যে চেহারাই ফুটুক, এই বেচারাদের সংসার খরচ চালাতে হয় খানিকটা ঠাট বজায় রাখতে হয়। সেজন্যে তাদের একটা সম্মানজনক বেতন দরকার। খুব উচ্চমহলে সেটা নিয়ে দেন দরবার করার পর একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটা মিলিয়ন ডলার উপদেশ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “আপনাদের বেতন বাড়ানোর কোনো রাস্তা নেই। পরীক্ষার খাতা-ফাতা দেখার সময় বেশি বেশি টাকা বিল করে কোনোভাবে পুষিয়ে নেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সে মিলিয়ন ডলার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তারা পরীক্ষার খাতা দেখার জন্যে টাকা নেন, পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার জন্যে টাকা নেন, ভাইভা নেওয়ার জন্যে টাকা নেন। পৃথিবীর সব দেশে পরীক্ষার খাতা একবার দেখা হয়, এই দেশে সেটা দুইবার দেখা হয়, কোনো কোনো সময় তিনবার!
আমি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পড়াই, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম সবসময় তক্কে তক্কে থাকতাম কীভাবে লেখাপড়া না করেই কাজ চালিয়ে দেওয়া যায়। আজকালকার ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা উন্নতি হয়নি। তারাও তক্কে তক্কে থাকে কীভাবে পড়াশোনা না করে ছাত্রজীবনটা ম্যানেজ করে ফেলা যায়। তাদেরকে জোর করে লেখাপড়া করানোর অমোঘ অস্ত্র হচ্ছে ঘন ঘন ক্লাস টেস্ট নেওয়া, আমি সেটা করি এবং আমার ধরনটা মুখে স্বীকার না করলেও আমার ছাত্রছাত্রীরা সে জন্যে কখনও আমাকে ক্ষমা করেনি।
খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি যে এখন নাকি ক্লাস টেস্ট নিলেও টাকা পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নানা ধরনের কমিটিতে থেকে কাজ করতে হয়। আজকাল দেখছি কমিটিতে বসে মিটিং করলেই একটা পেটমোটা খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়! আমি অপেক্ষা করে আছি কোনোদিন শুনতে পাব ক্লাস নিলেই এখন হাতে টাকার খাম ধরিয়ে দেওয়া হবে। এটাই শুধু বাকি আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাকা উপার্জনের সবচেয়ে সম্মানজনক এবং অনৈতিক পদ্ধতিটি হচ্ছে ভর্তিপরীক্ষা নামক প্রক্রিয়া থেকে টাকা উপার্জন। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একবার ভর্তিপরীক্ষার পর একেকজন শিক্ষক কত টাকা করে উপার্জন করেন তার তালিকাটি এক নজর দেখা উচিত। আমি বহুদিন থেকে সাংবাদিকদের বলে আসছি ভর্তিপরীক্ষা শেষ হবার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কে কোন কাজটুকু করার বিনিময়ে কত টাকা আয় করেছেন সেটা যেন প্রকাশ করে দেন। এটি একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ তথ্য হতে পারত।
আমার ধারণা আমাদের দেশের সাংবাদিকদের এখনও শিক্ষকদের জন্যে এক ধরনের সম্মানবোধ এবং মমতা আছে। তাই এই তথ্যগুলো কখনও প্রকাশ হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এত বড় সম্মানী মানুষেরা অল্প কিছু টাকা-পয়সার জন্যে এত ধরনের তুচ্ছ কাজ করেন, তার কারণ একটাই, তাদেরকে খুব অল্প বেতন এবং তার চাইতেও কম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে সম্ভবত তাদের আর কোনো উপায় নেই। তাই তারা যদি নিজেদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করেন, পথে নেমে দাবি-দাওয়া পেশ করেন ,তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আমি মনে করি তাদের দাবিটি খুবই যৌক্তিক কিন্তু তারপরও আমি কিন্তু সেই মানব বন্ধনে যোগ দিইনি। কেন যোগ দিইনি সেটি বলার জন্যে আমার এই বিশাল গৌরচন্দ্রিকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম হতে পারে কিন্তু তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ভাইস চ্যান্সেলররা, এই দেশের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। রিটায়ার করার পর তারা নানা দেশের হাই কমিশনার অ্যাম্বেসেডর হন। তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন। রাষ্ট্রের সব বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে তারা সদস্য থাকেন।
প্রশ্ন ফাঁস হবার পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থা লাইনে আনার জন্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে মিটিং ডেকেছিলেন আমি সেখানে বসে ডানে বামে যেদিকেই তাকিয়েছি সেদিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের দেখেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষদের দেখিনি। সেখানে কথাবার্তা যা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই বলেছেন। স্কুল-কলেজের লেখাপাড়ার সমস্যার কথা যখন আলোচনা হয়েছে সেটাও আলোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, যাদের প্রকৃত বাস্তব সমস্যা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
যারা এই দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন সেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যেন একটা গুরুত্বহীন জনগোষ্ঠী। তাদের কথা কে বলবে? কোথায় বলবে?
আমি মাঝে মাঝে একেবারে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি। তাদের জগৎটি প্রায় পরাবাস্তব জগতের মতো। যেভাবে তাদের দিন কাটাতে হয়, ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হয় সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ভোটার লিস্ট থেকে শুরু করে গ্রামে কতগুলো স্যানিটারি লেট্রিন আছে সেটাও তাদের করতে হয়। তারা কি যথেষ্ট বেতন পান? সেই বেতন নিয়ে তারা কি সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন? যদি না পারেন তাহলে তাদের বেতন বাড়ানোর কথা কে বলবে? কার কাছে বলবে? তাদের কথা কে শুনবে?
আমি বিশ্বাস করি তাদের কথাও আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বলতে হবে, কারণ আমরা একেবারে উপরের মহলে কথা বলার সুযোগ পাই, তারা পায় না। তাই আমি যখন হঠাৎ করে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের আলাদা একটা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করছেন, তখন আমার কেন জানি মনে হয় তারা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা বলছেন। দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়টুকু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঘাড়েই পড়েছে, তাদের দাবিটি হওয়া উচিত ছিল সকল শিক্ষকদের জন্যে। মানববন্ধন করা উচিত ছিল বাংলাদেমের সকল শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে নয়।