেতর সহজ ভালো লাগা ভালোবাসা জন্ম নেওয়ার কথা, সেই বয়সে তারা সেই অনুভূতিগুলোকে অশ্রদ্ধা করতে শেখে—সে জন্য তারা কত দূর যেতে পারে, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, সেই ভয়ংকর কাহিনি আমি কখনো কাউকে বলতেও পারব না!

যখন এই বাংলাদেশের সব মানুষ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন ইসলামী ছাত্রশিবির নামে এই সংগঠনের হতভাগ্য তরুণদের পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই, এখনো দেশের আনাচকানাচ থেকে তাদের ধরে জেলে ঢোকানো হচ্ছে। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে যে নেতারা তাদের বুঝিয়েছে, রাস্তায় নেমে চোরাগোপ্তা হামলা করে পুলিশের গাড়ি পোড়াতে হবে, নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করতে হবে। সেই সব নেতা কি তাদের সন্তানদেরও পথে নামিয়েছে? আমি মোটামুটি নিশ্চিত, সেটি ঘটেনি। আমি আগেও দেখেছি, এই নেতারা যখন তাদের কর্মী বাহিনীকে অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, তখন তাদের সন্তানেরা ইংরেজি মিডিয়াম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে।

আমি অনেক চিন্তা করেছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি, কেমন করে বাংলাদেশের মতো রক্তস্নাত একটি দেশে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা নৃশংস পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সেখানে একজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের ভালো না বেসে তাদের হত্যাকারীদের ভালোবাসতে পারে! আমার মনে আছে, আমি বহুকাল পরে যখন প্রথম এই দেশে ফিরে এসেছিলাম, তখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একটা মিছিল দেখে একধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখন লক্ষ করেছিলাম, একজন ছাত্র তার হাতের ফাইল দিয়ে নিজের মুখটি ঢেকে রেখেছে, যেন আমি তার মুখটা দেখতে না পারি। আমার সামনে এই পরিচয় দিতে তার লজ্জা কিন্তু এই মিছিল থেকে তার বের হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই—এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?

একজন ছাত্র কেমন করে শিবির করে, তার একটি উত্তর অবশ্য আমি একবার খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র একবার আমাকে একটি এসএমএস করে জানিয়েছিল যে সে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, খুব ভালো ছাত্র এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার খুব ইচ্ছে। তার বিভাগীয় প্রধান জামায়াতে ইসলামীর লোক এবং তাকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সে যদি শিবির না করে, তাহলে তাকে শিক্ষক হতে দেওয়া হবে না। সে জন্য সে শিবিরে যোগ দিয়েছে এবং এটি নিয়ে তার কোনো অহংকার নেই। সেই এসএমএসটিতে আমি একজন মেরুদণ্ডহীন অসহায় হতভাগা মানুষকে আবিষ্কার করেছিলাম। তার জন্য কোনো মমতা নয়, আমি করুণা অনুভব করেছিলাম। আমি ইচ্ছে করলেই সেই ছাত্রটিকে খুঁজে বের করতে পারতাম, তার নীতিহীন বিভাগীয় প্রধানের পরিচয় জানতে পারতাম কিন্তু আমি তার কিছুই করিনি—আমার রুচি হয়নি।

আমার মাঝেমধ্যে জানার ইচ্ছে করে, এ ধরনের কারণে কতজন তরুণ শিবিরে যোগ দিয়েছে—কোনো স্বপ্ন নয়, কোনো আদর্শ নয়, শুধু স্বার্থ, শুধু চাওয়া-পাওয়া। মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই, জামায়াতে ইসলামীর নাকি অনেক অর্থবিত্ত, তাদের অনেক ধরনের ব্যবসা। এই দলে যোগ দিলে নাকি তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা হল দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই হলে সিট পাওয়া যায়। তারা কলেজ দখল করে রাখে, তাদের দল করলে সেই কলেজে ভর্তি হওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় দেখি, পরিচিতদের কাছে শুনি, তাদের দল নাকি অত্যন্ত সংগঠিত। আদর্শ ছাড়া কিংবা ভুল আদর্শের সংগঠন কি খুব বেশি দিন টিকে থাকতে পারে? দীর্ঘদিন মিলিটারির শাসনে থাকার কারণে মানুষ যখন বিভ্রান্ত ছিল, তখন এই দেশে জামায়াতে ইসলামীরা ইলেকশনে ৩০টার মতো সিট পেয়েছিল। (কী লজ্জা!) যখন দেশের মানুষ গণতন্ত্রের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে, একটু বুঝতে শুরু করেছে তখন তাদের সিটের সংখ্যা এক-দুইয়ে নেমে এসেছিল। উপায় না দেখে তখন তারা বিএনপির ঘাড়ে চড়ে বসেছে, আবার তারা গোটা ত্রিশেক সিট পেয়েছে, মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। দেশের মানুষ যখন আবার সজাগ হয়েছে, তখন সিটের সংখ্যা আবার এক-দুইয়ে নেমে এসেছে। এখন তারা কার ঘাড়ে উঠবে। এই দেশে যদি নির্বাচন করেই শুধু ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তাহলে তাদের জন্য কোন পথটুকু খোলা আছে। আমার খুব আশা ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে দেশের মানুষের এত আগ্রহ, এত উত্তেজনা দেখে বিএনপি হয়তো যুদ্ধাপরাধীদের এই দলটিকে পরিত্যাগ করবে—তারা করেনি। আমি খুব আশাহত হয়েছি কিন্তু তাদের ছাত্রসংগঠন আমাকে আশাহত করেনি। তারা শিবিরের সঙ্গে হাত মেলাতে রাজি হয়নি।

আমি রাজনীতি ভালো বুঝি না, আমার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ কারও গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি একটা বিষয় খুব ভালো করে জানি, এই দেশে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে আর কেউ কোনো দিন রাজনীতি করতে পারবে না। পঁচাত্তর থেকে নব্বইয়ের সেই কালো সময় আমরা পার হয়ে এসেছি, আর কেউ কখনো এই দেশের মানুষকে সেই অন্ধকার জগতে ঠেলে পাঠাতে পারবে না। কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে কেউ সুবিধে করতে পারবে না, বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের বিচার করে এই গ্লানিময় অধ্যায়কে চিরদিনের মতো সমাপ্ত করে দিতে হবে।

৩.
আমার এই লেখাটি তোমরা যারা শিবির করো, তাদের জন্য। আমি জানি, এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি কাজ—আমার এই লেখাটি তোমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলবে না এবং তোমরা যারা পড়ছ তারা আমার এই লেখায় বিভিন্ন অংশের বিরুদ্ধে এর মধ্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়েছ। শুধু তা-ই নয়, তোমাদের প্রিয় জায়গা—ইন্টারনেটে সম্ভবত এই লেখার বিরুদ্ধে বিশাল একটা প্রচারণা শুরু হবে। কিন্তু তবু আমার মনে হয়েছে, আমার এই কাজটুকু করা উচিত, তোমাদের কখনো যে সত্য কথাগুলো বলা হয়নি, আমার সেটা বলা উচিত।
তোমাদের কাছে আমার প্রথম যে প্রশ্ন সেটি হচ্ছে, তোমরা কি জানো আবুল আলা মওদুদী নামে যে মানুষটির চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে জামায়াতে ইসলামী নামে রাজনৈতিক দলটি গড়ে উঠেছে, সেই মানুষটিকে মানুষ হত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল (যদিও সেটি শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি)। তোমরা কি জানো জামায়াতে ইসলামী ইসলাম প্রচারের দল নয়, এটি রাজনৈতিক দল এবং এটি সব সময় ভুল রাজনীতি করে এসেছে? এই উপমহাদেশে যখন ব্রিটিশদের বিদেয় করে পাকিস্তান সৃষ্টি করার আন্দোলন হয়েছে, তখন তারা সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে। আবার যখন এই দেশে পাকিস্তান নামের দানবকে পরাস্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের বিপক্ষে গিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে? এখন যখন মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ করে থাকা দেশদ্রোহীদের বিচার করা হচ্ছে, তখন আবার জামায়াতে ইসলামী সেই সত্যকে অস্বীকার করে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়েছে—সেটি ঘটেছে তোমাদের চোখের সামনে এবং তোমরা খুব ভালো করে জানো, সেখানে তোমাদের হূদয়হীনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

আমার ধারণা, তোমরা যারা শিবির করো, তারা সম্ভবত কখনোই খোলা মন নিয়ে এই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলো না। তোমরা সব সময়ই নিজেদের সঙ্গে নিজেরা কথা বলো, একে অন্যকে উৎসাহ দাও, একে অন্যের ওপর নির্ভর করো কিন্তু তোমাদের দলের বাইরের মানুষেরা তোমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, কখনোই তার খোঁজ নাওনি। যদি খোঁজ নিতে, তাহলে হয়তো তোমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ছবি দেখতে পেতে। তোমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করতে, তোমাদের যেভাবে যা কিছু শেখানো হয়েছে, তার সবকিছু সত্যি নয়। তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, এই দেশের অজস্র সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে তোমাদের দলের দু-একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়া অন্য কোথাও তোমাদের সম্পর্কে একটিও ভালো কথা ছাপা হয় না। কিছুদিন থেকে গাড়ি ভাঙচুর বা পুলিশকে আক্রমণ করার যে নতুন কর্মকাণ্ড শুরু করেছ, সেটি করে তোমরা যে নিজেরাই বিপদগ্রস্ত হতে শুরু করেছ, সেটা কি লক্ষ করেছ? আজ রাতেই আমি খবরে জানতে পারলাম, সাধারণ মানুষ তোমাদের ধাওয়া করছে, তোমাদের আক্রমণ করছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়তে থাকবে। তোমরা নিজেদের জন্য যে জীবন বেছে নিয়েছ, তার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র মর্যাদা আছে? আত্মতুষ্টি আছে?

আজ থেকে কয়েক যুগ আগেও এই পৃথিবী যে রকম ছিল, এখন সেই পৃথিবী নেই। এই পৃথিবী অনেক পাল্টে গেছে। নতুন পৃথিবী তালেবান বা লস্কর-ই-তাইয়েবার পৃথিবী নয়। জামায়াতে ইসলামী বা শিবসেনার পৃথিবীও নয়। নতুন পৃথিবী হচ্ছে মুক্তচিন্তার পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক একটা পৃথিবী। এই নতুন পৃথিবীর মানুষেরা অসাধারণ, তারা একে অন্যের ধর্মকে সম্মান করতে শিখেছে, একে অন্যের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে উপভোগ করতে শিখেছে, একে অন্যের চিন্তাকে মূল্য দিতে শিখেছে। এই নতুন পৃথিবীতে মানুষে মানুষে কোনো বিভাজন নেই। দেশ-জাতির সীমারেখা পর্যন্ত ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে।

তাই এই নতুন পৃথিবীতে যখন কেউ ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভাজন করে রাজনীতি করতে চায়, পৃথিবীর মানুষ তখন তাকে পরিত্যাগ করে। জামায়াতে ইসলামীর মতো বা শিবসেনার মতো রাজনৈতিক দল তাই হচ্ছে বাতিল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক দল—নতুন পৃথিবীতে এই দলগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

আমি জানি, যদিও আমি এই লেখাটি লিখেছি যারা শিবির করে তাদের উদ্দেশে কিন্তু তারা আসলে আমার একটি কথাও বিশ্বাস করবে না। যদি বিশ্বাস করেও ফেলে, তার পরও তাদের কিছু করার থাকবে না। এ ধরনের রাজনৈতিক দল যখন তৈরি করা হয়, তখন অনেক লোভ দেখিয়ে দলে টানা হয়। কিন্তু দলে যোগ দিয়ে যদি মোহভঙ্গও হয়, তবু তারা আর দল থেকে বের হতে পারে না। অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো এক অন্যকে আঁকড়ে ধরে টিকে থাকতে হয়।

যারা এখনো শিবিরে যোগ দেয়নি, তারা হয়তো এই লেখাটি পড়ে একটুখানি ভাববে। যখন তাকে এই দলে যোগ দেওয়ার কথা বলবে, হয়তো তারা একটিবার চিন্তা করবে, আমাদের এই ভালোবাসার দেশটিকে যারা টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছিল, আমি কেন সেই দলে যোগ দেব? দেশকে যখন ভালোবাসার কথা, তখন কেন আমি দেশের সঙ্গে বেইমানি করব?
মাতৃভূমিকে ভালোবাসার তীব্র আনন্দ যারা উপভোগ করেনি, যারা ভবিষ্যতেও কোনো দিন অনুভব করতে পারবে না, আমি সেসব হতভাগ্য মানুষের জন্য গভীর করুণা অনুভব করি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
ডিসেম্বর ০৭, ২০১২

দশ হাজার কোটি নিউরন

সপ্তাহ দুয়েক আগে একজন লিখে জানিয়েছে চারপাশের সবকিছু দেখে তার খুব মন খারাপ– আমি কি এমন কিছু লিখতে পারি যেটা পড়ে তার মন ভালো হয়ে যাবে। চিঠিটি পড়ে আমি একটু দুভার্বনায় পড়ে গেলাম; কারণ ঠিক তখন এই দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমি খুব দুঃখের একটা ‘গল্প’ লিখেছি। সেটা লিখেছি রেগে-মেগে, লেখা শেষ করে পড়ে আমার নিজেরই মন খারাপ হয়ে গেছে। আমার নিজের জন্যেই এমন কিছু একটা লেখা দরকার যেটা আমাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করবে।

সেটা করার জন্যে আমি সব সময়েই এই দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে ফিরে যাই। আমাদের দেশের লেখকরা ছেলেমেয়েদের জন্যে লিখতে চান না, আমি লিখি। আমার খুব সৌভাগ্য এই দেশের ছেলেমেয়েরা আমার ছোটখাট লেখালেখি অনেক বড়সড় ভালোবাসা দিয়ে গ্রহণ করেছে। আমার জন্যে এই ভালোবাসা প্রকাশ করতে তারা কার্পণ্য করে না।

যখন বিজ্ঞান কংগ্রেস, গণিত বা পদার্থ বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে যাই, আমাকে যখন স্টেজে তুলে দেওয়া হয়, সেই স্টেজে বসে আমি যখন সামনে বসে থাকা শিশু-কিশোরদের বড় বড় উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, মুহূর্তে আমার মনের ভেতরকার সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যায়। আমাদের কী সৌভাগ্য আমাদের দেশে এত চমৎকার একটা নূতন প্রজন্ম বড় হচ্ছে।

আমাদের দেশে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি– কিংবা কে জানে হয়তো আরও বেশি হতে পারে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে ছেলে-বুড়ো সব মিলিয়েও তিন কোটি দূরে থাকুক, এক কোটি মানুষও নেই। আমাদের এই তিন কোটি ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে, তারা যদি শুধু ঠিক করে লেখাপড়া করে তাহলে এই দেশে কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ঘটে যাবে কেউ কল্পনা করতে পারবে?

এই সহস্রাব্দের শুরুতে পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা সম্পদের একটা নূতন সংজ্ঞা তৈরি করেছেন, তারা বলেছেন জ্ঞান হল সম্পদ। তার অর্থ একটা বাচ্চা যখন ঘরের মাঝে হ্যারিকেনের আলো জ্বালিয়ে একটা অংক করে তখন আমার দেশের সম্পদ একটুখানি বেড়ে যায়। যখন একটি কিশোর বসে বসে এক পাতা ইংরেজি অনুবাদ করে, আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়। যখন একজন কিশোরী রাতের আঁধারে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদটা কেমন করে বড় হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে তখন আমার দেশের সম্পদ বেড়ে যায়।

মাটির নিচে খনিজ সম্পদ তৈরি হতে কোটি কোাটি বছর লাগে, কলকারখানায় শিল্প-সম্পদ তৈরি করতে যুগ যুগ লেগে যায়। কিন্তু লেখাপড়া করে জ্ঞানের সম্পদ তৈরি হয় মূহূর্তে মূহূর্তে।

আমাদের দেশের লেখাপড়া নিয়ে আমার অভিযোগের শেষ নেই সেটা এখন সবাই জানে, কিন্তু আজকে আমি অভিযোগ করব না। আজকে আমি শুধু সবাইকে মনে করিয়ে দেব এই দেশের তিন কোটি বাচ্চা প্রতি বছর নূতন বই হাতে নিয়ে লেখাপড়া করতে শুরু করে– শুধুমাত্র এই বিষয়টি চিন্তা করেই আমাদের সবার মনের সব দুশ্চিন্তা, সব দুর্ভাবনা দূর হয়ে যাবার কথা।

লেখাপড়া বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে কোনো একটি শিশু বই সামনে নিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে পড়ছে। শুধু তাই নয়, ‘পড়া মুখস্ত’ করা বলে একটা কথা মোটামুটি সবাই গ্রহণ করেই নিয়েছে। কিন্তু মুখস্ত করাই যে লেখাপড়া নয়, বোঝা, ব্যবহার করা কিংবা নিজের মত বিশ্লেষণ করাও যে লেখাপড়া করার একটা অংশ, সেটা মাত্র অল্প কয়দিন হল আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। যে জিনিসটা এখনও আমরা কাউকে বোঝাতে শুরু করিনি কিংবা বোঝাতে পারিনি সেটা হচ্ছে, শুধুমাত্র জিপিএ ফাইভ পাওয়া মোটেই লেখাপড়া নয়।

আমাদের অনেক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে, আমরা শুধু এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মাথা ঘামাই, সেটা হচ্ছে ক্লাসরুমের লেখাপড়া করে পরীক্ষার হলে সেটা উগড়ে দেওয়ার বুদ্ধিমত্তা! কিন্তু আমরা সবাই জানি, লেখাপড়ার বাইরে যে বুদ্ধিমত্তাগুলো আছে সেগুলো কিন্তু লেখাপড়ার মতোই, এমনকি অনেক সময় লেখাপড়ার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যারা শিক্ষকতা করি তারা সবাই দেখেছি আমাদের ক্লাসে যে ছেলেটি বা মেয়েটি সবচেয়ে তুখোড়, সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে কিন্তু অনেক সময়েই পরীক্ষায় সে রকম ভালো করতে পারে না। দোষটি মোটেও তার নয়, দোষ আমাদের, আমরা ঠিক করে পরীক্ষা নিতে পারি না। সারা পৃথিবীতেই মনে হয় এই সমস্যাটা আছে, একজনের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করার পদ্ধতি মনে হয় এখনও ঠিক করে আবিষ্কার করা যায়নি।

যখন আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বাইরের বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে চায় তখন আমাদের তাদের সম্পর্কে লিখতে হয়। আমি দেখেছি সেই ফর্মগুলোতে প্রায় সব সময়েই আমাদের একটা প্রশ্ন করা হয়, “এই ছেলেটির পরীক্ষার ফলাফল কি তার সঠিক সেবা যাচাই করতে পেরেছে?” আমাকে প্রায় সময়েই লিখতে হয়, ‘‘না, পারেনি। পরীক্ষার ফলাফল দেখলে মনে হবে সে বুঝি খুবই সাধারণ– কিন্তু বিশ্বাস কর, এই ছেলেছি বা মেয়েটি আসলে কিন্তু অসাধারণ!’’

