“আমার দেশ”-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পক্ষে যেরকম পনের জন সম্পাদক দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন, আদিলুর রহমান খানের পক্ষে এখন আরো বেশী মানুষ দাঁড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু পত্রপত্রিকা নয়, বড় বড় মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল, দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠান, এমনকি, আমাদের দেশের বড় বড় জ্ঞানী গুণী মানুষ। ‘অধিকার’ সংগঠনটি যদি বলতো অনেক মানুষ মারা গেছে এবং তখন তাকে যদি গ্রেপ্তার করা হতো, সেটাকে বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলা যেতো। কিন্তু যখন সংখ্যাটি অত্যন্ত নিখুঁত ৬১, তখন তাদেরকে এর ব্যাখ্যা দিতে হবে। বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে দেয়া হবে সেটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য কিছু নয়, ২১ আগস্ট ঘটনার পর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের কথা কেউ কি ভুলে গেছে?
এই দেশের যে সকল সুধীজন মে মাসের ৫ তারিখে মতিঝিলের “গণহত্যার” একজন প্রবক্তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের কাছে আমার শুধু ছোট একটি প্রশ্ন, তথ্যটি যদি মিথ্যা হয় তাহলেও কি আপনি তার পাশে এসে দাঁড়াবেন? বাকস্বাধীনতা চমৎকার বিষয়, আমি কয়েকজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, তারপরেও যদি এই লেখাটি সেই পত্রিকায় ছাপা হয় সেটি বাকস্বাধীনতা। কিন্তু একটা মিথ্যা তথ্য যদি একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে প্রচার করা হয়, তখন সেই তথ্য প্রচার করার অধিকার বাকস্বাধীনতা নয়, তখন সেই অধিকার হচ্ছে মিথ্যা কথা বলার অধিকার।
এই দেশে এমনিতেই অনেক মিথ্যা কথা বলা হয়েছে, এখন কি আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সেটাকে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে হবে?
সূত্র: http://opinion.bdnews24.com/bangla/2013/08/15/%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A7%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0/
মেডিকেল এবং অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা (আগস্ট ২৪, ২০১২)
১.
আমার অবস্থা অনেকটা বাঙালি হাসির গল্পের সেই নাপিতের মতো—যত দিন সে ডাক্তারি বিদ্যা জানত না তত দিন নির্দ্বিধায় তার ক্ষুর দিয়ে বড় বড় অপারেশন করে ফেলেছে। যখন ডাক্তারি বিদ্যা জেনেছে, তখন সে আর কিছুই করতে পারে না। আমিও একসময় নির্দ্বিধায় আমার ভালো লাগা মন্দ লাগার বিষয়গুলো জোর করে সবাইকে শুনিয়েছি, এখন কিছু লিখতে হলে অনেকবার চিন্তা করি, বিষয়টা ঠিক হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকি। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে অসংখ্য মানুষ যোগাযোগ করেছে, সবাই নিজের পছন্দের বিষয়টি আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি কিছু না বলে সবার কথা শুনে গিয়েছি—কয়েক দিন থেকে মনে হচ্ছে, আমার নিজের ভাবনাগুলো হয়তো অন্যদের জানানো উচিত, যাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁদের হয়তো কিছু কিছু বিষয় জানা দরকার।
বাংলাদেশ থেকে যদি সত্যি সত্যি ভর্তি পরীক্ষার মতো বিষয়টি তুলে দেওয়া যেত, তাহলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবে বলে মনে হয় না। তার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি পরীক্ষার নামে যে ভয়ংকর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাই, সারা পৃথিবীতে সে রকম কোনো উদাহরণ নেই। এইচএসসি পরীক্ষা একটি বড় পরীক্ষা, সেটা দিতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের অনেক রকম চাপ সহ্য করতে হয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নিষ্ঠুর কোনো সংগঠন নেই। তারা এইচএসসি পরীক্ষার মাঝখানে অবলীলায় হরতাল ডেকে এই বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর সেই চাপ ১০০ গুণ বাড়িয়ে দেয়, বিশাল অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাদের সবার দায়িত্ব এই ছেলেমেয়েগুলোকে কিছুদিনের জন্য হলেও একটু বিশ্রাম নিতে দেওয়া, একটু স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া। কিন্তু তারা এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিতে পারে না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরমুহূর্ত থেকে তাদের ভর্তি কোচিং শুরু হয়ে যায়। দেশে বিশাল বিশাল কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছে, মাফিয়া থেকেও তারা বেশি ক্ষমতাশালী। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তারা বের করে ফেলে, পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে গোপনে সারা রাত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়ে পরদিন পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। কোনো এক বছর আমি অনেক চেঁচামেচি করেছিলাম, কোনো লাভ হয়নি।
