আমি বাড়িয়ে বলছি না –আমি এটা জানি।
ইতিহাসের ইতিহাস
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সবসময়েই আমার বুকের মাঝে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা কাজ করে। মাঝে মাঝেই পথেঘাটে রেল স্টেশনে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমার হয়তো একজন মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হয়, টুকটাক কথার পর হঠাৎ করে সেই মানুষটি বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা!” আমি তখন সব সময়েই দ্বিতীয়বার তাঁর হাত স্পর্শ করি এবং সেই মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষটির মাঝে আমি টগবগে তেজস্বী একজন তরুণকে খুঁজে পাই। আমি জানি সেই তরুণটি কিন্তু নিজের জীবনকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা সবাই জানি কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসের ভেতর আত্মসমর্পণ করেছিল, একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিল তারা কিন্তু তখন সেটি জানত না। তারা সবাই কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করার জন্যেই গিয়েছিল। তাই সবসময়েই আমি মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির হাত স্পর্শ করে বলি, “থ্যাংকুু! আমাদেরকে একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে।”
মাঝে মাঝে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর সাথে আমার দেখা হয়, সে লাজুক মুখে আমাকে বলে, “আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা”, আমি তখন আবার তার মুখের দিকে তাকাই। তার লাজুক মুখের পিছনে তখন আমি তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব আর গৌরবের আলোটুকু খুঁজে পাই। আমি তখন তার বাবার খোঁজ-খবর নিই। বেশিরভাগ সময় আবিষ্কার করি তিনি আর বেঁচে নেই। যদি বেঁচে থাকেন তাহলে আমি সেই তরুণ কিংবা তরুণীকে বলি তাঁর কাছে আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে।
একাত্তর সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, দেশ স্বাধীন হবার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে তখন আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরা যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তারাও ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছে। কমবয়সী তরুণ কিন্তু এর মাঝে তাদের ভেতর কী বিস্ময়কর দেশের জন্যে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমি তাদের দেখি এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাই!
একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি, পিরোজপুরে মাঠে দুইএকদিন লেফট রাইট করা ছাড়া খুব লাভ হয়নি। আমার বাবাকে মেরে ফেলার পর পুরো পরিবারকে নিয়ে একেবারে বনের পশুর মতো দীর্ঘদিন দেশের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে হয়েছে। একটু স্থিতু হয়ে যখন বর্ড়ার পার হবার পরিকল্পনা করছি, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাত্র তের দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেল– আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হল না। এই নিয়ে আমার ভেতরে বহুদিন একটা দুঃখবোধ কাজ করত এবং আমার বয়সী মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আমি হিংসায় জর্জরিত হতাম।
খুবই ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সেই (হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী) হিংসাটুকু গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে শিখেছি দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়, সৃষ্টিকর্তা অনেক য্ত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন। বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবে, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবে, অস্কার বিজয়ী চিত্রপরিচালক হবে, অলিম্পিকে স্বর্ণবিজয়ী দৌড়বিদ হবে, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে, এমনকি মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবে কিন্তু আর কখনওই মুক্তিযোদ্ধা হবে না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাঁদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তাঁরাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নয়। (তাই আমি যখন দেখি, অল্প কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বের করে ফেলছে, তখন আমার মনে হয় গলায় আঙুল ঢুকিয়ে তাদের উপর হড় হড় করে বমি করে দিই!)
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভেতরে এখন গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি সব সময়ে চেষ্টা করে এসেছি নূতন প্রজন্মের ভেতর সেই অনুভূতিটুকু সঞ্চারিত করতে, যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পৌঁছে দিতে। একটি সময় ছিল যখন এই দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ত, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো হত, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হত– তখন এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর যে গভীর অভিমান জমা হয়েছিল আমি সেই কথা কখনও ভুলতে পারব না। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমরা সেই সময়টি পেছনে ফেলে এসেছি। এই দেশের মাটিতে আমরা আর কখনও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করতে চাই না।
তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে। এ কে খন্দকার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ। ষোলই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে তখন তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টা তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম তৈরি করে নূতনভাবে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন এবং আমাদের তরুণেরা সেটা আগ্রহে গ্রহণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভালোবাসা এদেশে আবার নূতন করে প্রচারিত হয়েছে।