বুদ্ধিমত্তা অনেক পরের ব্যাপার, আমরা কিন্তু জিপিএ ফাইভ নামের একটা কানাগলি থেকেই বের হতে পারিনি! আমরা ধরেই নিয়েছি, যে কোনো মূল্যে আমাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ ফাইভ পেতে হবে– দরকার হলে প্রশ্ন ফাঁস করেও। কিন্তু যে ছেলেটি বা মেয়েটি প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার পরও সেই প্রশ্ন না দেখে পরীক্ষা দিয়ে ভালো করেছে সে কি অন্য সবার থেকে আলাদা নয়? তার বুদ্ধিমত্তাটা কি আমরা আলাদাভাবে ধরতে পেরেছি? পারিনি! কিংবা যে ছেলেটি বা মেয়েটি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেয়েও দেখেনি– সে জন্যে পরীক্ষা তত ভালো হয়নি– তার ভেতরে যে এক ধরনের অন্যরকম শক্তি রয়েছে আমরা কি কখনও সেটা যাচাই করে দেখেছি? সেটাও দেখিনি।

প্রতন্ত গ্রামের দরিদ্র একটা পরিবারের একটা মেয়ে যখন সারাদিন তার ছোট ভাইকে কোলে করে মানুষ করে, তার ফাঁকে ফাঁকে লেখাপড়া করে পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করেছে, আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব মেয়েটির বুদ্ধিমত্তা কম? শহরের স্বচ্ছল পরিবারের একটি মেয়ে যে গাড়ি করে স্কুলে যায়, ফেসবুক ইন্টারনেট করে সময় কাটায়, সুন্দর করে ইংরেজি বলে, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে– আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব তার বুদ্ধিমত্তা গ্রামের মেয়েটির থেকে বেশি?

আসলে সেটি পারব না। কাজেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে, শুধুমাত্র পরীক্ষার রেজাল্ট কিংবা জিপিএ ফাইভ দেখে একজন ছেলে বা মেয়ের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করাটা নেহায়েতই বোকামি। আমাদের চোখ কান খোলা রেখে দেখতে হবে একটা শিশুর মাঝে আর কোন কোন দিকে তার বিচিত্র বুদ্ধিমত্তা আছে। আমাদের নিজেদের ভেতর যদি বিন্দুমাত্র বুদ্ধিমত্তা থাকে তাহলে আমরা কখনও-ই শুধুমাত্র পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করে ফেলার চেষ্টা করব না!

আমার সেই সব ছেলেমেয়েদের জন্যে খুব মায়া হয় যাদের বাবা মায়েরা শুধুমাত্র পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নিজেদের সন্তানদের ঠেলে দিয়ে তাদের শৈশবের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছেন। তাদের থেকে বড় দুর্ভাগা মনে হয় আর কেউ নেই!

২.

মাও সে তুংয়ের একটা খুব বিখ্যাত উক্তি আছে। উক্তিটি হচ্ছে এ রকম, প্রত্যেকটা মানুষ একটা মুখ নিয়ে জন্মায় কিন্তু সেই মুখে অন্ন জোগানোর জন্যে তার রয়েছে দুই দুইটি হাত! যার অর্থ, এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই অসহায় নয়– খেটে খাওয়ার জন্যে সবারই দুটি হাত রয়েছে, কাস্তে কিংবা কুঠার ধরে সেই হাত তার মুখে অন্ন জোগাবে।

আমি মাও সে তুং নই, তাই আমার উক্তিকে কেউ গুরুত্ব দেবে না, কিন্তু আমাকে সুযোগ দিলে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটাকে অন্য রকম করে বলতাম। আমার উক্তিটি হত এ রকম– প্রত্যেকটা মানুষ একটি মুখ আর মাত্র দুটি হাত নিয়ে জন্মায়। কিন্তু ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ সব মানুষের মাথার মাঝে রয়েছে দশ হাজার কোটি নিউরন!

যতই দিন যাচ্ছে আমি আমাদের মস্তিকের দশ হাজার কোটি নিউরনকে তত বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করেছি। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি তোমার শিক্ষকতা জীবনের কোন অভিজ্ঞতাটুকুকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে কর– আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলব, সেটি হচ্ছে একজন মানুষের মাথার ভেতরকার সোয়া কেজি ওজনের মস্তিক নামের রহস্যময় জিনিসটির অসাধারণ ক্ষমতা!

প্রায় সময়েই আমি অনেক ছেলেমেয়েকে হতাশ হয়ে বলতে শুনি, “আমি আসলে গাধা, আমার মেধা বলতে কিছু নেই”। তাদের অনেকের কথার সত্যতা আছে, পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে এবং পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পেতে পেতে তাদের অনেকই আসলে খানিকটা ‘গাধা’ হয়ে গেছে। কিন্তু সত্য কথাটি হচ্ছে, কাউকেই কিন্তু সেটা মেনে নিতে হবে না। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি যে, কেউ যদি সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করে তাহলে কত দ্রুত সে নূতন মানুষ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিপরীক্ষা নামে একটা ভয়ংকর অমানবিক প্রক্রিয়া ঘটানো হয়, সেই প্রক্রিয়া দিয়ে আমরা ‘মেধাবী’ সিল দিয়ে কিছু ছেলেমেয়েকে ভর্তি করি। তার মাঝেও আবার জনপ্রিয় আর অজনপ্রিয় বিভাগ আছে। যারা জনপ্রিয় বিভাগে ঢুকতে পারে সবাই তাদের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায়। যারা ঢুকতে পারে না তারা গভীর দুঃখে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা মায়ের গালাগাল শুনে।

অথচ মজার বিষয় হল, আমি খুব পরিষ্কার এবং স্পষ্টভাবে জানি, এই পুরো বিভাজনটি আসলে অর্থহীন। বিজ্ঞানের জন্যে গভীর ভালোবাসা, কিন্তু বাবা মা জোর করে ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার বানানোর জন্যে তাদের সন্তানদের একটা কষ্টের জীবনে ঠেলে দেন। আবার উল্টোটাও সত্যি, যে ছেলেটি অসাধারণ একজন ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতে পারত, ভর্তিপরীক্ষায় টিকতে না পেরে সে হয়তো জোর করে অপছন্দের একটা বিভাগে ভর্তি হয়ে অপছন্দের কিছু বিষয় পড়ে সময়টা অকারণে নষ্ট করছে।

এই মুহূর্তে কম্পিউটার সায়েন্স খুব জনপ্রিয় একটা বিষয়। চাকরি পাবার জন্যে এটা সবসময়েই একটা জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিভাগ থেকে পাশ করে ছেলেমেয়েরা অনেকেই নিজেদের সফটওয়ার ফার্ম খুলেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এই সফটওয়ার ফার্মে কিন্তু শুধু কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছেলেমেয়েরা নয়, অন্যান্য অনেক বিভাগের ছেলেমেয়েরাও আছে সমানভাবে। তারা কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের পাশ করা ছেলেমেয়ে থেকে কোনো অংশে কম নয়– তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। যার অর্থ পছন্দের বিভাগে ভর্তি হতে না পারলেই একজনের জীবন অর্থহীন হয়ে গেছে মনে করার কোনো কারণ নেই।

ছেলেমেয়েদের আগ্রহ এবং দেশ কিংবা পৃথিবীর প্রয়োজনের কথা মনে রেখে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা অন্যান্য বিভাগের ছেলেমেয়েদের জন্যে দ্বিতীয় মেজর (Second Major) হিসেবে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার সুযোগ করে দিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কী, সব বিভাগেই দ্বিতীয় মেজর নেওয়ার সুযোগ আছে। আমার ধারণা, সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে পড়ালেখা কেমন করে হয় এটি তার একটা চমৎকার উদাহরণ। ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের সব পড়ার পাশাপাশি শুধুমাত্র আগ্রহের জন্যে বাড়তি পড়াশোনা করছে– বিষয়টি দেখলেই এক ধরনের আনন্দ হয়।

একটা সময় ছিল যখন আমি মেধাবী শব্দটা ব্যবহার করতাম। আমার চারপাশে অনেক ‘মেধাবী’ হয়ে জন্মায়, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা সত্যিই বুঝি কিছু মানুষকে বেশি মেধা দিয়ে পাঠান। সেই ছাত্রজীবনেই আবিষ্কার করেছিলাম যে, আসলে বাড়তি মেধা বলে কিছু নেই, চারপাশের অনেক মেধাবী মানুষই জীবনযুদ্ধে ঝরে পড়েছে। আবার যাদেরকে নেহায়েতই সাধারণ একজন বলে ভেবেছিলাম, অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি, তারা উৎসাহ, আগ্রহ আর পরিশ্রম করে ‘মেধাবী’ দের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে।

সেগুলো দেখে দেখে আজকাল আমার নিজের ডিকশনারি থেকে ‘মেধাবী’ শব্দটা তুলে দিয়ে সেখানে ‘উৎসাহী’ শব্দটা ঢুকিয়েছি। আমি দেখেছি, উৎসাহ থাকলে সবই সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আমার পরিচিত জগতের সব মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। এক ভাগ হচ্ছে যারা উৎসাহী; অন্য ভাগ হচ্ছে যাদের কিছুতেই উৎসাহ নেই, যাদেরকে ঠেলাঠেলি করে নিয়ে যেতে হয়। উৎসাহীরা পৃথিবীটাকে চালায়, বাকিরা তার সমালোচনা করে!

আমার চারপাশে অসংখ্য উদাহরণ আছে যেখানে একজন ছেলে বা মেয়ে শুধুমাত্র নিজের উৎসাহটুকু দিয়ে এগিয়ে গেছে। এ রকম মানুষের সাথে কাজ করাতেও আনন্দ। উৎসাহ বিষয়টা ছোঁয়াচেও বটে– একজনের থেকে আরেকজনের মাঝেও সেটা সঞ্চারিত হয়ে যায়।

আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি দেখেছি। তাদের সুযোগ সুবিধে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি– আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কিছুই দিতে পারি না, মাঝে মাঝে শুধু একটুখানি উৎসাহ দিই। সেই উৎসাহ ভরসা করেই তারা কত কী করে ফেলে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।

তাই আজকাল সুযোগ পেলেই আমি ছেলেমেয়েদেরকে বলি, তোমরা যেটুকু প্রতিভা বা মেধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছ সেটুকুতে সন্তুষ্ট থাকার কোনো কারণ নেই। তুমি ইচ্ছে করলেই সেটাকে শতগুণে বাড়িয়ে ফেলতে পারবে। কাজেই আমি মনে করি পৃথিবীতে আসলে প্রতিভাবান বা মেধাবী বলে আলাদা কিছু নেই, যাদের ভেতরে উৎসাহ বেশি আর যারা পরিশ্রম করতে রাজি আছে তারাই হচ্ছে প্রতিভাবান, তারাই হচ্ছে মেধাবী।

সে জন্যে আমি মাও সে তুংয়ের উক্তিটিতে ‘হাত’ থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিই মস্তিস্কের দশ হাজার কোটি নিউরনকে। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই, কিন্তু মস্তিস্কের দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে অচিন্ত্যনীয় ম্যাজিক করে ফেলা সম্ভব। দুটি হাত দিয়ে খুব বেশি হলে এক দুইজন মানুষের মুখে অন্ন জোগানো সম্ভব। দশ হাজার কোটি নিউরন দিয়ে লক্ষ মানুষের মুখেও অন্ন জোগানো যেতে পারে!

৪.

আমি জানি আমাদের সমস্যার শেষ নেই। আমি জানি সব সমস্যার সমাধানও চট করে হয়ে যাবে না– আমাদের দীর্ঘদিন এই সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু সেটি নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই, কারণ বাংলাদেশ এখন ধীরে ধীরে নিজের পায়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে।

আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষ তাদের শক্ত দুটি হাত দিয়ে এই দেশকে ধরে রেখেছে। এই দেশের নূতন প্রজন্মকে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে দশ হাজার কোটি নিউরন নিয়ে!

জিপিএ ফাইভের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিং, গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্য– কোনো কিছুই এই দশ হাজার কোটি নিউরনকে পরাজিত করতে পারবে না।

দুঃখ, লজ্জা এবং ক্ষোভ (অক্টোবর ০৯, ২০১৩)

১.

কয়দিন থেকে মনটা খুব খারাপ – শুধু আমার নয়, আমার ধারনা পুরো দেশের প্রায় সব মানুষেরই মন খারাপ। একজন নয় দুইজন নয় – প্রায় আট দশ হাজার মানুষ এসে শতবর্ষের পুরানো ঐতিহ্যবাহী বারোটি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দিয়ে গেল? যার অর্থ এই দেশে অন্তত আট দশ হাজার মানুষ আছে যারা বিশ্বাস করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের উপাসনালয় পুড়িয়ে দেয়া যায়। যারা পুড়িয়েছে তারা নাকি বেশিরভাগই তরুন – যে বয়সে বুকের ভেতর স্বপ্ন জন্ম নেয়, মানুষের জন্যে ভালোবাসা জন্ম নেয় সেই বয়সে তারা এসে এরকম ভয়ংকর একটি ঘটনা ঘটিয়ে যেতে পারল? শুধু কী উপাসনালয় – তারা বেছে বেছে শুধু বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের বাসাও পুড়িয়ে দিয়ে গেছে, সেই বাসায় যারা ছিল শিশু কিশোর তরুণ তরুণী – তাদের বুকের ভেতর যে আতংক আর হতাশার জন্ম দিয়ে গেছে এই দেশ কী কখনো তাদের সেই আতংক আর হতাশা মুছে দিতে পারবে?

ঘটনাটি ঘটে যাবার পর বহুদিন আমি খবরের কাগজ পড়তে পারিনি-সেগুলো জমিয়ে রেখেছি। আমি না পড়লেই তো সেই ভয়ংকর তথ্যগুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে না, তাই সাহস সঞ্চয় করে একসময় একটু একটু করে পড়েছি। পড়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাচ্ছি, কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছি না।

ঘটনাটা শুরু হয়েছে ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার একটি ছবি ‘ট্যাগ’ করা থেকে। পৃথিবীতে ১০০ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে, আমি সেই ১০০ কোটি মানুষের একজন নই (শুনেছি আমার নামে নাকি ফেসবুকে একাউন্ট আছে- আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই) তাই ছবি ‘ট্যাগ’ করা মানে কী আমি জানতাম না। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি আমাকে দেখানোর জন্য কেউ আমার ফেসবুকে একটা ছবি পাঠাতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিক নিয়মে আমি তো দেখতেই পাব আমার ‘ফেসবুক বন্ধু’রাও দেখতে পাবে (মনে রাখতে হবে ‘বন্ধু’ এবং ‘ফেসবুক বন্ধু’ অনেকটা গণতন্ত্র এবং আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মতো), যারা ফেসবুক করে তাদের সবারই চেষ্টা থাকে ‘ফেসবুক বন্ধু’দের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে, তাই তারা সবাই যে সত্যিকার বন্ধু এবং কারো মনে কোনো দুরভিসন্ধি নেই সেটা গ্যারান্টি করা খুব কঠিন। কাজেই কোনো একজন ‘ফেসবুক বন্ধু’ যদি আমার কাছে খুব একটা আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে বসে থাকে তাহলে আমার অন্য সব ‘ফেসবুক বন্ধু’রাও অবাক বিস্ময়ে দেখবে আমি একটা আপত্তিকর ছবি আমার ফেসবুক একাউন্টের মাধ্যমে প্রচার করে বেড়াচ্ছি – যদিও সেখানে আসলে আমার বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই। রামুতে ঠিক সেরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল, একজন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী তরুনের ফেসবুক একাউন্টে কোনো একজন পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার একটা ছবি ট্যাগ করিয়ে সেই ছবিটি সেটি অন্যদের দেখার ব্যবস্থা করেছিল। তরুনটির ‘ফেসবুক বন্ধু’ সেই ছবিটি দেখে শুধু নিজেরাই ক্ষিপ্ত হল না, সেটি অন্যদের দেখিয়ে তাদেরকেও ক্ষিপ্ত হওয়ার সুযোগ করে দিল।

এর পরের ঘটনাগুলোর মাঝে অনেক রহস্য। ক্ষিপ্ত মানুষজন শুধু বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সেই তরুনের উপর ক্ষিপ্ত হল না তারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী সকল মানুষের উপর ক্ষিপ্ত হল। এরকম সময় সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে, উত্তেজিত মানুষদের শান্ত করে পুরো অবস্থাটাকে নিয়ন্ত্রন করতে হয়। কিন্তু আমরা খবরের কাগজে অবাক হয়ে দেখলাম বিএনপি দলীয় সংসদ বিক্ষোভকারীদের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করলেন। আওয়ামী লীগ ধর্ম নিরপেক্ষ দল, তাদের সরকার তাই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তাদের, তারাও সাচ্চা মুসলমান হওয়ার এই সুযোগটা ছাড়লেন না, তাদের অঙ্গ সংগঠন মিছিল বের করে স্লোগান দিল, ‘বড়ুয়াদের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’, তার চাইওতে ভয়ংকর তথ্য পুলিশদের নিয়ে তারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের রক্ষা করার চেষ্টা দূরে থাকুক বরং উত্তেজিত মানুষদের উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

প্রশাসন, সরকারী দল, বিরোধী দল সবাই যদি বোদ্ধ ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে যায় তাহলে জামাতে ইসলামী, ধর্মান্ধ, রোহিঙ্গা জঙ্গী তারা এই সুযোগটি কেন ছেড়ে দিবে? বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, মোটর সাইকেল হাজার হাজার লোক হাজির করে ফেলল, রীতিমত উৎসব করে তারা একটি নয়, দুটি নয় বারোটি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দিল। ২০০১ সালে তালেবানরা যখন আফগানিস্থানের বামিয়ানে বৌদ্ধ মূর্তিগূলো ধ্বংস করছিল সেই দৃশ্যটি আমার ভেতর যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল রামুর ঘটনা তার থেকে অনেক বেশী ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। অনেক কষ্টে পাওয়া আমাদের এই দেশটিকে নিয়ে আমাদের কতো ভালোবাসা, কতো স্বপ্ন, মাত্র কয়েক ঘন্টার মাঝে সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের দেশের মুখে যে কালিমা লেপে দেয়া হলো সেটি কী আমরা এতো সহজে মুছে ফেলতে পারব?

ঘটনা সেখানেই শেষ নয়। আমরা ভেবেছিলাম এরকম ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে যাবার পর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সবাই সতর্ক হয়ে যাবে কিন্তু হতবাক হয়ে দেখলাম এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে লাগল, পরের দিন উখিয়া আর পটিয়াতে একই ঘটনা ঘটতে লাগল। শুধু বৌদ্ধ বিহার নয় হিন্দু মন্দির পুড়িয়ে দেয়া শুরু হয়ে গেল।
রাজনৈতিক দলগুলো এই উন্মত্ততা থামানোর কোনো চেষ্টা করছে বলে মনে হল না কারন আমরা অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম তারা একে অপরকে গালাগাল করার কাজে লেগে গেল। এর চাইতে বড় হৃদয়হীন ব্যাপার আর কী হতে পারে?

২.

একটা দেশ কেমন চলছে সেটা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সেই দেশের সংখ্যা লঘুদের দেশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা। তারা যদি মনে করে তারা নিরাপদে আছে, দেশের অন্য দশজন মানুষের মতো তারাও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে তাহলে বুঝতে হবে দেশটা ভালো চলছে। যদি দেখা যায় তাদের ভেতর এক ধরনের হতাশা, অনিশ্চয়তা আর আতংক তাহলে প্রতি মাসে একটা করে পদ্মা সেতু তৈরী করলেও বুঝতে হবে দেশটি ভালো নেই।
আমি নিজে কোনো জরিপ করিনি কিন্তু তারপরেও আমি জানি এই দেশের সংখ্যা লঘুরা ভালো নেই। জাতিসংঘে চাকরী করে সেনাবাহিনীর লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করতে যেন কোনো অসুবিধে না হয় সেটা নিশ্চিত করার জন্য সরকার যেদিন ঘোষনা দিল এই দেশে আদিবাসী বলে কেউ নেই সেদিন শুধু আদিবাসীরা নয়, সংখ্যালঘুরাও হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। যে রাজনৈতিক নেতারা আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন এখন তারাই যখন চোখের পাতি না ফেলে অম্লান বদনে বলেন এই দেশে কোনো আদিবাসী নেই তখন আমি হতবাক হয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। (যারা এখনো জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেই, আদিবাসী মানে নয় যারা আদি থেকে বাস করছে, ইংরেজী Indigenous শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করা হয় যার অর্থ মূল ধারা থেকে আলাদাভাবে থেকে যারা তাদের আদি ঐতিহ্যকে ধরে বেঁচে থাকে।)

এই দেশে সংখ্যালঘুরা যে ভালো নেই তার খুব বড় একটা প্রমান কয়দিন আগে পত্রিকায় বের হয়েছিল, সেখানে লেখা হয়েছিল এই দেশে হিন্দুদের সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমরা সবাই সেই রিপোর্টটি দেখেও না দেখার ভান করেছি, পত্রপত্রিকার কোথাও সেটা নিয়ে কারো আলোচনা বা মন্তব্য চোখে পড়েনি। মনে হয় সবাই ধরে নিয়েছে এরকমই তো হবার কথা। এই দেশে আহমদিয়াদের উপর নিয়মিত হামলা হয়, গত নির্বাচনে চার দলীয় জোট বিজয়ী হয়ে হিন্দুদের উপর একটা পৈচাশিক নিপীড়ন চালিয়েছিল, এবার প্রথমবারের মত বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের উপর হামলা হল, তাহলে কী তাদেরকেও এই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার কূট কৌশল শুরু হয়েছে? মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর যে নিপীড়ন চলছে, এই দেশে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের উপর অত্যাচার করে তার একটা বদলা নেব, সেটাই কি উদ্দেশ্য? (একটা জিনিষ কী কেউ লক্ষ করেছে, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মহান নেতা সারা পৃথিবীতে সম্মানিত, নোবেল বিজয়ী আংশান সুচি কিন্তু তাদের দেশে রোহিঙ্গাদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে সেই বিষয়ে কখনো মুখ খুলেন না?)

৩.

আমি আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে কয়টি সত্য আবিষ্কার করেছি তার একটি মাত্র দুটি শব্দ ব্যবহার করে লিখে ফেলা যায়, সেটি হছে ‘বৈচিত্রেই সৌন্দর্য’- আমি এটা প্রথম স্পষ্টভাবে টের পেয়েছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। আমি বেল কমিউনিকেশন্স রিসার্চের যে গ্রুপে কাজ করতাম সেখানে প্রায় সব দেশেরই এক দুইজন করে লোক ছিল। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা দেশের মানুষ সবাই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে মহানন্দে পাশাপাশি বাস করছে। (শুধু আমার মনে হয় কোনো সমস্যা আছে, তা নাহলে দেশের আকাশ কালো করে আসা মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি আর ব্যাঙের ডাক শোনার জন্যে কেন এতো মন কেমন কেমন করত কে জানে!) যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় বড় সমস্যা আছে (যেমন সেই দেশের কালো পুরুষ মানুষের বেশীর ভাগ জেলে থাকে) তারপরেও বলতে হবে এই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন (diversity) ধরনের মানুষের বেঁচে থাকা। তারা নিজের দেশের ঐতিহ্য বা কালচারকে ছুড়ে ফেলেনি, সেগুলোকে ধরে রেখেই সবাই মিলে পাশাপাশি বাস করছে। যারা আমার কথা বিশ্বাস করতে চায় না তদেরকে বলব সেখানকার চায়না টাউন ঘুরে আসতে। আমার খুব মজা লাগে যখন দেখি সেখানে আজকাল বাংলা টাউনও তৈরী হতে শুরু করেছে। আমার বুকটা ভেঙ্গে যায় যখন দেখি এই দেশে আমরা আমাদের শিশুদের পুরোপুরি উল্টো জিনিষ শিখিয়ে বড় করি। তাদেরকে আমরা শেখাই, ‘আমার থেকে ভিন্ন মানে আমার থেকে খারাপ।’ অথচ সত্যি কথাটা হচ্ছে আমার থেকে ভিন্ন কাউকে পাওয়ার অর্থ হচ্ছে পৃথিবীটাকে আরেকটু সুন্দর করে দেখার একটা সুযোগ।

আমার সব সময় মনে হয় আমাদের দেশে মানুষের মাঝে বৈচিত্র (diversity) বলতে গেলে নেই। আমাদের খুব দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ভিন্ন কালচার, ভিন্ন ভিন্ন গায়ের রঙ, ভিন্ন ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন ভিন্ন ভাষার মানুষ খুব কম। তাই যে কয়জন আছে তাদেরকে আমাদের বুক আগলে রাখার কথা, আমাদের লক্ষ্য রাখার কথা তারা যেন তাদের ভাষার চর্চা করতে পারে, তাদের সংস্কৃতিটাকে ধরে রাখতে পারে, তাদের ধর্ম নির্ভয়ে পালন করতে পারে। আগের প্রজন্মের অনেকেই বড় ধরণের ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়েছে। আমাদের বাচ্চাদের পাঠ্যবইয়ে কিছুদিন আগেও আদিবাসী বা সংখ্যালঘু এমন কী মেয়েদের নিয়ে কী অসম্মানজনক কথা লিখে রাখা হতো সেটা কী কেউ লক্ষ্য করেছে? আস্তে আস্তে সেগুলো পাল্টানো হচ্ছে। আমার খুব বিশ্বাস করার ইছে যে আমাদের নূতন প্রজন্ম বড় হবে অনেক উদার মনের, আমরা পৃথিবীর যে সৌন্দর্য দেখতে পারিনি। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মাঝে তারা সেই সৌন্দর্য দেখতে পাবে। রামু, উখিয়া, পটিয়ায় যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে সেটা যেন এই দেশের মানুষদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে। নূতন প্রজন্মকে একেবারে শৈশব থেকে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন কালচার, ভিন্ন ঐতিহ্যকে সম্মান করা শেখাতে হবে।

এই দেশে যারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী তারা নিশ্চয়ই তাদের মনের ভিতর একটি গভীর বেদনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আমি তাদেরকে বলতে চাই তারা যেন হতাশাগ্রস্থ না হন, রামুর সেই ভয়ংকর রাতেও অল্প কিছু মানুষ জীবনের ঝুকি নিয়ে এই উন্মত্ত ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিল, এই দেশে এ রকম অসংখ্য মানুষ আছে, তারাই হচ্ছে এই দেশের শক্তি। এই দেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক নয়, আমি নিশ্চিত ছাই হয়ে যাওয়া ফিনিক্স পাখী যেরকম আবার নূতন জন্ম নিয়ে পাখা মেলে দাঁড়ায়, এই দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাও সেভাবে পাখা মেলে দাড়াবে।

মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান যেভাবে পাশাপাশি যুদ্ধ করে বুকের রক্ত দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছে, ঠিক সেভাবে আবার সবাই মিলে পাশাপাশি দাড়িয়ে এই দেশ থেকে চিরদিনের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষ বৃক্ষকে টেনে উপড়ে তুলে ফেলতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ নামের দেশটিই তো অর্থহীন হয়ে যাবে।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-10-09

প্রতিবন্ধী নই, মানুষ

১.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক কাজ করি সে কারণে তাদের অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে এবং ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। একবার কোন এক কারণে আমি তাদের অফিসে গিয়েছি, সেখানে যাঁরা ছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই শুধু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী নন, বেশিরভাগই পুরোপুরি দৃষ্টিহীন। সে জন্য তাঁরা যে কোন কাজকর্ম করছেন না তা নয়, সবাই কিছু না কিছু করছেন। কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ কারেন্ট চলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকার হলে আমাদের কাজকর্ম থেমে যায়, কারেন্ট এলে আবার কাজ শুরু হয়। আমি নিজের অজান্তেই সে রকম কিছু একটা ভেবেছিলাম কিন্তু হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম সেই প্রতিষ্ঠানের কোন কাজ বন্ধ হলো না, সবাই নিজের মতো কাজ করতে লাগলেন। বিষয়টা আমার আগেই অনুমান করার কথা ছিল কিন্তু কখনও মাথায় আসেনি। আমরা যারা চোখ ব্যবহার করে কাজকর্ম করি তারা অন্ধকারে কাজ করতে পারি না। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পারে, আলো না থাকলে আমরা খানিকক্ষণের জন্য প্রতিবন্ধী হয়ে যাই, তারা হয় না।
আমার অবিশ্য তখন আরও কিছু জানা বাকি ছিল। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার জন্য ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। কাগজে যখন ব্রেইলে কিছু লেখা হয় তখন সেটা খানিকটা উঁচু হয়ে যায় এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা হাত দিয়ে স্পর্শ করে সেটা পড়তে পারেন। এই ব্রেইল প্রিন্টার খুব দামী একটা প্রিন্টার তাই অনেকদিন থেকেই আমি সাধারণ ডট মেট্রিক্স প্রিন্টার দিয়ে ব্রেইলে লেখার একটা পদ্ধতি বের করার চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেই প্রিন্টার তৈরি হয়েছে এবং সেই প্রিন্টারে লেখা পড়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা খুব খুশি। এ রকম সময়ে তাদের কমবয়সী একজন ছেলে বলল, ‘স্যার, আমাদের এখানে সত্যিকারের ব্রেইল প্রিন্টার আছে, আপনাকে দেখাই।’ আমি আগে ব্রেইল প্রিন্টার দেখিনি তাই তার সঙ্গে পাশের ঘরে গেলাম। সেখানে সে কম্পিউটার টেপাটেপি করে ব্রেইল প্রিন্টারে কিছু একটা প্রিন্ট করতে দিল। সারা পৃথিবীর সকল প্রিন্টারে যা হয় এই মহামূল্যমান প্রিন্টারেও তাই হলোÑ হঠাৎ করে ভেতরে কাগজটা আটকে গেল। আমি ধরেই নিলাম ব্রেইল প্রিন্টার দেখানোটা আজকের মতো এখানেই শেষ।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ব্রেইল প্রিন্টার দেখানো এখানেই শেষ হলো না। কারণ আমি দেখলাম পুরোপুরি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলেটা একটা স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে প্রিন্টারটা খুলতে শুরু করল। কিছুক্ষণেই সে প্রিন্টারটা খুলে ফেলল এবং ভেতরের যন্ত্রপাতি আলাদা হয়ে গেল এবং ভেতরে কোন এক জায়গায় আটকে থাকা কাগজটা টেনে বের করে ফেলল। তারপর যে দক্ষতায় সে প্রিন্টারটি খুলেছিল সেই একই দক্ষতায় পুরো প্রিন্টারটা জুড়ে ফেলল। (আমি যখন যন্ত্র খুলে সেটা আবার লাগানোর চেষ্টা করি তখন সব সময়েই কিছু স্ক্রু বাড়তি থেকে যায়, এবারে কিন্তু কোন বাড়তি স্ক্রু থাকল না এবং সব স্ক্রু ঠিক ঠিক জায়গায় লাগানো হয়ে গেল।) প্রিন্টার রেডি হবার পর সে আবার কম্পিউটার টেপাটিপি করে কাগজে ব্রেইল প্রিন্ট করে দেখাল। ব্রেইল প্রিন্টার দেখে আমি যতটুকু মুগ্ধ হয়েছিলাম তার থেকে এক শ’ গুণ বেশি মুগ্ধ হলাম এই ছেলেটিকে দেখে। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ নিশ্চয়ই কিছু কিছু কাজ কখনই করতে পারবে না আমার মনে সে রকম একটা ধারণা ছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম কিছু কিছু কাজ নিশ্চয়ই শুধুমাত্র যারা দেখতে পায় তারা করবে। আমার ভুল ভাঙল, কে কী কাজ করতে পারবে আর কী কাজ করতে পারবে না সেই সীমারেখাটি কেউ কোনদিন টানতে পারবে না। আমি যাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভেবে এসেছি আসলে নিজের চোখে দেখলাম দৃষ্টি না থাকাটা এখন আর তার জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নয়, আমরা যে কাজটা আমাদের দৃষ্টি ব্যবহার করে করি এই ছেলেটি সেই একই কাজ দৃষ্টি ব্যবহার না করেই করতে শিখেছে। সবাই হয়ত তার মতো পারবে না কিন্তু এই ছেলেটি যেহেতু পারে তার অর্থ চেষ্টা করলে পারা সম্ভব। ঠিকভাবে সুযোগ দেয়া হলে আরও অনেকে নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু করতে পারবে যেটা আমরা এখন চিন্তাও করতে পারি না। আমার মনে হলো হয়ত প্রতিবন্ধী শব্দটাই নতুন করে ব্যাখ্যা করা দরকার, তার কারণ একজন একদিকে প্রতিবন্ধী হলেও অন্যদিকে তারা সেটি পূরণ করে নিতে পারে, আমাদের শুধুমাত্র সেই সুযোগটি করে দিতে হবে।
এটি যে আমার দেখা একটিমাত্র ঘটনা তা কিন্তু মোটেও নয়। বেশ কয়েক বছর আগে একটি মেয়ে আমাকে কোন একটি কাজে ফোন করেছিল। ফোনে কথা বলে বুঝতে পারলাম সে শারীরিকভাবে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, তাকে চলাফেরার জন্য হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমাকে কেন ফোন করেছিল এতদিন পরে আর মনে নেই, আমি তাকে সম্ভবত ছোটখাটো সাহায্যও করেছিলাম। মেয়েটি ব্লগে লেখালেখি করে, প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার নিয়ে সে রীতিমতো একটা আন্দোলন শুরু করেছে। তার তৈরি করা একটা সংগঠনও আছে এবং সেখানে আরও অনেকে যোগ দিয়েছে। (মেয়েটি বা তার প্রতিষ্ঠানের নাম বললে অনেকেই হয়ত তাকে চিনে যাবে, ইচ্ছে করেই তার নামটা এখানে উচ্চারণ করছি না। আমি যে কারণে এই লেখাটি লিখছি সেখানে তার পরিচয়টি হবে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ, আমি সেটা চাই না। তার সত্যিকারের পরিচয় সে ঠিক আমাদের মতো একজন মানুষ, যখন সে রকমভাবে পরিচয় দিই তখন তার নাম লিখতে আমার কোন দ্বিধা হবে না।) যাই হোক, এক সময় মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হলো, তখন আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম তার যে এত লেখালেখি, এত বড় সংগঠন, এত চমৎকার একটি আন্দোলন, সমাজের জন্য তার চেয়ে এত বড় অবদান তার সবকিছু করেছে শুধুমাত্র একটি আঙ্গুল দিয়ে। সারা শরীরের শুধু এই আঙ্গুলটি দিয়ে কোন কিছু স্পর্শ করতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী এই মেয়েটিকে দেখে আমার নিজেকে পুরোপুরি অকিঞ্চিতকর একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে। শুধুমাত্র একটা সচল আঙ্গুল দিয়ে একজন মানুষ যদি এত কিছু করতে পারে তাহলে আমরা আমাদের সারা শরীর হাত পা মাথা ঘাড় বুক পেট সবকিছু নিয়ে কেন কিছু করতে পারি না? এই মেয়েটি যদি কোন অভিযোগ না করে তার সব কাজ করে যেতে পারে তাহলে আমরা কেন সারাক্ষণ জগতসংসার দেশ নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে অভিযোগ করি? আমাদের সমস্যাটা কেথায়?
বেশ কিছুদিন আগে আমি আরও একটি টেলিফোন পেয়েছিলাম, যে আমাকে ফোন করেছিল সেও ছিল একটি মেয়ে। গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলাম বয়স বেশি নয়, কিছু তার কথা বুঝতে আমার একটু সমস্যা হচ্ছিল। আমার কাছে মনে হচ্ছিল তার গলার স্বরটা কেমন যেন একটু যান্ত্রিক। মেয়েটি তখন আমাকে এসএমএস পাঠাল এবং সেখান থেকে জানতে পারলাম সে শুধু হুইলচেয়ারে নয়, সে পাকাপাকিভাবে একটা বিছানায় আবদ্ধ একজন মানুষ। কিছুদিন আগেও সে পুরোপুরি সুস্থ সবল ছটফটে দুরন্ত একটি মেয়ে ছিল। কোন একটি গণিত অলিম্পিয়াডে তার সঙ্গে নাকি আমার একবার দেখাও হয়েছিল। কোন একভাবে সে তার স্কুলের চারতলা থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে পড়ে কারো বেঁচে থাকার কথা নয়, সে প্রাণে বেঁচেগিয়েছিল কিন্তু সে চিরদিনের জন্য একটা বিছানায় আবদ্ধ হয়ে পড়ল, নিশ্বাসটুকুও নিতে হয় যন্ত্র দিয়ে। সেই মেয়েটিও তার একটি মাত্র আঙ্গুল ব্যবহার করে কবিতা লিখত, সেই কবিতা সে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। আমাকে বলেছিল এই শারীরিক অবস্থা নিয়ে সে নাকি ছবিও আঁকত। বিছানার মাঝে আটকে থাকা একটা কিশোরীর সামনে বাইরের পৃথিবীর জানালা কিভাবে খুলে দেয়া যায় আমি যখন সেটা ভাবছি তখন তার একজন বান্ধবী আমাকে জানাল সেই মেয়েটি আর বেঁচে নেই। যে মানুষটিকে কখনও সামনা সামনি দেখিনি তার জন্য দুঃখে আমার বুকটা একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছিল।

২.
আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা কত? আমি জানি সংখ্যাটি শুনলে সবাই চমকে উঠবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আর বিশ্বব্যাংকের ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রতিবন্ধী মানুষ হচ্ছে শতকরা ১৫ জন। (সত্তরের দশকেও সংখ্যাটি ছিল শতকরা ১০ জন)। সারা পৃথিবীতে যে হিসাব বাংলাদেশ তার বাইরে থাকবে সেটা হতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কী যে দেশ একটু দরিদ্র সেই দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বেশি। কাজেই আমরা যদি বাংলাদেশের জন্যও এই ১৫ শতাংশ সংখ্যাটি ধরে নিই তাহলে এখানে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লাখ। সংখ্যাটি কত বড় অনুমান করার জন্য বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় যদি এই সংখ্যক মানুষকে প্রতিবন্ধী হতে হয় তাহলে সেই দেশের প্রত্যেকটা মানুষকে প্রতিবন্ধী মানুষ হতে হবে।
আমি যখন প্রথমবার এই সংখ্যাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি তখন আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমাদের দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা ২০ লাখের কাছাকাছি, আমরা এই মানুষগুলোর অধিকারের জন্য সব সময় সোচ্চার থাকি। সরকার যখন ঘোষণা দিল এই দেশে আদিবাসী নেই আমরা তখন তীব্র ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেছিলাম। এই দেশের প্রায় নব্বই ভাগই এখন মুসলমান, বাকি অল্প যে কজন ভিন্ন ধর্মের মানুষ আছে তাদের নিয়ে যেন এ দেশে একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকে আমরা সব সময়েই সেটা লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করি। অথচ সংখ্যায় তাদের থেকে অনেক বেশি হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষ, কিন্তু তারা কী পূর্ণাঙ্গ মানুষের মর্যাদা নিয়ে এ দেশে আছে নাকি একটা ঘরের ভেতর সবার চোখের আড়ালে এক ধরনের গভীর হতাশায় ডুবে আছে সেটা নিয়ে আমরা কখনও মুখ ফুটে কথা বলি না। এর চাইতে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?
প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে আমাদের ভেতরে এখনও কোন সচেতনতা নেই। বরং উল্টোটা আছে, তাদের সম্পর্কে আমাদের নানা রকম নেতিবাচক ধারণা আছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমরা প্রথম একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র ভর্তি করেছিলাম তখন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব বুড়ো প্রফেসর আমাদের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়কে নানা ধরনের হাইকোর্ট দেখাতেন তাঁরা রীতিমতো আঁতকে উঠেছিলেন। ‘কানা খোঁড়া’ মানুষ ভর্তি করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি না করি সেজন্য আমাদের উপদেশ দিয়েছিলেন। প্রথমবারের মতো একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র ভর্তি হচ্ছে, তাও সেটি কোন কোটায় নয় নিজের যোগ্যতায় সেটি নিয়ে আমার ভেতরে এক ধরনের আনন্দ ছিল এবং আমার মনে আছে একাডেমিক কাউন্সিলে বুড়ো প্রফেসরদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রতিবন্ধী ছাত্রটি ভর্তি করা হয়েছিল। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এ রকম ভয়াবহ হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী ছাত্র যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকভাবে পড়তে পারে সেজন্য নীতিমালা আছে, আমরা তাদের প্রয়োজনটুকু দেখার চেষ্টা করি।
কিন্তু এই কথাটি কী পুরোপুরি সত্যি? আমাদের দেশে আইন করা হয়েছে প্রত্যেকটা নতুন বিল্ডিংয়ে হুইলচেয়ার করে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাথরুমগুলোতে যেন হুইলচেয়ার নিয়ে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ ঢুকতে পারে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু আমাদের এত আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিল্ডিংয়ে সেটি করা হয়নি। আমার মনে আছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি টিম এসেছে যার একজন হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে। অত্যন্ত দক্ষ প্রোগ্রামার হিসেবে সেই টিম একটা পুরস্কার পেয়ে গেল, এখন তাদের মঞ্চে গিয়ে পুরস্কার নিতে হবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা আমাদের অডিটরিয়ামের রাজসিক মঞ্চ কিন্তু হুইলচেয়ারে করে আসা সেই ছেলেটির মঞ্চে ওঠার কোন জায়গা নেই। লজ্জায় মনে হলো মাটির সঙ্গে মিশে যাই। তার বন্ধুরা তাকে হুইলচেয়ারসহ মঞ্চে তুলে নিয়ে এলো। সেখানে বন্ধুদের ভালবাসা আছে কিন্তু পুরস্কার পাওয়া তরুণের সম্মানটুকু নেই। আমি তখন তাকে কথা দিয়েছিলাম পরের বছর সে যদি আসে আমরা তাহলে তার জন্য একটা র‌্যাম্পের ব্যবস্থা করে রাখব। (সত্যি কথা বলতে কী, পরের বছরও আমি বিষয়টা ভুলে গিয়েছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে যখন মনে পড়েছে তখন তাড়াতাড়ি করে একজন কাঠমিস্ত্রি ডেকে খুব দায়সারা একটা র‌্যাম্প তৈরি করে রেখেছিলাম যেন সেটা দিয়ে তার বন্ধুরা হুইলচেয়াটাকে খানিকটা হলেও সম্মান নিয়ে উপরে নিয়ে যেতে পারে!)
নতুন একটা বিল্ডিং তৈরি করতে যত টাকা দরকার হয় তার তুলনায় সেই বিল্ডিংয়ে হুইল চেয়ারে ওঠার ব্যবস্থা করে দেয়া বা বাথরুমে হুইলচেয়ার নিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য বলতে গেলে কিছুই খরচ নেই, তারপরেও সেটা করা হয় না। দেশে এটা নিয়ে একটা আইন তৈরি করা হয়েছে, আমরা বেশিরভাগ সেই আইনটার কথা জানিই না! বিল্ডিংয়ে ঢোকার শুধু একটা অংশ, যে মানুষটি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করে তার কোন একটা বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে অনেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাস্তাঘাট যানবাহন কোনকিছুতেই কিন্তু হুইলচেয়ারে করে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। যে সব দেশ প্রতিবন্ধী মানুষবান্ধব সেখানে গেলে এক ধরনের মুগ্ধতা নিয়ে দেখতে হয় তারা কত গভীর মমতা নিয়ে এই মানুষগুলোর চলাফেরার ব্যবস্থা করে রেখেছে। সেখানে সাধারণ মানুষের চলাফেরা করার যেটুক অধিকার হুইলচেয়ারে করে একজন মানুষের তার সমান অধিকার। রাস্তাঘাট ফুটপাথ সব জায়গায় হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া যায়, হুইলচেয়ারের সুবিধাটুকু বড় বড় স্পষ্ট সাইন দিয়ে বলে দেয়া থাকে। পার্কিংলটে হুইলচেয়ারের যাত্রীদের গাড়ি পার্কিংয়ের আলাদা জায়গা থাকে। বাস, ট্রেনে তাদের ওঠার ব্যবস্থা থাকে, ওঠার পর হুইলচেয়ারে বসে যাওয়ার আলাদা জায়গা থাকে। একজন মানুষ তার বাসা থেকে হুইলচেয়ারে রওনা দিয়ে সারাদিন পুরো শহর চষে বেড়িয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসতে পারবে, তারে একটি বারও অন্য কারও সাহায্য নিতে হবে না। আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষ যদি এর মাঝেই প্রতিবন্ধী মানুষদের যাতায়াতের জন্য অনেক কিছু করে ফেলতে পারে তাহলে আমরা কেন পারব না?
একটি প্রতিষ্ঠানকে কিংবা একটা শহরকে এমনকি একটা দেশকেও যদি হুইলচেয়ারে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিতে হয় তার জন্য এমনকিছু বাড়তি টাকা পয়সার দরকার হয় না। যেটুকু দরকার হয় সেটি হচ্ছে একটুখানি ইচ্ছে বা একটুখানি সিদ্ধান্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে ক্ষুদ্র টাকা পয়সা খরচ করে সবার জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা হবে তার প্রতিদানে যেটুকু পাওয়া যাবে তার মূল্য সেই টাকা পয়সার সহস্র গুণ বেশি। প্রতিবন্ধী মানুষ বলে আমরা যাদের চোখের আড়াল করে রেখেছি, সমাজের বোঝা বলে আমরা যাদের অবহেলা করে এসেছি, তাদের কিন্তু আসলেই সবার চোখের আড়ালে সমাজের বোঝা হিসেবে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। যদি এই দেশের পথেঘাটে বাসে ট্রেনে গাড়িতে একজন হুইলচেয়ারে করে নিজে নিজে যেতে পারে তাহলে আমরা অবাক হয়ে দেখব তাদের আর পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না, তারা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে নিতে পারবে। এই দেশের দুই কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ যদি কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধী হয় তাহলে তাদের ঘরের মাঝে আটকে রেখে চোখের আড়াল করে ফেলার চেষ্টা করার কোন মানে হয় না। আমাদের তাদের মুক্ত করে দিতে হবে। এই বিশালসংখ্যক মানুষের যতজনকে সম্ভব পরিপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার দিতে হবে।

৩.
কিছুদিন আগে একজন ব্রিটিশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কাজগুলো দেখতে এসেছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে জানতে পারলাম সে গণিতে লেখাপড়া করে এসেছে। যে মানুষটি চোখে দেখতে পায় না সে কেমন করে গণিত নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে সেটি নিয়ে আমার কৌতূহল ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল চোখে দেখতে পায় না বলে ভুল করে সে অন্য একটি ক্লাশরুমে গিয়েছিল, সেখানে সে শুনতে পেল গণিত পড়ানো হচ্ছে, তার কাছে মনে হলো বিষয়টা খুব চমৎকার তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের গিয়ে জানাল সে গণিতে স্নাতক পড়তে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় অধ্যাপক বলল, যে মানুষ চোখে দেখতে পায় না সে কখনও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণিতে স্নাতক ডিগ্রী নিতে পারবে না। মেয়েটি বলল, এটা তোমাদের একটা থিওরি, আমাকে দিয়ে এই থিওরির একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখো তোমাদের থিওরিটা সঠিক কী না! কাজেই প্রফেসররা তাকে গণিত পড়তে দিতে বাধ্য হন। এবং সে সকল থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করে স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে বের হয়ে এলো!
আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লন্ডন শহরে তুমি কেমন করে যাতায়াত কর? সে বলল, সে সম্পূর্ণ একা একা পুরো লন্ডন শহর চষে বেড়ায়, সে জন্য তার দরকার ছোট একটা কম্পিউটার ট্যাবলেট, আর কিছু নয়!
এই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির এমন কিছু নতুন আবিষ্কার এখন সবার হাতে হাতে চলে এসেছে যেগুলো প্রতিবন্ধী মানুষের সামনে একেবারে নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। একটি উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষের প্রয়োজন ভিন্ন, কাজেই এর সমাধানও হতে হবে ভিন্ন আর সেই কাজটুকু করতেও হবে আমাদের নিজেদের। এর মাঝে সেটি শুরু হয়েছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেটা করার চেষ্টা করি, অন্যরাও যদি করে আমার মনে হয় অনেক কিছু হতে পারে।

৪.
প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন নিয়ে আমাদের কোন আগ্রহ নেই, তাই তাদের লেখাপড়া নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকবে সেটি নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি না। প্রতিবন্ধী বাচ্চারা যতটুকু সম্ভব সাধারণ বাচ্চাদের সঙ্গে লেখাপড়া করে বড় হবে সেটা সবার স্বপ্ন। এই মুহূর্তে তার ব্যবস্থা নেই কিন্তু আইন করে সেই ব্যবস্থা করা হবে। আমরা তার অপেক্ষা করে আছি। যেটি করা কঠিন সেটা করতে সময় লাগতে পারে। কিন্তু যেটি করা সোজা সেটি যদি করা না হয় তাহলে আমরা হতাশা অনুভব করতে থাকি। যেমন ধরা যাক ব্রেইল বইয়ের ব্যাপারটি, কথা ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের জন্য ব্রেইল বই দেয়া হবে কিন্তু সেটি দেয়া হলো না। তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা অন্তত পক্ষে পাঠ্য বইগুলোর সফট কপির জন্য ঘঈঞই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করলাম যেন নিজের উদ্যোগে সেগুলোকে ব্রেইল করে নেয়া যায়। বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, প্রত্যেকটা পাঠ্যবই পি.ডি.এফ
করে তাদের ওয়েবসাইটে রাখা আছে যে কেউ সেটা ডাউনলোড করে নিতে পারবে। কিন্তু ব্রেইলে ছাপানোর জন্য যে রকম ভাবে টেক্সট ফাইল দরকার সেটি কিছুতেই পাওয়া গেল না।
বিষয়টি যখন জানাজানি হলো তখন এই দেশের তরুণেরা নিজেরা সেই বইগুলো নতুন করে টাইপ করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে! প্রতিবছর এই দেশের বাচ্চারা নতুন বই হাতে বুঝে বিশাল একটা হাসি নিয়ে বাড়ি যায়Ñ এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। ঠিক একই সময় সব রকম চেষ্টা করেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য পুরো ক্লাসের জন্য একটা করে ব্রেইল বই আমরা তুলে দিতে পারি না! শুধু তাই নয়, যখন প্রক্রিয়াটা আমরা নিজেরাই করতে চাই তখনও ঘঈঞই থেকে আমরা সহযোগিতা পাই না।

৫.
আগামী ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো দিনটিকে গুরুত্ব দিয়ে নিয়ে সবার ভেতরে এক ধরনের সচেতনতা তৈরি করবে বলে খুব আশা করে আছি। প্রতিবন্ধী মানুষদের আমাদের পাশাপাশি নিয়ে এসে এক সঙ্গে কাজ করার গন্তব্যটুকুতে আমরা এখনও পৌঁছিনি। যাত্রা শুরু করলে এক সময় পৌঁছব, আমরা এখনও যাত্রা শুরু করিনি। সবাই মিলে যাত্রাটাকু শুরু করি, কাজটুকু খুবই সহজ, শুধু মনে রাখতে হবে প্রতিবন্ধী মানুষেরা আসলে প্রতিবন্ধী নয়, আসলে তারা মানুষ।

২০-১১-১৩

প্রশ্নপত্র ফাঁস কি অপরাধ নয়

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার পরিচিত মানুষেরা আমার এই লাগামছাড়া আশাবাদ দেখে খানিকটা কৌতুক অনুভব করেন, আমি তাতে কিছু মনে করি না। তার প্রথম কারণ, এই আশাবাদের কারণে আমি অন্যদের থেকে অনেক বেশি আনন্দে দিন কাটাই। দ্বিতীয় কারণ, আমার দীর্ঘজীবনে আমার বেশিরভাগ আশাবাদই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

এই দেশ নিয়েও আমি সবসময় খুব আশাবাদী। আমার নিজের চোখেই দেখছি, দেশটি আর দারিদ্রে মুখ থুবড়ে পড়া দেশ নয়। দেশটির অর্থনীতি আগের থেকে অনেক বেশি শক্ত। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পাশের দেশের মানুষ থেকে আমাদের দেশের মানুষ অনেক দিক থেকেই বেশি শান্তিতে আছেন। এ রকম তথ্য আমি অমর্ত্য সেনের লেখা থেকে জেনেছি।

এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের অর্থনীতি চালিয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা এবং খেত-খামারের চাষীরা। আমাদের মতো শিক্ষিত মানুষেরা এখনও দেশের অর্থনীতিতে সে রকম কিছু দিতে পারেনি, কিন্তু আমি সেটা নিয়ে মোটেও নিরাশ নই। আমি সবসময় জোর গলায় বলি, আমাদের দেশের স্কুলের ছাত্রছাত্রীই হচ্ছে প্রায় তিন কোটি (কানাডার লোকসংখ্যার সমান)। আর এই ছাত্রছাত্রীরা ঠিকভাবে লেখাপড়া শিখে যখন খেটে খাওয়া মানুষজনের পাশে দাঁড়াবে, তখন দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।

আমি অনেক জোর দিয়ে এই কথাটি বলতাম। কিন্তু গত সপ্তাহের পর থেকে এই কথাটি বলার আগে আমার বুক থেকে ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে। গত সপ্তাহে আমি নিশ্চিত হয়েছি, এই দেশে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়মিত ফাঁস হয়ে যাচ্ছে এবং আমাদের দেশের সরকার নিয়মিতভাবে সেটা অস্বীকার করে যাচ্ছে।

পরীক্ষা লেখাপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের মতো দেশে পরীক্ষাটা আরও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ সব ছাত্রছাত্রীই পরীক্ষায় ভালো করতে চায়। তাই পরীক্ষাটি যদি খুব ভালোভাবে নেওয়া যায়, অর্থাৎ পরীক্ষা পদ্ধতিটা যদি সঠিক হয়, তাহলে এই পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করতে গিয়েই ছেলেমেয়েরা সবকিছু শিখে ফেলে।

আমাদের যদি ভালো স্কুল না থাকে, ভালো শিক্ষক না থাকে, ভালো পাঠ্যবই না থাকে– কিন্তু খুব চমৎকার একটা পরীক্ষা পদ্ধতি থাকে, তাহলেও আমরা লেখাপড়ায় অনেক এগিয়ে যাব। দেশে যখন সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি এসেছে, আমরা তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ছাত্রছাত্রীদের আর মুখস্ত করতে হবে না, এখন তারা চিন্তাভাবনা করে মাথা খাটিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে।

আমি একটিবারও ভাবিনি আমার দেশের সরকার, সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা এই পরীক্ষার ব্যাপারে তাদের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে থাকবে। তারা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে দেবে আর সেটি নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ থাকবে না। এই সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আমি অনেক কাজ করেছি। এখন আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মন্ত্রণালয়টির দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, যখন দেখি এই দেশের এত বড় বিপর্যয় নিয়ে তাদের কোনো রকম প্রতিক্রিয়া নেই!

