ঘুমন্ত হুমায়ূন আহমেদ আমার কথা শুনতে পারছে কী না সেটা জানার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারি সে শুনছে, কারণ তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে।
আমি অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকি।
একদিন হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে বিপাশা তার বাবাকে দেখতে এলো। যে কারণেই হোক বহুকাল তারা বাবার কাছে যেতে পারেনি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সে যখন গভীর মমতায় তার বাবার কপালে হাত রেখে তাকে ডাকল, কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে কথা বলল, আমরা দেখলাম আবার তার দুই চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন, মনে হয় সে জন্যই এই দুঃখগুলো দিতেও কখনো কার্পণ্য করেননি।
১৯ জুলাই অন্যান্য দিনের মত আমি হাসপাতালে গিয়েছি, ভোর বেলা হঠাত্ করে আমার মা আমাকে ফোন করলেন। ফোন ধরতেই আমার মা হাহাকার করে বললেন, আমার খুব অস্থির লাগছে। কী হয়েছে বল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হবে, কিছুই হয়নি। প্রত্যেকদিন যেরকম হাসপাতালে আসি আজকেও এসেছি। সবকিছু অন্যদিনের মতো, কোনো পার্থক্য নেই। আমার মায়ের অস্থিরতা তবুও যায় না, অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করে ফোনটা রেখেছি, ঠিক সাথে সাথে আমার কাছে খবর এলো আমি যেন এই মুহূর্তে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যাই। হুমায়ূন আহমেদ মারা যাচ্ছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তথ্য কেমন করে পাঠানো সম্ভব তার সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আমি জানি। কিন্তু পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকে একজন মা কেমন করে তার সন্তানের মৃত্যুক্ষণ নিজে থেকে বুঝে ফেলতে পারে আমার কাছে তার ব্যাখ্যা নেই।
আমি দ্রুত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে গিয়েছি। হুমায়ূন আহমেদের কেবিনে সকল ডাক্তার ভিড় করেছে, তার চিকিত্সার দায়িত্বে থাকা ড. মিলারও আছেন। আমাদের দেখে অন্যদের বললেন, আপনজনদের কাছে যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি বুঝতে পারলাম হুমায়ূন আহমেদকে বাঁচিয়ে রাখার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এখন তাকে চলে যেতে দিতে হবে।
আমার স্ত্রী ইয়াসমিন আমাকে বলল, আমার মাকে খবরটা দিতে হবে। ১৯৭১ সালে আমি আমার মাকে আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে তার সারাটা জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিলাম। এতোদিন পর আবার আমি নিষ্ঠুরের মতো তাকে তার সন্তানের আসন্ন মৃত্যুর কথা বলব? আমি অবুঝের মতো বললাম, আমি পারব না। ইয়াসমীন তখন সেই নিষ্ঠুর দায়িত্বটি পালন করল, মুহূর্তে দেশে আমার মা, ভাইবোন সব আপনজনের হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে সব স্বপ্ন, সব আশা এক ফুত্কারে নিভে গেল।
কেবিনের ভেতর উঁচু বিছানায় শুয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদকে অসংখ্য যন্ত্রপাতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তার কাছে শাওন দাঁড়িয়ে আকুল হয়ে ডেকে হুমায়ূন আহমেদকে পৃথিবীতে ধরে রাখতে চাইছে। আমরা বোধশক্তিহীন মানুষের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে তরুণ ডাক্তার এতোদিন প্রাণপণ চেষ্টা করে এসেছে সে বিষণ্ন গলায় আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করল, বলল, আর খুব বেশি সময় নেই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কী কষ্ট পাচ্ছে? তরুণ ডাক্তার বলল, না, কষ্ট পাচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেমন করে জান? সে বলল, আমরা জানি, তাকে আমরা যে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি তাতে তার কষ্ট হবার কথা নয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এরকম অবস্থা থেকে যখন কেউ ফিরে আসে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার এখন কেমন লাগছে? সে বলল, স্বপ্ন দেখার মতো। পুরো বিষয়টা তার কাছে মনে হচ্ছে একটা স্বপ্নের মতো।
একটু পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, যদি কোনো জাদুমন্ত্র বলে হঠাত্ সে জ্ঞান ফিরে পায়, হঠাত্ সে বেঁচে উঠে তাহলে কী সে আবার হুমায়ূন আহমেদ হয়ে বেঁচে থাকবে? তরুণ ডাক্তার বলল, এখন যদি জেগে উঠে তাহলে হবে, একটু পরে আর হবে না। তার ব্লাডপ্রেশার দ্রুত কমছে, তার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমছে, মস্তিষ্কের নিউরন সেল ধীরে ধীরে মারা যেতে শুরু করেছে।
আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কমবয়সী তরুণী একজন নার্স তার মাথার কাছে সবগুলো যন্ত্রপাতির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদের জীবনের শেষ মুহূর্তটি যেন কষ্টহীন হয় তার নিশ্চয়তা দেয়ার চেষ্টা করছে। চারপাশে ঘিরে থাকা যন্ত্রপাতিগুলো এতোদিন তাকে বাঁচিয়ে রেখে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে, একটি একটি যন্ত্র দেখাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে তার জীবনের চিহ্নগুলো মুছে যেতে শুরু করেছে। ব্লাড প্রেশার যখন আরো কমে এসেছে আমি তখন তরুণ ডাক্তারকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, এখন? এখন যদি হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে উঠে তাহলে কী হবে? ডাক্তার মাথা নেড়ে বলল, যদি এখন অলৌকিকভাবে তোমার ভাই জেগে উঠে সে আর আগের মানুষটি থাকবে না। তার মস্তিষ্কের মাঝে অনেক নিউরণ সেল মারা গেছে।
আমি নিঃশব্দে হুমায়ূন আহমেদকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় জানালাম। তার দেহটিতে এখনো জীবনের চিহ্ন আছে, কিন্তু আমার সামনে যে মানুষটি শুয়ে আছে সে আর অসম্ভব সৃষ্টিশীল অসাধারণ প্রতিভাবান হুমায়ূন আহমেদ নয়। যে মস্তিষ্কটি তাকে অসম্ভব একজন সৃষ্টিশীল মানুষ করে রেখেছিল তার কাছে সেই মস্তিষ্কটি আর নেই। সেটি হারিয়ে গেছে।