[কবিতার প্রথম দুটি লাইন এ রকম:
ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম, শুনে লাগে খটকা,
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!]
তবে শব্দকল্পদ্রুম এর আরও একটি পরিচয় আছে, দ্রুম মানে বৃক্ষ বা গাছ। কল্পদ্রুম বা কল্পতরু মানে এমন একটি গাছ যার কাছে যাই চাওয়া যায় সেটাই পাওয়া যায়।
তাই শব্দকল্পদ্রুম মানে শব্দের একটি কল্পতরু– অর্থাৎ তার কাছে যে কোনো শব্দ চাইলেই সেই শব্দটি পাওয়া যাবে! সোজা কথায় সেটি হচ্ছে অভিধান বা ডিকশনারি। সত্যি কথা বলতে কী, ধারাকান্ত দেব নামের একজন খুব জ্ঞানী মানুষ চল্লিশ বছর খাটাখাটনি করে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে শব্দকল্পদ্রুম নামে একটা বাংলা অভিধান তৈরি করেছিলেন। আমাদের বাংলা বানান প্রতিযোগিতার নামকরণ করার পর আমরা আবিষ্কার করলাম, ঠিক এই নামে হায়াৎ মাসুদ একটা অসাধারণ বই লিখেছেন। শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা শেখার জন্যে এই দেশের কিশোর-কিশোরীদের এর থেকে চমৎকার কোনো বই আমার চোখে পড়েনি।
তথ্যপ্রযুক্তির কারণে সারা পৃথিবীতেই বানানের একটা সর্বনাশ হয়ে গেছে। একটা সময় ছিল যখন কিছু একটা করতে চাইলে বানানটি শুদ্ধভাবে লিখতে হত– আজকাল তার আর দরকার হয় না। ভুল-ভাল একটা বানান লিখলেও সার্চ ইঞ্জিনগুলো ঠিক-ঠাক উত্তর দিয়ে দেয়। অন্যদের কথা জানি না– আমি নিজেও ‘গুগল’ ব্যবহার করতে হলে শুদ্ধ বানান লেখার জন্যে এত ব্যস্ত হই না– আলাসেমি করে কাছাকাছি একটা লিখে বসে থাকি!
বাংলার জন্যেও আকজাল সেটা ঘটতে যাচ্ছে। তাই আমরা ঠিক করেছি আমাদের পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিনে কেউ ভুল বানান লিখলে তাকে অন্ততপক্ষে শুদ্ধ বানানটি জানিয়ে দেওয়া হবে। এক অর্থে পিপীলিকা সার্চ ইঞ্জিনকে ইচ্ছে করলে বাংলা অভিধান কিংবা ‘শব্দকল্পদ্রুম’ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
[কাজটি অনেক সহজ হত, যদি বাংলা একাডেমি তাদের অভিধানের শব্দগুলো আমাদের ব্যবহার করতে দিত। এখন আমাদের প্রায় বিশ হাজার শব্দ নূতন করে টাইপ করতে হচ্ছে।]
এটি সত্যি একসময় ভাষার জন্যে সকল কাজকর্ম গবেষণা করতেন ভাষাবিদেরা, আজকাল তার পরিবর্তন হয়েছে– এখন তথ্য-প্রযুক্তিবিদেরাও ভাষার জন্যে কাজ করেন। আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই যখন দেখি বাংলাকে কম্পিউটারে ব্যবহারের উপযোগী করার জন্যে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা বাংলা ভাষার বিচিত্র বিচিত্র দিকের রীতিমতো বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছে! সে সমস্ত বিষয়গুলো শুধুমাত্র ভাষাবিদেরা জানতেন, যেগুলো নিয়ে কথা বলতেন, আজকাল আমার ছাত্রছাত্রী কিংবা তরুণ শিক্ষকেরা সেগুলো নিয়ে কথা বলেন– দেখে খুব ভালো লাগে।
তবে সত্যি সত্যি যদি বাংলা বানান প্রতিযোগিতার জন্য সত্যিকারের একটা উদ্যোগ নিতে হয় তাহলে সেখানে আমাদের দেশের বড় বড় ভাষাবিদ-লেখক-সাহিত্যিকদের একটু সাহায্য নেওয়া দরকার। দেশের বড় বড় মানুষেরা বড় বড় কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই ধরেই নিয়েছিলাম তাদের সমর্থন পাব কিন্তু তাঁরা হয়তো সত্যিকার অর্থে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না।
কিন্তু আমি খুব বিম্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম, এই দেশের বড় বড় ভাষাবিদ-কবি-সাহিত্যিক-লেখকেরা আমাদের অনেক সময় ছিলেন। তাঁদের সাথে কথা বলে
‘শব্দকল্পদ্রুম’ কে শুধু বানানের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলা ভাষার জন্যে ভালোবাসার একটা উদ্যোগ হিসেবে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা করা হল। শুধুমাত্র ঢাকা শহরে না করে সারা দেশে করার ইচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা কেমন হবে তার কোনো ধারণা নেই। তাই পরিকল্পনা করা হল প্রথমে চট্টগ্রামে একটা পরীক্ষামূলক পর্ব করে দেখা হবে, সেই অভিজ্ঞতা যদি ভালো হয় তখন সারা দেশে তার আয়োজন করা যেতে পারে।
গত শুক্রবার ১৭ অক্টোবর এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে শনিবার দিনব্যাপী চট্টগ্রাম শহরের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে শব্দকল্পদ্রুম এর আয়োজন করা হল। অন্যদের কথা জানি না, এই দুটি দিন অসংখ্য শিশু-কিশোরের সাথে থেকে আমি অপূর্ব কিছু সময় কাটিয়েছি।
আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ স্যার এই দেশের শিশু-কিশোরদের কাছে খুব প্রিয় একটি নাম, তাঁকে কোনোভাবে একটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত করাতে পারলেই সেই অনুষ্ঠান সফল হয়ে যায়। শব্দকল্পদ্রুম এ শুধু আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদ স্যার নন, শিশু-কিশোরদের প্রিয় লেখক আলী ইমাম এবং ভাষাবিদ হায়াৎ মাসুদও ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলেন!
অনুষ্ঠানের শুরুতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার উপস্থিত প্রায় বারোশত শিশু-কিশোরদের সাথে গল্প করে আমাদের মাতৃভাষার কথা বললেন। সাধারণত তাঁর বক্তব্যের পর অন্য কেউ কথা বলতে সহস পায় না, কিন্তু আমাদের অনুষ্ঠানে একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটে গেল। তাঁর বক্তব্যের পর হুইল চেয়ারে বসে বসে সাবরিনা সুলতানা শিশু কিশোরদের বোঝালো কেন আমাদের দেশে হুইল চেয়ারে বসে থাকা শিশুই হোক, কিংবা বাক বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুই হোক, সবারই স্কুলে যাবার অধিকার আছে।
সাবরিনা সুলতানা এত সুন্দর করে কথা বলেছে যে, সব শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা শুনেছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এই শিশুগুলো যখন বড় হবে, বড় বড় দায়িত্ব নেবে তখন অন্তত তারা এই দেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেবে।
শব্দকল্পদ্রুম এ বানান এবং ভাষার মজার মজার অনেক কিছু নিয়ে ঘণ্টাখানেকের একটা লিখিত পরীক্ষার মতো হয়েছিল। বাংলাদেশের শিশুদের জন্যে এই ধরনের অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, নানা ধরনের অলিম্পিয়াড হয়। তবে আমার ধারণা, এই প্রথম একটি প্রতিযোগিতায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এবং ব্রেইলে উত্তর লিখে দিয়েছে। আমার খুব আনন্দ হয়েছে যখন দেখেছি তাদের বাংলা বানানের জ্ঞান অন্যান্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় যথেষ্ট ভালো।