৪.
এবারে একটু আওয়ামী লীগের কথা বলি। গত নির্বাচনের ফলাফলের দিনটি ছিল আমাদের মত মানুষের জন্যে খুব আনন্দের একটি দিন। সেদিন এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, যুদ্ধাবরাধীদের বিচারের পক্ষে, ডিজিটাল বাংলাদেরর পক্ষে- এক কথায় একটা আধুনিক বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছিল। দেশের মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা আর স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের যাত্রা শুরু করেছিল- (আরো একবার আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের অনেক আশা ভরসা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে)। বাংলাদেশ মানেই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বপ্ন দেখা সেই দেশ, তাই যখন বাংলাদেশকে কেউ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ঠিক করে দেখা থেকে সরিয়ে অন্য পথে নেয়ার চেষ্টা করে তখন দেশটা আর বাংলাদেশ থাকে না। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সেই স্বপ্ন থেকে সরে এসেছে- কোনো দল জামাতে ইসলামীকে সহযোগী হিসেবে নিলে সেটি আর মুক্তিযোদ্ধকে ধারণ করতে পারে না কাজেই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বটি এখন পুরোপুরি আওয়ামী লীগের উপর। প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ সেই দায়িত্বটি নিতে রাজী কি না (আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করিনি “প্রস্তুত” কী না- আমি জিজ্ঞেস করেছি “রাজী” কী না!) আমরা আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখেছি তাতে মনে হয় তারা সেই দায়িত্বটি নিতে আর আগ্রহী নয়। ৭১ সালে তারা দায়িত্ব নিয়েছিল, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন আর যুদ্ধ করার সুযোগ নেই এখন দায়িত্ব নিতে হলে ভোট পেতে হবে, ভোট পেতে হলে সম্ভাব্য ভোটারদের খুশী রাখতে হবে- আমরা সবাই দেখছি তারা হিসেব করে যে কাজগুলো করছে সেগুলো হচ্ছে ঠিক তা উল্টো। কয়েকটা উদাহরণ দিই।
শুরু করতে হবে প্রফেসর ইউনুসকে দিয়ে। প্রফেসর ইউনুস সারা পৃথিবীর মাঝে একজন অত্যন্ত সম্মানী মানুষ। তিনি শুধু যে ২০০৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তা নয়, কিছুদিন আগে তাকে স্টীভ জবস, বিল গেটস কিংবা গুগল বা ফেসবুকের প্ররর্তকদের মত সমান কাতারের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি (আশির দশকেই আমি একটা লেখায় তার নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম) কাজেই তাঁর সম্পর্কে আমার লেখায় যুক্তিতর্ক খুঁজে লাভ নেই! কিন্তু প্রফেসর রেহমান সোবহান তার লেখায় লিখেছিলেন এই মানুষটি সারা পৃথিবীর অল্প কয়েকজন মানুষের ভেতর একজন যিনি যে কোনো সময় পৃথিবীর যে কোন রাষ্ট্রনায়কদের সাথে টেলিফোন তুলে কথা বলার অধিকার রাখেন। কাজেই বাংলাদেশের উচিৎ হবে এই অসাধারণ সুযোগটি দেশের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করা। আওয়ামী লীগ সরকারের এই সুযোগ গ্রহণ করা তো দূরের কথা- তারা তাদের সকল শক্তি নিয়োগ করেছে তাকে অপমান করার জন্যে। হিলারী ক্লিনটন ঘুরে যাবার পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রফেসর ইউনুস সম্পর্কে যে ভাষায় কথাগুলো বলেছেন সেগুলো পড়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে আতঙ্ক অনুভব করেছি। সম্মানী মানুষ সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বললে তার সম্মানের ক্ষতি হয় না। কিন্তু কথাগুলো বলে একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তার নমুনা আমাদের সামনে তুলে ধরলেন সেটা দেখে কী দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের আতংক হতে পারে না?
