২.
ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল দিয়ে একটা ছেলে বা মেয়েকে বেছে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? প্রশ্নটা একটু জটিল। কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র যদি মানসম্মত হয়, তাহলে তার উত্তর হবে এক রকম আর প্রশ্নপত্র যদি খুব নিম্নমানের হয়, তাহলে তার উত্তর হবে অন্য রকম। গত বছর হাইকোর্ট থেকে আমাকে ডাকার কারণে আমি আবিষ্কার করেছি, এ দেশে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও শুধু গাইড বই থেকে প্রশ্ন নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র করে ফেলতে পারে! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা খুব যত্ন করে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার চেষ্টা করি এবং যারা শুনতে রাজি আছে, তাদের বলার চেষ্টা করি, ভালো ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কারও কোনো কোচিং সেন্টারে যেতে হবে না, কোনো গাইড বই মুখস্থ করতে হবে না। আমাদের ডেটাবেইসের গত তিন বছরে তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখছি, এসএসসি ও এইচএসসিতে খুব ভালো গ্রেড নেই কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় শতকরা ৫০ ভাগ। এটি অনেক বড় সংখ্যা, যার অর্থ আমাদের পাবলিক পরীক্ষা এখনো একটা ছেলে বা মেয়েকে সঠিকভাবে যাচাই করতে পারছে না এবং শুধু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল দেখে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করে নেওয়া হলে শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্রছাত্রীর ওপর অবিচার করা হবে।
৩.
মেডিকেল পরীক্ষা নিয়ে দেশে একটু উত্তেজনা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। এটি আমার কাছে রহস্যের মতো। এই দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। শিক্ষার্থীরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পরীক্ষা দিতে পারে না। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েই না খেয়ে না ঘুমিয়ে সারা রাত বাসে, ট্রেনে করে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে যায়। অপরিচিত শহরে বিশ্রাম নেওয়া দূরে থাকুক, বাথরুমে যাওয়ার পর্যন্ত কোনো জায়গা নেই। সেভাবে দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় এই অসহায় ছেলেমেয়েগুলো তাদের মা-বাবাকে নিয়ে ছুটে বেড়ায়। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এই ছেলেমেয়েদের বিশাল একটা অঙ্কের টাকা খরচ হয়। কাজেই যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত, তাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতাও থাকে না। কাজেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগও কমে আসে। ঘুরেফিরে পড়াশোনার সুযোগটা আবার সেই বিত্তশালী মানুষের ছেলেমেয়েদের কাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
সব মেডিকেল কলেজ মিলে একটি ভর্তি পরীক্ষার মতো পরীক্ষার উদ্যোগ কয়েক বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছিল। এর সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাকে একটা প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি তখন ছিলাম অজ্ঞ নাপিত। তাই সেই সভায় বাংলাদেশের সব ভাইস চ্যান্সেলরের সামনে কীভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া যায়, তার স্পষ্ট একটি ব্যাখ্যা করে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না বলে সেটাকে শেষ পর্যন্ত কেউ গুরুত্ব দেয়নি!
ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের এত কষ্ট করতে হয় এবং বিষয়টা পুরোপুরি জেনেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় না এবং এর মূল কারণটা বাণিজ্যিক। এটা জানার পর থেকে আমি সব সময়ই নিজের ভেতরে একধরনের ক্ষোভ অনুভব করি। আমি সব সময়ই মনে মনে আশা করে থাকি যে কোনো একজন শিক্ষার্থী কিংবা তার অভিভাবক ক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট করে দেবেন এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবেন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষার সময় কী ধরনের কাজ করেন, কত টাকা উপার্জন করেন, সেই তালিকাটা প্রকাশিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষা নিতে বাধ্য করবেন।
সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য, এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ জানে না, প্রতিবছরই কিন্তু সারা দেশের সব পরীক্ষার্থী নিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। তিন-চার লাখ পরীক্ষার্থী সেই পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং অত্যন্ত সুচারুভাবে তার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। আমি নিজে এই তথ্যটি জানতাম না। এই দেশব্যাপী বিশাল একটি ভর্তি পরীক্ষার খুঁটিনাটি আমি জানতে পেয়েছি। কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা গত বছর তাদের কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছি। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে আমি আরেকটি বিষয় আবিষ্কার করেছি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ডিজিটাল কর্মকাণ্ড করার পরও কোনো পত্রপত্রিকায় তাদের সম্পর্কে একটি ভালো কথাও বলা হয় না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রমাণ করে রেখেছে, এই দেশে চার-পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার জন্য ডিজিটাল বা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব। অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া সম্ভব। তারা প্রমাণ করছে, এই চার-পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থীর জন্য প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা সম্ভব এবং সিকিউরিটি প্রেস সেগুলো ছাপিয়ে কঠিন নিরাপত্তার মধ্যে সারা দেশের সব পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানো সম্ভব। তারা প্রমাণ করেছে, একই দিনে সারা দেশের অসংখ্য পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব এবং মূল্যায়নের জন্য উত্তরপত্র একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিরাপদে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তারা প্রমাণ করেছে, সেই উত্তরপত্র নির্ভুলভাবে যাচাই করে নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব এবং পুরোপুরি ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় তাদের ভর্তি করানো সম্ভব।
এককথায় বলা যায়, এই দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে সম্মিলিত একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে যে কাজগুলো করতে হবে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিটি ধাপ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেছে। আমি এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানি। কারণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে আমার তরুণ সহকর্মীরা সব কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে এবং এই বছর ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি।
তাই অন্যান্য বছর থেকে এ বছর আমার ভেতর ক্ষোভটা একটু বেশি। কারণ, এই বছর আমি আরও অনেক বেশি নিশ্চিতভাবে জানি, সম্মিলিতভাবে একটি ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জীবনটুকু অনেক সহজ ও সুন্দর করতে পারতাম। আমরা সেটা করছি না।
আমি জানি না, এই ছেলেমেয়েগুলো আমাদের ক্ষমা করবে কি না।