তারা এখন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, মুক্তিযুদ্ধের পতাকাবাহক? এটি কী করে সম্ভব? আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেবে? না কি প্রকৃত ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর– জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের গ্রহণ করার জন্যে আওয়ামী লীগকেই খানিকটা পাল্টে যেতে হবে? তাদের এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বেশি বলা যাবে না, বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে হবে, হিন্দুধর্মের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে হবে, পেট্রোল বোমা বানানো শিখতে হবে?
কেউ কি আমাকে একটু বুঝিয়ে দেবেন? যে আদর্শকে আমরা এত গুরুত্ব দিয়ে নিই, রাজনীতিতে সেটা আসলে একটা রঙ-তামাশা?
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন খবর পেলাম খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান লন্ডনে ঘোষণা দিয়েছেন, তার বাবা জিয়াউর রহমান যেহেতু ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন তাই তিনিই হচ্ছেন দেশের ‘প্রথম’ প্রেসিডেন্ট! ভাগ্যিস বেচারা জিয়াউর রহমান বেচেঁ নাই। যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার গুণধর ছেলের কথাবার্তা শুনে লজ্জায় গলায় দড়ি দিতেন।
কান পেতে রই’
আমি তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নূতন যোগ দিয়েছি। একদিন বিকেলে আমার বিভাগের একজন ছাত্র আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ছাত্রটির উদভ্রান্তের মতো চেহারা, শূন্য দৃষ্টি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে!’’
ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেন?”
ছাত্রটি কোনো সদুত্তর দিতে পারল না; শুধু বুঝতে পারলাম কোনো একটা দুর্বোধ্য কারণে সে তীব্রভাবে হতাশাগ্রস্ত, মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কীভাবে মানসিকভাবে বির্পযস্ত বা হতাশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের হতাশা থেকে টেনে বের করে আনতে হয়, আমার জানা নেই। শুধুমাত্র কমন সেন্স ব্যবহার করে আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছি, শক্তি দেবার চেষ্টা করেছি।
সে যখন চলে যাচ্ছে, আমি তখন তাকে বলেছি, ‘‘তোমার যদি আবার কখনও আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে, করে আমার কাছে চলে এস।”
ছেলেটি মাঝে মাঝেই আসত। শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলত, “স্যার, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে।”
আমি তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, সাহস দিতাম। ছাত্রটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেনি, পাশ করে বের হয়েছে। কিন্তু আমার একটি ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল। এতদিন হয়ে গেছে, তবু সেই ঘটনাটির কথা ভুলতে পারি না। এখনও যখন কোনো একটি ছাত্র বা ছাত্রী আমার অফিসে ঢুকে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে– স্যার, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে– আমার বুক কেঁপে উঠে।
আমি জানি, সাহস করে কিংবা মরিয়া হয়ে যে এক বা দুজন ছাত্রছাত্রী আমার কাছে আসে, তার বাইরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আছে যারা কোনো কারণ ছাড়াই হতাশাগ্রস্ত, নিঃসঙ্গ, কিংবা আত্মহত্যাপ্রবণ। তারা কী করবে বুঝতে পারে না, কোথায় সাহায্য পাবে জানে না। আমাদের সবার অজান্তে তারা বিচিত্র এক ধরনের যন্ত্রণায় ছটফট করে। একজন শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা আমরা সবাই জানি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও তাকে যে একটু সেবা করে স্বাভাবিক করে তুলতে হয় সেটা কিন্তু আমরা এখনও জানি না।
আজকে আমার এই লেখাটি লিখতে খুব আনন্দ হচ্ছে। কারণ কিছু তরুণ-তরুণী মিলে এই দেশে মানসিক সেবা দেওয়ার জন্যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘কান পেতে রই’ এবং এই সপ্তাহে একই প্রতিষ্ঠানটির এক বছর পূর্তি হবে। এই এক বছর তারা অসংখ্য হতাশাগ্রস্ত নিঃসঙ্গ বিপর্যস্ত মানুষকে টেলিফোনে মানসিক সেবা দিয়েছে। আত্মহত্যা করতে উদ্যত মানুষকে শান্ত করে নূতন জীবন উপহার দিয়েছে। আজকে আমি এই প্রতিষ্ঠানটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে লিখতে বসেছি।
টেলিফোনে মানসিক সেবা দেওয়ার ব্যাপারটি যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এটি কীভাবে কাজ করে আমি বুঝতে পারছিলাম না। এর পেছনের কাহিনিটি খুবই চমকপ্রদ। সেটা জানার পর আমি প্রথমবার বুঝতে পেরেছি এটা কীভাবে কাজ করে।
যুক্তরাজ্যের একজন ধর্মযাজকের কোনো একজন কাছের মানুষ হঠাৎ আত্মহত্যা করেছিল। ধর্মযাজক মানুষটি কোনোভাবে এটা মেনে নিতে পারলেন না। তখন তিনি ঠিক করলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত মানুষদের তিনি বোঝাবেন, সাহস দেবেন, শক্তি দেবেন, সান্ত্বনা দেবেন। সত্যি সত্যি তিনি একদিন কাজটি শুরু করে দিলেন এবং দেখতে দেখতে অনেক মানুষ তাঁর কাছে সাহস, সান্ত্বনা, উপদেশ আর শক্তি পেতে আসতে শুরু করল।
কিছুদিনের ভেতরে ধর্মযাজক আবিস্কার করলেন, এত মানুষ তার কাছে আসতে শুরু করেছে যে, তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে ওয়েটিং রুমে অসংখ্য মানুষ বসে থাকে। ধর্মযাজক মানুষটি তখন কিছু ভলান্টিয়ারকে ডেকে নিয়ে এলেন, যারা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করা মানুষদের একটু চা-কফি খেতে দেবে, তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে অপেক্ষার সময়টুকু কাটানোর জন্যে সাহায্য করবে।
ক’দিনের ভেতরে ধর্মযাজক অত্যন্ত বিচিত্র একটি বিষয় আবিস্কার করলেন। ধর্মযাজক দেখলেন, যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসছিল, হঠাৎ করে তাদের আর তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হচ্ছে না। ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে কথা বলেই তারা খুশি হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে।