*********
সাহেব।
চিন্তার রেশ কেটে যায় স্লিম্যানের। কুঠিতে নিজের অফিসঘরে জানালার সামনে। দাঁড়িয়ে দূরের একটা টিলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন।
এদেশে আসার আগে থেকেই অনেক কিছু শুনেছিলেন স্লিম্যান। হাতি, স্নেক চার্মার, রোপ ট্রিক আর সাধু সন্ন্যাসীদের দেশ নাকি ভারতবর্ষ। শুনেছিলেন এদেশের অতুল ঐশ্বর্য আর অতিথিপরায়ণতার কথা। এসে দেখেছেন আরও অনেককিছু। দেখেছেন মুষ্টিমেয় লোকের অবিশ্বাস্য পরিমাণ ঐশ্বর্য আর বাকি ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বুভুক্ষা, দারিদ্র, অন্ধ অশিক্ষা, আর আদিম কুসংস্কার। দেখেছেন ভেঙ্গে পড়া শাসনব্যবস্থা, সর্বব্যাপী অনিশ্চয়তা। দেখেছেন সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে একই রাস্তায় হেঁটে চলা ঠগি, ম্যাকফানসা আর ধুতুরিয়াদের, লুঠপাট আর খুনজখম করে উদরপূর্তি করাই যাদের কাজ। দেখেছেন আইন ও শাসনব্যবস্থার শোচনীয় দুরবস্থা, চারিদিকে কালো। কুয়াশার মতন ছড়িয়ে থাকা ভয় আর অরাজকতার বাতাবরণ।
সামনের জমিতে থেবড়ে বসে আছে দুটি মানুষ। ঊধ্বাঙ্গে একটা নোংরা ফতুয়া। পরনে, ততোধিক নোংরা একটা ধুতি নিম্নাঙ্গে, হাঁটুর ওপর অবধি গোটানো। গালে অনেকদিনের না কামানো দাড়ি, ধূলিধূসরিত পা। দুজনেরই দুচোখে একটা উদাস শান্ত সমাহিত দৃষ্টি, হঠাৎ করে দেখলে সাধুমহাত্মা বলে ভুল হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
এবং এই দুজনকে বাদ দিয়ে শুধু স্লিম্যান, একমাত্র স্লিম্যানই জানেন যে এই দুজনের শিরা ওঠা হাতগুলির ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লেখা আছে কোন ভয়ঙ্করতম ইতিহাস। সাতশো থেকে আটশো, স্লিম্যান নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন না, তবে ওর মধ্যেই হবে, প্রায়। এতগুলো মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে, বিস্ফারিত চোখে, সামনের দিকে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চেয়ে ছটফট করতে করতে মরেছে, তার পর চিরঘুমে শায়িত হয়েছে কোনো না কোনো কবরের তলায়, বিস্তীর্ণ মধ্যভারত জুড়ে! এই দুইজোড়া হাতের দৌলতে।
তোপের মুখে বেঁধে দুটোকেই উড়িয়ে দেওয়া উচিত। ইংল্যান্ড হলে সেই হুকুমই দিতেন স্লিম্যান, মধ্যভারতে কোম্পানির প্রতিনিধি উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান।কিন্তু এই লোকগুলোকে ওঁর চাই।নইলে মাকড়সার জালের মতন সমস্ত ভারতে ছড়িয়ে থাকা এই অত্যন্ত গুপ্ত খুনি সংগঠনটিকে উনি টেনে তুলতে পারবেন না। ওঁর একটা প্রবেশসূত্র দরকার, একটা ছোটো ছিদ্র, তারপরেই…
বলো ফিরিঙ্গিয়া, কী বলছিলে। দোস্তকে নাস্তাপানি করিয়েছ?
জি সাহেব।
বলো, তোমার দোস্তু কী বলতে চায়। প্রথম থেকে বলতে বলো। কী নাম তোমার? আরেকজন নড়েচড়ে বসে, সেলাম করে, ঘরঘরে গলায় নিজের নাম বলে ।
প্রথমে ঠিক করে নামটা শুনতে পাননি স্লিম্যান, ভুরু কুঁচকে একটু এগিয়ে আসেন,
খোদাবক্স, সাহিব, গলাটা খাঁকার দিয়ে পরিষ্কার করে নেয় আগন্তুক, বান্দার নাম খোদাবক্স। সাকিন নৈনপুরের কাছে জেওনারা গাঁও। আমি একজন ঠগি হুজৌর, ভুকোত জমাদারের দলের। কামকাজ ভালোই চলছিল হুজুর, মা ভবানীর দোয়াতে। হাসিখুশি ছিলাম সবাই, ভাইবেরাদরের মতন। কিন্তু হুজুর আজ থেকে তিন সাল পেহলে…
দুনিয়া ভুলে এই লোকটির কাছে আরও নিবিড় হয়ে ঘেঁষে বসেন স্লিম্যান। ভ্রূকুটিকুটিল, কিন্তু উজ্জ্বল চোখে।
শেষ পর্যন্ত অচিন পাখির খোঁজ পাওয়া গেল!
*********
সকালটা শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সকালের মতনই। দলের নাউরিয়া বাবুনিয়া দুসাদ সবাইকে ডেকে ডেকে দিচ্ছিল। দলের নতুন নাউরিয়াদের কাজই হল এইসব বেকার খিদমৎ খাটা, আসল কাজ শেখাবার নামই নেই, অসন্তুষ্ট মুখে বিড়বিড় করছিল বাবুনিয়া। তবে জায়গাটা খাসা, কারও সন্দেহের কোনও কারণই থাকবে না। খিজিরপুরের কাস্টমস হৌসের একটু দূরে একটা বড় আমবাগানের মধ্যেই ডেরাডান্ডা বেঁধেছিল দলের সবাই, ঠাকুর যেমনটি বলে দিয়েছিলেন! কোম্পানির ছত্রছায়ায় বসে থাকার সুবিধাও অবশ্য অনেক বেকার হাঙ্গামহুজ্জত এড়ানো যায় সহজেই।
খোদাবক্স ফিরেছিল একটু ভোররাতের দিকেই। ঘুমও আসেনা ছাই এই অসময়ে, তাই ফতুয়াটা খুলে তাকিয়া মতন করে মাথার নীচে দিয়ে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছিল আর কী! এমন সময়ে মুখের ওপর কোন বেওকুফের ছায়া পড়লো কে জানে? খোদাবক্স আধবোজা চোখটা বিরক্তির সঙ্গে খুলেই দেখে ঠাকুর!
ধড়মড় করে উঠেই বসছিল খোদাবক্স, ঠাকুর ইশারায় উঠতে বারণ করেন।নিজেই। ধপ করে বসে পড়েন পাশে।
খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে খোদাবক্স। তবিয়ত শরিফ তো? গেছিলে কোথায়? অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে মনে হচ্ছে, বলি দোস্তের বাড়ির সব খবর ভালো তো?
সতর্কহয় খোদাবক্স। এইহ্যায়ওয়ানবরাত্তনটার কাছে বেশি মুখ খোলা যাবেনা আর। এইসব ভালো ভালো প্রশ্নের মানেই হচ্ছে পাক্কা কিছু সন্দেহ করেছে শয়তানটা।মুখৌটা। পরে থাকতে হবে, হরহামেশা। যদ্দিন না…।
হাঁ ঠাকুর। অনেকটা আসতে হয়েছে হেঁটে, রাস্তা কি কম? সেই খুরাই থেকে রাত থাকতেই রওয়ানা দিয়েছি, সকাল সকাল দলের সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে যে! আর হ্যাঁ, আপনার দোয়াতে দোস্ত আর ওর জরু ভালোই আছে। ফসল ভালোই হয়েছে এবার। নতুন বলদ কিনেছে দুটো, নানহিমুনহি একটা বেটিও হয়েছে ওদের।
বেটি? একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান ঠাকুর, বেটি বললে নাকি?