০৯.
আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে, তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিনস পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাসে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা, মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কখনো আমার স্যুট-টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না! আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমায় সেরকম জাযগায় যেতে হচ্ছে না।)
১০.
আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে, তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক। পান চিবুতে চিবুতে এদিক-সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেয়ালের কোনাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্য!) শুধু পানের পিক নয়, চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে কেউ অন্যায় মনে করে না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠার আগে এই অভ্যাসগুরো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে।)
একটা বড়সরো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারাল অনুষ্ঠানে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়।) তবে পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি, ঢেকুর এরকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায়, তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো। সেটা হচ্ছে- থ্যাংক ইউ। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ অনুভব করি, তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।
১১.
আমেরিকাতে তরুণ-তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না। কারণ তাহলে অন্যরা সেটাকে বিশেষ এক ধরণের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা-কাচ্চারা সেটা পড়ে ফেলে বলে খবর পেয়েছি –তাই এই বিষয়টাকে আর বিস্তৃত করা গেল না!)
১২.
আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটা বলার জন্য উপরের কথাগুলো একটি ভনিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবারে আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।
আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, সেটা একটা কৌতুকের মতো)। তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে, তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না। আমি আশায় আশায় থাকি, যে কোনোদিন এই দেশের সরকার একটি দুটি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে, আমার খুব ইচ্ছে তারা অত্যন্ত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক, এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।
আমাদের দেশ থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়ে সেখানে থেকে যায়, তাদেরকে আসলে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ কখনো ভুলতে পারে না যে, তারা এই দরিদ্র দেশটির মূলন্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিদানে তারা দেশকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকাকে (বা সেরকম কোনো একটা দেশকে) সেবা করে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে।