সমুদ্রের নিটোল জীবন্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ইন্ডিয়া গেটের বাঁধান ঘাটে। প্রতিহত হয়ে ফিরে যেতে গিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরবর্তী ঢেউ। ভিজে যাচ্ছে কংক্রিট। মানুষের বাঁধ দেওয়ায় বিরক্ত সমুদ্র।খুশি মানুষ। ঘাটের একটু নিচে নামলে সমুদ্রের জল ছিটকে আসছে। ভয়ঙ্কর আকর্ষণ সমুদ্রের। নিরলস প্রকৃতির নিয়মে মাঝ সমুদ্র থেকে কিছুটা কালো ও ঘোলা জলের ঢেউয়ের প্রবাহ প্রবল শক্তিতে ছুটে আসছে তীরের দিকে। সমুদ্রের মতোই মানুষের মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে দেখার জন্য অনেক সময় বেশি কেউ থাকে না ধারে কাছে। কিন্তু নম্রতাকে দেখতে হতো তার মারমুখী স্বামীকে।
কিন্তু তোকে ও মারতো কেন?
এমনিই হঠাৎ করে।
এমনিই!
হ্যাঁ। আবার কখনও পায়ে ধরে ক্ষমাও চাইতো। কাঁদতো। আমি আমার বউদিকে জানিয়েছিলাম ব্যাপারটা। বৌদি আমাকে কিছু ট্যাবলেট পাঠিয়েছিলেন। রোজ একটা করে খেতাম। ও এসব জানতো না। ওর ধারণা ছিল আমি ওর বাচ্চা ক্যারি করছি।
আজ বুঝতে পারি নম্রতা সেদিন আমাকে অনেক কিছু বলেনি। আমিও জিগেস করিনি। আমার তখন একুশ বছর বয়স। নম্রতারও এই রকম। তার ওপর ওই রকম হেনস্থার পর নতুন জীবন শুরু করেছে ও। তাই তখন আর বিবাহিত জীবনের গোপন কথা জিগেস করার কথা মনে হয়নি। একটা নিষ্পাপ সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে স্বামীর হাতে প্রায় প্রতিদিন মার খাচ্ছে এটা ভাবতেই আমার রক্ত জল হয়ে যাচ্ছিল তখন।
আজ চিত্রনাট্য লিখতে বসে মুম্বাইয়ের সমুদ্র যেন ঢুকে পড়ছে নম্রতাদের ঘরে। বিছানার ওপর আছড়ে পড়ছে। উথাল-পাথাল ঢেউ উঠছে ঘরের হাল্কা অন্ধকারে।
পালিয়ে এলি কি করে?
এ ব্যাপারে আমাকে শাশুড়ি কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। একদিন আমার দাদা এল কলকাতা থেকে। ও তো দাদার সামনেই চুলের মুঠি ধরে মারতে লাগল। দেখে তো দাদা রেগে আগুন। যাই হোক ও দোকানে বেরিয়ে গেল। দাদা সেই সময় আমায় নিয়ে চলে এল কলকাতায়। শাশুড়িও তাই চেয়েছিলেন। শাশুড়ি মানুষটা বেশ ভালো ছিলেন।
দোকানে মানে—ও কি করত?
ওর তো কাপড়ের দোকান ছিল। শোনা যায় ফিল্মস্টার অরুণা ইরানির সঙ্গে ওর একটু সম্পর্কও ছিল।
কাপড়ের দোকানদার। কাপড়ের দোকানদারকে তুই বিয়ে করলি! নিজে ফিলসফিতে অনার্স পড়ছিস। তুই কি রে? ওর পড়াশোনা কতদূর ছিল?
