৩.
আগেই বলেছি এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়– আমার মতো অনেকেরই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মতো যে সব মানুষের এক ধরনের ছেলেমানুষী উচ্ছাস রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি মনে কষ্ট পেয়েছে। তবে আমার ধারণা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের, যে ভাষায় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাঁকে অসম্মান করা হয়েছে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমার ধারণা তিনি নিজেও নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে কথাগুলো ইতিহাসের সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছি সেই কথাগুলো তো বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর জন্যে আরও অনেকেই আগে এভাবে বলেছে– তাহলে এই বইয়ে সেটি লিখে কার লাভ হল?
আমিও ভাবছিলাম, কার লাভ হল, এখন হঠাৎ করে উপলব্ধি করেছি যে লাভ হয়েছে বইয়ের প্রকাশকের! বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা এবং তারা একটু পরে পরে বইটির বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটির বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খুবই স্থূলভাবে বলা যায়, এটি করে বই বিক্রি হচ্ছে, একজন সেই বই কিনছে, সেই বই পড়ছে আর মন খারাপ করছে আর ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর ক্যাশ বাক্সে একটু করে অর্থ যুক্ত হচ্ছে। আমি যদি একজন প্রকাশক হতাম তাহলে কি শুধুমাত্র কিছু অর্থ উপার্জন করার জন্যে এ রকম একটি বই প্রকাশ করে এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষটিকে এ রকম অসম্মানের দিকে ঠেলে দিতাম? কিছুতেই দিতাম না।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে, মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তাঁর মত প্রকাশ করার জন্য ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই পড়ে বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্টে পেতে পারে বলে তিনি বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্যে সময় নেওয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে– একজন মানুষকে অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত অর্থ উপার্জন পৃথিবীর একমাত্র পথ নয়।
বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি খচখচ করছিল, বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের উপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতূহলটি মেটানোর জন্যে আমি ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম, তাদের কাছে অনুরোধ করলাম তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কি আমি এক নজর দেখতে পারি? তারা একটু ইতস্তত করে আমাকে জানালেন, সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তাদের কাছে নেই। কিছু আছে। তবে তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত সে রকম সাক্ষ্য প্রমাণ তাদের কাছে আছে।
আমি লেখালেখি করি, তাই এই উত্তর শুনে আমি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল এই বইটি কেমন করে লেখা হয়েছে কিংবা ‘প্রস্তুত’ করা হয়েছে সেটা খুব কৌতূহলউদ্দীপক একটা বিষয় হতে পারে। বই লেখা আর বই প্রস্তুত করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমরা কি ‘প্রথমা’ প্রকাশনীর কাছ থেকে এই বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেতে পারি। আমাদের মনের সান্ত্বনার জন্য?
৪
আমরা সবাই জানি এই বইটি লেখার জন্যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে সম্ভবত তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব দেবেন না আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। তাঁর বই পোড়ানো হয়েছে, খন্দকার মুশতাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী বলা হচ্ছে সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম।
কিন্তু সবার কাছে আমার একটি খুব সোজা একটি প্রশ্ন। এই বইটি লেখার দায়ভার কি শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কি খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন সেটি কেমন কথা? আমরা কি কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি?
হুবহু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে এবং আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই ঘটনাটি মনে আছে। ২০০৭ সাল ‘প্রথম আলো’র রম্য সাপ্তাহিকী ‘আলপিন’-এ একটা অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সেই নিরীহ কার্টুনটিকে একটা ইসলামবিরোধী রূপ দিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে দেয় এবং আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। শুধু তাই নয়, এটা প্রকাশ করার অপরাধে ‘আলপিন’-এর সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করা হল।
এখানেই শেষ নয় আমরা দেখলাম ‘প্রথম আলো’র সম্পাদক জনাব মতিউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেলেন। (আমার ধারণা ছিল সংবাদপত্র আদর্শ এবং নীতির কাছে কখনও মাথা নত করে না, সেদিন আমার সেই ধারণাটিতে চোট খেয়েছিল।)
এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নাটকীয় ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম কোনো কিছু বিতর্কিত বা আপত্তিকর ছাপানো হলে লেখকের সাথে সাথে প্রকাশকদেরও সেই দায় গ্রহণ করতে হয়। আগে গ্রহণ করেছে।