তুচ্ছতার কথায় সেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র’ নাটকের লাইনটার কথা মনে পড়ে। রাখাল বালকেরা যেমন মাছি মারে—ভগবানের কাছেও আমরা তেমনই।
‘অ্যাজ ফ্লাইজ অর টু দি ওয়ানটন বয়েজ।
আর উই টু দা গডস’
তবু সমুদ্রের দৃশ্য বা সিকোয়েন্স এখানে রাখি। চিত্রনাট্যে মাঝেমাঝেই দেখা যাচ্ছে তীরে সমুদ্রের আছড়ে পড়া। ঢেউ-এর প্রত্যাবর্তন ও মাঝ দরিয়া থেকে অনবরত ঢেউ-এর ছুটে আসা। মনে পড়ে কারুর করা ওথেলো সিনেমার শুরুই হয়েছিল বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের দৃশ্য দিয়ে।
সমুদ্রের তরঙ্গ জীবনের অনেক অবস্থার মধ্যে মিলে যায়, মানিয়ে যায়। তাই সমুদ্রের এত প্রভাব মানুষের জীবনে। ইয়োরোপের মানুষদের জীবনে তো ভীষণভাবেই। ওদের শিল্প-সাহিত্য যেন অনেকখানি দখল করে আছে সমুদ্র। যাই হোক জীবনসমুদ্র এই ধারণাটার সঙ্গে মিলিয়ে আরব সাগরের এই দৃশ্যটা আমি চিত্রনাট্যের এখানে রাখলাম। সুটিং তোলার পর এডিটিং টেবিলে গিয়ে দেখতে হবে কি রকম মানাচ্ছে।
নম্রতাকে তখন বলেছিলাম, একজন নারীর দৃষ্টিতে জীবন ও পৃথিবী এভাবেই লিখব গল্পটা।
ও বলেছিল, তোর যা খুশি।
আসলে আমার উওম্যান কনসেপ্ট নিয়ে বেশ কয়েকটা গল্প লেখা আছে। নারীর নানা রূপ, মা, প্রেমিকা, মেয়ে ইত্যাদি নানাভাবে দেখানো হয়েছে সেখানে। কিন্তু একজন নারীর চোখে…সেভাবে তো কিছু লেখা হয়নি। নম্রতার দৃষ্টিতে এই গল্পটা লিখব। সবচেয়ে অসুবিধে হচ্ছে আমি বিবাহিত নই। সেই একুশ বছরেও নয় আর এখন এই বেয়াল্লিশ বছরেও নয়। নম্রতার তখনকার সমস্যা, মারধোরের বর্ণনা—এসব কিছুই ঠিক বুঝতে পারিনি। তখন। এখনও খুব পরিষ্কার নয়। কিছুটা ওপর থেকে জীবনের স্পন্দবিন্দু হিসেবে দেখতে হবে সমস্যাটাকে।
সে গল্প কোনদিন লেখা হয়নি। তাই আজ এতদিন পরে চিত্রনাট্যে তা রূপ দেবার চেষ্টা করছি। পরে ফিল্ম করব। তখন নম্রতাকে খবর দেব। একদিন, তা-ও অনেকদিন আগে, নম্রতার সঙ্গে হঠাৎ নিউ কয়লাঘাটে বুকিং অফিসের সামনে দেখা। বলল, বিয়ে করে দিল্লিতে আছে। নিশ্চয়ই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভালো আছে এখন। বহুদিন আমার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই।
ও আমাকে ওর জীবনের এই ঘটনা নিয়ে লিখতে বলেছিল আমি তা লিখতে পারিনি। এর জন্য একটা গ্লানি বা অপরাধবোধে ভুগতাম। ইচ্ছে করে যে লিখিনি তা নয়। আসলে আমি ঠিক রিয়ালাইজ করতে পারিনি ওর পরিস্থিতিটাকে। ওর অভিজ্ঞতা, ওর অনুভূতি নিয়ে নিটোল গল্প লেখার ক্ষমতা ছিল না আমার। তাই লেখা হয়নি। তাই ওকে নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে বসে বোধহয় একটা কোলাজধর্মী গল্পই হয়ে গেল। টুকরো টুকরো কথা টুকরো টুকরো ছবি, তা থেকে কি ধরা পড়ল না গত শতাব্দীর শেষ দিকের মানুষের জীবন যাপনের এক রকম একটা অংশ। সেদিন ওর বলা টুকরো টুকরো কথা যেন আলাদা পৃথিবী তৈরি করেছিল। মানুষের আচরণে তা যেন ঘোরা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমার কাছে নম্রতার সেই নারীর আলোকপাতে দেখা পৃথিবীটা বঙ্কাল থেমে আছে। প্রায় বিস্মৃত, পরিত্যক্ত স্কুলের গ্লোবের মতো আলমারির ওপরে এক ধারে পড়ে আছে। এর মধ্যে বাস্তব পৃথিবীতে নারীরা অনেক সচেতন হয়েছে। গায়ত্রী স্পিভাক তার একটা বইয়ের নাম দিলেন ‘ক্যান দি সাব অলটার্ন স্পিক?’ বললেন, এতকাল নারীমুক্তির প্রসঙ্গে সাদা চামড়ার বা ইয়োরোপ ও আমেরিকার নারীদেরই বিবেচনা করে হয়েছে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের নারীরা কোথায় যাবে? তারা কি তাদের কথা বলতে পারবে নারী মুক্তির প্রসঙ্গে? সেই জন্যই কি শোভা দের লেখা সাহিত্যকর্ম বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়ান হয় বলে শোনা গেছে। সেখানে ভারতীয় মেয়েদের কথা আছে বলে? অরুন্ধতী রায়ের বিখ্যাত বই ‘গড অফ স্মল থিংস’এ ও তো কেরালার মহিলাদের জীবনকথা আঁকা হয়েছে। তাই কি পশ্চিম পৃথিবীতে ওই বইয়ের এত জয় জয়কার? ভারতীয় নারীদের কথা শুনতে কি বহিঃবিশ্ব খুবই আগ্রহী আজকাল? ঠিক বুঝতে পারি না। তসলিমা নাসরিনকে তো আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছে পশ্চিম পৃথিবী। বিংশ শতাব্দীর শেষে এই উপমহাদেশে তসলিমাই নারী মুক্তির জোরাল প্রবক্তা। কিন্তু এই তসলিমাই মারাত্মক জীবন সংশয় হয়েছিল এক সময়। ১৯৯৪ সালের ১৪ই মের পর থেকে বেশ কয়েক মাস বাংলাদেশে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছিল তাকে। সেই সময়ের মধ্যে কোন এক সময় ফরাসি নারী সংগঠনের কাছে তসলিমার পাঠান ফরাসি ভাষায় পাঠান ফ্যাক্স বার্তাটি আমি খাতায় লিখে নিয়েছিলাম। ফরাসি ভাষা শেখার সূত্রে কলকাতার আলিয়স ফ্রঁসেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে মাঝে মাঝে বসতাম। সেখানে পেয়েছিলাম বার্তাটা এবং অন্য আরও অনেক কথা। ফরাসি এল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মেয়েদের পত্রিকা এল। তসলিমা সেখানে লিখেছিলেন, ‘সোভে মোয়া’ যার অর্থ——আমাকে বাঁচাও বা সেভ মি। সেই সময় ওই পত্রিকা তসলিমাকে নিয়ে অনেক কিছু লিখত। যেমন একবার ঘোষণা করল, আসুন আমরা সকলে তসলিমার মুক্তির দাবীতে রোজ প্যারিসের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে সন্ধ্যায় একঘন্টা করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাই। এমনি আরও অনেক লেখা থাকত তসলিমাকে কেন্দ্র করে তসলিমার সমর্থনে। তখন আমাদের দেশেও তসলিমাকে নিয়ে কোন খবর প্রচারিত হলে তা শুনতে বিশেষ আগ্রহ দেখালে মহিলারা। হয়ত তারা ভাবতেন আমার যা বলতে পারিনি তসলিমা তা বলতে পেরেছেন।