কোচিং সেন্টার যদি প্রশ্ন বের করতে নাও পারে, তারা এই ছেলেমেয়েগুলোকে যেভাবে প্রস্তুত করে, শিক্ষার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। পত্রপত্রিকায় তারা যেভাবে বিজ্ঞাপন দেয়, সেটি দেখে আমার গলায় আঙুল দিয়ে বমি করতে ইচ্ছা করে। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশের প্রায় সব ছেলেমেয়ে পরীক্ষার পরদিন থেকে এই কোচিং শুরু করে দেয়। যারা মফস্বলে বা গ্রামে থাকে, তাদের শহরে এসে বাসা ভাড়া করে, হোস্টেলে থেকে, মেসে থেকে এই কোচিং করতে হয়। এর চেয়ে অমানবিক কোনো ব্যাপার হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষা থেকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার একটা বড় পার্থক্য আছে, সেটি হচ্ছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সব সময়ই এই বছরের পরীক্ষার্থী থেকে গত বছরের পরীক্ষার্থীরা বেশি ভর্তি হয়। তার কারণটি বুঝতে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। কারণটি খুবই সহজ, যারা গত বছর এইচএসসি পাস করেছে, তারা ভর্তি পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার জন্য সময় পায় এক বছর থেকে বেশি। এই বছরের ছেলেমেয়েরা সেই তুলনায় সময় পায় মাত্র কয়েক মাস। যে প্রক্রিয়ায় নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের থেকে অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের সুযোগ বেশি, সেটি কোনোভাবেই সঠিক প্রক্রিয়া নয়। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যারা দেখেছে, তারা সবাই জানে এই প্রশ্ন দিয়ে আসলে মেধাবী সৃজনশীল ছেলেমেয়ে খুঁজে বের করা হয় না, কে কত বেশি তথ্য মুখস্থ করে রাখতে পারে, সেটা খুঁজে বের করা হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, যারা বেশি মুখস্থ করতে পারে, তাদের খুঁজে বের করে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে সৃজনশীল অনেক ছেলেমেয়ে যারা মুখস্থ করতে চায় না, তাদের প্রতি একধরনের অবিচার করা হয়। কোনো পরীক্ষা না নিয়ে শুধু লটারি করে কিছু ছেলেমেয়েকে বেছে নিলেও একধরনের অবিচার হয়—কোনটি বেশি বড় অবিচার, আমি সেটা নিয়ে নিশ্চিত নই।
কাজেই আমি যখন শুনতে পেয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষার নামে এই নৃশংস প্রক্রিয়াটি উঠে যাচ্ছে, আমি তখন খুব খুশি হয়েছিলাম। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত খুব উচ্চপর্যায়ের একজন মানুষ যখন এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। আমার শুধু একটি প্রশ্ন, এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে, এ রকম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের কাছাকাছি, এদের ভেতর থেকে দুই হাজার ছেলেমেয়ে কেমন করে আলাদা করা হবে। তখন আমি জানতে পারলাম, যদিও এই দেশে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় নম্বর তুলে দিয়ে গ্রেড পদ্ধতি করা হয়েছে কিন্তু সেই নম্বরগুলো কোনো এক গোপন জায়গায় রাখা থাকে। সেই গোপন নম্বরগুলো গোপনে ব্যবহার করে খুবই গোপনে কিছু ছেলেমেয়েকে বেছে নেওয়া হবে। শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুর্বলভাবে বলার চেষ্টা করলাম, যখন আমরা এই দেশের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নম্বরভিত্তিক না করে গ্রেডভিত্তিক করে ফেলেছি, তখন আমাদের আর সেই নম্বর ব্যবহার করার কোনো অধিকার নেই। যদি সেই নম্বর ব্যবহার করে একটি ছেলে বা মেয়েকে যাচাই করতে চাই, তাহলে সবার আগে সেই নম্বরটি সবার মধ্যে প্রকাশ করে দিতে হবে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও একাধিকবার এই নম্বরগুলো ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেই দেশের আইন তাদের অনুমতি দেয়নি। আমাদের কে অনুমতি দেবে?
কেন বিষয়টা করা যাবে না সেটি খুবই স্পষ্ট। ধরা যাক, দুজন ছেলে বা মেয়ে। দুজনেরই এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫, দুজনেই মেডিকেলে ভর্তির জন্য আবেদন করেছে। ধরা যাক, দেখা গেল একজন সুযোগ পেয়েছে অন্যজন সুযোগ পায়নি। যে পায়নি সে ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইবে, কেন সে পায়নি? তখন তাকে বলা হবে, যদিও তুমি জিপিএ-৫ পেয়েছ কিন্তু আসলে পরীক্ষায় তুমি কম নম্বর পেয়েছ। তখন ছেলেটি বা মেয়েটি বলবে, হতেই পারে না, আমাকে দেখাও যে আমি পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছি। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তখন সম্ভবত দাঁত বের করে হেসে বলবেন, সেটা দেখানো যাবে না, সেটা গোপন!
এর চেয়ে বড় অস্বচ্ছ কাজ পৃথিবীতে আর কী হতে পারে? একটি ছেলে বা মেয়ের সারা জীবনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেওয়া হবে কিন্তু সেই ছেলে বা মেয়েটি কখনো জানতে পারবে না, কেন তার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে। যদি সেটা তাকে জানাতে হয়, তাহলে আমাদের গ্রেডিং পদ্ধতি বাতিল করে আগের সেই নম্বরভিত্তিক ফলাফলে ফিরে যেতে হবে। আমরা কি সেটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি? এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মেডিকেলে সিট বণ্টন করা শুরু হলে সেটাকে নির্ভর করে কী কী দুর্নীতি এবং কী কী বাণিজ্য হতে পারে, সেটা চিন্তা করে এখনই আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। যাঁরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা এই সহজ বিষয়টা চিন্তা করেননি দেখে আমি একধরনের আতঙ্ক অনুভব করছি।
আমি বিশ্বাস করি, ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে মেডিকেল (বা অন্য কোথাও) পড়ার সুযোগ করে দেওয়া একটি অত্যন্ত চমৎকার ব্যাপার। কিন্তু এই চমৎকার ব্যাপারটি যদি করা হয় খুব অস্বচ্ছভাবে, তাহলে এটি কিন্তু খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। আমি প্রায় সময়েই বলে থাকি, দুধ শিশুদের জন্য খুবই চমৎকার খাবার কিন্তু একটা দুধের ড্রামের মধ্যে একটা শিশুকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলে সেই শিশুটি দুধের মধ্যেই ডুবে মারা যাবে। এখানেও তা-ই। ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার চমৎকার বিষয়টা করতে হবে সঠিকভাবে, যেন এখানে কেউ ডুবে না যায়।