সেই সময়ে আমার মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন। আমি জানি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে প্রতি সপ্তাহে আমার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। আমার মা তার গুটি গুটি হাতের লেখায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাসার খবর দিয়েছেন, ভাইবোনদের খবর দিয়েছেন, আত্নীয়স্বজনদের খবর দিয়েছেন, এমন কী দেশের খবরও দিয়েছেন। আমার প্রবাস জীবনে দেশ কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি শুধুমাত্র আমার মায়ের চিঠির কারনে।
কয়েক বছর পর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা এসেছিল, তখন আমার মা প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি লিখতেন – একটি আমাকে আরেকটি আমার ভাইকে।
আমার মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো বাঁচিয়ে রাখিনি – এখন চিন্তা করে খুব দুঃখ হয়। যদি চিঠিগুলো থাকতো তাহলে সেটি কী অসাধারণ দলীল হতো আমি সেটি চিন্তাও করতে পারি না।
আমার মা খুবই সাধারণ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন – অন্তত আমরা সবাই তাই জানতাম। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন আমাদের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পরনের কাপড় নেই, তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই আমার মায়ের একটা সংগ্রামী নূতন রুপ আবিষ্কার করলাম। আমরা ভাইবোনেরা সবাই লেখাপড়া করছি – কিছুতেই লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না তাই বাবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স আর পেনশনের অল্প কিছু টাকার উপর ভরসা করে ঢাকায় স্থায়ী হলেন। কী ভয়ংকর সেই সময়, এখন চিন্তা করলেও আমার ভয় হয়! বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের জন্যে আমার মা একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন। আমি পত্রিকায় কার্টুন আঁকি – গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করি, এভাবে কোনোমতে টিকে আছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাশ করে একটা চাকরী পাবে সবাই সেই আশায় আছি। এরকম সময় আমি একদিন হঠাৎ করে বলাকা সিনেমা হলের নিচে একটা বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলী আবিষ্কার করলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম তিনশ টাকা! (এখনকার টাকায় সেটি নিশ্চয়ই দশ বারো হাজার টাকার সমান হবে!) এতো টাকা আমি তখনো একসাথে হয়তো ছুয়েও দেখিনি। এই বইয়ের সেট আমার ধরা ছোয়ার বাইরে। তবু আমি বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখি, লোভে আমার জিভে পানি এসে যায়।
যাই হোক বিকালবেলা বাসায় ফিরে এসেছি, ভাইবোনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমি তখন মানিক গ্রন্থাবলীর সেটটার কথাই শুধু ঘুরে ফিরে বলছি, কী অপূর্ব সেই বইগুলো, দেখে কেমন লোভ হয় কিছুই বলতে বাকী রাখি নি। আমার মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “কতো দাম?” আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “তিনশ টাকা।” আমার মা বললেন, “আমি তোকে তিনশ টাকা দিচ্ছি, তুই কিনে নিয়ে আয়।”
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের পরিবারের তখন যে অবস্থা তখন প্রত্যেকটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করা হয়। তার মাঝে আমার মা আমাকে তিনশ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন এরকম ভয়ংকর একটা বিলাসিতার জন্যে? “মানিক গ্রন্থাবলী” কিনে আনার জন্যে? টাকাটা কোথা থেকে দিচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে বই কিনে ফেলার পর সংসারের কোন চাকাটা অচল হয়ে পড়বে আমার সেইসব জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিলো! আমি তার কিছুই করিনি। মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম, ভয়ে বুক ধুকধুক করছে, এর মাঝে যদি কেউ সেই বইগুলো কিনে নিয়ে যায় তাহলে কী হবে?
বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখলাম বইগুলো তখনো আছে। আমি টাকা দিয়ে লোভীর মতো মানিক গ্রন্থাবলীর পুরো সেট ঘাড়ে তুলে নিলাম। আহা কী আনন্দ!
বাসার সবাই বই পড়ে, তাই সেই আনন্দ শুধু আমার একার নয়, সবার। কেউ তখন বাসায় এলে বিচিত্র একটা দৃশ্য আবিষ্কার করতো, ঘরের একেক কোনায় একেকজন বসে, শুয়ে, আধাশোয়া হয়ে, কাত হয়ে, সোজা হয়ে মানিক গ্রন্থাবলী পড়ছে!
তারপর বড় হয়েছি, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক কিছু কিনতে হয়, অন্য অনেকের মতো আমিও কিনেছি। আমেরিকা থাকতে শো রুম থেকে নূতন গাড়ী কিনে ড্রাইভ করে বাসায় এসেছি, ঝকঝকে নূতন বাড়ীও কিনেছি – কিন্তু সেই মানিক গ্রন্থাবলী কেনার মত আনন্দ আর কখনো পাইনি, আমি জানি কখনো পাব না। এটি আমার জীবনের ঘটনা, যারা আমার মায়ের কাছাকাছি এসেছে তাদের সবার জীবনে এরকম ঘটনা আছে। কাউকে কিছু কিনে দিয়েছেন, কাউকে অর্থ সাহায্য করেছেন, কাউকে চিকিৎসা করিয়েছেন, কাউকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন কিংবা কাউকে শুধু আদর করেছেন, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।
আমরা যখন আমেরিকা থাকি তখন একবার তাঁকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলাম। আমেরিকা দেখে আমার মা খুবই অবাক, তাঁর শুধু একটাই প্রশ্ন, “মানুষ জন কোথায় গেল?” আমরা তাঁকে বোঝাই, মানুষ জন কোথাও যায়নি – যাদের দেখছেন তারাই আমেরিকার মানুষ! আমরা যখন বাসায় থাকি না তখন মাঝে মাঝে আমার মা হাঁটতে বের হন, রাস্তা ধরে এদিক সেদিক হেঁটে আসেন। একদিন হেঁটে এসে আমাদের বললেন, “তোরা কখনো বলিস নি, এখানে একটা কবরস্থান আছে। কী সুন্দর কবরস্থান, কবরের উপর কতো ফুল। আমি সেই কবরগুলো জেয়ারত করে এসেছি।”
আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, “হায় হায়! আপনি জানেন কী করেছেন?”
মা বললেন, “কী করেছি?”
আমি বললাম, “ওটা কুকুর বেড়ালের কবর। আপনি কুকুর বেড়ালের কবর জেয়ারত করে ফেলেছেন!”
এই দেশে কবরস্থানে কুকুর, বেড়ালকে কবর দেয়া হয়, শুনে মা চোখ লপালে তুললেন আর আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম।