ধর্মযাজক হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই মানুষগুলো কোনো উপদেশ শুনতে আসে না, তার আসলে তাদের বুকের ভেতর আটকে থাকা অবরুদ্ধ যন্ত্রণার কথা বলেই ভারমুক্ত হতে চায়। কোনো একজন মানুষ যদি গভীর মমতা দিয়ে একজন হতাশাগ্রস্ত বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের কষ্টের কথাটি শুনে, তাহলে তাদের অনেকেই মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যায়।
ধর্মযাজক এই অবিশ্বাস্য চমৎকার তথ্যটি আবিস্কার করে ১৯৫২ সালে লন্ডনে টেলিফোনে মানসিক সেবা দেওয়ার একটি হেলপ লাইন বসিয়েছিলেন। সেখানে কিছু ভলান্টিয়ার হতাশাগ্রস্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিংবা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মনের কথা শুনত। তারা নিজে থেকে কোনো উপদেশ দিত না। যারা তাদের যন্ত্রণার কথা, কষ্টের কথা বলত– সেই মানুষজন কথা বলতে বলতে আবিস্কার করত তাদের যন্ত্রণা কমে আসছে– একজন মানুষ গভীর মমতা দিয়ে তার দুঃখের কথা শুনছে– সেখান থেকেই তারা সান্ত্বনা খুঁজে পেত।
পদ্ধতিটি এত সহজ, এত সুন্দর এবং এত সফল যে, পৃথিবীর চল্লিশটি দেশে এ রকম মানসিক সেবা দেওয়ার হেলপ লাইন রয়েছে। ‘কান পেতে রই’ দিয়ে বাংলাদেশ হচ্ছে একচল্লিশতম দেশের একচল্লিশতম প্রতিষ্ঠান।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চল্লিশটিরও বেশি দেশে এই হেলপ লাইনগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তাই কীভাবে এটা দিয়ে কাজ করানো যায় সেটি অজানা কিছু নয়। যারা ‘কান পেতে রই’ দাঁড় করিয়েছে তাদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক সেবা দেওয়ার হেলপ লাইনে প্রায় তিন বছর কাজ করে এসেছে।
সারা পৃথিবীতেই যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হয়, এখানেও তাই। এই কাজটি করে ভলান্টিয়াররা, কিন্তু এরা কেউ সাধারণ ভলান্টিয়ার নয়। অনেক যাচাই-বাছাই করে তাদেরকে নেওয়া হয়। তারপর সবাইকে একটা দীর্ঘ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যারা সফলভাবে পুরো প্রক্রিয়াটার ভেতর দিয়ে যেতে পারে, তারাই এই হেলপ লাইনে টেলিফোনের সামনে বসতে পারে। যে ফোন করে সাহায্য নিতে চায় তাকে তার নিজের পরিচয় দিতে হয় না। সে যে সমস্যার কথাটি বলে সেটি পুরোপুরি গোপন রাখা হয়, পৃথিবীর আর কেউ সেটি জানে না।
আমার কাছে যেটি সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে, ‘কান পেতে রই’ প্রতিষ্ঠানটিতে যে ভলান্টিয়াররা কাজ করে তাদের পরিচয়ও বাইরের কাউকে জানানো হয় না! একশ দিন পূর্তি হওয়ার পর তারা একটি অনুষ্ঠান করেছিল। সেখানে কয়েকজন ভলান্টিয়ার উপস্থিত দর্শকদের সামনে কথা বলেছিল। কিন্তু তারা কথা বলেছিল পর্দার আড়াল থেকে। সাদা স্ক্রিনে শুধু তাদের ছায়া দেখা গেছে।
আমাকে অবশ্যি এই ভলান্টিয়ারদের পর্দার আড়াল থেকে দেখতে হয় না, আমি তাদের অনেককেই চিনি। আমি নিজেও ভাবছি, কোনো এক সময় ভলান্টিয়ার হওয়ার প্রশিক্ষণটুকু নিয়ে নেব।
হেলপ লাইনের টেলিফোনের সামনে বসার মতো সাহস আমার নেই। যখন কোনো একজন ছাদে রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে লাফ দেওয়ার পূর্বমুহূর্তে ফোন করবে কিংবা একগাদা ঘুমের ওষুধ হাতে নিয়ে টেলিফোন ডায়াল করবে কিংবা ধারালো ব্লেড হাতে নিয়ে শরীরের কোনো একটা ধমনী কেটে ফেলার হুমকি দেবে, তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে বলে শান্ত করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার নেই। কিন্তু অন্তত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কেউ যদি উদভ্রান্তের মতো আমার কাছে সাহায্যের জন্যে ছুটে আসবে, তখন কীভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, সেটুকু হয়তো আরেকটু ভালো করে জানব।
‘কান পেতে রই’ সম্পর্কে জানার পর এর মাঝেই আমার একটা বড় লাভ হয়েছে– আগে যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেউ আসত, আমার ভেতরে একটা ধারণা কাজ করত যে, তাকে বুঝি কিছু উপদেশ দিতে হবে। এখন আমি জানি, কোনো উপদেশ না দিয়ে শুধু যদি তাদের কথা একটু মমতা দিয়ে শুনি, তাহলেই তাদের অনেক বড় উপকার হয়। আমি সেটা ঘটতে দেখেছি।
‘কান পেতে রই’ প্রতিষ্ঠানটির ভলান্টিয়াররা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছে তারা কখনওই সাহায্যপ্রার্থীর পরিচয় বা সমস্যার কথা কাউকে বলবে না, তাই বাইরের কেউ সেটি জানতে পাবে না। বড়জোর একটা পরিসংখ্যান পেতে পারে। এই পরিসংখ্যানগুলো গবেষণার বিশাল একটা উপাত্ত হতে পারে।
তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমি পুরো প্রক্রিয়াটির রুদ্ধশ্বাস এবং নাটকীয় অংশটুকু অনুভব করতে পেরেছি। আত্মহত্যা করতে উদ্যত কোনো একজন মানুষের সঙ্গে যখন কোনো ভলান্টিয়ার দীর্ঘ সময় কথা বলে, তার উত্তেজিত স্নায়ু শীতল করে আনে, তার আশাহীন অন্ধকার জগতের মাঝে ছোট একটা প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত টেলিফোনটি নামিয়ে রাখে, তখন অনেক সময়েই ভলান্টিয়াররা নিজেরাই হতচকিত, বিচলিত, ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে যায়। অন্য ভলান্টিয়াররা তখন তাকে ঘিরে রাখে, তাকে এক কাপ চা তৈরি করে খাওয়ায়, পিঠে থাবা দেয়!
আমি সবিস্ময়ে এই ভলান্টিয়ারদের দেখি; তার কারণ এদের মাঝে এক-দুজন চাকুরিজীবী থাকলেও সবাই কমবয়সী তরুণ-তরুণী। বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আমি আমার জীবনে একটা সত্য আবিস্কার করেছি; সেটি হচ্ছে, বড় কিছু করতে হলে সেটি ভলান্টিয়ারদের দিয়ে করাতে হয়, যে ভলান্টিয়াররা সেই কারণটুকু হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে। কাজেই মানসিক সেবা দেওয়ার এই কাজটুকুও আসলে ভলান্টিয়াররা করে।