৩.
আমাকে মাঝেমধ্যেই নানা রকম অনুষ্ঠানে যেতে হয়, সেই অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান হচ্ছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। সেখানে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে থাকে এবং সবাই পুরস্কার পায়। সেখান থেকে কেউ মন খারাপ করে যায় না।
সব অনুষ্ঠান এত সুন্দর নয়—অনেক অনুষ্ঠানেই প্রতিযোগিতা হয় এবং প্রতিযোগিতা হলেই সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন বিজয়ী থাকে। যারা বিজয়ী হতে পারে না, আমি তাদের মনের কষ্টটা বুঝতে পারি। কারণ আমি ছেলেবেলায় অসংখ্যবার এই গ্লানি সহ্য করেছি। তাই এ ধরনের অনুষ্ঠানে গেলে আমি আমার সময়টুকু ব্যয় করি তাদের বোঝাতে যে বিজয়ী হতে না পারা অগৌরবের কিছু নয়। প্রতিযোগিতা একটা ছেলেমানুষি প্রক্রিয়া—পৃথিবীর বড় কাজ প্রতিযোগিতা দিয়ে হয় না, পৃথিবীর সব মহৎ কাজ হয় সহযোগিতা দিয়ে। তাই ছোটখাটো ব্যর্থতায় কোনো গ্লানি নেই, এটা হচ্ছে জীবনের পথচলার অভিজ্ঞতা। সবাইকে এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে!
আমি খবর পেয়েছি, অনেক বাচ্চা-কাচ্চাও খবরের কাগজে ছাপা হওয়া আমার কলামগুলো পড়ে ফেলে! (কটমটে নীরস কলাম পড়ে সম্ভবত খানিকক্ষণ আমার মুণ্ডুপাতও করে।) অনুমান করছি, অনেক কম বয়সী ছেলে এই কলামটিও পড়ে ফেলবে। আমি শিরোনামটি এমনভাবে লিখেছি যেন যারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা এটি পড়ে ফেলে।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে তাদের অভিনন্দন। আমি নিশ্চিত তাদের পরিবার হইচই করে মিষ্টি কিনে আনবে—পাড়াপড়শি সবাইকে সেই মিষ্টি দেওয়া হবে। সেই মিষ্টি মুখে না দিয়েই আমি এখনই তার মিষ্টি স্বাদ অনুভব করতে পারছি। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনটা হোক আনন্দময়, হোক সৃজনশীল। দোয়া করি তাদের যেন প্রাইভেট পড়তে না হয়, তাদের কোচিং করতে না হয়, জীবনে কখনো যেন তাদের গাইড বই স্পর্শ করে হাতকে অপবিত্র করতে না হয়। দোয়া করি, তারা বড় হয়ে এই দেশের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিক।
যাদের পরীক্ষার ফল মনমতো হয়নি কিংবা আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় খুব খারাপই হয়েছে, আমার এই লেখাটি তাদের জন্য। আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, তাদের এই আশাভঙ্গের সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের এই পচা শিক্ষাব্যবস্থা। ১০ বছর লেখাপড়া করার পর যদি কেউ শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে তার দায়ভার তার একা নেওয়ার কথা নয়। সবাই মিলে এই দেশের লেখাপড়া ঠিক করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে যেটা হয়নি, এই প্রথমবার সেগুলো হচ্ছে। (এই দেশের অসম্ভব বড় সৌভাগ্য যে তারা একজন সত্যিকারের শিক্ষামন্ত্রী পেয়েছে, যিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা জানেন। সেটাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। তাকে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু তাঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, দেশের মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে।) ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েদের যেন এক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, সেটাই আমাদের স্বপ্ন।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি, তাদের নিশ্চয়ই মন খারাপ হবে—সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন খারাপ করে তারা যেন হতাশ হয়ে না যায়। পৃথিবীটা বিশাল, তার চেয়েও বিশাল হচ্ছে মানুষের জীবন। সেই বিশাল জীবনের সঙ্গে তুলনা করলে এসএসসি পরীক্ষাটা খুব ছোট একটা ঘটনা!
কাজেই বিশাল জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এই ছোট ঘটনার কথা ভুলে নতুন উৎসাহে তাদের জীবন শুরু করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে—এই বয়সটাই অন্য রকম, এই বয়সটাতে সবকিছুকেই একশ গুণ বড় মনে হয়। আনন্দকে একশ গুণ বড় করে দেখায় দোষ নেই।
কিন্তু দুঃখ-কষ্ট-হতাশাকে একশ গুণ বড় করে দেখা যাবে না। সামনের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
সূত্র: http://www.sadasidhekotha.com/article.php?date=2012-03-20
রাজনীতি নিয়ে ভাবনা (মে ১৯ , ২০১২)
১.
আমার এই লেখাটি কারোই খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, কারণ যে বিষয় নিয়ে লিখছি আমি তার বিশেষজ্ঞ নই। প্রশ্ব উঠতেই পারে তাহলে আমি লিখছি কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরও আমি একটা দাঁড়া করিয়ে রেখেছি: সবকিছুই কি বিশেষজ্ঞদের চোখে দেখতে হয়? একটা গুরুতর বিষয় সাধারণ মানুষ কেমন করে দেখে, সেটাও কী অন্যদের জানার কৌতুহল হওয়া উচিৎ না?