প্রফেসর ইউনুস আসলেই “রক্তচোষা” “মহাজন” কী না আমি সেই কুতর্ক শুরু করতে চাই না- শুধু বলতে চাই এই দেশে তার তৈরী করা গ্রামীন ব্যাংকের প্রায় এক কোটি সদস্য এবং তাদের আত্মীয় স্বজন মিলে কয়েক ককোটি মানুষ আছে যাদের সবাই ভোটার। এই দেশের প্রায় সত্তুর আশি লক্ষ মানুষ বিদেশে থাকে তারাও ভোটার (ভোটের সময় তারা আসলে ভোট দিতে পারেন কী না সেটি আবশ্যি ভিন্ন প্রশ্ন)।
এই দেশের তরুণেরা প্রায় কয়েক কোটি- তাদের একটা বড় অংশ ভোটার! আমি যে তিনটি দলের মানুষের কথা বলেছি তাদের প্রত্যেকে প্রফেসর ইউনুসকে পছন্দ করেন এবং যখন তাদের অসম্মান করা হয়েছে তারা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছে। যে দল ভোটের রাজনীতি করে সেই দল এক সাথে এতো ভোটারকে এতো দক্ষতার সাথে অন্য কোনোভাবে বিরক্ত করেছে বলে আমার জানা নেই- কী কারণে সেটা করেছে তার কারণটা আমি এখনো জানি না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনুসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট করার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা না করে তাঁকে যদি তার অফিসে সুধুমাত্র একবার চা খেতে ডাকতেন তাহলেই এদেশের কতো মানুষের বুকের ভার যে লাঘব হতো সেটা কী তারা জানেন?
বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লক্ষ আদিবাসী রয়েছে (মতান্তরে ৪০ লক্ষ)। তবে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার হঠাৎ করে একদিন ঠিক করেছে তাদেরকে আর আদিবাসী বলা যাবে না, তাদেরকে উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃতাত্বিক গোষ্ঠী বা এই ধরণের আরো কঠিন এবং অসম্মানজনক কিছূ বলতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকার কেন এই সিদ্বান্ত নিয়েছে সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। লোকমুখে শুনেছি এই সিদ্বান্তের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একটা চাপ রয়েছে, জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরীতে সেনাবাহিনী যেতে পারবে কী পারবে না এই নামকরেণের সাথে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের মানুষজনের সাথে এ ব্যাপারে নিরিবিলি কথা বলার ষেষ্টা করলে তার ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক শুরু করে দেন- কিন্তু এতোদিন কেন তাহলে তাদের আদিবাসী বলা হল, হঠাৎ করে কেন আর তাদের আদিবাসী বলা যাবে না সেটা ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। কেনো একটা কিছু বোঝাতে যখন একটা শব্দ ব্যবহার করা রেওয়াজ হয়ে যায় তখন সেটাই যে প্রচলিত হয়ে যায় এই সোজা কথাটা কে বোঝাবে? কিছুদিন আগে আমার চোখে একটা সরকারী সার্কুলারের অনুলিপি চোখে পড়েছে যেখানে বলা হয়েছে আগস্ট মাসকে শোকের মাস দেখিয়ে আদিবাসী দিবসকে উদযাপন করতে যেন সব মহলকে নিরুৎসাহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডকে এরকম কূটকৌশলে একটা হীন কাজে ব্যবহার করা হবে সেটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না! যাই হোক, যে সরকারকে ভোটে জিতে আসতে হবে তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে হবে, চল্লিশ লক্ষ আদিবাসী অন্ততপক্ষে বিশ লক্ষ ভোটার! এতোগুলো ভোটারকে এতো অবলীলায় ক্ষুব্ধ করে তোলার উদাহরণ আর কোথায় পাওয়া যাবে?