শুধু যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া নেই তা নয়, পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও সে রকম প্রতিক্রিয়া নেই। আমি যে খবরের কাগজটি পড়ি সেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবরটি ছাপ হয়নি, সম্পাদকীয় লেখা হয়নি, দেশের গুণীজন উপসম্পাদকীয় লিখেননি।

টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাই না, তাই সেখানে কী হচ্ছে জানি না, কিন্তু ছোটখাট বিষয়ের জন্যেও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার মতামত নিতে চলে আসে। এবারে কেউ আসেনি, শুধুমাত্র একটি চ্যানেল আমার কাছে সেটি জানতে চেয়েছে। তাও সেটি ঘটেছে, কারণ আমি ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এবং পরীক্ষার প্রশ্ন পাশাপাশি বসিয়ে খবরের কাগজগুলোতে একটা লেখা লিখেছিলাম।

এই কাজটুকুও আসলে আমার করার কথা নয়, এটি করার কথা সাংবাদিকদের। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াতে পুরো জাতি অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে থাকে এবং এটি আসলে এখন প্রচার করার মতো কোনো খবর নয় বলে পত্রপত্রিকা বিশ্বাস করে থাকে, তাহলে এর থেকে বড় বিপদে আমরা আগে কখনও পড়েছি বলে মনে হয় না।

নিজের চোখে ফাঁস হয়ে যাওয়া এইচএসসির প্রশ্নপত্র দেখার পর আমি খোঁজখবর নিয়েছি এবং আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি পিএসসি এবং জেএসসির প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছিল। এই ছোট ছোট শিশুগুলোর মা-বাবা কিংবা শিক্ষক তাদের হাতে প্রশ্নগুলো তুলে দিয়ে তাদের সেটা পড়িয়েছে। শিশুগুলো সেগুলো পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিস্কার করেছে, হুবহু সেগুলোই পরীক্ষায় এসেছে।

তখন তাদের মনে বিস্ময়, আতঙ্ক কিংবা লোভ জন্মেছে কি না জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি এটি ছিল শিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতি শেখানোর প্রথম পদক্ষেপ। একটি দুটি শিশু তাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে অন্যায় করতে শিখে যেতে পারে, কিন্তু একটি রাষ্ট্র দেশের পুরো শিশুসমাজকে দুর্নীতি করতে শিখাতে পারে, এটি সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি।

আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘটনাগুলো স্বীকার করেনি, তাই এ রকম কাজ যে অন্যায় বাংলাদেশের কেউ এখনও সেটা জানে না। যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে, তারা এই দেশের আইনে এখনও অপরাধী নয়। অপরাধীর শাস্তি অনেক পরের ব্যাপার, কিন্তু প্রশ্ন ফাঁস করা যে অপরাধ এই সরকার এখনও সেই ঘোষণাটিও দেয়নি।

সরকার যদি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সেই বিষয়টি স্বীকারই না করে তাহলে এত বড় একটা অপরাধ করার জন্যে কাউকে শাস্তি কীভাবে দেবে? যারা প্রশ্ন ফাঁস করার সঙ্গে জড়িত, যারা এই দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যাবে না– এর কারণটি কী আমি বুঝতে পারছি না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি মনে করে থাকে একটা অন্যায় এবং অপরাধের বিচার নিয়ে মুখ না খুললেই বিষয়টার কথা মানুষ ভুলে যাবে, তাহলে তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, সেটি সত্যি নয়। এই দেশের প্রত্যেকটি মানুষ এই ঘটনার কথা জানে; বিশেষ করে যে সব তরুণ-তরুণী এই প্রশ্নফাঁসের কারণে হতাশায় ডুবে গেছে, তাদের অভিশাপ থেকে কিন্তু কেউ মুক্তি পাবে না।

২.

আমার কাছে প্রথমবার যখন একটি মেয়ে ফোন করে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার কথা জানিয়েছে তখন তার কাছে আমি ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো চেয়েছিলাম। পরীক্ষা হওয়ার পর সে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রটিও পাঠিয়েছিল। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ছাড়াও পরীক্ষার প্রশ্নটি দেখে আমি আহত হয়েছিলাম অন্য কারণে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী যে পরীক্ষা দিচ্ছে সেই পরীক্ষার প্রশ্নটি এত অযত্নে কেমন করে তৈরি করা হল? প্রশ্নে যে জঘন্য ছবিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে এর চাইতে রুচিসম্মত সুন্দর ছবি আঁকার মতো কেউ কি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিকে সাহায্য করার জন্যে নেই!

সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে, একটা সমস্যার সমাধান করার জন্যে ধ্রুবগুলোর যে মানটুকু জানানো প্রয়োজন সেটি টাইপ করে লেখারও কেউ প্রয়োজন মনে করেনি! অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে প্রায় দুর্বোধ্য হাতের লেখায় প্রশ্নপত্রে লিখে দেওয়া হয়েছে। দেখেই বোঝা যায়, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, টাইপ বা ছাপার পুরো ব্যাপারে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমি বিশ্বাস করতেই রাজি নই যে, এত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে করা সম্ভব ছিল না।

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে চরম অবহেলা রয়েছে তার আরও অনেক প্রমাণ আছে। আমার কাছে অনেক ছাত্রছাত্রী অভিযোগ করেছে, যারা ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের প্রশ্নে অনেক বড় বড় ভুল রয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রশ্নে এমন ভুল আছে, যার কারণে উত্তরে আকাশ-পাতাল পার্থক্য হয়ে যেতে পারে।

অবহেলা ছাড়াও আরও সমস্যা আছে। ছাত্রছাত্রীরা অভিযোগ করেছে, জীববিজ্ঞান পরীক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ প্রশ্ন গাইড বই থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তারা আমার কাছে গাইড বইটির নামও উল্লেখ করে দিয়েছে।

আমি সাংবাদিক নই। সাংবাদিক হলে তাদের অভিযোগটি যাচাই করে দেখতে পারতাম। এই মূহূর্তে আমার যাচাই করার সুযোগ নেই, কিন্তু এটি নিশ্চয়ই যাচাই করে দেখা সম্ভব। যদি দেখা যায়, সত্যিই প্রশ্নগুলো গাইড বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাহলে কি যারা প্রশ্ন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না?

কেউ কি আমাকে বলতে পারবেন, এই দেশের ইতিহাসে কতবার কত প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, কিন্তু কখনও কি কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? হাতে হাতকড়া লাগিয়ে কখনও কি কোনো মানুষকে হাজতে নেওয়া হয়েছে?

ফেসবুক নামক একটি বিশেষ সামজিক নেটওয়ার্কিং-এর কারণে আজকাল ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন সবার মাঝে বিতরণ করা খুবই সহজ হয়ে গেছে। এই একটি দিকে বাংলাদেশ সত্যিকার ডিজিটাল যুগে পা দিয়েছে। মাঝে মাঝেই দেখতে পাই, কমবয়সী তরুণেরা ফেসবুকে বেফাঁস কোনো কথা বলে দেওয়ার কারণে পুলিশ কিংবা র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ছে, জেল খাটছে। কিন্তু ফেসবুক ব্যবহার করে প্রকাশ্যে যখন ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে বাণিজ্য করা হয়, তখন কেন কখনও তাদের কাউকে ধরা হয় না? তারা কীভাবে সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়?

আমি কি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে খুব স্পষ্ট করে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? সত্যি কি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে? যদি ফাঁস হয়ে থাকে তাহলে সেটি কি অপরাধ? যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে সেই অপরাধীদের ধরার জন্যে কি কোনো মামলা করা হয়েছে? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। অনুগ্রহ করে আপনাদের কেউ কি আমার এই প্রশ্নটির উত্তর দেবেন?

৩.

প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমি গত সপ্তাহে একটা ছোট লেখা লিখেছিলাম। তারপর অনেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা যায় সে সম্পর্কে নানা পদ্ধতির কথা বলেছেন।

সত্যি কথা বলতে কী, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ব্যাপারটি সরকার স্বীকার করবে না, সেটাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে অপরাধীদের ধরে শাস্তি দেবে না– ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো তথ্যপ্রযুক্তির কোনো পদ্ধতিই আসলে কাজ করবে না।

সরকার যদি এই ভয়ংকর ব্যাপারটি ঘটেছে সেটা ঘোষণা দিয়ে স্বীকার করে নিয়ে অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করে তাদের ভয়ংকর শাস্তি দিতে শুরু করে, তাহলে আর কিছুই করার প্রয়োজন হবে না। যে পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়, বিতরণ করা হয়, সেই পদ্ধতিইে প্রশ্ন ফাঁস হতে না দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যাবে।

সত্যি কথাটি হচ্ছে, প্রশ্ন আসলে ফাঁস হয় না, প্রশ্ন ফাঁস হতে দেওয়া হয়।

৪.

এই দেশের ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে কয়দিন থেকে আমার মনটা খুব খারাপ। পিএসসি কিংবা জেএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিশুদের ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেওয়া হয়। যারা বৃত্তি পেয়েছে তারা আমাকে চিঠি লিখে বলেছে, যদিও তারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছে, কিন্তু সবাই এখন তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নানা রকম কটূক্তি করেছে।

যারা বৃত্তি পায়নি তাদের অনেকে আমাকে জানিয়েছে তাদের থেকে খারাপ পরীক্ষা দিয়ে অনেকে বৃত্তি পেয়ে গেছে; কারণ তাদের উপরের মহলে ধরাধরি করার লোক আছে। যেহেতু সাধারণের কাছে গোপন পরীক্ষায় পাওয়া আসল নম্বরের ভিত্তিতে এই বৃত্তি দেওয়া হয়, তাই এই পুরো পদ্ধতিটাই আসলে ভয়ংকর রকম অস্বচ্ছ!

এই শিশুদের অভিযোগ সত্য নয়, এই কথাটি পর্যন্ত কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করে নম্বর তুলে দেওয়া হয়েছে– কিন্তু সেই নম্বর দিয়ে একটা ছাত্র বা ছাত্রীর ভবিষ্যৎও নির্ধারণ করা হয় এবং কেউ কোনোদিন সেটা জানতে পারবে না। এত বড় একটা অস্বচ্ছ ব্যাপার কীভাবে সবাই দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি না।

যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা একটু বড় হয়েছে। এখন তাদের সেই বয়স, যে বয়সে তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করার আগেই তাদের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া হচ্ছে এবং সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার সেটি করছে তারাই যাদের স্বপ্ন দেখানোর কথা। যারা ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পেয়ে সেটা পড়ে পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে (শুনেছি ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে লেখাপড়া করতে বসিয়ে মায়েরা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে ছেলেমেয়েদের জন্যে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন বের করে এনেছেন)।

ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রে যারা পরীক্ষা দিয়েছে, তারা নিজেদের জন্যে নানা ধরনের যুক্তি দাঁড় করিয়ে নিয়ে অপরাধবোধটি কমানোর চেষ্টা করছে এবং সেটি হচ্ছে দুর্নীতি শেখার প্রথম ধাপ। এই ছেলেমেয়েগুলো কিন্তু নিজে থেকে দুর্নীতি করতে চায়নি, তাদেরকে জোর করে দুর্নীতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ব্যবহার না করে পরীক্ষা দিয়েছে, তাদের ভেতর এখন একই সঙ্গে তীব্র হতাশা এবং ক্ষোভ। তাদের মুখে একটিই কথা, “ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন দিয়েই যদি সবাই পরীক্ষা দিয়ে ভালো নম্বর পাবে, তাহলে সারা বছর এত মনোযোগ দিয়ে পড়ে আমার কী লাভ?’’

এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা শুরু হয়ে, তখন এই ছেলেমেয়েগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা তাদেরকে সত্য এবং ন্যায়ের কথা বলি, কিন্তু অসত্য আর অন্যায়কে লালন করি– এত বড় ভণ্ডামির উদাহরণ কি আর কেউ দিতে পারবে?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বড় বড় হর্তাকর্তারা, সরকারের বড় বড় লোকজন খুব শান্তিতে থাকেন। ছোট ছোট শিশুরা, এই দেশের কিশোর-কিশোরীরা, তরুণ-তরুণীরা তাদের ধারেকাছে যেতে পারে না। তারা পুলিশের প্রহরায় গাড়ি করে যান, তাদের চিঠি পড়তে হয় না, ই-মেইল দেখতে হয় না। এই শিশু-কিশোর-তরুণেরা কিন্তু আমার মতো মানুষের কাছে আসতে পারে। যখন তীব্র ক্ষোভ নিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করে তখন আমি তাদেরকে কী বলে সান্ত্বনা দিব বুঝতে পারি না।

তারপরও আমি তাদের সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি, আমি তাদেরকে বোঝাই শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবে, অন্যায়কে অন্যায় বলা হবে, অপরাধকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে-মুছে ফেলে নূতন করে সবকিছু শুরু করা হবে। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা যে কাজটি করতে পারেনি, নূতন প্রজন্ম নিশ্চয়ই সেই কাজটি করতে পারবে।

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। দেশের সব মানুষের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করব, তাদের অবহেলা করে ঠেলে ফেলে দেবেন না।

তাদেরকে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বড় হতে দিন।

প্রিয় সজল (মে ২৪, ২০১৩)

এয়ারপোর্টে পরের ফ্লাইট ধরার জন্যে বসে আছি তখন আমার মেয়ে এসে আমাকে বলল এভারেস্ট অভিযানে বাংলাদেশের একজন মারা গেছে। মানুষটি কে,কীভাবে মারা গেছে কিছুই শুনিনি কিন্তু মুহূর্তে আমার জগতটি গভীর বিষাদে ঢেকে গেলো। আমি সাথে সাথে বুঝে গেলাম সজল আর নেই। এই সুদর্শন প্রতিভাবান তরুণটিকে আবার দেখবো না। মাটির মানুষ হয়ে সুউচ্চ অহংকারী এভারেস্টকে পদানত করার অপরাধে সে আরো একজন পর্বতারোহীর উপর প্রতিশোধ নিয়েছে।

আমি জানতাম সজল দ্বিতীয়বারের জন্যে এভারেস্টে যাচ্ছে, মুহিত যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘায়। বছরের এই সময়টাতে আমাদের তরুন অভিযাত্রীরা হিমালয়ের চূড়ায় উঠে। আর আমরা দুর দুর বক্ষে সেই প্রতীক্ষিত এস.এম.এস এর জন্যে বসে থাকি যখন আমাদের জানানো হয় দেশের তরুনেরা পাহাড়ের চুড়ায় উঠে আবার সুস্থ দেহে নিচে ফিরে এসেছে। এবারে ভাগ্য আমাদের নিষ্ঠুর ভাবে বিমুখ করেছে, এভারেস্ট সজলকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়নি। তার দুই বছরের বাচ্চাটি যখন বড় হবে তার কাছে দুঃসাহসী বাবার কোন স্মৃতি থাকবে না। একটা গভীর বেদনায় আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল।

আমি সজলকে জানতাম ফিল্মমেকার হিসেবে, সে যে একই সাথে একজন পর্বতআরোহী সেটা আমি জেনেছি পরে। আমাদের নূতন প্রজন্ম একাত্তরকে গভীর ভাবে অনুভব করে , সজলও তাদের একজন। ‘একাত্তরের শব্দসেনা’ নামে তার একটি অসাধারন ডকুমেন্টরী রয়েছে। আমার সাথে তার পরিচয় এবং অন্তরঙ্গতা হয়েছিল যখন সে আমার একটি কিশোর উপন্যাসকে (কাজলের দিনরাত্রি) চলচ্চিত্রায়িত করার পরিকল্পনা করছিল। এই দেশে সিনেমা তৈরির মত কঠিন কাজ আর কিছু হতে পারে না- তার পরেও অসাধারন দক্ষতায় সে চলচ্চিত্রটি শেষ করেছিল। শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি যখন প্রথম দেখানো হয়েছিল সজলের সাথে আমিও সেখানে ছিলাম। ছবিটা শেষ হবার পর বাচ্চাদের আনন্দোল্লাস শুনে আমার বুকটি ভরে গিয়েছিল। সজলের সুখের হাসিটির কথা আমি কোন দিন ভুলব না। সে বাচ্চাদের আনন্দ দিতে পারে এমন একটি ছবি তৈরি করতে পেরেছে এর চাইতে আনন্দের আর কী হতে পারে। মার্চ মাসে ছবিটি রিলিজ করার কথা ছিল। এভারেস্টে যাবার প্রস্তুতির জন্যে সজল সম্ভবত সেটা একটু পিছিয়েছিল। এখন হঠাৎ করে সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেছে। ছবিটি মাত্র কিছু দিন আগে আমার কাছে যতটুকু আনন্দের ছিল এখন ঠিক ততটুকু দুঃখের।

বাংলাদেশের মত সমতল দেশের তরুণরা যখন পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে সেটি ছিল আমাদের সবার জন্যে সাফল্য আর অর্জনের নতুন দিগন্ত। এই তরুণরা তাদের সকল অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির জন্যে উৎসর্গ করে এসেছে, আমাদের প্রজন্ম যেটা পারেনি এই নতুন প্রজন্ম সেটা করেছে- দেশের শিশু কিশোরকে দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। তাদের অভাবনীয় সাফল্য দেখে সাধারনের মনে হতে পারে কাজটি বোধ হয় সহজ, কিছু সময়, কিছু ট্রেনিং আর কিছু স্পন্সর হলেই বুঝি একজন এভারেস্টে যেতে পারে। কিন্তু এটা যে কত কঠিন সেটা শুধুমাত্র পর্বতারোহীরাই জানে- সাধারন মানুষের পক্ষে কল্পনা পর্যন্ত করা সম্ভব নয়। আট হাজার মিটার কিংবা পচিশ হাজার ফুট উচ্চতায় আসলে মানুশের বেঁচে থাকার কথা না, আক্ষরিক অর্থেই এটি হচ্ছে মৃত্যু উপত্যকা। যারা বেঁচে থাকে তারা শুধু মাত্র তাদের শারীরিক আর মানসিক শক্তির জোরে নিশ্চিত মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে থাকে। এতদিন আমরা শুধু সাফল্যের কথা শুনে এটাকে একটা দুঃসাহসিক অভিযান হিসেবে জেনে এসেছি , সজলের মৃত্যুর ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে এটি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আসা, মৃত্যু কখনও কখনও আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দেয়, কখনো কখনো করে না। সজলকে করেনি।

সজল সেটি জানত, আমরা যত টুকু জানতাম সে তার থেকে বেশি জানত। এর আগে সে হিমালয়ের অন্য চুড়ায় উঠেছে, এভারেস্টের কঠিন পথেও চেষ্টা করেছে। সব কিছু জেনেও সে এই পথে গিয়েছে বাংলাদেশের পতাকাটি এভারেস্টের চুড়ায় উড়িয়ে এসেছে। দিয়ে এসে আমাদের সেই কাহিনী বলতে পারেনি- এই কষ্টটি আমরা কোথায় রাখব?

প্রিয় সজল, তোমাকে আমরা ভুলবো না, তোমার অভাবটি কেউ পূরন করতে পারবে না।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2013-5-24

বই এবং বইমেলা (জানুয়ারি ২৯, ২০১২)

সেদিন আমাকে একজন ভদ্রলোক বললেন, ‘কী করি বলুন তো। আমার ছোট ছেলেটা দিন-রাত টেলিভিশনে কার্টুন দেখে।’ আমি বললাম, ‘বন্ধ করে দিন। দরকার হলে টেলিভিশনটা দোতলা থেকে নিচে ফেলে দিন। একটা টেলিভিশন নষ্ট হবে, কিন্তু একটা ছেলে রক্ষা পাবে।’ ভদ্রলোক আমার কথা খুব সিরিয়াসলি নিলেন না। ভাবলেন, আমি ঠাট্টা করছি। আমি কিন্তু মোটেও ঠাট্টা করছিলাম না। আমি আসলেই বিশ্বাস করি, একটা ছোট শিশু যখন বড় হয়, তখন টেলিভিশনের থেকে খারাপ কিছু হতে পারে না। সারা পৃথিবীতে যে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, যদি শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে তার জন্য টেলিভিশন (এবং কম্পিউটার গেম) দায়ী, তাহলে আমি মোটেও অবাক হব না।
টেলিভিশন যে রকম ভয়ংকর একটা জিনিস, ঠিক তার উল্টো অসম্ভব সুন্দর একটা জিনিস হচ্ছে বই। যে শিশু লেখাপড়া শেখেনি, কথা বলতে শেখেনি তাকেও যদি নিয়মিতভাবে তার উপযোগী বই পড়ে শোনানো হয়, তাহলে সে নিজে নিজে লেখাপড়া শিখে যায়, সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। বই কী অপূর্ব একটা জিনিস, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি দেওয়া কিছু অক্ষর, কিছু শব্দ, কিছু বাক্য—আমার চোখ দিয়ে আমি সেগুলো দেখি আর আমার মস্তিষ্কের ভেতর ম্যাজিক হতে শুরু করে। বইয়ের লেখাগুলো আমার কল্পনার জগৎটা খুলে দেয়। যে মানুষের কল্পনাশক্তি যত বেশি, একটা বই তার জন্য তত চমৎকার একটা বিষয়।
শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই টেলিভিশন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন বইকে হটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি মনে করি, মানবসভ্যতার জন্য এটা হচ্ছে সত্যিকারের একটা হুমকি। যদি দেখা যায়, সত্যি সত্যি মানুষ বই পড়া বন্ধ করে টেলিভিশন দেখে বিনোদনের সব কাজ সেরে নিচ্ছে, তাহলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়, মানুষের প্রজন্ম তখন হবে অসম্পূর্ণ একটা প্রজন্ম! টেলিভিশনের রেডিমেড ফাস্টফুড বিনোদনে যদি অভ্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে আমরা কি সত্যিকারের মননশীল কাজ কখনো করতে পারব?
সে জন্য আমি সুযোগ পেলেই সবাইকে বই পড়ার কথা বলি। কেউ যদি বলে খুব আনন্দ হচ্ছে, তাহলে আমি বলি, একটা ভালো বই পড়ে আনন্দটা আরও বাড়িয়ে নাও। কেউ যদি বলে মনটা ভালো নেই, তাকেও আমি বলি, বই পড়ো, তাহলে মনটা ভালো হয়ে যাবে। কেউ যদি বলে ঘুম আসছে না, আমি তাকে বলি, বই পড়ো, ঘুম চলে আসবে। কেউ যদি বলে শুধু ঘুম পায়, তাকেও আমি বলি, বই পড়ো, তাহলে ঘুম চলে যাবে। কেউ যদি বলে শরীরটা ভালো লাগছে, আমি বলি, চমৎকার, এটা হচ্ছে বই পড়ার সময়। কেউ যদি বলে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে, আমি বলি, বই পড়ো, শরীর ঠিক হয়ে যাবে! আমি কৌতুক করে বলি না, আমি গভীর বিশ্বাস থেকে বলি।
ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের বইমেলা হয়। এটা কী চমৎকার একটা ব্যাপার। যারা বই পড়ে না, তারাও এই মেলায় চলে আসে। বই নেড়েচেড়ে দেখে। মাঝেমধ্যে কেনে। বাসায় নিয়ে সাজিয়ে রাখে। আমার খুব ইচ্ছে, আমাদের তরুণ প্রজন্ম বই পড়ুক। একটা বই পড়ার আগে তারা যে মানুষ থাকে, একটা ভালো বই পড়ার পর তারা আর সেই মানুষটি থাকে না। তারা অন্য একজন মানুষ হয়ে যায়! নিজেকে ভালো মানুষে পাল্টে দেওয়ার এত সহজ সুযোগটি তারা কেন ছেড়ে দেবে?

বই বইমেলা এবং অন্যান্য


আমার যতগুলো প্রিয় উৎসব আছে তার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় একটি হচ্ছে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। পুরস্কার বললেই চোখের সামনে একটা প্রতিযোগিতার দৃশ্য ফুটে উঠে। আমরা ধরে নিই অসংখ্য মানুষ বিশেষ কোনো একটা কিছুর জন্যে এসে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে এবং তার মাঝে মাত্র একজন বা দুইজন অন্য সবাইকে কনুই দিয়ে পিছনে ফেলে দিয়ে পুরস্কারটা ছিনিয়ে নিচ্ছে।

অন্যদের কাছে জানি না আমার কাছে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান মানেই একটা দুঃখের অনুষ্ঠান, আশাভঙ্গের অনুষ্ঠান। একজন দুজন পুরস্কার পায়, অন্য সবার আশাভঙ্গ হয়। সেই হিসেবে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান একটি অসাধারণ উৎসব। কারণ সেখানে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীর সবাই বিনয়ী, সবাই পুরস্কৃত! এ রকম চমকপ্রদ অনুষ্ঠান সারা পৃথিবীতে কতগুলো আছে আমার জানা নেই– খুব বেশি থাকার কথা নয়।

এই উৎসবে সবাই যে পুরস্কার পায় শুধু তাই নয়, সেই পুরস্কারটি তাদেরকে দেওয়া হয় একটি অসাধারণ কাজের জন্যে, সেটি হচ্ছে বইপড়া। কেউ কেউ মনে করতে পারে বইপড়া আর এমন কী বিষয়, এর জন্যে পুরস্কার দিতে হবে কেন? হাই জাম্প লং জাম দিয়ে মানুষ পুরস্কার পেতে পারে কিন্তু বই পড়ে কেউ পুরস্কার পাবে কেন?

কিন্তু আমার ধারণা, বইপড়া একটা অসাধারণ বিষয়। যত দিন যাচ্ছে আমার সেই ধারণাটা আরও পোক্ত হচ্ছে। আমি জানি না সবাই এই বিষয়টা লক্ষ্য করছে কী না, আমরা যখন কিছু একটা পড়ি তখন আসলে কাগজের উপর আঁকি-বুকি করে রাখা কিছু ছোট ছোট চিহ্নের দিকে তাকাই (সেগুলোকে আমরা বর্ণ বা অক্ষর বলি)। সেই চিহ্নগুলো চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে (উল্টো হয়ে) রেটিনার উপর পড়ে। রেটিনা থেকে সেই সিগন্যাল মস্তিষ্কে যায়। মস্তিষ্ক সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে। আমরা তখন তার মর্মোদ্ধার করি।

তারপর আসল ব্যাপারটা শুরু হয়– যেটা পড়েছি সেটা কল্পনা করি। যার কল্পনাশক্তি যত ভালো সে তত চমৎকারভাবে পুরো বিষয়টা উপভোগ করে। পুরো বিষয়টা আসলে অবিশ্বাস্য রকম উঁচুমানের একটা কাজ, মানুষ ছাড়া আর কারও পক্ষে সেটা করা সম্ভব না। যারা বই পড়ে, নিঃসন্দেহে তারা যারা পড়ে না তাদের থেকে ভিন্ন।

আমাকে মাঝে মাঝেই অনেকে জিজ্ঞেস করে, ভালো লেখক হওয়ার কোনো একটা শর্টকাট পদ্ধতি আমার জানা আছে কী না। আমি সবসময়েই বলি, ভালো লেখক হওয়ার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে বই পড়া। যে যত বেশি বই পড়বে সে তত ভালো লিখতে পারবে। আমি এটা জোর দিয়ে বলি, কারণ আমাদের পরিবারের হুমায়ূন আহমেদ এই দেশের একজন অসাধারণ লেখক ছিল, আর সে একেবারে শিশু বয়স থেকে শুধু বই পড়ে আসছে। আমার মনে হয় সে জন্যে সে এত সুন্দর লিখতে পারত।

বই পড়ে সবাই যে সফল লেখক হয়ে যাবে তা নয় কিন্তু বই পড়লে নিশ্চিতভাবে নিজের ভেতরে একটা পরিবর্তন হয়। সেই কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, জীবনানন্দ দাস ট্রামের তলায় চাপা পড়েছেন। মজার ব্যাপার হল, তাদের লেখাগুলো এখনও পুরোপুরি জীবন্ত। যখন পড়ি তখন মনে হয় তাঁরা বুঝি সামনে বসে আছেন। আমাদের দেশের মানুষের বইপড়ার অভ্যাসটি কম। যত দিন যাচ্ছে মনে হয় অভ্যাসটি আরও কমে যাচ্ছে।

ইউরোপ-আমেরিকার বাস বা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করার সময় দেখা যায় সবাই একটা না একটা বই পড়ছে (আজকাল ই-বুক রিডার দিয়েও পড়ে)। খুব যে গভীর জ্ঞানের বই তা নয়, জনপ্রিয় কোনো বই কিন্তু পড়ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই তুলনায় আমাদের দেশের বাস-ট্রেন-স্টেশনে গেলে দেখতে পাই মানুষজন খুবই বিরস বদনে কিছু না করে চুপচাপ বসে আছে (আজকাল মোবাইল টেলিফোন হয়েছে, তাই হয়তো মোবাইল ফোনে জোরে জোরে কথা বলছে)।

কিন্তু বইপড়ার দৃশ্য খুবই কম। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, যদি-বা কেউ বই পড়ে সেটি হবে কমবয়সী ছেলে বা মেয়ে, বড় মানুষ নয়। বড় মানুষেরা পত্রিকা পড়তে পারে। বড়জোর ম্যাগাজিনে চোখ বুলায় কিন্তু বই পড়ে খুব কম।

সারা পৃথিবীতেই বইয়ের প্রতিশব্দ এখন টেলিভিশন। বইপড়া যে রকম একটা অসাধারণ উঁচুমানের মানসিক প্রক্রিয়া, টেলিভিশন ঠিক সে রকম নিচুমানের মানসিক প্রক্রিয়া! বইপড়ার সময় মস্তিষ্কে যে রকম নানা ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে, টেলিভিশন দেখার সময় তার কিছুই হয় না। আমরা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই সবকিছু আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে যায়।

আমি বেশকিছু কিশোর উপন্যাস লিখেছি। মাঝে মাঝেই টিভির লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই উপন্যাসগুলো থেকে টিভির উপযোগী নাটক বানানোর অনুমতি চান। আমি কখনও তাদের অনুমতি দিই না। বিনয়ের সঙ্গে বলি, যখন কেউ আমার কিশোর উপন্যাসটি পড়ে, তখন সে চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে কল্পনা করে নিতে পারে। যার কল্পনাশক্তি যত প্রবল তার চরিত্রগুলো তত জীবন্ত। কিন্তু যখন সেটি থেকে টেলিভিশনের জন্যে নাটক (বা সিরিয়াল) তৈরি হবে তখন চরিত্রগুলোকে সে আর কখনও কল্পনা করতে পারবে না, সরাসরি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে।

একজন শিশু, কিশোর যদি কল্পনা করা না শিখল তাহলে তার জীবনের পাওয়ার মতো আর কী থাকল? পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, জ্ঞান থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি। এর চাইতে খাঁটি কথা আর কিছু হতে পারে না। জ্ঞান যদি হয় একটা দামি গাড়ি, তাহলে কল্পনাশক্তি হচ্ছে পেট্রল! পেট্রল নামের কল্পনা ছাড়া জ্ঞানের গাড়ি নিশ্চল হয়ে এক জায়গায় পড়ে থাকবে, তাকে দিয়ে কোনো কাজ করানো যাবে না।

যারা টেলিভিশনের জন্যে নাটক তৈরি করতে খুবই আগ্রহী, তখন তারা আমাকে বোঝান বই খুব বেশি মানুষ পড়ে না, কিন্তু সবাই টেলিভিশন দেখে। আমি তখন তাদের উল্টো বুঝাই, সে জন্যেই বই নামে একটা বিষয়কে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, যেন কেউ কেউ সেটা পড়ে অন্যসব সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে বড় হতে পারে।

যারা বই পড়ে তারা অন্য রকম মানুষ। একসময় তারাই দেশ, সমাজ কিংবা পৃথিবীর নেতৃত্বে দেবে। এখন আউট বই পড়ার জন্যে, তারা তাদের বাবা-মা থেকে যতই বকুনি শুনুক, একসময় তারাই হবে গুরুত্বপূর্ণ।

সে জন্যে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি আমার খুব প্রিয় একটি উৎসব। আমি যদি সেখানে যাবার সুযোগ পাই তাহলে হাজার হাজার শিশু-কিশোরকে দেখার সুযোগ পাই যারা অন্যদের থেকে ভিন্ন, যারা বই পড়ে। আমি জানি যারা বড় হয়ে তারাই এই দেশকে চালাবে।

বইয়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে টেলিভিশনের সঙ্গে এখন আরও একটি বিভীষণ যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে কম্পিউটার। কম্পিউটার নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটি তৈরি হয়েছিল কম্পিউট বা হিসাব করার জন্য। এখন মাঝে মাঝেই মনে হয় এটি ব্যবহার করে ‘কম্পিউট’ ছাড়া অন্য সব কাজই করা হয়!

সারা পৃথিবীর সকল মানুষের ভেতরে এখন একটা দুর্ভাবনা কাজ করছে; সেটা হচ্ছে আগে যখন তরুণ প্রজন্ম তার সময়ের একটা অংশ পড়ার জন্যে ব্যবহার করত, বেশিরভাগ সময়েই সেই পড়া ছিল খাঁটি পড়া। এখন সেই পড়ার মাঝে ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে। এখন তারা অনেক সময় নষ্ট করে সামাজিক নেটওয়ার্কের অপ্রয়োজনীয় ‘স্ট্যাটাস’ পড়ে! সেই পড়াটিও ভাসা ভাসা, যেটুকু পড়ে তার চাইতে বেশি দেখে। বিষয়টি নূতন, তাই কেউই সঠিকভাবে জানে না এর ফলাফলটা কী হবে।

যখন কোনো একটা বিষয় সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, তখন সেটা বিশ্লেষণ করতে হয় কমন সেন্স দিয়ে। আমাদের কমন সেন্স বলে, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়। যদি প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করে তখন বুঝতে হবে কোথাও বড় ধরনের সমস্যা আছে। আমার ধারণা সেটি ঘটতে শুরু করেছে। এই ব্যাপারে প্রযুক্তি আমাদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

বই নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই বই নিয়ে বলতে চাই। আমাদের দেশে ফেব্রুয়ারির বই মেলা নামে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটে। কেউ যেন ভুলেও মনে না করে এটা বই বিক্রি করার একটা আয়োজন। এটা মোটেও সেটি নয়। আমরা দেখেছি প্রকাশকেরা বিক্রি বাড়ানোর জন্যে মাঝে মাঝে মেলার সময় বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে ঠেলে মার্চে নিয়ে গেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দর্শকেরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত হইচই করে উৎসাহ নিয়ে মেলায় গিয়েছেন কিন্তু মার্চ মাস আসা মাত্রই তারা মেলায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।

বই মেলার একটা নিজস্ব চরিত্র আছে, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করি। অনেক কিছুই বুঝতে পারি না, শুধু অনুভব করতে পারি। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম, বই মেলাটি যখন ধীরে ধীরে তার বর্তমান রূপটি নিয়েছে আমি আসলে সেটি দেখিনি। তবে সম্ভবত প্রথম উদ্যোগটি আমরা দেখেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে কার্জন হল থেকে হেটে হেঁটে টিএসসি যাবার সময় বাংলা একাডেমিতে উঁকি দিয়ে দেখি কয়েকটা টেবিলে কিছু বই নিয়ে মুক্তধারা নামের একটি প্রকাশনী বসে আছে।

সেই বই মেলা এখন বলতে গেলে বিশাল একটা জাতীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবাই এই মেলার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। ভালো ভালো লেখকেরা শুধুমাত্র বই মেলা উপলক্ষে বই লেখার বিষয়টা একেবারেই পছন্দ করেন না। এর মাঝে সৃজনশীলতার অংশটি কম, কুটির শিল্পের অংশটা বেশি। আমি যেহেতু ভালো লেখকদের দলে নই (বাচ্চাকাচ্চাদের জন্যে লেখার মহা সুবিধে, কেউ সিরিয়াসলি নেয় না, যা খুশি করা যায়!), তাই আমি বই মেলা উপলক্ষে লিখি।

আমি ব্যাপারটি দিয়ে বলতে পারি যদি ফেব্রুয়ারির বই মেলা না থাকত আমার লেখালেখি বলতে গেলে হতই না! পৃথিবীর সব দেশে একজন লেখক তিন-চার বছর সময় নিয়ে একটা বই লিখেন। আর আমাদের দেশের লেখকদের প্রতি বছর তিন-চারটা বই লিখতে হয়।

অন্যদের কথা বলি না, আমার যে লিখতেই হবে আমি সেটা নিশ্চিতভাবে জানি। আমার পাঠক বাচ্চাকাচ্চা, তাদের চাওয়া আসলে সরাসরি হুমকির মতো। তাদের জন্যে কিছু একটা লিখে ফেললে তারা যে ভালোবাসাটুকু দেখায় সেটা এত আন্তরিক যে আমার সেটাকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই বিদগ্ধ খাঁটি লেখকেরা আমাদের মতো মৌসুমী লেখকদের নিয়ে যতই হাসি-তামাশা করেন না কেন, আমি এই বই মেলার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার লেখালেখি হয়েছে এই বই মেলার জন্যে।

বই মেলায় পাঠক-লেখক-প্রকাশক সবারই নিজস্ব এক ধরনের ভাবভঙ্গি থাকে। বড় লোকের ছেলেমেয়েরা মা-বাবাকে নিয়ে আসে, যেটা কিনতে চায় সেটা ঝটপট কিনে নেয়। আবার দরিদ্র মা তার সন্তানকে নিয়ে এসেছে, বাচ্চাটা একটা বই উল্টেপাল্টে দেখছে, চোখে লোভাতুর দৃষ্টি, মা টাকার হিসেব করে ম্লান মুখে বাচ্চাটিকে মাথা নেড়ে নিষেধ করছে, দেখে বুকটা ভেঙে যায়।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এই দেশের মানুষের জন্যে আমাদের দেশের বইয়ের দাম অনেক বেশি। আমার কাছে যখন কেউ এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলে আমি তাদের সঙ্গে একমত হই। সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে আরেকটা কথা মনে করিয়ে দিই। সেটা হচ্ছে কেউ যদি মনে করে সে শুধুমাত্র বই কিনে পড়বে তাহলে কিন্তু সে খুব বেশি বই পড়তে পারবে না। কোনো একটা শখের বই কিনে সংগ্রহে রাখতে পারে কিন্তু বেশিরভাগ বই তাকে পড়তে হবে না কিনে। লাইব্রেরি থেকে এনে কিংবা পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নিয়ে। শৈশবে আমাকে যদি বই কিনে পড়তে হত তাহলে আমি আর কয়টা বই পড়তাম?

