২.
এবারের স্বাধীনতা দিবসে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া নিয়ে শুরুতেই একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল, আমরা সবাই সেটা জানি। জটিলতাটি এসেছিল ইসলামী ব্যাংকের অনুদান নিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল যে কুলাঙ্গারেরা, তাদের সমর্থনপুষ্ট এই ব্যাংক কী করেছে সেটি তো কারও অজানা নেই! এই মুহূর্তে যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলছে, সেই বিচারকাজ থামানোর জন্যে দেশে-বিদেশে যে লবিস্ট লাগানো হয়েছে, তাদেরকেও টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করছে এই ব্যাংক– আমাদের কাছে সে রকম গুরুতর অভিযোগ আছে।
জামায়াতে ইসলামী নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী যে দলটি আছে, তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে টাকা-পয়সা আর ব্যবসা-বাণিজ্য। এই ব্যাংকটি দিয়েই সেই টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেই ব্যাংকটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে টাকা দেবে আর সেই টাকায় আমরা ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইব– এটি যে কত উৎকট একটি রসিকতা সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার জানে না সেটা বিশ্বাস করা কঠিন!
কিন্তু সেটাই ঘটে গিয়েছিল, এই দেশের তরুণেরা প্রথমে এর বিরোধিতা করে সোচ্চার হয়েছিল; তারপর অন্যেরা। এই দেশের মানুষের প্রচণ্ড চাপে সরকার শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছে যে, ইসলামী ব্যাংকের টাকাটা তারা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করবে না।
এইটুকু হচ্ছে ভূমিকা। আমি এর পরের কথাটা বলার জন্যে এই ভূমিকাটুকু করেছি। সরকার ঘোষণা দিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের টাকা জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্যে ব্যবহার করা না হলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্যে ব্যবহার করা হবে! সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, এই দেশের তরুণ ছেলেমেয়েরা ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলেছে, ইসলামী ব্যাংক যেন সেই দুর্ব্যবহারে মনে কষ্ট না পায় সে জন্যে যেভাবে হোক সরকারের তাদেরকে যখোপযুক্ত সম্মান দেখাতে হবে! তাই তাদের টাকাটা বাংলাদেশের আয়োজিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যবহার করা হবে!
বেশ কিছুদিন আগে যখন হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছিল, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এটা এমন কিছু বেশি টাকা নয় (শুনে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম, টাকা চুরি করার টার্গেট হিসেবে কত টাকা রাখা যেতে পারে সেখানে এটা একটা নূতন মাত্রা যোগ করেছিল)! যদি চুরি করার জন্যেই হাজার কোটি টাকা খুব বেশি টাকা না হয়, তাহলে ইসলামী ব্যাংকের মাত্র কয়েক কোটি টাকা যেন আমাদের দেশের জাতীয় একটা অনুষ্ঠানে নিতেই হবে? দেশের মানুষের রক্তমাখা টাকা তাদের ফিরিয়ে দিলে কী হত? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারকে জানতে হবে, ইসলামী ব্যাংকের প্রতি তাদের এই ভালোবাসা আর সহমর্মিতা এই দেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে হতাশ করেছে– আমাকেও হতাশ করেছে।
শুরুতে বলেছিলাম, দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে হলে মূল কিছু বিষয়ে সবার একমত হতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে এই দেশের স্থপতি সেটি হচ্ছে এ রকম একটি বিষয়। এই দেশটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ করে পাওয়া একটি দেশ; তাই মুক্তিযুদ্ধের যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটি শুরু করা হয়েছিল সেই স্বপ্নকে ভিত্তি করে তার উপর পুরো দেশটি দাঁড় করানো হবে– এই সত্যটিও সে রকম একটি বিষয়।
আমরা আজকাল খুব ঘন ঘন গণতন্ত্র শব্দটি শুনতে পাই। যখনই কেউ এই শব্দটি উচ্চারণ করেন তখনই কিন্তু তাকে বলতে হবে এই গণতন্ত্রটি দাঁড়ানো থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির উপরে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সরিয়ে একটা গণতন্ত্র তৈরি করব, সেই গণতন্ত্র এই দেশটিকে একটা সাম্প্রদায়িক দেশ তৈরি করে ফেলবে, সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল মানুষ সেই দেশে সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে না– সেটা তো হতে পারে না।
কাজেই ধর্ম ব্যবহার করে রাজনীতি করা গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করা হলেও কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের সঙ্গে খাপ খায় না। গত নির্বাচনের ঠিক আগে আগে নির্বাচন প্রতিহত করা আর যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রতিহত করার আন্দোলন যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, তখন সন্ত্রাস কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেটা দেশের মানুষের নিজের চোখে দেখার একটা সুযোগ হয়েছিল।
সেই সন্ত্রাসের নায়ক ছিল জামায়াতে ইসলামী আর তার ছাত্র সংগঠন। একাত্তরে এই দেশটি যুদ্ধাপরাধ করেছিল। চার দশক পরেও সেই যুদ্ধাপরাধের জন্যে তাদের মনে অপরাধবোধ নেই, গ্লানি নেই, একাত্তরের সমান হিংস্রতা নিয়েই তারা এই দেশে তাণ্ডব করতে রাজি আছে।
আমি অবশ্য এই লেখায় জামায়াতে ইসলামীর সন্ত্রাস নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি কিছুদিন আগে দেখা খবরের কাগজের একটা রিপোর্টের কথা বলতে এসেছি যেখানে লেখা হয়েছে উত্তরবঙ্গের কোনো একটি শহরে জামায়াতে ইসলামীর বড় একটা দল অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে এসেছে। বিষয়টা কি এতই সহজ?
যে সারাজীবন জামায়াতে ইসলামী করে এসেছে, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের জবাই করেছে, হিন্দুদের বাড়ি লুট করে তাদেরকে দেশছাড়া করেছে, এই কয়েক মাস আগেও পেট্রোল বোমা দিয়ে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, হিন্দুদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে– রাতাবাতি তারা জামায়াতে ইসলামী থেকে আওয়ামী লীগ হয়ে গেল! তাদের সমস্ত মন-মানসিকতা, চিন্তা করার ধরন, আদর্শ, স্বপ্ন একটা ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেল?