অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ভলান্টিয়ারদের থেকে ‘কান পেতে রই’-এর ভলান্টিয়াররা একটু ভিন্ন; কারণ তাদের পরিচয় কেউ কখনও জানতে পারবে না। তারা কাজ করে সবার চোখের আড়ালে। আত্মহত্যা করতে উদ্যত যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা না করে নিজের জীবনে ফিরে গিয়েছে সেও কোনোদিন জানতে পারবে না কোন মানুষটির কারণে সে বেঁচে আছে। কোনোদিন তার হাত স্পর্শ করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবে না।
এটি একটি অসাধারণ ব্যাপার! আমি মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে দেখি। তাদের দেখে আমি এই দেশের তরুণ-তরুণীদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস পাই।
পৃথিবীর যেসব দেশে মানসিক হেলপ লাইন পুরোপুরি চালু আছে সেখানে এটি সপ্তাহের সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। ‘কান পেতে রই’ সে রকম পর্যায়ে যেতে পারেনি। এটি সপ্তাহের পাঁচদিন একটা নির্দিষ্ট সময় চালু থাকে। ধীরে ধীরে তারা তাদের সময় বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে তাদের ভলান্টিয়ারের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। চব্বিশ ঘণ্টা চালু রাখতে হলে ভলান্টিয়ারের সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হবে। তারা ধীরে ধীরে সেই কাজ করে যাচ্ছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে তারা হয়তো সেটা আরও দ্রুত করতে পারত।
সপ্তাহের সাতদিন পুরো চব্বিশ ঘন্টা ভলান্টিয়াররা হয়তো থাকতে পারে না, কিন্তু যখন তাদের থাকার কথা তখন কিন্তু তারা সবাই থাকে। এই দেশটি যখন হরতাল আর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়েছিল তখনও তারা হাজির ছিল। তারা ঈদের দিনও হাজির ছিল, পূজার ছুটিতেও হাজির ছিল। মানসিক সেবা দিতে আসার সময় তারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে, সাইকেলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কোনো যানবাহন না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে হেঁটে এসেছে, কিন্তু কখনও কেউ অভিযোগ করেনি।
কোনো পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হবে না, কোনো টেলিভিশনে তাদের দেখা যাবে না– কিন্তু কখনও তাদের মুখের হাসিটি বন্ধ হয়নি। এই মুহূর্তে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষজনকে সাহায্য করে যাচ্ছে। একসময় তারা বড় হবে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব নেবে। তখনও তারা নিশ্চয়ই সেখানে অন্য সবার থেকে ভিন্ন হবে। আমি সেটা দেখার জন্যেও অপেক্ষা করে আছি।
‘কান পেতে রই’ সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি। কারণ আমার পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য এদের সঙ্গে যুক্ত। তারা যখন তাদের কাজ শুরু করে তখন খুব বড় গলায় আমাদের বলেছিল, “আমরা তোমাদের মতো বড় বড় মানুষের কোনো সাহায্য না নিয়ে এটা দাঁড় করাব।”
প্রথমেই তারা আটকে পড়েছিল। রিকশা করে ঘুরছে দুটি কমবয়সী মেয়ে, তাদেরকে ঢাকা শহরের কোনো বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে রাজি হওয়া দূরে থাকুক, কথা বলতেই রাজি হয়নি। কাজেই বাসা ভাড়া করার জন্যে আমাদের মতো বড় মানুষদের একটি-দুটি টেলিফোন করতে হয়েছিল। এরপর তারা আর কখনও আমাদের সাহায্য নেয়নি। কোনো এক সন্ধেবেলা একটা কেক বা সদ্যপ্রকাশিত একটা বইয়ের বান্ডিল নিয়ে গেলে ভিন্ন কথা– সেগুলো নিয়ে তাদের উচ্ছাসের কোনো অভাব নেই।
আমি পত্রপত্রিকায় লিখি। সবসময় খারাপ খারাপ বিষয় নিয়ে লিখতে ভালো লাগে না, সুন্দর কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। আমি ‘কান পেতে রই’-এর এই উদ্যোগ নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। একই পরিবারের সদস্য রয়েছে বলে তারা অনুমতি দেয়নি। এখন আমার পরিবারের সদস্য এখানে নেই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আছে। শুধু তাই নয়, পুরো এক বৎসর তারা সফলভাবে কাজ করে গেছে। তাই এবারে যখন ‘কান পেতে রই’-কে নিয়ে লিখতে চেয়েছি, তারা আনন্দ এবং আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়েছে।
আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাদের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কিছু কী তারা সবাইকে জানাতে চায়। তারা বলেছে শুধুমাত্র তাদের সেবা দেওয়ার সময় এবং তাদের টেলিফোন নম্বরগুলো জানালেই হবে। এই মুহূর্তে তাদের প্রচারের পুরো কাজটুকু হয় সামাজিক নেটওয়ার্ক কিংবা লিফলেট বিতরণ করে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার তাদের বাজেট নেই। বয়স কম বলে তারা এখনও আপোস করতে শেখেনি। তাই আদর্শের মিল নেই বলে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় তাদের উপর ফিচার করতে চাইলেও তারা রাজি হয় না।
কাজেই যারা কম্পিউটারের নেটওয়ার্কে নেই, তাদের বেশিরভাগই এই চমৎকার উদ্যোগটার কথা জানে না। যারা খবরের কাগজ পড়ে, তাদের মাঝে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেউ যদি থাকে তাহলে হয়তো তারা একটুখানি সাহায্যের খোঁজ পেতে পারবে। কাজেই আমি ‘কান পেতে রই’-এর সময়সূচি আর টেলিফোন নম্বরটুকু দিয়ে দিচ্ছি:
রবিবার থেকে বুধবার, দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা। বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে ভোর ৩টা।
টেলিফোন নম্বরগুলো হচ্ছে–
০১৭৭৯৫৫৪৩৯১, ০১৭৭৯৫৫৪৩৯২, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৫, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৬, ০১৯৮৫২৭৫২৮৬ এবং ০১৮৫২০৩৫৬৩৪।
গত বই মেলায় আমি এই প্রতিষ্ঠানের ভলান্টিয়ারদের একটা বই উৎসর্গ করেছিলাম। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম–
“তোমরা কিছু তরুণ-তরুণী মিলে নিঃসঙ্গ, বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্তদের মানসিক সেবা দেবার জন্যে একটা হেলপ লাইন খুলেছ। এমনকি আত্মহত্যা করতে উদ্যত কেউ কেউ শেষ মূহূর্তে তোমাদের ফোন করেছিল বলে তোমরা তাদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছ। আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে কখনও কারও জীবন বাচাঁতে পারিনি, কিন্তু তোমরা এই বয়সেই মানুষের জীবন বাচাঁতে পার– কী আশ্চর্য!’’