সম্ভবত হয়নি- কারন আমার দেশের সম্পাদক মহোদয়কে অত্যন্ত সঙ্গত কারনে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং এই দেশের পনেরটি গুরুত্বপূর্ন পত্রিকার ততোধিক গুরুত্বপূর্ন সম্পাদক প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে তার পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। মোটামুটি একই সময়ে প্রায় একই ধরনের কারন দেখিয়ে চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, পনেরোজন সম্পাদক তখন একত্র হয়ে তাদের জন্যে মুখ ফুটে কোনো কথা বলেননি। ভাগ্যিস গোলাম আজম কিংবা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মত যুদ্ধাপরাধীদের কোনো পত্রিকার সাথে সম্পর্ক নেই, যদি থাকতো তাহলে এই পনেরোজন সম্পাদক হয়তো তাদের পক্ষেও বিবৃতি দিতেন। “আমার দেশ” এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের তীব্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ প্রচারনার কারনে এই দেশে অনেক প্রাণ ঝড়ে গেছে, তিনি নিজের হাতে কোনো খুন হয়তো করেননি কিন্তু তার কারনে মানুষের প্রাণ বিপন্ন হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের এরকম একজন মানুষের জন্যে এই দেশের পনেরোজন সম্পাদক বিবৃতি দিতে পারেন সেই আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। ঘটনাটি আমাকে গভীরভাবে ব্যাথিত করেছে এবং আমি জানি এই দেশের তরুন সমাজকে প্রচন্ডভাবে ক্রুদ্ধ করেছে। এই গুরুত্বপূর্ন পত্রিকাগুলোই যেহেতু এই দেশের মানুষের কাছে সব খবর পৌছে দেই তাই নূতন প্রজন্মের ক্ষোভের কথাটি হয়তো দেশের মানুষ কোনোদিন জানতেও পারবেনা।
যাই হোক, রাজনৈতিক মানুষের কাছে হয়তো আমরা নৈতিকতা আশা করা ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু ধার্মিক মানুষের কাছে তো আশা করতেই পারি। আমাদের মত সাধারণ মানুষ হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের মত ইসলামের আলেম বা চিন্তাবিদ না হতে পারে, কিন্তু তাই বলে আমাদের মত মানুষেরা যে কোরান হাদীস পড়তে পারেনা তা নয়। (হেফাজত ইসলামের ব্লগের উপর খুব রাগ কিন্তু তাঁরা কি জানে ইসলামের উপর খুব চমৎকার ব্লগ আছে?) ইসলাম ধর্মের ধর্ম গ্রন্থে তো খুব পরিষ্কার ভাবে লেখা আছে কোনো মানুষকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া খুব বড় অপরাধ, পরকালে তাঁর জন্যে খুব কঠোর শাস্তির কথা বলা আছে। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো কিংবা “আমার দেশ” পত্রিকার মতো হেফাজতে ইসলাম কেমন করে ঢালাওভাবে শাহবাগের সকল তরুন তরুনীদের নাস্তিক হিসেবে ঘোষনা দিতে পারল? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হলেই সে জামাতে ইসলামের বিপক্ষের একজন মানুষ হবে, কিন্তু জামাত্তে ইসলামীর বিপক্ষে হলেই সে ইসলামের বিপক্ষে হবে এই সরলীকরন কবে থেকে শুরু হল?
৩.
মে মাসের পাঁচ তারিখে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধের ডাক দিয়েছিল। তাদের সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই কথাটি অনেকবার বলার পরও খালেদা জিয়ে অবরোধের সাথে মিলিয়ে আটচল্লিশ আলটিমেটাম দিলেন। হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের কী পরিকল্পনা ছিল তাদের সাথে বিএনপি বা জামাতের কী যোগাযোগ ছিল আমরা কিছু জানিনা কিন্তু মে মাসের পাঁচ তারিখ ভোর চারটায় সময় আমি আমার ফোনে একটি এসএমএস পেলাম। ইংরেজী অক্ষরে বাংলায় লেখা এসএমএস পেলাম। ইংরেজী অক্ষরে বাংলায় লেখা এসএমএস আমি হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ
“এই নাস্তিক জাফর ইকবাল, তোদের মৃত্যুর ঘন্টা বাজছে। হতে পারে আজ রাতই তোদের শেষ রাত। কাল হয়তো তোরা আর পৃথিবীতে থাকতে পারবিনা কারন এই জমানার শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদিস আল্লামা আহমদ শফির ডাকে সারা বাংলাদেশের তোহিদি জনতা মাঠে নেমে এসেছে। সেই সব তোহিদি জনতা প্রধান-মন্ত্রী সহ তোদের সব ধরে ধরে জবাই করে ছাড়বে। আমার আল্লাহকে নিয়ে বিশ্বনবীকে নিয়ে আলীমকে নিয়ে কোরানের হাফেজদের নিয়ে কট্যুক্তি করার ভয়ংকর পরিনাম কী তা আগামী কালকেই হাড়ে হাড়ে টের পাবি তোরা।”
যে কোনো হিসেবে এটি একটি অত্যন্ত ভয়ংকর একটি এসএমএস (এটি পাবার পর আমার সম্ভবত পুলিশকে জানানো উচিত ছিল কিন্তু এসব খবর সংবাদপত্রে চলে যায়, আপনজনেরা ভয় পায় আমি তাই চেপে যাবার চেষ্টা করি।) তবে এই এসএমএসটি পড়লে ৫ মে এর ঘটনা সম্পর্কে অনেক কিছু পরিস্কার হয়ে যায়। সরকার যদিও এতাকে একটা “শান্তিপূর্ন” “নিয়মতান্ত্রিক” অবরোধ এবং সমাবেশ ভেবে তাদের ঢাকা শহরে আসতে দিয়েছিল কিন্তু তাদের কর্মীদের অন্য পরিকল্পনা ছিল। হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের তাদের নেতাদের উপর অটল বিশ্বাস এবং তাঁর নেতৃত্বে তাঁরা আমাদের মত মানুষদের জবাই করে ফেলাটাকে তাদের ইমানী দায়িত্ব হিসেবে মনে করে। মে মাসের ৫ তারিখে খালেদা জিয়া হেফাজতে ইসলামকে সব রকম সাহায্য করার আহবান জানিয়ছিলেন। তার আহবানে শহরে একটা চরম বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে দেয়া হলে শেষ পর্যন্ত কী হতো আমরা জানিনা।
সেদিন ঢাকা শহরে যে তান্ডব হয়েছিল দেশের মানুষ তা অনেকদিন মনে রাখবে। ইসলামকে হেফাজত করার দায়িত্ব নিয়ে এক স্থে এত কোরান শরীফ সম্ভবত পৃথিবীর আর কোথাও কখনো পোড়ানো হয়নি-এবং সম্ভবত আর কখনো হবেও না। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যদি কখনো কোরান শরীফের অবমাননা করা হয় বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয়। এই প্রথমবার ইসলাম পন্থী দলগুলো একেবারে নিঃশব্দে পবিত্র কোরান শরীফের এতো বড় অবমাননাটি মেনে নিয়েছে, কেউ টু শব্দটি করেনি। মে মাসের ৫ তারিখের মতো এতো বড় নিষ্ঠুরতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ আমরা আগে কখনো দেখছি বলে মনে করতে পারিনা আর এর সবকিছু ঘটানো হয়েছে ইসলামকে রক্ষা করার নামে, এর থেকে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?