এ রকম একটা মন খারাপ করা কুৎসিত বিষয় লিখতে আমার খুব খারাপ লাগছে; কিন্তু আমি সেটা মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারি। কারণ প্রতিদিনই আমার খাঁটি অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা গভীর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সন্তানদের বড় করছেন। সন্তানের শখ পূরণ করার জন্য নিজের সময় দিচ্ছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার উৎসবে বাবা-মায়েরা কষ্ট করে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। গণিত, বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এ ধরনের অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়ার জন্য সন্তানদের উৎসাহ দিচ্ছেন। ছবি আঁকার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছেন; ছেলেমেয়েদের দেশকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন, মানুষকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন। আমি হতদরিদ্র অশিক্ষিত বাবা-মায়েদের দেখেছি, যারা সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য নিজের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছেন। আমি জানি, আমার হতাশ হওয়ার কিছু নেই।
কিন্তু যখন দেখি একটা তরুণ শুকনো মুখে আমাকে বলে, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি বলে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তখন আমার পরিচিত জগৎটি এলোমেলো হয়ে যায়। যখন শুনি বাবা-মায়ের প্রচণ্ড চাপে একটি মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে কিংবা বাড়ি থেকে পালিয়ে একটা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে, আমি তখন আতঙ্কে শিউরে উঠি। আমার এই লেখাটি সে ধরনের কোনো অভিভাবকদের চোখে পড়বে কিনা জানি না। যদি পড়ে তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনাদের জীবনের অপূর্ণ স্বপ্ন আপনাদের সন্তানদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। তাদেরকে তাদের নিজেদের স্বপ্ন দেখতে দিন। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। তাদেরকে জোর করে একটা প্রতিযোগিতা থেকে অন্য একটা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেবেন না। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে বাধ্য করবেন না। তারা যে কাজটুকু করতে আনন্দ পায় সেই কাজটুকু করতে দিন।
আমাদের একটি মাত্র জীবন, সেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অংশটুকু হচ্ছে শৈশব। তাদের শৈশবটিকে বিষাক্ত করে দেবেন না। তাদেরকে একটা আনন্দময় শৈশব নিয়ে বড় হতে দিন। তাদেরকে সবকিছু অর্জন করতে হবে না, সবকিছুতে পুরস্কার পেতে হবে না, তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে হবে। তাদেরকে জীবনটা উপভোগ করতে দিন।
যেসব অভিভাবক তাদের সন্তানদের অন্যায় কাজ করতে ঠেলে দিচ্ছেন তাদেরকে কী বলব আমি জানি না। তারা কীভাবে তাদের সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি এই গুরুতর অপরাধটি করো।’ এ রকম কোনো একজন অভিভাবক কি আমাকে ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে দেবেন?
অভিভাবকরা সন্তানদের ভালোবাসা দেবেন, তাদের জীবনে তারা কেন অভিশাপ হয়ে যাবেন?
অসহায় মা অসহায় শিশু (জুন ১৪, ২০১২)
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন পুরো দেশকে পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে, তখন আমরা একটি গ্রামের একজন অবস্থাপন্ন মানুষের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম । মে মাসের ৫ তারিখ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার বাবাকে হত্যা করার পর আমাদের আশ্রয় দেওয়া গৃহস্বামীর মনে হলো, যে মানুষটিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছে, তাঁর পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া বিপজ্জনক। তিন দিন পর বিকেলবেলা তিনি আমাদের পুরো পরিবারকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন ।
আমার মা ছোট ছোট দুটো নৌকা ভাড়া করে আমাদের ছয় ভাইবোনকে নিয়ে পুরোপুরি অনিশ্চিত পথে যাত্রা করলেন । যখন পদে পদে মৃত্যুর আশঙ্কা, তখন পুরোপুরি আশ্রয়হীন হয়ে নৌকায় করে নদীতে ভেসে বেড়াতে কেমন লাগে, তখন আমাদের সেই অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল। একজন মানুষের যখন সারা পৃথিবীতে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না, তখন বুকের ভেতর যে অসহায় অনুভূতি হয় এবং জগৎ-সংসারের প্রতি যে অভিমানের জন্ম হয়, তার চেয়ে হূদয়বিদারক কোনো অনুভূতি আছে বলে আমার জানা নেই।
প্রায় ৪০ বছর পর খবরের কাগজ খুলে হঠাৎ করে আমি সেই অনুভূতিটি নতুন করেঅনুভব করছি। নিজ দেশে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আশ্রয়ের আশায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের দেশে আসছে। অসহায়-আতঙ্কে হকচকিত শিশু, আশ্রয়ের আশায় ব্যাকুল মা—হঠাৎ করে খবরের কাগজের ছবিতে আমি নিজেকে, নিজের ভাইবোনকেখুঁজে পেতে শুরু করেছি।ছবিগুলো অনেক নিষ্ঠুর, কারণ, বাংলাদেশ সরকার সদম্ভে ঘোষণা করেছে, কেউ এখানে আশ্রয় পাবে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, আগরতলায়যত অধিবাসী ছিল, শরণার্থীর সংখ্যা ছিল তার থেকে বেশি। যদি পার্শ্ববর্তী দেশ সদম্ভে ঘোষণা দিত, সেই দেশে বাংলাদেশের কোনো অসহায় মানুষ আশ্রয় পাবেনা, তাহলে নিশ্চিতভাবেই১৯৭১ সালের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ৩০ লাখে থেমে না গিয়ে আরও কয়েক গুণ বেড়ে যেত।
পৃথিবীতে অনেক নিষ্ঠুরতা আছে, তার পরও আমরা পৃথিবীতে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকি। কারণ, আমরা জানি এখানে যতটুকু নিষ্ঠুরতা আছে, তার থেকে অনেক বেশি রয়েছে মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা। বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গারা যখন আমাদের দেশে আশ্রয়ের জন্য ছুটেআসছে, আমরা অমানুষের মতো বলছি, এই দেশে তোমাদের স্থান নেই, তোমরা ফিরে যাও। আমার দেশ এ রকম অমানবিক, এ রকম নিষ্ঠুর—নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না।
একাত্তর সালে আশ্রয়হীন হয়ে যখন আমার মা তাঁর অসহায় সন্তানদের নিয়ে নৌকায় ভেসে বেড়াচ্ছিলেন, তখন একজন হতদরিদ্র মানুষ আশ্রয় দেওয়ার জন্য ছুটে এসেছিল। সেই ভয়ংকর বিপদে আশ্রয় পেয়েছিলাম বলে আমরা প্রাণে বেঁচেছি। আমি সেই কথাটিএক মুহূর্তের জন্য ভুলিনা। আমি জীবনে কখনো মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাইনি। আমি জানি, এই পৃথিবীটা এত সুন্দর, কারণ, মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা কখনো ফুরিয়ে যাবে না।
তাহলে আমাদের সরকার কেমন করে এত নিষ্ঠুর হয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে? আমরা কেমন করে এত সহজে ১৯৭১-কে ভুলে গেলাম?
অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর
১.