সবাই মিলে সেই কাজটা শুরু করে দিই না কেন?
সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য (জুন ১১, ২০১৩)
১০ মে ২০১৩ তারিখে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে দেয়া বক্তব্য
——————————-
আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা:
আজকের দিনটি তোমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি- একই সাথে এটি সবচেয়ে আনন্দেরও একটি দিন। আমার অনেক বড় সৌভাগ্য যে তোমাদের এই আনন্দের দিনটিতে আমি তোমাদের সাথে কিছু সময় কাটাতে পারছি। আমাকে এই সুযোগটি দেয়ার জন্যে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। তোমরা যেরকম তোমাদের জীবনের প্রথম সমাবর্তনে এসেছ আমিও ঠিক সেরকম আমার জীবনের প্রথম সমাবর্তন বক্তা হিসেবে এসেছি। সমাবর্তন নিয়ে তোমাদের মনের ভেতর যেরকম আগ্রহ এবং উদ্দীপনা তোমাদের সামনে কয়েকটি কথা বলার জন্যে আমার ভেতরেও ঠিক একই আগ্রহ এবং উদ্দীপনা।
তোমাদেরকে আমি কোনো উপদেশ দেব না, তোমাদের কোনো নীতিকথাও শোনাব না, আমি তোমাদের হয়তো কয়েকটি কথা স্মরণ করিয়ে দেব। তার পাশাপাশি আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে যে কয়টি সত্য উপলব্ধি করেছি তোমাদেরকে সেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করব। কয়েক যুগ পর তোমরা হয়তো নিজেরাই এই সত্যগুলো উপলব্ধি করতে, আমি মাঝখানের সেই দীর্ঘ সময়টুকু শর্ট সার্কিট করে দিচ্ছি মাত্র- তার বেশী কিছু নয়।
তোমরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনের পরের ধাপে পা দিতে যাচ্ছ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চলে আসার কারণে দেশের সবাই এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়ায় কতো খরচ হয় তার একটা ধারণা পেয়ে গেছে। সেই তুলনাটি থেকে তোমাদের ধারণা হতে পারে তোমরা বুঝি খুব অল্প খরচে একটা ডিগ্রী পেয়েছ- সেটি কিন্তু সত্যি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটকে তোমাদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে তোমাদের লেখাপড়ার খরচটুকু বের হয়ে আসবে এবং আমি বাজী ধরে বলতে পারি সেই পরিমানটুকু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ থেকে কোনো অংশে কম নয়- বরং বেশী হলে আমি অবাক হব না। তোমাদের পেছনে এই খরচটুকু করেছে সরকার। সরকার এই অর্থটুকু কার কাছ থেকে পেয়েছে? পেয়েছে এই দেশের চাষীদের কাছ থেকে, শ্রমিকদের কাছ থেকে, খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে। আমি তোমাদের শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই এই দেশের অনেক দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ হয়তো তার নিজের সন্তানকে স্কুল কলেজ শেষ করিয়ে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি, কিন্তু তার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির অর্থ দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছে। এখন তোমরাই ঠিক করো তোমার এই শিক্ষাটুকু দিয়ে তুমি কার জন্যে কী করবে!
কিছু দিন আগে খবরের কাগজের একটি প্রতিবেদন চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাকে একটি সত্য নূতন করে জানিয়ে দিয়েছে। সত্যটি হল আমাদের দেশ অর্থনৈতিক ভাবে অনেক এগিয়ে এসেছে আর এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে দেশের তিন ধরণের মানুষ। গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা- যার বেশীরভাগই হচ্ছে মেয়ে- অর্ধ সহস্রাধিক* সেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের আমরা সাভারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছি। প্রবাসী শ্রমিক- যারা নিজের আপনজনকে দেশে ফেলে নির্বান্ধব পরিবেশে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এবং এই দেশের কৃষক যাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার জন্যে আমরা আমাদের ভাষায় চাষা নামক একটা শব্দ তৈরী করে রেখেছি। আমি রীতিমত ধাক্কা খেয়েছি যখন আবিষ্কার করেছি- যারা এই দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে আমি তাদের কেউ নই তাদের কারো সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই- আমি তাদের জন্যে কখনো কিছু করিনি। আমার মনে হয়েছে আমি বুঝি এই দেশের বোঝা, এই দেশের গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিকেরা আর মাঠে ঘাটের চাষীরা আমাকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিয়েছে- প্রতিদানে আমি তাদের কিছু দিই নি।
আমি তখন নিজেকে বুঝিয়েছি, দেশের অর্থনীতিকে এখন গার্মেন্টেসের মেয়েরা, প্রবাসী শ্রমিক এবং চাষীরা সচল রেখেছে, তারা একটি গাড়ীর তিনটি চাকার মতো- গাড়ীটি সত্যিকার ভাবে ছুটতে পারবে যখন তার সাথে চতুর্থ চাকাটি জুড়ে দেয়া হবে। সেই চতুর্থ চাকা কোনটি? তোমরা হচ্ছ সেই চতুর্থ চাকা, জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে বলীয়ান আমাদের নূতন প্রজন্ম। আমি বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করে আছি তোমাদের মেধা মনন এবং সৃজনশীলতা নিয়ে কখন তোমরা এই দেশের শ্রমজীবী মানুষের পাশে এসে দাড়াবে। কখন মানুষের শরীরের ঘাম অপসারিত হবে মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।
তোমরা কী জান, এটি তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়? তোমরা কী জান তোমাদের চোখে রয়েছে রঙিণ চশমা, আমাদের চোখে যেটি একেবারেই সাদামাটা তোমাদের চোখে সেটিই বিচিত্র বর্ণে উজ্জল? তোমরা কী জান এখন তোমাদের জীবনকে উপভোগ করার সময়?
তোমরা কী জান জীবনকে কীভাবে সবচেয়ে বেশী উপভোগ করা যায়? তোমাদের সবারই নিশ্চয়ই এই বিষয়ে নিজের একটা ভাবনা আছে- আমি তোমাদের সাথে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া আমার ভাবনাটুকু বিনিময় করি। নিজের জন্যে যখন কিছু একটা করি তখন অবশ্যই আমাদের একধরণের আনন্দ হয় কিন্তু তার থেকে শতগুণ বেশী আনন্দ হয় যখন আমরা অন্যের জন্যে কিছু করি! তোমাদের ভেতর যারা বন্যা পীড়িত মানুষের কাছে গিয়ে তাদের হাতে একটুখানি ত্রাণ তুলে দিয়েছ তখন তাদের মুখে যে হাসিটুকু দেখেছ আমি জানি সেটি তুমি কখনো ভুলবে না। তুমি যখন রক্ত দিয়েছ সেই রক্তের ব্যাগ থেকে ফোটাফোটা রক্ত গিয়ে যখন একজন মূমূর্ষ বিবর্ণ রোগীর মুখে জীবনের স্পন্দন দিয়ে এসেছে, আমি জানি তুমি সেই আনন্দের কথা কখনো ভুলতে পারবে না। তুমি যখন তোমার ক্যাম্পাসের পথে ঘাটে পাতা কুড়ানো হতদরিদ্র শিশুটিকে বারান্দায় বসিয়ে বর্ণ পরিচয় করিয়েছ তুমি নিশ্চয়ই সেই আনন্দটির কথাও কখনো ভুলতে পারনি। যখন গণিত অলিম্পিয়াডে গিয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের সাহায্য করেছ তখন তাদের উজ্জল চোখের দৃষ্টিটি নিশ্চয়ই তুমি ভুলতে পারনি। যারা এখনো সেই তীব্র আনন্দের স্বাদ উপভোগ করোনি তাদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই- জীবনটিকে একেবারে কানায় কানায় উপভোগ করার এখনই সময়। অন্যের জন্যে কিছু করে জীবন উপভোগ করার এই পথটুকুর সন্ধান পেতে পেতে আমার অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল- আমি কিন্তু তোমাদের অনেক আগেই বলে দিয়েছি!