তবে যে বিষয়টি আগে একেবারেই ছিল না এখন প্রবলভাবে হয়েছে সেটি হচ্ছে, ঈদ উপলক্ষে পাঠানো এসএমএস। অন্যদের কথা জানি না, আমার ‘ঈদ এসএমএস’ পড়ে শেষ করতে কয়েকদিন লেগে যায়!
২.
এই লেখাটি যখন ছাপা হবে তখন ঈদ সবেমাত্র শেষ হয়েছে, তাই সবার জন্যে রইল ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদের শুভেচ্ছা কথাটি লিখতে গিয়েও আমি থমকে দাঁড়িয়েছি, আমি কি সবাইকে এই শুভেচ্ছাটি দিতে পারব! প্রতিদিন খবরের কাগজ অবরুদ্ধ গাজার স্বজনহারা ফুটফুটে শিশুদের আতঙ্কিত ছবি ছাপা হচ্ছে। (যখন এটি লিখছি তখন এক হাজারের বেশি মানুষকে ইজরায়েলি সৈন্যরা হত্যা করে ফেলেছে!) আমি যদি সেই শিশুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাই তাহলে তারা কি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে না?
তাদের চোখের সেই নিরব অভিশাপ থেকে নির্বিকার পৃথিবীর নির্বিকার মানুষ কখনও কি মুক্তি পাবে?
২৭.৭.১৪
এই লজ্জা কোথায় রাখি (আগস্ট ৩০, ২০১৩)
১.
কাক কাকের গোশত খায় না- কিন্তু এবারে মনে হয় একটু খেতেই হবে। আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি না। কিন্তু এবারে মনে হয় করতেই হবে। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতো শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি, এই মুহূর্তে দয়া করে ১৫ দিনের জন্য দম নেওয়া হচ্ছে, তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।
আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভেতর কী সমস্যা, সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ; ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন, তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তার পরও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাঁদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন, সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে, সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হয়। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে, যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্র-পত্রিকার ইলেট্রনিক ভার্সন রয়েছে, সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠকরা আবার ভুল বানান ও অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! তাই সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্য ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মধ্যে আটকে রাখা গুরুতর অন্যায়। স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই; কিন্তু আমার ধারণা, দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এই কাজটি করছেন, আমার এই লেখা তাঁদের চোখে পড়বে কি না আমি জানি না। যদি পড়ে, তাহলে তাঁদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাঁদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। ১৫ দিন পর তাঁরা আবার যখন তাঁদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তাঁর অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তাঁরা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাঁদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন। তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা)?’ তখন তাঁরা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাঁকে আমরা দুই চোখে দেখতে পারি না। তাই তাঁকে আমরা তাঁর অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাঁকে আমরা বের হতে দিই না।’
আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি, তাতে আমার ধারণা, তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’
‘হ্যাঁ, জেলখানায় যে রকম কেউ বের হতে পারে না, সে রকম। তাঁকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’
বাক্যালাপের এ রকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’
‘তাদের আবার বলার কি আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গেছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেই নাই।’ বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’
শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ, উচিত শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে, তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয়, তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’