আমি যতদূর জানি, আমাদের বাংলাদেশ এখন বিদেশিদের সাহায্যের ওপর সেভাবে নির্ভর করে না। এখনও এদেশে নিশ্চয়ই অনেক টাকা-পয়সা আসে এবং সেগুলো আসে বিভিন্ন এনজিও-এর কাছে। আমি এ রকম একটা এনজিও-এর বোর্ড অব ডিরেক্টরদের একজন সদস্য হিসেবে তাদের বড় কর্মকর্তার বেতন ঠিক করে দিয়েছিলাম, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর হিসেবে আমি তখন যত বেতন পাই সেই বেতনটি ছিল তার চার থেকে পাঁচ গুণ।
কাজেই এনজিও-এর কর্মকর্তারা নিশ্চয়ই ভালোই থাকেন এবং যে দেশ থেকে তাদের বেতন-ভাতা আসে সেই দেশের প্রতি তাদের নিশ্চয়ই এক ধরনের কৃতজ্ঞতা থাকে। কাজেই সেই দেশের এজেন্ডাগুলো নিশ্চয়ই সোজাসুজি কিংবা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়নের একটা চাপ থাকে। তাই তারা তাদের নির্ধারিত কাজ ছাড়াও বাড়তি কাজ করেন। এই দেশের মানুষকে ফ্রি উপদেশ দেন।
সেটি সমস্যা নয়, আমরা সবাই উপদেশ দিতে পছন্দ করি। কিন্তু ঠিক সেই সময় দেশটি ভয়ংকর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত। মানুষকে পুড়িয়ে মারার হোলি উৎসব চলছে। রেললাইন তুলে ফেলে ট্রেন ফেলে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা কেটে ফেলা হচ্ছে। পুলিশকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আমাদের এনজিও কর্মকর্তারা এই ভয়ংকর সন্ত্রাস বন্ধ করার কথা বললেন না, তারা সরকারকে নির্বাচন বন্ধ করার উপদেশ দিলেন। নির্বাচন বন্ধ করার জন্যে এই দেশে ভয়ংকর সন্ত্রাস চলছিল, তাই প্রকারান্তরে তারা সন্ত্রাসেরই পক্ষ নিলেন।
এই ব্যাপারটা আমাকে খুব আহত করেছে। আমি জানি আমাদের দেশের এনজিওগুলো অসাধারণ কাজ করে। আমি তাদের অনেকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য। তারা মাঝে মাঝে আমাকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে বলেন। কিন্তু এখন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে আমার মনে হচ্ছে, বিদেশিদের টাকা দিয়ে চলছে এ রকম প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেটে ফেলার সময় হয়েছে।
আমার শ্রমটুকু হয়তো দেওয়া উচিত দীনহীন দুর্বল প্রতিষ্ঠান বা স্বেচ্ছাসেবকদের। তারা নিজেদের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাই দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। তারা যতই দুর্বল হোক, তারা আমার দেশের প্রতিষ্ঠান। যারা আমার দেশকে অপমান করে, তাদের কাছ থেকে তারা কোনো টাকা নেয় না। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নিশ্চয়ই এক ধরনের গৌরব আছে।
এই দেশের রাজনীতিতে আমার চাওয়া খুবই কম। যে দলটি দেশ চালাবে সে হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাসী। একই সঙ্গে যে দলটি বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেটিও হবে মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী। শুধু এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের সকল মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত। সরকার পরিবর্তন হলেও কারও মনে বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা থাকবে না। একটি ভিন্ন দল দেশকে চালানোর দায়িত্ব পাবে, কিন্তু দেশটুকু অগ্রসর হবে একই গতিতে।
অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতির প্রথম মাপকাঠি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নে বিশ্বাস করে না, তার এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।
দ্বিতীয় মাপকাঠিটি নিয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। সেটি হচ্ছে আমাদের দেশে হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মানুষজনের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকার। গত কয়েকদিন এই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে আঘাত নেমে এসেছে, তার চাইতে লজ্জা এবং অপমানের বিষয় আর কিছু হতে পারে না। আমি মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছি, তাই এই দেশে আমার বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আছে, আমার তো একটি হিন্দু পরিবারেও জন্ম হতে পারত। আমি কোথায় জন্ম নেব সেখানে তো আমার কোনো ভূমিকা নেই।
একটি শিশু ঘটনাক্রমে একটি হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছে বলে তার জীবনের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না, আমরা কেমন করে সেটি ঘটতে দিলাম? খবরের কাগজে যখন একজন ভীত মায়ের কোলে একজন শিুশুর অসহায় মুখটি দেখি, আমি প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। আমার মনে হয়, এর জন্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আমরাই দায়ী।
যারা এটি করে তাদের মস্তিস্ক কীভাবে কাজ করে আমার জানা নেই। এর মাঝে শুধু যে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আছে তা নয়, একটা হিন্দু পরিবারকে কোনোভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উৎখাত করতে পারলে তার জায়গাটা দখল করে নেওয়ার সুযোগ আছে। সেই ব্যাপারটিতে শুধু জামাত-বিএনপি আছে তা নয়, আওয়ামী লীগের লোকজনও আছে। পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ছবিও ছাপা হয়।
কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত এই মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া না হয় কিংবা যতক্ষণ পর্যন্ত এ রকম ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে সেই বিষয়টা নিশ্চিত করা না হয়, এই দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা আমাদের ক্ষমা করবেন না। শুধুমাত্র পুলিশ-র্যাব দিয়ে বাড়ি পাহারা দিয়ে তাদেরকে রক্ষা করার পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। আসলে সেই এলাকার মানুষজনকেও দায়িত্ব নিতে হবে। আগে একটা সময় ছিল যখন রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনগুলো এগুলো করত; এখন সেটি আর ঘটতে দেখি না। এখন আমরা ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটতে দিই; তারপর সেই ঘটনার প্রতিবাদে বড় শহরে একটা মানব বন্ধন বা একটা সেমিনার করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলি।
আমাদের আরও এক ধাপ অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা-ভাবনারও পরিবর্তন করতে হবে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ কী ভাবছে সেটা বোঝার জন্যে তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে হত। এখন সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো হওয়ার কারণে কাজটা সহজ হয়েছে। কে কী ভাবছে সেটা নেটওয়ার্কে তাদের কথাবার্তা, মন্তব্য দেখে বোঝা যায়।