ক্লাস ফাইভ।
ওঃ–ক্ষোভ, অবাক হওয়া আর অসহায় ভাবটা জমাট বেঁধে বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে।
অনুরোধে মানুষ টেকি গেলে শুনেছিস? আমি অনুরোধে পেঁকি গিলেছিলাম? তবে আমার মনে হয়েছিল পড়াশোনা কম হলেই একজন মানুষ খারাপ হবে তার কোনও মানে নেই।
সাদা শাড়ি পরে আছে নম্রতা। কি অদ্ভুত সরলতা ঘিরে আছে ওকে। আজও যখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কাজে যাই ওই লনটা দেখলে মনে পড়ে আজও যেন ওখানে আশির দশকের সময়কাল জমাট বেঁধে আছে। স্থির হয়ে আছে ওই দিনটা। নম্রতার সঙ্গে আমার কথা বলা মুহূর্তের সারিগুলি। বাতাসে উড়তে উড়তে স্থির হয়ে গেছে। নম্রতার সাদা শাড়ি আর সরলতা।
চিত্রনাট্যে কি এখানে একটা ফ্রিজশট বসিয়ে দেব?
নম্রতা বলতে লাগল, তারপর ডিভোর্সের জন্য চেষ্টা শুরু করলাম। ও-ও কলকাতায় চলে এল। আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। ওকে লোক দিয়ে ভয় দেখান হল যে বাড়ির সামনে তোমাকে দেখলে একেবারে ধুনে দেব। ও ফুঁসে উঠে বলছিল, ওর বাচ্চা আমার পেটে আছে। কিন্তু ও তো জানতো না যে তা সত্যি নয়। আমি রোজ একটা করে ট্যাবলেট খেতাম। যাই হোক শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স হয়ে গেল। এখন কি করব জানি না।
বাইশ বছরের নম্রতা দিগন্ত রেখার দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু দিগন্তরেখা তো নেই। রাস্তা বি.টি. রোড। কিছু বাড়ি আর ফ্ল্যাটের সারি। বিষ্ণুদের লেখা সে কবিতার লাইনটা কেন জানি না মনে হচ্ছে, দিগন্তে হায় মরীচিকাও যে নেই।
কেন তুই তো পড়াশোনা শুরু করেছিস আবার। পড়।
হ্যাঁ, কিন্তু আমায় কি কেউ আর বিয়ে করবে?
নিশ্চয়ই ডিভভার্সের পরে কত বিয়ে হচ্ছে।
তোর যে সব লেখা আছে ওগুলো আমাকে পড়তে দিবি?
দেব।
সেদিন তোর গল্পটা শুনে মনে হল। আমার কথা বললে হয়তো তুই লিখতে পারবি।
হ্যাঁ, ভালোই করেছিস বলে। আমারও খুব কৌতূহল ছিল ব্যাপারটা জানার।
তুই বেশ জেনে নিলি সব।
হ্যাঁ, অপ্রতিভভাবে আমি বললাম।
লোককে আমার ঘটনা বলতে বলতে আমি একেবারে জেরবার হয়ে গেলাম। বম্বে থেকে চলে আসার পর সকলে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে বল। আমার একদম আর ভালো লাগে না এইসব কথা বলতে।
ছেড়ে দে। আর সব কিছু তো মিটে গেছে।
গল্পটা লিখে দেখাস। তোর অন্য সব লেখাগুলো পড়তে দিস।
হ্যাঁ।
একটু থেমে বললাম।
বম্বে তো আমি কখনও যাই নি। বম্বে শহরটা ঠিক কি রকম?
অনেকটা কলকাতার মতোই। সমুদ্র আর সি বিচ আছে এই যা।
পরে আমি মুম্বই গেছি। জুহু বিচে গেছি। মেরিন ড্রাইভে গেছি। ইন্ডিয়া গেটের বাঁধানো সমুদ্র তটে জলরাশির আছড়ে পড়া দেখেছি। বসেওছি সেখানে কিছুক্ষণ। নম্রতার কথা মনে হয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী সেখানে কখনও বসত। সমুদ্রে প্রবল বিস্তারে ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে বসে বোঝাই যায় না এমনটা ঘটেছিল কখনও। তা ছাড়া ব্যাপক মানব জীবন চর্যার কাছে কি আর এমন এ ঘটনা। তুচ্ছ। আমাদের সারাজীবনটাই যেন তুচ্ছ মনে হয় এই সমুদ্র বিস্তারের সামনে ও উন্মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়ালে।