যে কয়দিন মেলবোর্নে ছিলাম তখন বোঝার চেষ্টা করেছি এই শহরটি কেন সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের পুরস্কার পেয়েছে। বাসযোগ্য শহর হতে হলে মানুষকে বাস করতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে মেলবোর্নে পথেঘাটে মানুষই চোখে পড়েনি! পুরো দেশেই মানুষ মাত্র দুই কোটি (এবং এটি শুধু দেশ নয়, মহাদেশও বটে)। তাই চারদিক ফাঁকা। শহরে উচু বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট খেলনার মতো বাসা। বাসাগুলো ক্যালেন্ডারের ছবির মতোন। বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট ঠিক কী কী কারণে পেয়েছে জানা নেই, তবে বৈচিত্র্যে এই শহরটি অভিনব।
দক্ষিণ গোলার্ধ বলে এখানে সবকিছু উল্টো। আমাদের দেশে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শীত আসছে। সেখানে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসছে। তবে মনে হল গ্রীষ্ম আসার কোনো তাড়াহুড়া নেই। এখনও প্রচুর শীত। রাতে লেপমুড়ি দিয়ে হিটার জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। মেলবোর্ন শহরে একই দিনে কখনও প্রচণ্ড গরম। কখনও কনকনে শীত, কখনও বৃষ্টি, আবার কখনও উথালপাথাল হাওয়া। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মানুষজন নাকি চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবহাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বের হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য (প্রায়) শহর থেকে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরে পা দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা চকমপ্রদ অভিজ্ঞতা। তবে বলে রাখি ঢাকা ফিরে আসার পর যখন প্লেন থেকে নেমেছি আগুনের তাপের মতো দুঃসহ গরমের একটা ঝাপটা অনুভব করেছি। হরতালের মাঝে বাসায় ফিরে এসেছি। এসে দেখি বাসায় পানি নেই। এর মাঝে হঠাৎ করে ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকার মশাদের সে কী আনন্দ! আমাদের ঘিরে তাদের মহোৎসব! কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমার এতটুকু বিরক্তি অনুভব হল না। বরং মনে হল, আহা, ঢাকার মতো এ রকম ভালোবাসার শহর কয়টি আছে পৃথিবীতে?
৩.
আমেরিকা গেলে মানুষ যে রকম নায়েগ্রা ফলস না দেখে ফিরে আসে না, ঠিক সে রকম অস্ট্রেলিয়া গেলে মানুষ ক্যাঙ্গারু না দেখে ফিরে আসে না। যখন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম তখন আমাদের ক্যাঙ্গারু দেখার শখ পূরণ করিয়ে দিয়েছিল জিন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। (আবেদ চৌধুরী আর তার স্ত্রী টিউলিপ আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু। আমরা আমেরিকাতে একই ইউনিভার্সিটিতে পিএইচ-ডি-এর জন্যে কাজ করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া এসে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়া যে কোনা হিসেবেই অপরাধ!)
ক্যানবেরা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে যেতে দেখলাম পথের দুই পাশে কাঙ্গারু। রাতের অন্ধকারে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা পড়েছে। জীবিত না হোক, তবুও তো ক্যাঙ্গারু– আমি এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু আবেদ চৌধুরী আমাদের জীবিত ক্যাঙ্গারু না দেখিয়ে ছাড়বে না।
তাই পরদিন কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে এক জায়গায় হাজির হল। সেখানে পথের দুই পাশে অসংখ্য ক্যাঙ্গারু। আমাদের দেশের এমপিরা যখন তাদের এলাকায় যান তখন স্কুলের হেডমাস্টাররা যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের ধরে এনে রাস্তার দুইপাশে রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখেন, ক্যাঙ্গারুরা ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যে রকম বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম, মনে হল তারাও সেই একই রকম বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!
ক্যাঙ্গারুর চলাফেরা খুব মজার। তাদের মতো লেজে ভর দিয়ে জোড়া পায়ে লাগিয়ে আর কোনো প্রাণি ছুটতে পারে না। তার থেকেও মজার হচ্ছে ক্যাঙ্গারু মায়ের পেটের থলেতে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার বসে থাকা। বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি এর থেকে আরামের কোনো জায়গা নেই।
ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী। সবগুলো দেশের অ্যাম্বেসি কিংবা হাইকমিশন এখানে। এগুলোর পাশে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে অপূর্ব একটি বিল্ডিং। চাঁদ-তারা আঁকা লাল পতাকা দেখে বুঝতে পারলাম এটা তুরস্কের হাইকমিশন। টিউলিপ আমাদের বলল, এই জমিটুকু বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন তৈরি করার জন্যে ভিত্তিপ্রস্তরও বসিয়ে গিয়েছিলেন।
পরের বার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের আমলে বসানো ভিত্তিপ্রস্তরে যেন বিল্ডিং তোলার অপমান সহ্য করতে না হয় সে জন্যে জমিটুকু হাতছাড়া হতে দিয়েছে।
তথ্যটি বিচিত্র হলেও অবিশ্বাস্য নয়। দেশের তথ্য পাচার হয়ে বাইরে যেন চলে না যেতে পারে সেজন্যে এই সরকার একবার বিনি পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করে পুরো দেশের মানুষকে ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত করেছিল।
ক্যানবেরার অসংখ্য অ্যাম্বেসি এবং হাইকমিশনের মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ অ্যাম্বেসিটি একটা তাঁবুর মাঝে। তাদের পুরানো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সেই দেশের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করার জন্যে বিশাল একটা পতাকা উড়িয়ে তাঁবুর মাঝে নিজেদের অ্যাম্বেসি বসিয়ে রেখেছে। সরকার তাদের ঘাটায়নি, বছরের পর বছর সেভাইে রয়ে গেছে।
আমি তাদেরকে দেখে আমার নিজের দেশের আদিবাসীর কথা স্মরণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেনাবাহিনী কেন জাতিসংঘের লোভনীয় চাকুরী নিরবচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারে সেজন্যে এই দেশের আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে এই দেশে আদিবাসী বলে কিছু নেই। এর চাইতে মমত্বহীন কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।