২.
আমরা সবাই জানি এই দেশের সাথে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল জামাতে ইসলামী। জার্মানীতে নাৎসী বাহিনী নেই, ইতালীতে ফ্যাসিস্ট বাহিনী নেই কিন্তু আমাদের দেশে কেমন করে জামাতে ইসলামী থেকে গেল? এখন আমরা সবাই জানি কেন এবং কেমন করে সেটা ঘটেছে কিন্তু যেটা এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না সেটা হচ্ছে সেই জামাতে ইসলামরীর একটা ছাত্র সংগঠন আছে। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন করে? কম বয়সী তরুণদের দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা, দেশের জন্য লাগাম ছাড়া ভালোবাসার আবেগে ডুবে যাবার কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহংকার করার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উচ্ছাস করার কথা, পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ার কথা, ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে রক্ত গরম করার কথা, ষোলই ডিসেম্বরে মাথায় লাল সবুজ পতাকা বেধে পথে নেমে যাবার কথা, একুশে ফেব্রুয়ারীতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরী করার কথা অথচ সেই বয়সের তরুণেরা এসব কিছু না করে কেমন করে সেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হিসেবে মেনে তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে পারে? দেশকে ভালো না বেসে কেমন করে সেই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন থেকে ঠেলে সরিয়ে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করতে পারে? আমি জানি আমি কখনোই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব না, কেউ যদি কিছু একটা উত্তর আমাকে দেয়ার চেষ্টাও করে আমি সেটা বুঝতে পারব না! (বেশ কিছুদিন আগে খবরের কাগজে আমি এরকম একটা কথা আরো একবার লিখেছিলাম, তখন একটা ছাত্র আমাকে এসএমএস করে জানিয়েছিল সে খুব ভালো ছাত্র এবং তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সে জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবির করে কারণ তার বিভাগীয় প্রধান তাকে বলেছে তা না হলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে না। আমি খোঁজ নিইনি, কাজেই জানি না শেষ পর্যন্ত সে শিক্ষক হতে পেরেছেল কী না!)
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে চুরানব্বইয়ের শেষে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম। দেশ তখন বিএনপি সরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোতেও বিএনপি এর ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের ছেলেরাই বেশী। তাদের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের কথা অনেক বড় করে বলা হয়। একদিন এক অনুষ্ঠানে একজন রাজকারদের বিদ্রুপ করে বক্তৃতা করেছে পরেরদিন খবর পেলাম শিবিরের ছেলেরা তার পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। দেশের বাইরে থাকতেই এই পদ্ধতির খবর পেয়েছিলাম দেশের ফিরে এসে এই প্রথম আমার নিজের চোখে রগ কাটার ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হল। ছাত্রদলের ছেলেদের ভেতর দেশের জন্যে তীব্র ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের জন্যে গভীর মমতা এবং রাজাকারদের জন্যে ভয়ংকর ঘৃণা। সেসব নিয়ে শিবিরের সাথে ছাত্রদলের ছাত্রদের প্রতি মুহূর্তে সংঘাত। বিশ্বিদ্যালয়ে যোগ দেবার কিছুদিনের ভিতরেই আমাকে একটা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হল। রাজাকরদের নিয়ে কিছু একটা বলার জন্য শিবিরের একজন ছাত্রদলের একজনের পিঠে চাকু মেরেছে সেটি নিয়ে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত শেষ করার আগেই শিবিরের ছাত্রটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় দেশ পর্যন্ত ছেড়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গিয়েছে!
এভাবেই চলছিল, ঠিক তখন নিরানব্বই সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ এবং দুর্ভাগ্যময় ঘটনাটি ঘটে গেল। ভোটের রাজনীতি করার কন্যে বিএনপি আর জামাত একত্র হয়ে গেল। আমার মনে আছে ছাত্রদলের তরুণ ছেলেদের মাথায় রীতিমত আখাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমার কাছে এসেছিল সান্তনা পাবার জন্যে, শুকনো মুখে তারা আমাকে অনেক কথা বলেছে, আমি তাদের কিছু বলে সান্তনা দিতে পারিনি। কমবয়সী তরুণ ছাত্রেরা সেটা বুঝতে পেরেছিল বিএনপি এর বড় বড় নেতারা সেটা বুঝতে পারেনি। আমরা সবাই যেটি অনুমান করেছিলাম সেটি ঘটতে শুরু করল নব্বইয়ের দশকের আধুনিক একটা রাজনৈতিক দল দেখতে দেখতে জামাতে ইসলামী ধাঁচের একটি দল হয়ে গেল। এই দেশের জন্যে কতো বড় দুর্ভাগ্য! কী দুঃখের কথা!
৩.
আমার ধারণা বিএনপি এর নেতারা খুব বড় একটা ভুক লরছেন- তারা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টাকে খাটো করে দেখেছেন- এই দেশের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ মোটেও খাটো একটা বিষয় নয়। এই দেশে অনেক মানুষ আছে যাদের আওয়ামী লীগ নিয়ে এলার্জী আছে, তার মানে কিন্তু এই নয় যে তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও এলার্জী আছে! পচাত্তর থেকে নব্বই ছিল এই দেশের জন্যে অন্ধকার সময়, সেই সময়ে এই দেশের প্রজন্মকে অন্ধকারে রেখে বড় করা হয়েছিল, দেশের ইতিহাস না জানিয়ে তাদের গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই অন্ধকার সময় কিন্তু কেটে গেছে, আবার কিন্তু সেই সময় আর ফিরে আসবে না। এরপর প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যারা দেশের সত্যিকারের ইতিহাসটুকু জানে। আমাদের ইতিহাসটুকু হচ্ছে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস। তাই নূতন প্রজন্ম কিন্তু বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে ভালবেসে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে দেশোদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক আর যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাস- তাই নূতন প্রজন্ম বড় হচ্ছে জামাত শিবিরকে ঘৃণা করে। বিএনপি যখন সেই জামাত শিবিরকে আলিঙ্গন করে, নূতন প্রজন্মের কাছে সেটি কখনোই কিন্তু গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি নিশ্চিত বিএনপির ভেতরেও অসংখ্য নেতা কর্মী রয়েছেন যারা কোনোদিন জামাতে ইসলামীর সাথে জোটটুকু কখনো মেনে নেননি, মেনে নেয়া সম্ভব না।
আমার ধারণা বিএনপির ভেতরের এই নেতাকর্মীরা আগে হোক পরে হোক মাথা তুলে দাড়াবে। ভোটের কথা বলে এক সময় জামাতে ইসলামীর সাথে জোট করা হয়েছিল সেই ভোটের সংখ্যাই যদি কমে যায় তাহলে আদর্শকে কেন শুধু শুধু ছুড়ে ফেলা হবে? বাংলাদেশ এখন এমন একটি জায়গায় পৌছে গেছে যে মুক্তিযুদ্বকে অস্বীকার করে কোনো দল আর এখানে রাজনীতি করতে পারবে না। (কেউ কী লক্ষ্য করেছে জামাতে ইসলামী ইদানীং স্বাবীনতা দিবসে বা বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্বের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে?) কাজেই আমার ধারণা বিএনপি যদি জামাতে ইসলামীকে পরিত্যাগ না করে তাহলে আগে হোক পরে হোক তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ আর বিপক্ষে এই দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে পরে যে দলটি জামাত ঘেষা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেই দলটি মুসলিম লীগের মত দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে একদিন শেষ হয়ে যেবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলটি সত্যিকার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে যাবে।
বিএনপির মত এতো বড় একটি রাজনৈতিক দল এই কথাগুলো জানে না সেটি হতে পারে না। তাই আমার কাছে খুব অবাক লাগে যখন দেখি তারা এই দেশের মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা দেশ নিয়ে তীব্র আবেগটুকু অনুভব করতে পারে না। যুদ্ধবাপরাধীদের বিচারের দাবী না করে তারা বিচারের বিরুদ্ধে একশ রকম কুযুক্তি দাড়া করাতে চায়। কী আশ্চর্য!