সত্যি কথা বরতে কী, আলাদা বেতন স্কেলে যদি শুরু করতে হয় তাহলে প্রথমে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দিয়েই শুরু করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দেশের শিক্ষার মান বাড়াতে চাই, হাই ফাই নূতন বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে হবে না, ভালো প্রাইমারি স্কুল দিয়েই করতে হবে।
অবশ্যি বলাবাহুল্য, এই পুরো দাবিটা আসলে এক ধরনের নিষ্ঠুর কৌতুকের মতো, আমরা সবাই জানি কখনও-ই এটা হবে না, ক্ষমতাশালী আমলারা গলা টিপে শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের দাবিটাকে শেষ করে দেবেন। শিক্ষক বললে যে মানুষগুলোর ছবি তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই মানুষগুলোর জন্যে তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়ার আগে রাস্তাঘাট তৈরি হবে, ব্রিজ তৈরি হবে, কলকারখানা হবে, এয়ারপোর্ট হবে, যুদ্ধজাহাজ হবে, ক্যান্টনমেন্ট হবে। দাবিটার আগে প্লেন হবে, বন্দর হবে, শুধু শিক্ষকদের বেতনটুকু হবে না। তাদেরকে সম্মানজনকভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে না।
কেমন করে হবে? বাংলাদেশ সরকার সারা পৃথিবীর সামনে অঙ্গীকার করেছিল যে এই দেশেরি জিডিপির শতকরা ৬ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ করবে। সেই অঙ্গীকার সরকার রাখেনি, এখন জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ হয়।
আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পিছনে এত কম টাকা খরচ করে না। সত্যি কথা বলতে কী, এত কম টাকা খরচ করার পরও আমরা যে কোনো এক ধরনের শিক্ষা পাচ্ছি সেটাই মনে হয় আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।
বাংলাদেশে যদি শুধুমাত্র একটা দাবি করতে হয় তাহলে সেটি হতে হবে এই বিষয়টি নিয়ে, দরকার হলে সব কিছু বন্ধ করে শিক্ষার জন্যে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
শিক্ষকদের দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে তাদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করে দিতে হবে। আমি এর সরাসরি বিরুদ্ধে। অল্প কিছুদিন আগেও সেটা ছিল ৬০ বৎসর, কীভাবে কীভাবে সেটা জানি ৬৫ করিয়ে নেওয়া হল। সেটাতে এখনও অভ্যস্ত হইনি। এখন হঠাৎ করে দাবি উঠেছে সেটাকে ৬৭ করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী অন্য সবাইকে দাবি করে সেটা আদায় করতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত, তাদের কারও কাছ থেকে সেটা আদায় করতে হয় না, নিজেরা নিজেরাই সেটা নিজেদের জন্যে করে ফেলে। যতদূর জানি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেটা এর মাঝে করেও ফেলেছে। অন্যদের তাহলে দাবি তুলে সেটা আদায় করতে হবে কেন? নিজেরা নিজেরা করে ফেললেই পারে।
পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে পুরানোদের সরে গিয়ে নূতনদের জায়গা করে দিতে হয়। বুড়ো অধ্যাপকেরা যদি সরতে রাজি না হন, বছরের পর বছর নিজের চেয়ারটা জোর করে আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন তাহলে নূতনেরা কেমন করে দায়িত্ব নেবেন? যারা চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাদের কয়জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে তারা নিজেদের কাজকর্ম গবেষণা দিয়ে এই জায়গায় পৌঁছেছেন?
যারা সত্যিকারের ভালো অধ্যাপক তাদের সাহায্যটুকু নেওয়ার জন্যে একশ একটা উপায় বের করা যায়। সে জন্যে তাদের চাকরির বয়স ৬৭ করতে হয় না।
যখন শুনতে পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করার একটা পাঁয়তারা চলছে তখন আমার একজন অধ্যাপক বন্ধু আমাকে বিষয়টা বুঝিয়েছিল। সে বলেছিল, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক অমুক প্রফেসরের রিটায়ার করার সময় এসেছে, অবসরের বয়স ৬৭ করা না হলে তারা বিদায় হয়ে যাবে, ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স আর করতে পারবে না। পলিটিক্সের জন্যে তাদেরকে রাখতেই হবে, সেই জন্যে তাড়াহুড়ো করে চাকরির বয়স ৬৭ পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
আমার অধ্যাপক বন্ধু আরও ভবিষ্যৎবাণী করল, বলল, “অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয় এখন বয়সসীমা ৬৭ করবে না, কারণ সেটা করা হলে অমুক অমুক প্রফেসরদের বিদায় করা যাবে না। তারা বিদায় হবার পর এটা ৬৭ করা হবে, কারণ তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। ভাইস চ্যান্সেলরদের বয়স কম, তাদের কোনো তাড়াহুড়া নেই!”
আমি বিশ্ববিদ্যালয় জটিল পলিটিক্স বুঝি না, তাই আমার অধ্যাপক বন্ধুর ভবিষ্য বাণীর মাঝে কতটুকু যুক্তি এবং কতটুকু টিটকারি ধরতে পারিনি। ভবিষ্যৎবাণীটুকু মিলে গেলে বুঝতে পারব, দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
আপাতত আমি বলতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬৭ করে ফেলাটুকু হবে নেহায়েত স্বার্থপরের কাজ। শুধুমাত্র নিজেদের জন্যে আলাদা বেতন স্কেল দাবি করে যে স্বার্থপরের কাজ করেছি, নূতন প্রজন্মকে জায়গা করে না দিয়ে জোর করে চেয়ারটা ধরে রেখে সেই স্বার্থপরতাটুকু ষোল কলায় পূর্ণ করার আমি ঘোরতর বিরোধী।
আমার কথা কাউকে মানতে হবে না, শুনতে দোষ কী?
আমাদের ছেলেমেয়েদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ও অপমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দেশে তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সারা দেশে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার মতো ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দুইজনের বেশি নেই বিষয়টি সংবাদপত্র খুব ফলাও করে প্রচার করেছে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর অনেক বক্তব্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমি একমত নই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ার মতো যোগ্যতা ষোল কোটি মানুষের দেশে বলতে গেলে কারও-ই নেই– এ ব্যাপারটিতে তিনি যা বলেছেন আমি মোটামুটিভাবে তাঁর সাথে একমত।
আমি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখিনি, ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার জন্যে কী কী যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে তার খুঁটিনাটিও জানি না কিন্তু শুধুমাত্র কমন সেন্স ব্যবহার করে খুব জোর গলায় বলতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ার যোগ্যতা এই দেশে অনেক ছেলেমেয়েরই আছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের অসংখ্য ছেলেমেয়ের পৃথিবীর যে কোনো দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো বিভাগের পড়ার মতো যোগ্যতা রাখে।