০২.
আমি জানি অনেকের মনেই একটা প্রশ্ন উশখুশ করছে, এই ম্যানুয়েল লিফটটা তৈরি করতে কত খরচ হয়েছে? আমি জানি শুনে অনেকেই অবাক হয়ে যাবে, একটা ভালো ল্যাপটপ কিনতে যত টাকা খরচ হয়, এই লিফটটা তৈরি করতে সেরকম খরচ পড়েছে- মাত্র নব্বই হাজার টাকা। যার অর্থ একটা স্কুলে এরকম একটা লিফট বসানোর জন্য কাউকে বিদেশি অনুদানের জন্য বসে থাকতে হবে না। বড় বড় করপোরেশনের কাছে হাত পাততে হবে । কয়েকজন মিলেই এটা তৈরি করে ফেলতে পারবে। আমার ধারণা মোটামুটি বড় একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা নিজেরাই চাঁদা তুলে তাদের স্কুলে এরকম ম্যানুয়েল লিফট বসিয়ে ফেলতে পারবে।
সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছে, এই ঘটনাটি নিয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। হওয়ার কারণও আছে। পৃথিবীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী যে কোনো দেশের শতকরা পনেরো ভাগ হচ্ছে কোনো না কোনো ধরণের ‘প্রতিবন্ধী’ (কুৎসিত শব্দটা আবার ব্যবহার করতে হলো!), তার মাঝে একটা অংশকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। যারা হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে, তারা যেন যে কোনো বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতে পারে, বাথরুমে যেতে পারে,অর্থাৎ তাদের প্রবেশ গম্যতা থাকে, তার জন্য দেশে আইন আছে। অন্য অনেক আইনের মতো এই আইনটিও এখনও সেভাবে মানা শুরু হয়নি। আমরা আশা করছি, সেটা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাঝে সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের ঘটনাটি আমাদের নতুন একটা আশা দিয়েছে। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে এরকম অসংখ্য ছেলেমেয়েকে এই দেশের অনেক স্কুল ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের আর ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এরকম একটা খবর পেলে বি-স্ক্যানের মতো সংগঠনের সাথে সাথে সবাই মিলে সেই স্কুলের ওপর চড়াও হতে পারবে, তাদেরকে বাধ্য করা যেতে পারে একটা ছোট শিশুর লেখাপড়া যেন তারা নিশ্চিত করে। এরকম একটা শিশুকে স্কুলে নেওয়া হলে কারো কারো একটু বাড়ি ‘ঝামেলা’ হতে পারে, কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিতে পারি, এই ছোট একটুখানি ঝামেলা সহ্য করার পরিবর্তে সবাই যে আনন্দটুকু পাবে, সেই আনন্দের কোনো তুলনা নেই। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না, তারা চেষ্টা করে দেখতে পারে।
০৩.
এই প্রসঙ্গে শেষ কথাটুকু বলে দেওয়া যাক। পৃথিবীতে যতোভাবে আনন্দ পাওয়া সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে তীব্রভাবে সেটি পাওয়া যায় যখন অন্যের জন্য কিছু একটা করা হয়। সিদ্বেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলে গিয়ে আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি। বি-স্ক্যানের স্বেচ্ছাসেবকেরা সেখানে হাজির ছিল, তাদের আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।
আমি দেশের তরুণদের এই কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই, শুধু নিজের জন্য বেঁচে থেকে কোনো আনন্দ নেই, বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ আনন্দ পেতে হলে অন্যের জন্য কিছু একটা করতে হয়। তাই যারা বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ আনন্দটি কী, সেটা জানতে চায় তাদেরকে বি-স্ক্যান বা এরকম অন্য কোনো একটি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে কিছু একটা করার জন্য অনুরোধ করছি।
আমি এটা নিশ্চিতভাবে জানি, আমি অনয়ের মুখের হাসিটি নিজের চোখে দেখেছি।
০৪.
ফিরে আসার আগে আমি সব শিশুদের অটোগ্রাফ দিয়ে এসেছিলাম। তাদেরকে যে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথাটি রেখে এসেছিলাম!
একজন সাধাসিধে মা
১.
আমার মা সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ খুব ভোর বেলা মারা গেছেন। আমার বাবা যখন মারা গেছেন তখন তার কাছে কোনো আপনজন ছিলো না, একটা নদীর তীরে জেটিতে দাড়া করিয়ে পাকিস্তান মিলিটারী গুলি করে তাকে হত্যা করে তাঁর দেহটা নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আমার মা যখন মারা যান তখন তার সব আপনজন – ছেলে মেয়ে ভাই বোন নাতি নাত্নীরা সবাই তার পাশে ছিল। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার মায়ের বয়স মাত্র ৪১, তারপর আমার মা তার সন্তানদের এবং তার আপনজনদের জন্যে আরো ৪৩ বছর বেঁচে ছিলেন।
আমার মায়ের মৃত্যুটি একান্তভাবেই একটি পারিবারিক ঘটনা হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি এক ধরণের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি তার অসুস্থতার খবরটিও পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরটি সব পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। যদি খবরের শিরোনাম হতো, “হুমায়ূন আহমেদের মায়ের জীবনাবসান”, আমি সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরে নিতাম। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখেছি আমার মা’কে তার নিজের নামে পরিচয় দিয়ে লিখেছে, “আয়েশা ফয়েজের জীবনাবসান”। আমি জানতাম না এই দেশের মানুষ আমার মা’কে তার নিজের নামে চেনে। সেজন্যে আমি আজকে এই লেখাটি লিখতে বসেছি – মনে হয়েছে যদি সত্যিই দেশের মানুষ তাকে তাঁর পরিচয় দিয়েই চেনে তাহলে হয়তো অনেকেই আমার একেবারে সাদাসিধে মায়ের জীবনের একটি দুটি ঘটনা শুনতে আপত্তি করবেন না।
মাঝে মাঝেই আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, “আপনি আমেরিকার এতো সুন্দর জীবন ছেড়ে দেশে কেন চলে এলেন?” নানাভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিজের দেশে ফিরে আসতে যে কোনো কারণ লাগে না – বরং উল্টোটাই সত্যি, দেশ ত্যাগী হওয়ার পিছনে ভালো কারন থাকা দরকার সেটা কাকে বোঝাব? প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ই-মেইল ইন্টারনেট আবিষ্কার হয়নি, ডজন হিসেবে টিভি চ্যানেল ছিলো না, টেলিফোন অনেক মূল্যবান বিষয় ছিল, মায়ের ফোন ছিল না থাকলেও আমার তাকে নিয়মিত ফোন করার সামর্থ্য ছিল না। যোগাযোগ ছিলো চিঠিতে – চিঠি লিখলে সেটা দেশে আসতে লাগতো দশ দিন, উত্তর আসতে লাগতো আরো দশ দিন। মেল বক্সে দেশ থেকে আসা একটা চিঠি যে কী অবিশ্বাস্য আনন্দের বিষয় ছিল সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।