দেশে থাকতে মা কতো রকম কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকেন, আমেরিকায় তার কোনো কাজ কর্ম নেই। আমার ছেলে মেয়েরা ছোট তাদের বাংলা পড়তে শেখান। তখন নূতন পার্সোনাল কম্পিউটার বের হয়েছে, বাসায় একটা আছে, আমি সেখানে বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করেছি। একদিন মা’কে বাংলা লেখা শিখিয়ে দিলাম। আমার মা তখন কম্পিউটারে বাংলায় দেশে ছেলে মেয়ে নাতী নাত্নীর কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলেন। কম্পিউটারে বাংলায় লেখা মায়ের চিঠি দেখে দেশে সবাই হতবাক হয়ে গেল!
এতো কিছু করেও মায়ের অনেক অবসর। আমার স্ত্রী তখন মা’কে বলল, “আপনার এতো ঘটনাবহুল একটা জীবন, আপনি বসে বসে সেই জীবনীটুকু লিখে ফেলেন না কেন?” আমার মা একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত লিখতে রাজী হলেন। তারপর বসে বসে তাঁর বৈচিত্রময় জীবনীটুকু লিখে ফেলেন, আমি কম্পিউটারে সেটা টাইপ করে দিলাম। মা দেশে যাবার সময় তার হাতে পুরো পান্ডুলিপিটা দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করলেই কোনো প্রকাশককে দিয়ে সেটা প্রকাশ করানো যেতো কিন্তু কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা দেশে বাক্সবন্দী হয়ে থাকল। আমরা আমার মায়ের লেখা আত্মজীবনীর কথা ভুলেই গেলাম।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে, আমি দেশে ফিরে এসেছি তখন হঠাৎ করে উইয়ে কাটা অবস্থায় এই পান্ডুলিপি নূতন করে আবিষ্কৃত হল, আমি তখন উদ্যোগ নিয়ে সময় প্রকাশনীকে সেটি দিয়েছি ছাপানোর জন্যে। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে নিল। যখন বইয়ের ছাপা শেষ, বাঁধাই হচ্ছে তখন হঠাৎ করে আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ। কী কারণে তার ধারণা হল তিনি বুঝি আর বাঁচবেন না, আমি তখন সিলেটে, আমাকে ফোন করে বললেন, “বাবা, যদি তোদের সাথে কখনো ভুল করে থাকি, মনে কষ্ট রাখিস না। আমাকে মাফ করে দিস।”
শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা, মা’কে মাফ করে দেবো মানে? আমি তখনই সময় প্রকাশনীর সত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদকে ফোন করে জিগ্যেস করলাম আমার মায়ের বইয়ের কি অবস্থা। ফরিদ জানালেন বই বাঁধাই হচ্ছে। আমি বললাম এই মুহুর্তে দুটি বই বাঁধাই করে আমার মার হাতে দিয়ে আসতে হবে। আমি জানি একজন লেখকের জীবনের প্রথম বইয়ের থেকে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই। ফরিদ ছুটতে ছুটতে বই নিয়ে আমার মায়ের হাতে তুলে দিল এবং সাথে সাথে মায়ের সব অসুস্থতা দূর হয়ে গেল! আমার মা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেন। শুধু ডাক্তাররা চিকিৎসা করে কে বলেছে, আমিও চিকিৎসা করতে পারি। আমার মা খুবই আন্তরিকভাবে এই বইটি লিখেছিলেন, যারাই বইটি পড়েছে তাদের সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। একজন মানুষ জীবনে কতোভাবে কষ্ট পেতে পারে, এই বইটি পড়লে সেটি বোঝা যায়।
হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার পর আমার মা আবার নতুন করে যে কষ্ট পেয়েছিলেন সেই কষ্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন আমরা কেউ ভাবিনি। সেই কষ্ট ভুলে থাকার জন্যে আমার মা বসে বসে তার কাছে চিঠি লেখার মত করে অনেক কিছু লিখেছেন। পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছে আছে, হয়তো এটাও কোনো প্রকাশককে দিয়ে কখনো প্রকাশ করিয়ে দেব।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুটি আমার মা’কে খুব বড় একটা আঘাত দিয়েছে, সত্যিকারভাবে আমার মা কখনোই সেই আঘাত থেকে বের হতে পারেননি। আমরা টের পেতাম তার মনটি ভেঙে গেছে, একজনের মন ভেঙে গেলে তাকে জোর করে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আমরাও পারিনি, গত ২৭ তারিখ আমার মা তার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের কাছে চলে গেছেন। সে সম্ভবত আমার বাবাকে নিয়ে আমার মায়ের জন্যে অপেক্ষা করছিল। তারা তখন একজন আরেকজনকে কী বলেছিল আমার খুব জানার কৌতূহল হয়।
২.
খবরের কাগজে আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ ছাপানোর সময় অনেকেই তাকে রত্নগর্ভা বলে সম্বোধন করেছে। এই বিশেষণটি পড়ে আমি দুই কারণে একটু অস্বস্তি বোধ করেছি। এক: এটি সত্যি হলে আমাদের ভাইবোনের সবারই ছোটবড় মাঝারি রত্ন হয়ে ওঠার একটা চাপ থাকে, কাজটি সহজ নয়! দুই: এই বিশেষণটি সত্যি হলে বোঝানো হয় আমার মায়ের নিজের কোনো অবদান নেই, তার একমাত্র অবদান হচ্ছে তিনি ছোট-বড়-মাঝারি ‘রত্ন’ জন্ম দিয়েছেন!
কিন্তু আমি জানি রত্নগর্ভা হিসেবে নয়, আসলে আমার মা একজন খুব সাদাসিধে মা হিসেবেই অনেক বড় অবদান রেখেছেন। আমার মা যেভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের পুরো পরিবারটিকে রক্ষা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। যদি বুক আগলে আমাদের রক্ষা না করতেন তাহলে আমরা কেউই টিকে থাকতে পারতাম না।
কীভাবে কীভাবে জানি আমার মায়ের একটা পরিচিতি হয়েছে, তিনি অসুস্থ হলে টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়, তিনি মারা গেলে খবরের কাগজে কালো বর্ডার দিয়ে খবর ছাপা হয়। কিন্তু আমি আমার মা’কে দেখে বুঝেছি এই বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আমার মায়ের মত অসংখ্য মা আছেন যারা যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছিলেন এবং যারা নিজের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ঠিক আমার মায়ের মত সংগ্রাম করেছিলেন। তাদের কথা কেউ জানে না, তাদের কথা কেউ বলে না। আমার মনে হয় আমাদের বাংলাদেশ যে পৃথিবীর অন্য দশটা দেশ থেকে ভিন্ন তার একটা বড় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পর এই দেশে অনেক মা ঘর থেকে বের হয়ে সংগ্রাম শুরু করেছেন। বেঁচে থাকার জন্যে সেই সংগ্রামের কথা কতোজন জানে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে যুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের দেশের সেই মায়েদের যুদ্ধ তাঁদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমরা কী সেটা মনে রাখি?