আমার মনে হয়, বি-স্ক্যান সম্পর্কে দুই একটা কথা বলা দরকার। অনেকদিন আগে সাবরিনা সুলতানা নামে একটা মেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সেই এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবক এই সংগঠনে কাজ করে। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাদের অধিকার সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করাই হচ্ছে এই সংগঠটার মূল কাজ। সাবরিনা খুব সুন্দর লিখতে পারে, ব্লগে সে অসাধারণ কিছু লেখা লিখে অনেক তরুণদের এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। আমার প্রথম যেদিন সাবরিনার সঙ্গে দেখা হলো, আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। কারণ সে হুইল চেয়ারে আটকা পড়ে আছে। একটা হাতের এক দুইটা আঙুল ছাড়া আর কিছুই সে ব্যবহার করতে পারে না। আমি আমার সমস্ত শরীর হাত-পা ব্যবহার করে যেটুকু কাজ করতে পারি, সে শুধু এক দুটি আঙুল ব্যবহার করেই তার থেকে বেশি কাজ করতে পারে দেখে ‘প্রতিবন্ধী’ মানুষ সম্পর্কে আমার ধারণাই পাল্টে গিয়েছে। আমি এখন প্রতিবন্ধী বলে এই কুৎসিত শব্দটি ব্যবহার করি না। আমার কাছে তারা বিশেষ (Spacial) মানুষ।
সাবরিনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমি তাকে আমার ‘নেতা’ হিসেবে মেনে নিয়েছি। সে আমাকে কিছু একটা করতে বললে আমি সেটা করার চেষ্টা করি। সে আমাকে আজ সাড়ে এগারোটায় এই স্কুলে আসতে বলেছে। আমি তাই চলে এসেছি।
সাবরিনা চট্টগ্রাম থাকে। তার জন্য ঢাকা আসা রীতিমত একটা বিশাল অ্যাডভেঞ্চার। তার সবকিছুর জন্য এই অ্যাডভেঞ্চার করতে হয় না। কারণ বি-স্ক্যানের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব ঢাকা থাকে। সালমা-সাবরিনা একটা অসাধারণ জুটি, তাদের কাজের কোনো তুলনা নেই। এই স্কুলের ছেলেটাকে কীভাবে লেখাপড়া করার সুযোগ দেওয়া যায়, সেটা নিয়ে তারা চিন্তা ভাবনা করতে লাগল এবং তার যে সমাধান বের করল, তার কোনো তুলনা নেই। ঠিক করা হলো স্কুলের দোতলায় ওঠার জন্য একটা লিফট বসানো হবে।
আমি জানি, সবাই চমকে উঠেছে। একটা স্কুলে লিফট বসানো নিশ্চয়ই সোজা কথা নয়, এটা তো লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের ব্যাপার। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশের সাধারণ একটা স্কুলে একটা লিফট বসানোর সুযোগ কোথায়? কিন্তু এসব কিছুই সমস্যা নয়। কারণ যে লিফটটি বসানো হবে, সেটা ম্যানুয়েল লিফট। এটা চালাতে ইলেকট্রিসিটি লাগবে না, একজন হাত দিয়ে হ্যান্ডেলের মতো একটা জিনিষ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উপরে তুলে নিতে পারবে, নিচে নামিয়ে আনতে পারবে। যিনি সেই ম্যানুয়েল লিফট ডিজাইন করেছেন, তার নাম মহিউদ্দিন বাবুল। এটি তার প্রথম ডিজাইন নয়। সাভারের সিআরপি এর জন্য তিনি আগেও এটা তৈরি করেছেন। এই লিফটটি বসানোর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিয়েছেন, অনয়ের বাবা ছেলের লেখাপড়ার জন্য খরচটা বহন করেছেন। আজকে সেই ম্যানুয়েল লিফটটি উদ্বোধন করা হবে এবং আমি সেটা নিজের চোখে দেখার জন্য ছুটে এসেছি।
মহিউদ্দিন বাবুল নামে যিনি এই লিফট তৈরি করেছেন তার সঙ্গে পরিচয় হলো। ঘটনাক্রমে তিনিও হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। শৈশবে গাছ থেকে পড়ে মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়েছিলেন। সাবরিনা-সালমা জুটি চলে এসেছে। কিছুক্ষণের মাঝে অনয় নামের যে শিশুটির জন্য দজ্ঞযজ্ঞ, সেও চলে এলো। এখন বাকি আছে এই ম্যানুয়েল লিফটটা উদ্বোধন করা।
আমরা সবাই মিলে রওনা দিলাম। নিচতলায় স্কুলের বারান্দায় ওঠার জন্য এবং একটা বারান্দা থেকে অন্য বারান্দায় যাওয়ার জন্য দুটো র্যা ম্প (Ramp –ঢালু পথ) তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো তৈরি করে দিয়েছে কানাডার টরন্টো শহরের একটি সংগঠন। আমাদের সাথে এই স্কুলের ছোট ছোট ছেলেদের বিশাল একটা বাহিনী, তাদের উৎসাহের কোনো সীমা নেই।
লিফটের সামনে হাজির হওয়ার পর আমি আবিষ্কার করলাম, আমার জন্য ছোট একটা বিষ্ময় অপেক্ষা করছে। ফিতা কেটে আমাকেই এই লিফটের উদ্বোধন করতে হবে। সালমা-সাবরিনার কিংবা লিফট ডিজাইনার মহিউদ্দিন বাবুলের এটি উদ্বোধন করে দেওয়ার অধিকার আমার থেকে একশত গুণ বেশি, কিন্তু কিছু করার নেই। ঘটনাটি সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে। আমি এক ধরণের আনন্দ মেশানো বিষ্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম অনেক সাংবাদিক, টেলিভিশনের ক্রু চলে এসেছেন। এই অসাধারণ ঘটনাটি আমাদের সাথে সাথে দেশের অনেক মানুষ দেখতে পাবে!
অনয় আর হেডমাস্টারকে নিয়ে আমি লিফটের ভেতর ঢুকে গেলাম, সামনে একটা ফিতা লাগানো হয়েছে। সেটা কেটে দেওয়ার পর একটা গগন বিদারী চিৎকার দেওয়া হলো। যে সকল অনুষ্ঠানে ছোট ছোট বাচ্চা থাকে, সেখানে অত্যন্ত চমকপ্রদ গগন বিদারী চিৎকার দেওয়া সম্ভব।
উদ্বোধনের পর আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, অনয়কে নিয়ে এই লিফটে করে দোতলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি জবুথবু ধরণের মানুষ, ভুল কিছু করে ফেলে মাঝ পথে আটকা পড়ে যাই কী না কিংবা উপর থেকে নিচে ফেলে দেই কী না, সেটা নিয়ে নিজের ভেতর দুর্ভাবনা ছিল। তাই আরেকজন সঙ্গে ওঠে গেলেন। তারপর হ্যান্ডেলটা ঘোরানো শুরু করতেই এই ম্যানুয়েল লিফটটা তরতর করে উপরে ওঠতে শুরু করল। দেখতে দেখতে আমরা দোতলায় ওঠে গেলাম। অন্য বাচ্চারা এর মাঝে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সবাই মিলে একটা আনন্দোল্লাসের মাঝে অনয়ের হুইল চেয়ারটা ঠেলে তার ক্লাসরুমে নিয়ে যাওয়া হলো।
আমার হিসেবে বাংলাদেশে একটা ইতিহাস রচিত হলো।