আমাদের এত কষ্টের, এত ভালোবাসায় দেশকে আমরা যেভাবে চাই যদি সেভাবে গড়ে তোলা না হয় তাহলে কি এই দেশেও নূতন একটা রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে পারে না যার চালক হবে নূতন প্রজন্ম? আগামী এক, দুই, পাঁচ বছরে না হোক– তার পরেও কি হতে পারে না?
তাদের তো হারানোর কিছু নেই, দেওয়ার অনেক কিছু আছে।
১৫.১.২০১৪
একজন অনয়ের গল্প
০১.
ঘুম থেকে উঠেই আমার মনে পড়ল, আজকের দিনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সেটা স্বচক্ষে দেখার জন্য আমার সকাল সাড়ে এগারোটার সময় একটা জায়গায় পৌঁছাতে হবে। ঢাকা শহরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে কতটুকু সময় লাগবে তার কোনো বাধা-ধরা নিয়ম নেই। এ সম্পর্কে একজন একটা থিওরি দিয়েছে, সেটা এরকম- ঢাকা শহরে গাড়ি করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। রিকশায় গেলে দুই ঘণ্টা আর হেঁটে গেলে সময়টাকে এক ঘণ্টায় নামিয়ে আনা যায়।
আমি গাড়ি করে যাব, তাই আমার তিন ঘণ্টা হাতে নিয়ে বের হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু আমি আশাবাদী মানুষ, তাই দেড় ঘণ্টা সময় নিয়েই বের হয়ে গেলাম। আমার ভাগ্য ভালো, পথে নানারকম ছোট বড় মাঝারি সরল এবং জটিল ট্রাফিক জ্যাম অত্রিক্রম করে আমি ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
আমার গন্তব্য ছিল সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুল। আমি আগে কখনও আসিনি কিন্তু জায়গাটা খোঁজে পেতে সেরকম সমস্যা হলো না। পৌঁছে দেখি অন্যরা সবাই চলে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যারা একটু দূর থেকে এসেছে তাদের কেউ কেউ ভোর সাতটায় রওনা দিয়েছে, তারা সবাই এই ঘটনাটি নিজের চোখে দেখতে চায়।
আমি পৌঁছানো মাত্রই সেখানে একটা উত্তেজনা শুরু হলো। কারণ আমি জানতে পারলাম, আমি নাকি প্রধান অতিথি। (আমাদের দেশের এই প্রধান অতিথি এবং অ-প্রধান বা নগণ্য অতিথির কালচারটা আমি ভালো করে বুঝতে পারি না। আশা করছি, ধীরে ধীরে এটা উঠে যাবে। এক সময় সব অতিথিই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেওয়া হবে।) আমাকে ঢাউস একটা ফুলের তোড়া দেওয়া হলো এবং আট দশ বছরের অনেক ছেলেরা আমাকে ঘিরে ধরলো। তাদের হাতে ছোট বড় মাঝারি কাগজের টুকরো। কিছু কিছু কাগজের টুকরোর অবস্থা রীতিমত শোচনীয়- মনে হয়, রাস্তা থেকে তুলে এনেছে! সবারই অটোগ্রাফের দরকার, যাদের হাতে কাগজ নেই তারা তাদের হাতটাই বাড়িয়ে দিল। সরাসরি হাতের তালুতে অটোগ্রাফ দিতে হবে। (এটি নতুন পদ্ধতি এবং খুব দ্রুত জনপ্রিয় হতে শরু করেছে!) আমি বাচ্চাগুলোর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, আগে কাজটা করতে এসেছি সেটা সেরে ফেলি, তারপর সবাইকে অটোগ্রাফ দেওয়া যাবে। আমি তাদের কথা দিলাম, তাদের সবাইকে অটোগ্রাফ না দিয়ে আমি যাব না।
ছোট বাচ্চারা মোটেও রাজনৈতিক নেতাদের মতো না। তারা আমার কথা বিশ্বাস করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। এই বয়সী বাচ্চাদের দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি-হুটোপুটি থেকে সুন্দর দৃশ্য খুব বেশি নেই।
আমি তখন যে কাজটি করতে এসেছি, সেই কাজটি করতে এগিয়ে গেলাম। আমার মনে হয়, আমি কী কাজ করতে এসেছি, এখন সেটি বলার সময় হয়েছে।
এই স্কুলে অনয় নামে একটি ছোট ছেলে লেখাপড়া করে। অন্য বাচ্চাদের মতোই লেখাপড়ায় আগ্রহ কিন্তু হঠাৎ করে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার কারণ এই ছেলেটি অন্য দশটি ছেলের মতো নিজের পায়ে ছোটাছুটি করতে পারে না, তাকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত নিচের তলায় ক্লাশরুম থাকায় তার কোনো সমস্যা হয়নি। সিক্সে ওঠার পর ক্লাসরুম দোতলায়, হঠাৎ করে তার ক্লাশে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের এরকম ছেলেমেয়ে আছে এবং যারা তাদের সেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে চান, তারা সবাই এই কাহিনীর সাথে পরিচিত। হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন, শুধু ক্লাশরুম পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না বলে একদিন তাদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়।
যখন এই দেশের শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়, তখন অনেকের সাথে আমিও সেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। আমরা সবাই মিলে খুব আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে এই শিক্ষানীতিতে একীভূত (Inclusive) শিক্ষা নামে একটা শব্দ ঢুকিয়েছিলাম। যার অর্থ এই দেশের সব ধরণের ছেলেমেয়ে একই সাথে পড়াশোনা করতে পারবে। শারীরিক প্রতিবন্ধী নামে একটা ভয়ঙ্কর শব্দ আবিষ্কার করে বিশেষ ধরণের ছেলেমেয়েদের শরীরে এই সিল মেরে দিয়ে আমরা তাদেরকে আলাদা স্কুলে পাঠিয়ে দিতাম। এই শিক্ষানীতি সেই প্রক্রিয়াটিকে বাতিল করে সবার জন্যই একই ধরণের শিক্ষার ব্যবস্থাটি চালু করে দিয়েছিল। আমি যতদূর জানি, এ ব্যাপারে একটা আইনও আছে। কিন্তু সেই আইনের অবস্থা ট্রাফিক আইনের মতো, কেউ সেটা মানে না। যদি কোনো অসহায় বাবা-মা হুইল চেয়ারে আটকে থাকা তার ছেলে কিংবা মেয়ের লেখাপড়ার জন্য এই আইনটির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন কোনো লাভ হয় না। ‘উটকো একটা ঝামেলা’ ঘাড়ে যেন নিতে না হয় তার জন্য তারা নানারকম ফন্দি-ফিকির বের করেন। ভর্তি করার আগে তাদের টেস্ট নেওয়া হয়, সেই টেস্টে তাদের ফেল করিয়ে দেওয়া হয়। এই গল্পগুলো আমি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে সেরকম ছেলেমেয়ের বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি।
সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের ছাত্র অনয়ের কপালেও এরকম একটা কিছু ঘটতে শুরু করল। এতোদিন একতলায় ক্লাশ হয়েছে কোনো সমস্যা হয়নি। দোতলায় ক্লাশটা চলে যাওয়ার পর অনয় আর তার বাবা-মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঠিক তখন একটা চমৎকার ঘটনা ঘটল। বি-স্ক্যান (B-SCAN: Bangladeshi System Change Advocacy Network) নামের একটা সংগঠন এই ব্যাপারটা জানতে পারল।