যেসব অভিভাবক আমার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলেন, তাদের মধ্যে একজনও নেই যার ছেলেমেয়ে সেই বছরের পরীক্ষার্থী নয়। দেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে তাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই, তাদের সব মাথাব্যথা শুধু নিজেদের ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমি তখন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে প্রবলভাবে সোচ্চার অভিভাবকরা আসলে খুব স্বার্থপর। তাদের নিজেদের সন্তানের ভালোমন্দের বাইরে তারা কখনও কিছু চিন্তা করেন না। স্বার্থপর মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার চেয়ে নিরানন্দ কাজ কিছু হতে পারে না। তাদের কথাবার্তাকে গুরুত্ব দিয়ে নেওয়ারও কোনো প্রয়োজন হয় না।
২.
স্বার্থপর অভিভাবক থেকেও ভয়ঙ্কর এক ধরনের অভিভাবক আছেন। তাদের সঙ্গে সাধারণত আমার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর। এবারে একজন আমার অফিসে এসেছেন। তার সঙ্গে একজন কম বয়সী তরুণ, চেহারা দেখে অনুমান করতে পারলাম, সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় সে রকম একজন। বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং আমি তাদের সামনে বসার আমন্ত্রণ জানালাম। ভদ্রলোক আমাদের এলাকার মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। আমাকে জানালেন, তার সঙ্গের ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি, তাকে ভর্তি করে দিতে হবে।
‘অমুক’ বিভাগে ভর্তি হয়েছে, তখন তাকে আপনার বিভাগে ভর্তি করে দিতে হবে এ রকম অনুরোধ মাঝে মধ্যে শুনতে পাই; কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাতেই টিকতে পারেনি তাকে ভর্তি করে দিতে হবে, এই অনুরোধটি নতুন। আমি এ ধরনের অন্যায় কাজ করতে পারি, লোকজন সেটা বিশ্বাস করে জানতে পেরে অবশ্যই আমার খুব আশাভঙ্গ হলো, আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো; কিন্তু তারপরও আমাকে জোর করে মুখে হাসি ধরে রেখে বলতে হলো, এ রকম কিছু করা সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ যদি এটা করার চেষ্টাও করে, তারপরও সেটি করার উপায় নেই। মেধা তালিকায় যারা আছে তাদের একজন একজন করে ভর্তি করা ছাড়া আমাদের সিস্টেম আর কিছু করতে পারবে না।
ভদ্রলোক আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, হেসে হেসে বললেন, এ দেশে সবকিছু সম্ভব। আপনার দেশের একজন মানুষের জন্য আপনার এটা করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
বেশ কিছুক্ষণ এ ধরনের আলাপ চলল, আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে পাশাপাশি বসে থাকা এই কম বয়সী তরুণ এবং তার অভিভাবকের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক পর্যায়ে আমাকে কঠিন হতে হলো, রূঢ় ভাষায় বলতে হলো যে এই ছেলেটি আপনার পাশে বসে বসে দেখছে তাকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা চলছে! আপনার সম্পর্কে এখন ছেলেটির কী ধারণা হচ্ছে? সে জানছে, তার অভিভাবক একজন ক্রিমিনাল, এসেছে আরেকজন ক্রিমিনালের কাছে?
ভদ্রলোক অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ন এবং বিরক্ত হয়ে বিদায় নিলেন। আমার ভেতরটা সারাদিনের জন্য তেতো হয়ে গেল। এ ধরনের অভিভাবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাদের ছেলেমেয়েদের সামনে তারা অন্যায় কাজ করে ফেলেন, ছেলেমেয়েদের বোঝান কোনো কিছু পাওয়ার জন্য অন্যায় করতে হয়। সৎ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেটা পাওয়ার কথা সেটা পেলেই হলো। এ ব্যাপারে খুব ছেলেমানুষি একটা ব্যাপার আমার ভেতরে বেশ দাগ কেটেছে। আমি বইমেলায় বসে আছি, শত শত ছেলেমেয়ে ভিড় করে আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। যখন দেখলাম এটা ম্যানেজ করা যাচ্ছে না, তখন আমি তাদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিলাম। কিছুটা হলেও একটু শৃঙ্খলা ফিরে এলো, তারপরও যে হুটোপুটি নেই তা নয়। তখন হঠাৎ করে একজন ভদ্রমহিলা তার ছেলেকে লাইনের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এর বইয়ে একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দিন।’ আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি সবার মতো লাইন ধরে এসেছ?’ মা ছেলেটিকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না, বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সে লাইন ধরে এসেছে।’ আমি আবার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সত্যি তুমি লাইনে ছিলে?’ ছেলেটি কিছু বলতে পারল না, মা আবার বললেন, সে লাইনেই ছিল, লাইন ভেঙে ঢোকেনি। আমি নিজের চোখে দেখেছি কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে এই ছোট বিষয় নিয়ে নাটক করার চেষ্টা না করে ছেলেটির বইয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে তাকে বললাম, ‘আমি দেখেছি, তুমি লাইন ভেঙে ঢুকেছ! কেন এটা করলে?’
ছেলেটির মুখ মুহূর্তে অপমানে ম্লান হয়ে গেল। তীব্র চোখে তার মায়ের দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি করতে চাইনি। আমার মা আমাকে করিয়েছে।’
আমি শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘এরপর থেকে মা করাতে চাইলেও করবে না, ঠিক আছে?’
শিশুটি চোখের পানি আটকে রেখে মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার ধারণা, যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তখন তারা অন্যায় করতে জানে না। অন্যায় করার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যখন তাদের সন্তানের সামনে অন্যায় করেন, সন্তানকে অন্যায় কাজ করতে শেখান, তখন তারা সেটা করতে শেখে। সুন্দর একটা মন ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যায়।
আমাদের দেশের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার কিছু কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিযোগ আছে। তারা অভিভাবক এবং তাদের সন্তানদের এক জায়গায় নিয়ে আসে। অভিভাবকদের খাওয়া এবং ঘুমের ব্যবস্থা থাকে, যখন পরীক্ষার্থীরা রাত জেগে ফাঁস করে আনা মেডিকেলের প্রশ্ন মুখস্থ করতে থাকে। ছেলেমেয়েরা জানে তাদের বাবা-মায়েরা কয়েক লাখ টাকা দিয়ে তাদেরকে ফাঁস করে আনা প্রশ্ন মুখস্থ করার সুযোগ দিয়েছে। সেটা নিয়ে তাদের বিবেক কোনো যন্ত্রণা দেয় কিনা আমার জানা নেই। টাকা দিয়ে তারা অনেক বড় অন্যায় করছে কিন্তু সেই বাবা-মা কীভাবে তাদের ছেলেমেয়েদের চোখের দিকে তাকান, আমি জানি না। আমার খুব জানার ইচ্ছে!