আমার ভণিতা দেখে সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করে ফেলেছেন আমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে (শুদ্ধ করে বলা উচিৎ চৌদ্দ দল- কিন্তু আগেই বলেছি লেখাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে লেখার প্রয়োজন নেই, এখানে অনেক ভুল ভাল থাকবে! দেশটা কেমন চলছে সেটা নিয়ে সবারই নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে, আমারও আছে। আমাদের দেশের এতো রকম সমস্যা তার সবকিছু ম্যানেজ করে কোনো সরকার পাঁচ বছর টিকে থাকতে পারলেই আমি তাকে পাশ মার্ক দিয়ে দিই। টিকে থাকার সাথে সাথে যদি সরকার শিক্ষার ব্যাপারটা দেখে তাহলেই আমি তাকে এ প্লাস দিতে রাজী আছি। (তার কারণ এই পৃথিবীতে যতগুলো দেশ তাদের সমস্যা মিটিয়ে মাথা তুলে দাড়াতে পেরেছে তারা সবাই সেটা করেছে। শুধুমাত্র শিক্ষাটাকে ব্যবহার করে।) আমি মনে মনে খুব আশা করে ছিলাম এই সরকার শিক্ষার জন্যে আরো টাকা পয়সা খরচ করবে, করল না! বাংলাদেশের শিক্ষার পিছনে খরচ করার কথা জিডিপির ছয় ভাগ – এই সরকার খরচ করে মাত্র ২-৪ ভাগ। পৃথিবী আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পিছনে এতো কম টাকা খরচ করে বলে আমার জানা নেই। সবাই পদ্মা ব্রীজ, উড়াল সেতু, পরিবেশ এই সব নিয়ে কথা বলে। কিন্তু যদি শুধু শিক্ষার জন্যে আর অল্প কিছু টাকা বেশী খরচ করত তাহলে এই দেশে যে কী ম্যাজিক হয়ে যেতো সেটা কেউ বুঝল না – আহা রে!
তবে আমার দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে আমি এই সরকারকে শুধু এ প্লাস নয় গোল্ডেন এ প্লাস দিয়ে দেব যদি তারা যুদ্বাপরাধীদের বিচারটা ঠিক ঠিক ভাবে করতে পারে। “ঠিক ঠিক ভাবে” বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? বিষয়টা খুবই সহজ, যাদেরকে ধরা হয়েছে আমাদের প্রজন্ম তাদের সবাইকে চেনে। আমাদের চোখের সামনে একাত্তরে তারা সেই ভয়ংকর কাজগুলো করেছে কাজেই ট্রাইব্যুনাল যদি তাদেরকে দোষী প্রমাণ করে শাস্তি দিতে পারে তাহলে আমরা বলব “ঠিক ঠিক ভাবে” বিচার হয়েছে। যদি দেখা যায় বিচার কাজে অবহেলার কারণে শেষ পর্যন্ত ফাঁক ফোকড় দিয়ে এই যুদ্বাপরাধীগুলো বের হয়ে গেছে তাহলে আমরা বুঝব “ঠিক ঠিক ভাবে” বিচার হয় নি। (যুদ্বাপরাধীদের বিচারের কথা মনে হলেই আমার একজন মানুষের কথা মনে পড়ে। সেক্টর কমান্ডারদের একটা মানববন্ধনে মানুষটি হিংস্র গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার বাবাকে তো তারা বিচার করে মারেনি, তাহলে তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্যে আমাদের কেন বিচার করতে হবে? আমি জানি এই যুক্তি ট্রাইব্যুনালকে দেয়া যাবে না কিন্তু কথাটি আমি কখনো ভুলতে পারি না।)
এই দেশে এখন যতগুলো অসমাপ্ত বিষয় আছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুদ্বাপরাধীর বিচার। একাত্তরের নৃশংসতাটি যে কী ভয়ংকর ছিল নূতন প্রজন্ম সেটি কোনোদিন অনুভব দূরে থাকুক কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু নৃতন প্রজন্ম নয়, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষও সেটি চিন্তাও করতে পারবে না। সেই নৃশংসতায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের বিচার না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের দেশটি আসলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিচার শেষ করার পর যুদ্বাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে আমরা এই গ্লানিময় অধ্যায়টিক পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব। বারো তেরো বছরের ছেলে মেয়েরা আর আমাকে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে না, “রাজাকারেরা কেমন করে এই দেশে গাড়ীতে ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়?” বরং আমি তাদের ডেকে ডেকে বলব, “চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর দেরী হলেও এই দেশের মাটিতে আমরা রাজাকরদের বিচার করেছি। দেশের মাটিটাকে পবিত্র করে ছেড়েছি!” কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার বুকটা কেমন করে ফুলে উঠবে সেটা চিন্তা করেই আমার বুকটা ফুলে উঠছে। আওয়ামি লীগ সরকার আমাকে সেই সুযোগটা দেবে তো?