কেউ যেন মনে না করে তাকে নিয়ে শুধু রাগ দুঃখ ক্ষোভ কিংবা ব্যবসা হচ্ছে, আমাদের চোখের আড়ালে তার জন্যে গভীর ভালোবাসার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগত্ রয়েছে। আমি আর আমার স্ত্রী ইয়াসমীন যখন হুমায়ূন আহমেদের পাশে থাকার জন্য নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম তখন একজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হয়েছিল। সে হুমায়ূন আহমেদের সেবা করার জন্যে তার কেবিনে বসে থাকতো। শেষ কয়েক সপ্তাহ যখন তাকে অচেতন করে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো তখনো এই ছেলেটি সারারাত হাসপাতালে থাকতো। হুমায়ূন আহমেদ যখন আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে তখনো সে আমাদের সাথে ছিল। সেই দিন রাতে এক ধরনের ঘোর লাগা অবস্থায় আমরা যখন নিউইয়র্ক শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি তখনো এই ছেলেটি নিঃশব্দে আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটে গেছে।
দেশে ফিরে এসে মাঝে মাঝে তার সাথে যোগাযোগ হয়। শেষবার যখন তার সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে সে বলেছে এখনো মঝে মাঝে সে বেলভিউ হাসপাতালে গিয়ে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বসে থাকে।
কেন বসে থাকে আমি জানি না। আমার ধারণা সে নিজেও জানে না। শুধু এইটুকু জানি এই ধরনের অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। মনে হয় এই ভালোবাসাটুকুই হচ্ছে জীবন।
আমেরিকা নিয়ে এক ডজন
আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে, অন্যরা পি.এইচ.ডি. করতে। এরা সবাই এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে জীবন হিসেবে বেছে নিলে পি.এইচ.ডি. করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি নিজেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার এই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেছে নেওয়ার আগে কোথায় কী ধরণের প্রোগ্রাম, কোন প্রফেসর কী গবেষণা করেন, তাদের র্যাংকিং কী রকম এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। আমার মনে আছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক করেছিলাম তার প্যাডের কাগজটি দেখে (না, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না)।
যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকাতে আঠারো বছর ছিলাম, এরপরেও অনেকবার যেতে হয়েছে, তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোনো বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র-ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো। আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল এরকম :
০১.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বা সহজ কথায় আমেরিকা) পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্যে সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু তাদের দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে সব দেশে হানাহানি খুনোখনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমিরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্যে সেটি চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়, তাই থাকার জন্যে, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্যে আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।
০২.
আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথে ঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পরে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।
০৩.
পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয়, সবার নামের দুটো অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্য এবং শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবুর রহমান) সেটা তারা জানে না। খেয়ালি বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা জানে না। একটু ঘনিষ্ঠ হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছু দিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদেরকে মোহাম্মদ বলে ডাকছে! তাই ঘনিষ্ঠদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায়, সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বরে দেওয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD লেখা খুবই বিপজ্জনক, তারা সেটাকে ডাক্তারি ডিগ্রি মনে করে সবসময়ই নামের পিছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
০৪.
যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায়, তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু তারা যখন খরচ করতে যায়, তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখামাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমড়ি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকেট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিমের কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সন্তানের পরিবারের জন্য সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা যারা এই দেশে বনানী গুলশানের হাইফাই দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ, এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে।) কাজেই অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে মনে মনে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।