কম দামে বই পড়ার এবং সংগ্রহ করার একটা সুযোগ এসেছে, যদিও সেটা সবাই সমান আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেনি। সেটি হচ্ছে ই-বুক। বইটি কাগজে ছাপা বই নয়, বইটি উলেকট্রনিক এবং সেটি পড়তে ল্যাপটপে, ট্যাবলেটে কিংবা ই-বুক রিডারে। এমনকি ভালো স্মার্ট ফোনেও এই বই পড়া সম্ভব।

আমি জানি, অনেকেই আমার কথাটা শুনে নাক কুঁচকে ফেলেছেন, হতাশভাবে মাথা নাড়ছেন এবং বলছেন একটা বই যদি হাত দিয়ে ধরতেই না পারলাম, নূতন বইয়ের ঘ্রাণটাই নিতে না পারলাম, তাহলে সেটি আবার কীসের বই? খুবই খাঁটি কথা। কিন্তু যখন আমি আবিষ্কার করি সারা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় বসে, পৃথিবীর প্রায় যে কোনো বই আমি মুহুর্তের মাঝে নামমাত্র মূল্যে কিনে ফেলতে পারব এবং সেটা বইপড়ার মতো পড়তে পারব– তখন আমার হাত দিয়ে স্পর্শ করার এবং নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেবার সুযোগ না থাকাটা মেনে নিতে এখন কোনো অসুবিধে হয় না।

আমরা যখন কোথাও গিয়েছি আমার ব্যাগে একটা বা দুটো বই থাকত। এখন যখন কোথাও যাই আমার ই-বুক রিডারে শ’খানেক বই থাকে। প্রয়োজনে আরও কয়েক হাজার বই থেকে যে কোনো বই কিনে ফেলার সুযোগ থাকে। কেউ বিষয়টা মেনে নিক আর নাই নিক, নূতন পৃথিবী কিন্তু খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আজ থেকে কয়েক বছর পর সব কাগজের বইয়ের পাশাপাশি এই অদৃশ্য ই-বুক জায়গা করে নেবে। লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান, গবেষণার জগতে এটা আসলে ঘটে গেছে। বিশেষ কিছু বইয়ের বেলায় কাগজের বই এখন অর্থহীন, প্রায় সব জার্নাল এখন ইলেকট্রনিক।

আমরা যারা পুরানো আমলের মানুষ তারা এখনও কাগজের বই আঁকড়ে ধরে রেখেছি কিন্তু নূতন প্রজন্মের মাঝে কোনো গোঁড়ামি নেই, তারা কাটশট নূতন স্টাইলে বই পড়া শুরু করবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ভবিষ্যতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নূতন বই না দিয়ে একটা ট্যাবলেট দেওয়া হবে সেখানে সকল পাঠ্যবই ডাউনলোড করে দেওয়া হবে!

বিষয়টা কিন্তু খুবই অবাস্তব কল্পনা নয়। প্রতি বছর প্রায় তিরিশ কোটি নূতন বই ছাপানো থেকে এটা লক্ষগুণ সহজ কাজ। ছোট শিশুরা নূতন পদ্ধতিতে ঝটপট অভ্যস্ত হয়ে যায়। কাজেই ঠিক করে পরিকল্পনা করে একটা দুটা পাইলট প্রজেক্ট হাতে নিলে এই বিপ্লবটি করে ফেলা যেতেই পারে।

কাজেই সবাইকে মাথায় রাখতে হবে বইয়ের জগতে নূতন একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। যারা পরিবর্তনটুকু গ্রহণ করতে রাজি আছে তারা এ ব্যাপারে থাকবে। অন্যেরা পিছিয়ে যাবে।

আমাদের দেশেও কিন্তু এই উদ্যোগটি নেওয়া শুরু হয়েছে। প্রতি কয়েক বছর আমার কাছে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা এসেছেন, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তারা আমার একটি দুটি বই ই-বুকে পাল্টে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শুরু করেছেন। এ বছরও একাধিক উদ্যোক্তা এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছেন।

বিষয়টা ঠিক কীভাবে অগ্রসর হবে আমরা জানি না। যারা প্রযুক্তিবিদ তারাই কি প্রকাশক হয়ে যাবেন কী না সেটা নিয়েও অনেকের মাঝে সন্দেহ রয়েছে। আমার ধারণা প্রযুক্তিবিদেরা যদি শুধুমাত্র প্রযুক্তির একটা ভিত্তি তৈরি করে দেন আর প্রকাশকেরা কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক বই ছাপানোর দায়িত্ব নিয়ে নেন– তাহলেই এই নূতন বিষয়টা ঘটে যেতে পারে। আমরা অনেক কম খরচে অনেক বই পড়া শুরু করতে পারব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্যে প্রতি বছর আমাদের আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি টাকার বই কিনতে হয়। বিদেশি একটা বইয়ের দাম দশ-পনর হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আইসিটি ইনসটিটিউট তৈরি হচ্ছে। তার লাইব্রেরির জন্যে প্রায় তেরো হাজার বই কেনার অর্ডার দেওয়া হয়েছে। গড়ে একটা বইয়ের দাম পড়েছে মাত্র চল্লিশ টাকা! কারণ বইগুলো ই-বুক।

ইনসটিটিউট তৈরি শেষ হয়নি, লাইব্রেরির দেওয়াল উঠেনি, সেলফ কেনা হয়নি। তের হাজার বই যে কোনোদিন চলে আসবে। বইগুলো কোথায় রাখা হবে সেটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা নেই। বইগুলো উইয়ে খেয়ে ফেলবে কী না সেটা নিয়েও আমার দুশ্চিন্তা নেই। কোনো দুষ্টু ছেলে বইয়ের পাতা কেটে ফেলবে কী না সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই।

আমাদের ডাটা সেন্টারের সার্ভারের হার্ড ড্রাইভে তের হাজার বই রাখতে কিংবা সংরক্ষণ করতে আমার এক চিমটিও বাড়তি জায়গা লাগবে না!

ভবিষ্যতের লাইব্রেরি কেমন হবে সেটি কি সবাই কল্পনা করতে পারছে?

বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড (জানুয়ারি ২৫, ২০১২)

কিছুদিন আগে আমি হিসাব করে দেখলাম, আমাদের দেশে এখন অনেক অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছে। গণিত অলিম্পিয়াড দিয়ে শুরু। তারপর দেখতে দেখতে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড, প্রাণরসায়ন অলিম্পিয়াড, অ্যাস্ট্রোনমি অলিম্পিয়াড, ভাষা অলিম্পিয়াড এবং এমনকি একেবারে শেষ সংযোজন দাবা অলিম্পিয়াড! সবটা যে একই রকম ও আকারে হচ্ছে, তা নয়। কিন্তু শুরু যে হয়েছে_ সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আন্তর্জাতিক গণিত আর ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা এর মধ্যে রীতিমতো মেডেল নিয়ে এসেছে। অন্য কয়েকটাতে পৃথিবীর আসরে বাংলাদেশের নাম সম্মানসূচকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। আমাদের বড় বড় মানুষ, বড় বড় খেলোয়াড়রা যা পারেননি, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে সেটা করে ফেলছে। কী চমৎকার একটা ব্যাপার!

এই চমৎকার ব্যাপারটার মাঝেও কিন্তু আমাদের খানিকটা ক্ষোভ রয়ে গেছে। বড় মানুষেরা যেটা দেশের জন্য করতে পারেননি, ছোট বাচ্চারা সেটা করে ফেলছে। তারপরও এই বিষয়গুলোতে কেন জানি সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যায় না। সরকারের কথা ছেড়েই দিলাম, সামরিক বাহিনীর জন্য সরকারের বিশাল বাজেট। এবার মনে হয় সেটা আরও বেড়ে গেছে। আমাদের কোনো আপত্তি থাকত না, যদি দেখতাম আমাদের শিক্ষা খাতেও বাজেট একইভাবে বাড়ছে। কিন্তু আসলে সেটি ঘটেনি, শিক্ষা খাতে বাজেট কমেছে।

একটি ছাত্র যদি একটু কিছু শেখে, সঙ্গে সঙ্গে দেশ আরও একটু সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপরও শিক্ষার বাজেট কমতে থাকে! আর শিক্ষার পাশাপাশি এই কার্যক্রমগুলো? সেগুলোর জন্য কোথাও কোনো অর্থ নেই! এক গণিত অলিম্পিয়াড ছাড়া অন্য কোনো অলিম্পিয়াডের ভদ্র কোনো বাজেট আছে বলে আমার জানা নেই। কেউ যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলে তারা অবাক হয়ে দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রেই একেবারে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষের অর্থ সাহায্যে এগুলো টিকে আছে! আমার কাছে ব্যাপারটা রহস্যের মতো মনে হয়_ শিশুদের জন্য টাকা খরচ করতে সবার এত কার্পণ্য কেন? একটি ব্যান্ড শো বা একটি ক্রিকেট খেলার জন্য আক্ষরিক অর্থে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু শিশুদের কার্যক্রম চালাতে উৎসাহী মানুষেরা বড় বড় কোম্পানি, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দ্বারে ঘুরতে থাকেন, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায় না। এই দেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতারা এত শিশুবিদ্বেষী কেন? আমি তার অর্থ খুঁজে বের করতে পারি না! কেউ কি কখনও লক্ষ্য করেছেন ঈদে প্রায় কয়েকশ’ নাটক দেখানো হয়, তার মধ্যে বাচ্চাদের নাটক বলতে গেলে একটিও নেই! যদিও এ দেশে শুধু স্কুলের বাচ্চার সংখ্যাই তিন কোটি! ছোট বাচ্চাদের বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই, তাদের জন্য আলাদা কোনো সিনেমা তৈরি হয় না, বই লেখা হয় না। কী আশ্চর্য!

তারপরও আমাদের দেশের বাচ্চারা হচ্ছে আমাদের অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে বই পড়ার একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ চালানো হয়। যারা সেই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত, তারা জানেন সেখানে ছেলেমেয়েরা কী ম্যাজিক করে ফেলছে! বিভিন্ন অলিম্পিয়াডে যারা গিয়েছে, সেখানে বাচ্চাদের যারা একনজর দেখেছে, শুধু তারাই এ দেশের জন্য নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে।

এই শুক্রবার বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের জাতীয় অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হতে যাচ্ছে। সারাদেশ থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এখানে অংশ নেবে। যারা সেই অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়, সেই শিশুরা বেশি আনন্দ পায়, নাকি আমরা যারা সেই শিশুদের দেখি তারা বেশি আনন্দ পাই_ সে ব্যাপারটি এখনও পরিষ্কার হয়নি! দেশ নিয়ে, পৃথিবী নিয়ে কতজনের কত অভিযোগ। কিন্তু এ রকম একটি অলিম্পিয়াডে এসে এই বাচ্চাদের একনজর দেখলে হঠাৎ মনে হয় কিসের দুঃখ, কিসের কষ্ট? যে দেশে এ রকম উৎসাহী শিশুরা এত আগ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানচর্চা করে, সেই দেশ যদি মাথা তুলে না দাঁড়ায়, তাহলে কোন দেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে?

বাংলাদেশ একাডেমী অব সায়েন্সের প্রতি কৃতজ্ঞতা এ রকম একটি অলিম্পিয়াড আয়োজন করার জন্য। সমকালের প্রতি কৃতজ্ঞতা এতে সঙ্গী হয়ে এগিয়ে আসার জন্য। আর দেশের শিশুদের কাছে কৃতজ্ঞতা আমাদের দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-01-25

 বিশ্বজিতের লাল শার্ট (ডিসেম্বর ২০, ২০১২)

আমি মনে হয় বাংলাদেশের অল্প কয়জন সৌভাগ্যবান মানুষের একজন, আমার বাসায় টেলিভিশন নেই বলে আমাকে টেলিভিশন দেখতে হয় না। তাই ডিসেম্বরের ৯ তারিখ যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে খুন করেছে, আমাকে সেই দৃশ্যটি দেখতে হয়নি। যারা দেখেছে, তাদের প্রায় সবারই মানুষ সম্পর্কে ধারণাটি পাল্টে গেছে। রাজনীতি, আইন, আইনের শাসন—এসব বিষয় নিয়ে তাদের অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। সবার ভেতরেই যে একজন করে নিষ্পাপ মানুষ থাকে, সেই মানুষটি ভয়ংকরভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে।

আমি কাপুরুষের মতো টেলিভিশন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু খবরের কাগজ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারিনি। খবরের কাগজের ছবিগুলো না দেখে দ্রুত পৃষ্ঠাগুলো উল্টে ফেলার চেষ্টা করলেও ছবিগুলো আমার মাথায় গেঁথে গেছে, চারপাশে ঘিরে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে হত্যা করছে, সেই মুহূর্তের বিশ্বজিতের চোখের দৃষ্টি আমাদের সবাইকে বাকি জীবন তাড়া করে বেড়াবে, সেই দৃষ্টিতে আতঙ্ক বা যন্ত্রণা ছিল না, একধরনের অসহায় ব্যাকুলতা ছিল, চারপাশে অসংখ্য মানুষ দৃশ্যটি দেখছে, কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না, সেটি নিয়ে হয়তো জগৎসংসারের প্রতি একটা তীব্র অভিমান ছিল। কোনো কোনো ছবিতে বিশ্বজিতের শার্টটি ছিল হালকা সাদা রঙের, আবার কোনো কোনো ছবিতে সেটি ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের, সেটি নিয়েও আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি যখন খবরের কাগজগুলো পড়েছি, ছবিগুলো নতুন করে দেখেছি, তখন আমি বুঝতে পেরেছি বিশ্বজিৎ লাল শার্ট পরেনি, রক্তে ভিজে তার শার্ট লাল হয়েছিল।

দেশের সব মানুষের মতো আমার মনেও অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে, খবরের কাগজ, টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান আর সাংবাদিকেরা শুধু ছবি তুলেই তাদের দায়িত্ব পালন না করে বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি কেন? এত কাছে পুলিশ থাকার পরও তারা এগিয়ে গেল না কেন? যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তখন হিপোক্রেটিক শপথ নেওয়া চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই।

আবার কিছু কিছু ভয়ংকর প্রশ্নের উত্তর আমি অনুমান করতে পারি। যেমন ছাত্রলীগের যে কর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করছিল, তারা দেখেছে চারপাশ থেকে ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলা হচ্ছে, তার পরও তারা কেন ক্যামেরার সামনে এই পৈশাচিক উন্মত্ততায় বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে? কিংবা প্রশ্নটি আরও ভয়ংকরভাবে করা যায়, চারপাশে ক্যামেরা ছিল বলেই কি তারা এত উন্মত্ত হয়েছিল, যেন সবাইকে দেখানো যায় তাদের কত সর্বগ্রাসী ক্ষমতা, কত ভয়ংকর?

বহু বছর আগে কাদের সিদ্দিকী যখন আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করার জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন তখন ছাত্রলীগের কর্মীরা এসে পুরো আয়োজনটি লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। আমি রাজনীতি ভালো না বুঝলেও অন্তত এতটুকু জানি এগুলো রাজনীতিতে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ‘মাঠ দখল’ বা ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’ এই ধরনের বাক্যাংশ দিয়ে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়। (সত্যি কথা বলতে কি, বিএনপি আর জাতীয় পার্টি এই দুটি দলই এই কায়দায় তৈরি হয়েছে, মিলিটারি জেনারেলরা প্রথমে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে, তারপর রাজনৈতিক দল করে গণতন্ত্রের জন্য জায়েজ করেছে) তবে আমার বক্তব্য একটু ভিন্ন জায়গায়, ছাত্রলীগের যে কর্মীরা কাদের সিদ্দিকীর সম্মেলনটি লন্ডভন্ড করেছিল, তারা সেখানেই থেমে যায়নি, তারপর তারা সংবাদপত্র অফিসে গিয়ে নিশ্চিত করেছিল সম্মেলন ভন্ডুলকারী সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে তাদের নামগুলো যেন পত্রিকায় ছাপা হয়। তাদের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে দেশের মানুষ এবং তাদের দলের নেতারা যেন ঠিকভাবে জানতে পারে কারা এই ‘গুরুদায়িত্ব’ সঠিকভাবে পালন করেছে।

আমি পরে অসংখ্যবার এটা দেখেছি এবং এটা শুধু ছাত্রলীগের ব্যাপার নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের এই একই ব্যাপার। সন্ত্রাসী হিসেবে নিজের নাম ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে বিশাল কৃতিত্ব, হলে-হোস্টেলে ফ্রি খাওয়া যায়, কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা যায়, সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা যায় এবং ভবিষ্যতে বড় রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায়। আমার ধারণা, বিশ্বজিতের বেলাতেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে। তাকে সবাই মিলে যখন কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তখন তারা একবারও ভাবেনি সেটি গোপনে করতে হবে, এটি ছিল একধরনের বীরত্ব প্রদর্শন এবং ছাত্রলীগের কর্মীরা ধরেই নিয়েছিল এটা যত মানুষ দেখবে সেটা তাদের তত মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যাবে। আমার ধারণা, টেলিভিশন-ক্যামেরা ইত্যাদি থাকার কারণে তাদের নৃশংসতা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

ছাত্রলীগের কর্মীদের ভাবনা যে মোটেও ভুল ছিল না, আমরা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রমাণ পেয়েছি। একেবারে চোখের সামনে ঘটনা ঘটেছে, সবার নাম-পরিচয় জেনেও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাঁচানোর জন্য পুলিশ মামলা করেছে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নাম দিয়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন হত্যাকাণ্ডে জড়িত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের কারণে ততক্ষণে দেশের সব মানুষ হত্যাকারীদের চিনে গেছে, তাই তারা বিস্মিত হয়ে দেখল আসল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার না করে অন্যদের গ্রেপ্তার করে বসে আছে। ছাত্রলীগের কর্মীদের বাঁচানোর জন্য নতুন জজ মিয়ার নাটক মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে। (সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য মাত্র কিছুদিন আগে এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অন্য মামলার আসামিদের নাম ঘোষণা করেছেন। রামুর ঘটনার জন্য সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের দোষারোপ করেছেন কিন্তু পরের দিন কিংবা তার পরের দিনে আক্রান্ত হওয়া মন্দিরকে রক্ষা করতে পারেননি) পত্রপত্রিকাগুলো লেগে থাকল এবং তখন সত্যিকারের অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হতে শুরু করল।

এখন ভিন্ন একটি নাটক মঞ্চস্থ হতে শুরু করল, সবাই প্রমাণ করতে শুরু করল এই অভিযুক্তরা কেউ ছাত্রলীগের কর্মী নয়। ছাত্রলীগ বলল, এরা তাদের মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে পারে কিন্তু এরা তাদের কর্মী নয়। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বললেন, আওয়ামী লীগকে দায়ী করা যাবে না, এর আগের দিন আনন্দ মিছিলে বোমা পড়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জোর গলায় বললেন এরা ছাত্রলীগের কর্মী নয়। সবচেয়ে হূদয়বিদারক কাজটি করলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব। ঘোষণা দিলেন অভিযুক্তরা সবাই জামায়াত-শিবির, কারণ তাদের আত্মীয়স্বজন জামায়াত-শিবির। (কয় দিন আগে আমি শিবিরের তরুণদের উদ্দেশ করে একটা লেখা লিখেছিলাম, সেটা পড়ে একজন আমার কাছে খুব দুঃখ করে লিখেছে, সে তার বাবা-মাকে ঘৃণা করে; কারণ, তারা জামায়াত করে, সে দেশকে খুব ভালোবাসে) বিশ্বজিতের মতো একজন তরুণের এ রকম একটি মৃত্যুর পর কেন পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এই হত্যাকারীদের রক্ষা করার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না, শুধু এটুকু জানি যে বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা যত বড় অপরাধ, তার হত্যাকারীদের রক্ষা করার চেষ্টা করা তার থেকে অনেক বড় অপরাধ। যারা মনে করে দেশের সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে এত বড় একটা অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে, তারা এই দেশের মানুষকে চেনে না। আমি রীতিমতো অপমানিত বোধ করি, যখন দেখতে পাই এই দেশের সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে দেশের মানুষ নেহাত নির্বোধ—তাদের যেটা বলায় তারা সেটাই বিশ্বাস করে বসে থাকবে! এই দেশে যা কিছু ঘটছে, আমরা সেগুলো শুধু দূর থেকে খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের ভেতর দেখি না, আমরা অনেক সময় নিজের চোখে সরাসরি দেখি, তাই প্রকৃত সত্যটা আমরা খুব ভালোভাবে জানি। তাই যখন কাউকে দেখি সেই সত্যটাকে লুকানোর চেষ্টা করছে বা বিকৃত করার চেষ্টা করছে, সেটা আমাদের কাছে গোপন থাকে না। যত অপ্রিয় হোক, যত ভয়ংকর হোক, যত নিষ্ঠুর হোক সেটাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। তা না হলে সেটা আরও শত গুণ অপ্রিয়, সহস্র গুণ ভয়ংকর আর লক্ষ গুণ নিষ্ঠুর হয়ে ফিরে আসে।

কিছুদিন আগে একজন আমার সঙ্গে রাজনীতি, নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার—এ ধরনের বড় বড় বিষয় নিয়ে কথা বলছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় এই দেশের গণতন্ত্র বুঝি প্রায় একটা কৌতুকের মতো। বিশাল দক্ষযজ্ঞ করে নির্বাচন করে সাংসদেরা একদিনও সংসদে যান না (বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি আর বেতন-ভাতা রক্ষা করার জন্য এক-আধ দিন যেতে পারেন—আমি নিশ্চিত নই)! কাজেই এই দেশে বিরোধী দল হিসেবে সরকারের সমালোচনা করার কেউ নেই। সে জন্য সরকারকে সতর্ক করে গণতন্ত্রকে সচল রাখার পুরো দায়িত্বটি পালন করতে হয় সংবাদমাধ্যমের। আমাদের খুব সৌভাগ্য, আমাদের সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট স্বাধীন এবং এবার আমরা দেখেছি, বিশ্বজিৎকে হত্যা করে সত্যিকারের অপরাধীরা যেন পার না পেয়ে যায়, সেটি এই সংবাদপত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

আমার ধারণা, আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা সংবাদপত্রের এই ‘বাড়াবাড়ি’ দেখে খুব বিরক্ত হচ্ছেন, দেশে প্রতিদিন শত শত খুন হচ্ছে, ক্রসফায়ার হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে একজন ছাপোষা দরজির মৃত্যু নিয়ে এত হইচই করার কী অর্থ? অনেকে নিশ্চয়ই এটাকে দেখছেন পরবর্তী নির্বাচনে তাদের বিজয়ের সম্ভাবনাকে কমিয়ে আনার একটা সুগভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে। সত্য কথাটি হচ্ছে, সম্ভবত সত্যিই আওয়ামী লীগ যেন কিছুতেই পরের নির্বাচনে জিততে না পারে, কিংবা এই মুহূর্তেই যেন তাদের দুর্বল আর বিপর্যস্ত দেখায়, সে জন্য একটা গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং সেই ষড়যন্ত্রটি করছে বিশ্বজিৎ হত্যাকারী ছাত্রলীগ এবং এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টারত আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ ও আমলারা। এই বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি তারা বুঝতে পারবে, দেশের জন্য তত মঙ্গল। আমরা খুব দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চাই। এই দেশকে গ্লানিমুক্ত করতে চাই।

আমি নিজেকে বিশ্বজিতের আপনজনের জায়গায় বসিয়ে পুরো বিষয়টি কল্পনা করার চেষ্টা করে বুঝতে পেরেছি, তাদের পৃথিবীর কোনো মানুষ কোনো দিন সান্ত্বনা দিতে পারবে না। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে বিশ্বজিতের মনের ভেতর কী চিন্তা কাজ করেছিল, আমরা কোনো দিন সেটি জানতে পারব না। তার উদ্ভ্রান্ত ব্যাকুল দৃষ্টি দেখে সেটা শুধু হয়তো কল্পনা করতে পারব। পবিত্র কোরআন শরিফে আছে (৫.৩২) বিনা কারণে যদি কখনো কোনো মানুষকে হত্যা করা হয় তাহলে মনে করা যায় যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করা হলো। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিতে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ সকাল নয়টার সময় পুরান ঢাকায় আমরা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করেছি।

আমি জানি এই তীব্র অপরাধবোধ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। সত্যি যদি কোনোভাবে সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চাই তাহলে কোরআন শরিফের সেই অংশেই পরের লাইনে ফিরে যেতে হবে, যেখানে বলা হয়েছে, যদি কেউ একজনের প্রাণ রক্ষা করে তাহলে সে যেন পুরো মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল।

আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত এই মাতৃভূমিতে সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করার নিশ্চয়তা দেব?

সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-12-20

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

কয়েক বছর আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে একটা ছেলে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল। আমি এই ঘটনার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। শুধু মনে হয় কোনো দূর এক শহর থেকে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে এত দূরে তাকে টেনে আনার ফলেই হয়তো এত অল্প বয়সে মারা যেতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার নামে সবাই মিলে যে ভয়ঙ্কর একটি হৃদয়হীন পদ্ধতি দাঁড় করিয়ে রেখেছে, সেই পদ্ধতিটি কী কোনভাবে এর জন্যে দায়ী নয়? আবারও ভর্তি পরীক্ষা আসছে। আমি জানি, হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে তাদের অভিভাবকদের নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াবে। খাওয়া ঘুম বিশ্রাম দূরে থাকুক, অনেক জায়গায় তাদের একটা বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত থাকবে না।

অথচ এর কোন প্রয়োজন ছিল না। খুব সহজেই ছাত্রছাত্রীদের এই ভয়ঙ্কর অমানবিক ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার সুযোগ ছিল। বাংলাদেশের সব কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যদি রাজি হত তাহলে খুব সহজেই সবাই মিলে একটি (হ্যাঁ মাত্র একটি) চমৎকার মানসম্মত ভর্তি পরীক্ষা নিয়েই এই দেশের সব ছাত্রছাত্রীকে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে বিবেচনা করতে পারত।

এই সরকার আসার পর শিক্ষা মন্ত্রনালয় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে ডেকে সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সেখানে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন এবং আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিষয়টির সম্ভাব্যতা নিয়ে একটা বক্তব্য দিতে। আমি একটু গাধা প্রকৃতির মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে সকল তথ্য উপাত্ত নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। বক্তব্য শুরু করার আগেই অবশ্য টের পেয়েছিলাম, আমার সেখানে হাজির হওয়া বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা হয়েছে! সেখানে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলররা আসেন দেরি করে এবং চলে যান সবার আগে। যাবার আগে বলে যান যে, তাদের বহুল পরীক্ষিত একটা ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু আছে সেটা নড়চড় করার কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। গুরুত্বপূর্ণ ভাইস চ্যান্সেলররা বলেন যে, তারা কঠিন নিরাপত্তার মাঝে ভর্তি পরীক্ষা নেন। সবাই মিলে পরীক্ষা নিলে তাকে কে সেই নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে? একজন ভাইস চ্যান্সেলর খোলাখুলি বলেই ফেললেন, তিনি যদি সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার মতো একটা প্রস্তাব নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যলয়ে ফিরে যান, তাহলে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। বেশিরভাগ ভাইস চ্যান্সেলররা অবশ্য আমার বক্তব্যের মাথামুন্ড কিছু বুঝতে পারলেন না কিংবা বোঝার চেষ্টাও করলেন না। আমার ছেলেমানুষী বক্তব্য শুনে হতাশভাবে মাথা নাড়তে থাকলেন।

শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজের মতো করে ভর্তি পরীক্ষা নিতে থাকল। আমার ধারণা বিষয়টা আরো খারাপ হলো। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মনে হয় প্রায় রাগ করেই ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যে নির্ধারিত পরীক্ষার দিনগুলোতে ইচ্ছেমতো তাদের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ফেলতে লাগল। এতে বাধ্য হয়েই ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেষ মুহুর্তে তাদের পরীক্ষার তারিখ পাল্টালো। আমি জানি আমাদের পরপর দুই বছর কুয়েট (খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) -এর সাথে একই দিন পরীক্ষা নিতে হয়েছে। যে সব ছেলেমেয়েদের এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েই পরীক্ষা দেয়ার আগ্রহ ছিল তারা মন খারাপ করে, ক্ষুদ্ধ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশা ছেড়ে অন্য একটিতেই পরীক্ষা দিতে বাধ্য হলো।

কিছু দিন আগে ইউ.সি.জি. থেকে আবার সকল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার সম্ভব্যতা আলোচনা করার জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ন্যাড়া দুইবার বেল তলায় যায় না। কিন্তু এটি আমার প্রিয় বেল, তাই ন্যাড়া হয়েও আবার বেলতলায় গিয়েছিলাম। আমি এবারে খানিকটা কৌতুক এবং অনেকখানি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিই সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে বক্তব্য দিলেন। শুধু তাই নয়, কখন কীভাবে এই পরীক্ষাটি নেয়া যায় সেই খুঁটিনাটি নিয়েও দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হলো এবং আমি যেহেতু নির্বোধ প্রকৃতির, তাই আবার একটু আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম!

দেখতে দেখতে আবার ভর্তি পরীক্ষার সময় এসেছে এবং দেখা গেল অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। সব বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের নিজেদের ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। কেউ কেউ বরং উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সন্তুষ্ট না থেকে প্রত্যেকটা বিভাগের জন্য আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিন্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এই দেশে হতভাগ্য ছাত্রছাত্রীদের নিপীড়ন করার জন্য এরচেয়ে নির্মম কিছু আবিষ্কার করা যায় কী না আমার সেটি জানা নেই।

এই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি কোনোই পরির্তন হয়নি, সেটি অবশ্যি পুরোপুরি সত্যি নয়। খুব ছোট একটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা এত ছোট যে, হয়তো কারো চোখেই পড়বে না। কিন্তু আমার ধারণা পরিবর্তনটা গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি খুলে বলা যাক, কিছুদিন আগে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে তাদের সমাবর্তন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল (আমার জন্যে সেটি ছিল অনেক বড় একটা দায়িত্ব এবং অবশ্যই অনেক বড় সম্মান।)। সমাবর্তনের পুরো অনুষ্ঠান শেষ করে যখন ফিরে আসছি তখন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর আমাকে বললেন, ‘আমরা তো অনেকদিন থেকেই সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা ভর্তি পরীক্ষার জন্যে চেষ্টা করে আসছি, কথা-বার্তা হচ্ছে কিন্তু কোন কাজ তো হচ্ছে না। শুধু আমরা আর আপনারা মিলে একটা যৌথ ভর্তি পরীক্ষা করলে কেমন হয়? একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যায়, তার একটা উদাহরণ তৈরি হোক।’ আমি বললাম- ‘চমৎকার আইডিয়া। আপনার প্রস্তবটা আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাব, দেখি সবাইকে রাজি করানো যায় কী না।’

নিজেদের প্রশংসা করা ঠিক না, তারপরও বলছি- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ভবিষ্যৎ মুখী, অনেক আধুনিক। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবটা আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলে উপস্থাপন করা মাত্রই সবাই সেটি লুফে নিল। আমি সেটি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়কে জানালাম এবং তখন তারা খুঁটিনাটি আলাপ-আলোচনা করার জন্য তাদের কয়েকজন ডিন, বিভাগীয় প্রধান, সিনিয়র শিক্ষক, তরুণ প্রযুক্তিবিদ নিয়ে সারারাত গাড়ি চালিয়ে যশোর থেকে সিলেটে হাজির হয়ে গেলেন।

সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য আমরা যে পদ্ধতিটি গ্রহণ করতে যাচ্ছি সেটি এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, যেন এর কারণে কোন বিশ্ববিদ্যালয়কেই তাদের প্রচলিত কোনো নিয়মকেই পরিত্যাগ করতে হবে না। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম পুরোপুরি রক্ষা করেই এই সুযোগটি নিতে পারবে। সেটি সম্ভব হয়েছে তার কারণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিভাগীয় বিষয় নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয় না। ঘুরে-ফিরে সবসময়েই ছাত্রছাত্রীর এইচ.এস.সি.‘র বিষয়গুলোর উপর পরীক্ষা নেওয়া হয়। অর্থাৎ যে ছাত্রটি কম্পিউটার সায়েন্স কিংবা ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্যে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে তাকে তার কম্পিউটার সায়েন্স বা ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তার জ্ঞানের পরীক্ষা করা হয় না। পরীক্ষা করা হয় তার এইচ.এস.সি. ‘র পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত, রসায়ন, ইংরেজি ইত্যাদি বিষয়ের উপর দক্ষতা। যদি এইচ.এস.সি. পরীক্ষা সত্যি সত্যি ছাত্রছাত্রীর সত্যিকারের মেধা যাচাই করতে পারত এবং ফলাফল মাত্র কয়েকটা গ্রেডের মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলা না হত তাহলে আলাদাভাবে আমাদের কোনো ভর্তি পরীক্ষা নেয়ারই প্রয়োজন ছিলো না। যেহেতু আমরা এইচ.এস.সি. পরীক্ষার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে পারি না । তাই সেই এইচ.এস.সি.‘র বিষয়গুলোই নতুন করে নিজেদের মতো করে পরীক্ষা নেই। কাজেই সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার মূল ধারনাটি হচ্ছে এইচ.এস.সি. পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর পরীক্ষা নিয়ে নেয়া। তারপর যে বিশ্ববিদ্যালয় মার্কস যেভাবে ব্যবহার করতে চায়, তাদেরকে সেভাবে ব্যবহার করতে দিয়ে মেধা তালিকা তৈরি করে দেওয়া হবে। এক সময় এটা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল, কম্পিউটারের কারণে এখন এটা পানির মতো সহজ। এটি যুগান্তকারী নতুন কোনো ধারণা নয়। SAT বা GRE -তে ঠিক এরকমভাবেই পরীক্ষা নেওয়া হয়। আমাদের একটা বাড়তি সুবিধা রয়েছে, টেলিটক মোবাইল ফোনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের এস.এস.সি. বা এইচ.এস.সি. এর মার্কসগুলো সরাসরি পেয়ে যাই। যে বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে এই মার্কস ব্যবহার করতে চায়, তারা সেটি করতে পারবে। (আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম যখন শুধু একটি এস.এম.এস. দিয়ে রেজিস্ট্রেশনের পুরো প্রক্রিয়া শেষ করার পরিকল্পনা করেছিলাম, তখন বনেদী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের অনেকরকম ভয়ভীতি দেখিয়েছিল। এখন দেখি তারাও আনন্দের সাথে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে যাচ্ছে।)

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এক সাথে পরীক্ষা নেওয়ার একটা বড় সুবিধা হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার সময় শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে খুশি থাকতে হবে না, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বসে প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন। সেজন্য হয়তো তাদের দুই একদিন এক সাথে বসতে হবে কিন্তু কোনো শিক্ষকরাই সেটা করতে আপত্তি করবেন না।

এই পদ্ধতিটি গ্রহণ করা হলে সবচেয়ে বড় লাভ হবে ছাত্রছাত্রীদের। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে। যার অর্থ সারাদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসতে হয়। এই বছর তাদের কষ্ট অনেক কমে যাবে। সেই উত্তর বঙ্গের ছাত্রছাত্রীদের কষ্ট করে সিলেট আসতে হবে না। তারা কাছাকাছি যশোর ক্যাম্পাসেই পরীক্ষা দিতে পারবে। ঠিক সেরকম সিলেট এলাকার কোনো ছাত্রছাত্রী যদি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, তাকে আর কষ্ট করে যশোর যেতে হবে না। তারা সিলেট বসেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের জন্য বিবেচিত হতে পারবে।

আমাদের এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নভেম্বরের শেষে (৩০ নভেম্বর)। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। আমাদের তরুণ শিক্ষকেরা সবকিছু গুছিয়ে রেখেছেন। আমরা ইচ্ছে করলেই নেটে দেখতে পারি- কত জন এখন পর্যন্ত এই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষা দিতে রেজিস্ট্রেশন করেছে। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া শেষ হতে এখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি। এর মাঝে আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রতি দশজনের মাঝে একজন ঠিক করছে তারা যশোর বসে সিলেটের জন্যে কিংবা সিলেটে বসে যশোরের জন্যে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। যার অর্থ ভর্তি পরীক্ষার সময় বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায়, না ঘুমিয়ে না খেয়ে না বিশ্রাম নিয়ে আসতে হবে না। ভবিষ্যতে যদি আমাদের এই উদ্যোগের সাথে আরও বিশ্ববিদ্যালয় যোগ দেয় তাহলে কী চমৎকার একটা ঘটনাই না ঘটবে।

২.

আমাদের বিশ্বাস, আমরা যে উদ্যোগটি নিয়েছি সেটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভোগান্তি কমানো সম্ভব, সেটি হয়তো এবারে প্রমাণ করা যাবে। অবশ্য এটি নতুন করে প্রমাণ করার কিছু নেই, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় বহুদিন থেকে এটি করা হচ্ছে। শুধু মেডিকেল কলেজের জন্য এটি করা হয় তা নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিবছর সারা দেশের অসংখ্য কলেজে তিন চার লক্ষ ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি পরীক্ষা নেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন আমি সরাসরি নিজের চোখে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষতার সাথে এই পরীক্ষাটি চালিয়ে আসছে। যার অর্থ বাংলাদেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে হলে যে কাজগুলো করতে হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নীরবে প্রতিবছর সে কাজগুলো করে আসছে। অথচ মজার ব্যাপার হলো, আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যম কখনোই এই বিশাল প্রক্রিয়াটি দেশের মানুষের নজরে আনেনি। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যম খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক খবরগুলো বের করে সেটা ফলাও করে প্রচার করতে পছন্দ করে। তাদের সত্যিকারের ইতিবাচক সংবাদটিও কাউকে জানাতে আগ্রহী হয় না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশের হাই-ফাই ইউনিভার্সিটির হাই-ফাই গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় সবাই কিন্তু দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশটি চালাচ্ছে কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গ্র্যাজুয়েটরা। অথচ সংবাদ মাধ্যমের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কোনো সমবেদনা নেই, কোনো মমতা নেই। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে। দেশের সরকার যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটু গুরুত্ব দিয়ে তাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে দিতে আগ্রহী হত, তাহলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর নয়, আমাদের নিজের দেশের অনেক বড় উপকার হত!

৩.

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শেষ হওয়া মানেই সব সমস্যার সমাধান নয়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অল্