একসাথে দেশের অনেক মানুষকে ক্ষুদ্ধ করে তোলার আরেকটা সহজ উপায় কী হতে পারে? সেটা হচ্ছে ঈদে যেন মানুষজন তাদের বাড়ীতে যেতে না পারে তার ব্যবস্থা করে দেয়া। এই সরকারের আমলে ঠিক এই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ঈদের আগে আগে দেখা গেল রাস্তাঘাটের অবস্থা এতো খারাপ যে সেই পথে কোনো বাস যেতে পারছে না। আমরা দেখতে পাই ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে নানা ধরণের উড়াল সেতু ফ্লাইওভার তৈরী হচ্ছে, একটি নয় দুই দুইটি পদ্মা সেতু তৈরী নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার আলোচনা হচ্ছে (তার প্রস্তুতির জন্যে নিশ্চয়ই এর মাঝে কয়েকশত কোটি টাকা খরচ পর্যন্ত হয়ে গেছে) কিন্তু সাধারণ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ী যেতে পারছে না- এর চাইতে দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে? দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন কাজেই রসিক বাঙ্গালী এখন ভাঙ্গাচোরা বেহাল রাস্তাঘাট বোঝানোর জন্যে বলে “আবুলী রাস্তা”! ডিকশনারীতে একটা নূতন শব্দ যোগ করে আমাদের বাংলা ভাষা হয়তো একটু সমৃদ্ধ হল কিন্তু ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হল কী? বিষয়টা আরো গুরুতর হয়ে গেল যখন দেখা গেল রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্যে টাকার বরাদ্দ আছে কিন্তু সেই টাকা খরচ করে রাস্তাঘাট ঠিক করার জন্যে কারো গরজ নেই। কারণটা বোঝার জন্যে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না- দেশের ভেতরকার রাস্তাঘাট তৈরীতে পয়সা কড়ি নেই, বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার, বড় বড় পদ্মা সেতুতে অনেক টাকা পয়সা। কাজেই উৎসাহটা সেখানেই বেশী।
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ অনেকদিন থেকে আলোচনার মাঝে রয়েছেন। আমাদের দেশের দূর্নীতির খবর সাধারণত দেশের ভেতরেই থাকে। আমাদের এই মন্ত্রীর কারণে দূর্নীতির খবরটি মোটামুটিভাবে একটা আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দেশের সরকারের সাথে উত্তপ্ত চিঠি চালাচালি হইচই, উইকিলিকস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির অত্যন্ত অসম্মানজনক বক্তব্য বের হয়ে আসছে, কানাডার কোর্টে মামলা হয়ে রায়ে বের হচ্ছে যেখানে মন্ত্রী মহোদয়ের ফার্মের সাথে যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া গেছে, সব মিলিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ লেজে গোবরে অবস্থা। পদ্মা সেতুর টাকা আটকে গিয়েছে- যে পদ্মা সেতু দেখিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে পারত, সেই পদ্মা সেতু কেলেংকারীতে এখন তাদের মুখে চুনকালি লাগানোর অবস্থা। সরকার যদিও ভাঙ্গা রেকর্ডের মত “কোনো দূর্নীতি হয়নি” বলে যাচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষের আসল সত্যটি বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। মন্ত্রী মহোদয়ের কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে চলে গেছেন। এই বিষয়টা থেমে যাবার আগেই আমাদের রেলমন্ত্রী সুরন্জিত সেনগুপ্তের নাটক মঞ্চস্থ হল। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গেছে মন্ত্রী মহোদয়ের কোনো দোষ নেই, কিন্তু দেশের কতোজন মানুষ এই রিপোর্টটাকে বিশ্বাস করে?
রাজনৈতিক নেতারা এতো কিছু বুঝেন কিন্তু কেন জানি একটা অত্যন্ত সহজ জিনিষ বুঝেন না- আসলে কি ঘটেছে তার থেকে অনেক-অনেক-অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাটি কী। কাগজে কলাম অনেক কিছু লিখে ফেলা যায়, অনেক কিচ্ছু প্রমাণ করা যায়- কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের ধারণার কোনো পরিবর্তন হয় না। দূর্নীতির ছাপ “পার্মানেন্ট ইংক” এর ছাপের মতন, একবার লেগে গেলে শতবার ঘষেও তোলা যায় না। যাদের উপর এই ছাপ পড়েছে তাদের সরে যাওয়া ছাড়া এর আর কোন বিকল্প নেই।
“আবুলী” রাস্তার কথা যেহেতু বলা হয়েছে “শাহজাহানী” ড্রাইভারের কথা বলা না হলে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের রাস্তাঘাট পৃটিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা, যুদ্ধের মাইন ফিল্ড থেকে এটি কোনো অংশের কম নয়। এর প্রধাণ কারণ হচ্ছে ড্রাইভারেরা- তারা যেভাবে গাড়ী চালায় (কিংবা মালিকদের চাপে যেভাবে চালাতে বাধ্য হয়) সেটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের জন্যে সৃষ্টিকর্তার এক ধরণের মায়া আছে তা না হলে প্রতিদিন রাস্তাঘাটে আরো অসংখ্য মানুষ মারা যেতো। আমাদের জিডিপি ৬ নাকি ৭ এ নিয়ে তুমুল তর্ক বিতর্ক চলছে অথচ কেউ খেয়াল করে না যে সড়ক দূর্ঘটনার কারণে আমাদের দেশের জিডিপির ১ থেকে ২ অংশের অপচয় হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির সাথে সড়ক দূর্ঘটনার এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিন্তু সেটি নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই, দেখে খুব কষ্ট হয়। হঠাৎ করে যখন সবার খুব প্রিয়জন যিনি একই সাথে দেশের সম্পদ, অর্থহীন গাড়ী একসিডেন্টে মারা যান তখন সারা দেশে সেটা নিয়ে হই চই শুরু হয়ে যায়। সেই সময় যখন আমাদের নৌপরিবহন মন্ত্রী সড়ক দূর্ঘটনার নায়ক ড্রাইভারদের আরো সহিংস হতে উৎসাহ দিয়ে কথাবার্তা বলেন তখন সেগুলো এই দেসের সব মানুষের একেবারে স্নায়ুতে গিয়ে কামড়ে ধরে। শাহজাহান খানের দেয়া উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে যখন কোনো ড্রাইভার বেপরোয়াভাবে রাস্তায় গাড়ী চালায় তাদের নূতন নামকরণ হয়েছে “শাহজাহানী” ড্রাইভার। ডিকশনারীতে একটা নূতন শব্দ আওয়ামী লীগের কতোগুলো ভোটকে নষ্ট করে সেই হিসেবটা কেউ কী করছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় মাথা ব্যাথার কারণ হচ্ছে স্টক মার্কেট। আমি আগেই বলে রাখি স্টক মার্কেট কীভাবে কাজ করে আমি সেটা জানি না। চেষ্টা করলে বিষয়টা যে বুঝতে পারব না তা নয়, কিন্তু আমার বোঝার কোনো আগ্রহ নেই। বেঁচে থাকতে হলে মানুষকে টাকা পয়সা রোজগার করে সংসার চালাতে হয় এবং সেজন্যে পরিশ্রম করতে হয়। কোনো পরিশ্রম না করে শুধুমাত্র টাকা পয়সা নাড়াচাড়া করে কেউ যদি টাকা উপার্জন করে তখন আমার কাছে মনে হয়ে এর মাঝে কিছু একটা গোলমাল আছে। যেহেতু সারা পৃথিবীই এই গোলমালকে মেনে নিয়ে চলছে কাজেই আমি স্বীকার করে নিচ্ছি সমস্যাটা পৃথিবীর নয়, সমস্যাটা আমার। এই স্টক মার্কেটে টাকা ঢেলে এই দেশের আনেক মানুষ সর্বসান্ত হয়ে গিয়েছে। যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে তারা সাধারণ মানুষ এবং যারা তাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে তারা এই দেশের বড় বড় রাঘব বোয়াল। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হয়েছে, দেশের বিশ্বাসযোগ্য মানুষেরা তদন্ত করে রাঘব বোয়ালদের চিনিয়ে দিয়েছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি! রাঘব বোয়ালরা আরও বড় রাঘব বোয়াল হয়েছেন। ভবিষ্যতে আবার সাধারণ মানুষদের সর্বস্বান্ত করে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং দেশের মানুষ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যে শুধু একটি তথ্য দেয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে এরা সবাই ভোটার।
এই দেশের মানুষের জন্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। আমি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু বিশেষজ্ঞ না হয়েও যে কোনো বিষয়ের মূল অংশটুকু বুঝে ফেলা যায়া কাজেই টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে যখন ভারতবর্ষ আমাদের নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটুকু পেয়ে যায় সেটা এই দেশের জন্যে সুখবর হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে এই সরকারের কথাবার্তা এতো নরম সুরের যে শেষ পর্ষন্ত রাশেদ খান মেনন বলতে বাধ্য হয়েছেন যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের কথা শুনলে মনে হয় তারা যেন আমাদের নয় ভারতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। অনেক দুঃখে বলা কথা কিন্তু এই কথার মাঝে যে অনেকখানি সত্যতা আছে সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা ইনিয়ে বিনিয়ে এই দেশের পাবলিককে টিআপিমুখ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন- পরিষ্কার করে তাদের বুঝতে হবে এই দেশের পাবলিক টিপাইমুখ খাবে না। বাঁধ দেওয়ার পর পানির পরিবর্তে সরবত এলেও খাবে না, কাজেই তাদেকে আরো স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে হবে!
নেতিবাচক কথা বলতে বা লিখতে ভালো লাগে না, আমি এতোক্ষণ এতোগুলো নেতিবাচক কথা লিখতে লিখতে একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, এবারে শুধু শেষ একটি বিষয় লিখে ক্ষান্ত দেই। সেই বিষয়টা হচ্ছে ছাত্রলীগ। একেবারে ভেতর থেকে দেখে আমি আবিষ্কার করেছি ছাত্র রাজনীতি থেকে অনেক বেশী ভয়ংকর হচ্ছে শিক্ষক রাজনীতি। যে সব ধুরন্ধর শিক্ষকেরা এই রাজনীতি করেন তারা সবসময় ছাত্রদের ব্যবহার করেন এবং মজার ব্যাপার হল খবরের কাগজে ছাত্রদের মাস্তানীর খবরটাই আসে, শিক্ষকদের ষড়যন্ত্রের খবরটা আসে না। যখনই ছাত্রলীগের দুই দল কিংবা উপদল (কিংবা উপ উপদল!) মারামারি করে তখন খবরের কাগজে সেই খবরটা অনেক বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানৌ হয়, সেখানে আবধারিতভাবে অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ছবি থাকে। সাধারণ মানুষদের এই ছবিগুলো ভয়ংকরভাবে ধাক্কা দেয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই তাদের মাঝে এক ধরণের বিতৃষ্ঞার জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশাল একটি অর্জন কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাত্রলীগের একজন কর্মীর তুচ্ছ একটা ঘটনার কারণে ম্লান হয়ে যেতে পারে। এই সরকারের বিষয়টি বুঝতে হবে। যেহেতু অনেক বড় বড় কাজ ছোট একজন মানুষের নির্বুদ্ধিতার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে যায় তাই এগুলোকে যেভাবে সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। “জয় বাংলা” এবং “জয় বঙ্গবন্ধু” শ্লোগান দিয়ে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা কোনো একটা অঘটন ঘটায় তখন তারা যে বাংলা এবং বঙ্গবন্ধুর কতো বড় অসম্মান করে সেটা কী তারা জানে?
তবে ইদানীং আমি আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করতে শুরু করেছি। ছাত্র রাজনীতি বলতেই দলবাজী, টেন্ডারবাজী, মাস্তানী করা একরোখা অসহিষ্ঞু অস্ত্র হাতে মাস্তানদের যে ছবি ভেসে উঠে সেটাই কিন্ধু পুরো চিত্র নয়। তার বাইরেও অনেক ছাত্র ছাত্রী আছে যারা কোনো রকম স্বার্থের জন্যে ছাত্র রাজনীতিতে আসে নি। এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যে সেটা খুবই স্বাভাবিক- তারা সত্যি সত্যি একটা আদর্শের জন্য রাজনীতিতে এসেছে। তাদের দেশের জন্যে গভীর মমতা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে সত্যিকারের ভালোবাসা রয়েছে। রাজনীতির জগৎটা যেহেতু ঘোলাটে এবং কলুষিত তাই যারা এই ছাত্রদের ব্যবহার করতে চায় তারাই শুধু তাদের সাথে সম্পর্ক রাখে অন্যেরা তাদের থেকে দূরে দূরে থাকে। এই ছাত্রগুলোর কেউ কেউ যেহেতু মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে তাই আমি জানি তাদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি আছে, শুধু তাই নয় তাদের মাঝে এক ধরণের ক্ষোভ আর অভিমানও আছে। কিছুদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে সম্ভবত পুরো বিষয়টা আমাদের আরো মমতা দিয়ে দেখা উচিৎ। এ কথাটি সত্যি, একজন আরেকজনকে অমানুষিক অত্যাচার করে খুন করে ফেলতে পারে এরকম ছাত্র সত্যিই আছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন সেনাবাহিনী মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল তখন তাদের বিরুদ্ধে তো এই ছাত্রেরাই প্রথম প্রতিবাদ করে মাথা তুলে দাড়িয়েছিল। ছাত্ররাজনীতির শুধু নেতিবাচক দিকগুলো একট আন্তরিকভাবে দেখলে শেষ পর্যন্ত আমরাই কী লাভবান হব না? নেতৃত্ব খুব একটা রহস্যময় ব্যাপার, যারা ভবিষ্যতের নেতা হবে আমরা কী এখন তাদের একটু সাহায্য করব না?