দুর্গাশঙ্কর এই শ্মশানের খোঁজ পান তার গুরুর কাছে। অমিত তন্ত্রশক্তিধারী সেই বৃদ্ধসাধক নিজের প্রিয়তম শিষ্যকে এই গহীন জঙ্গল, এই শ্মশান আর চূড়ান্ত সাধনসিদ্ধির পথ চিনিয়ে দিয়ে যান; আর বলে দিয়ে যান মহার্ঘ্যতম উপচারটি সংগ্রহের একমাত্র উপায়টির কথা, ঠগি।
মা ভবানীর অনুরক্ত, ভারতবর্ষের ইতিহাসের দুর্ধর্ষতম, নিপুণতম, নিষ্ঠুরতম খুনিদের দল ঠগি।
গুরুদেব ত্রিকালসিদ্ধ পুরুষ ছিলেন। কিন্তু তিনিও দুর্গাশঙ্করের অভীষ্ট জেনে কিছুতেই সম্মত হননি তন্ত্রের এই ভয়ঙ্করতম প্রকরণটি শেখাতে। শেষে শিষ্যের নিষ্ঠা আর একাগ্রতার কাছে ওঁকে হার মানতে হয়।
সচল হয়ে ওঠেন দুর্গাশঙ্কর। অনেক কাজ বাকি। এখনই শুরু করতে হবে বাকি প্রক্রিয়া।
শ্মশানের এক প্রান্তে একটি ছোটো কুঁড়েঘর। সেখান থেকে এক এক করে সমস্ত উপচার ও উপকরণ নিয়ে আসেন উনি। গাছের ডালে আবার একটি পাচা ডেকে ওঠে। বড় সুলক্ষণ, বড় সুলক্ষণ, বিড়বিড় করেন দুর্গাশঙ্কর।
শবদেহটিকে কোমর ধরে পূর্বদিকে মাথা রেখে উলটো করে শুইয়ে দেন। খুলে দেন। পরনের সমস্ত কাপড়। কলসে করে জল রাখাই ছিল, এনে ধুইয়ে দেন অনাবৃত শরীর। ধীরেধীরে চন্দনে চর্চিত করেন সমস্ত দেহ, কাঁধে, পিঠে, বাহুমূলে, করতলে একে নেন বিশেষ কিছু শাস্ত্রচিহ্ন।
এরপর পূর্বে গুরু, পশ্চিমে বটুক, উত্তরে যযাগিনী আর দক্ষিণে গণেশকে অর্চনা করে শুরু করেন শাস্ত্রোপচার।
প্রাথমিক পূজার্চনা শেষ হলে জয় ভবানীমন্ত্রে ভূতশুদ্ধি করে, শবের মাথার নীচে এনে দেন ঘাসের শয্যা। মুখের কাছে এনে রাখেন পোড়া মাছ, ভিজানো ছোলা, আর দেশি মদ, শব জেগে ওঠার উপক্রম করলে এগুলি মুখে দিতে হবে। এরপর শবের দশদিকে বারো আঙুল পরিমাপ দূরে দূরে প্রোথিত করে দেন অশ্বথ গাছের শাখা। এতদন্তে শবের উপরে বসে শুরু করেন তন্ত্রের জটিলতম প্রক্রিয়া, শবসাধনা।
তারপর অনেক সময় পরে, সমস্ত রাতচরা পাখি ঘরে ফিরে এলে, ব্রাহ্মমুহূর্তের একটু আগে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত। আজকের সাধনাও সফল হয়েছে ওঁর। পরিপূর্ণ হৃদয়ে, প্রসন্ন মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করেন তিনি। আর একটি, মাত্র একটি সোপান বাকি। তারপরেই দেবাসুরেরও অনায়ত্ত সেই মহত্তম ক্ষমতাটি ওঁর মুঠোর মধ্যে! স্মিত হাসি ফুটে ওঠে দুর্গাশঙ্করের শুষ্ক অধরে, সাপের মতন সরু জিভ বার করে ঠোঁটটা চেটে নেন উনি।
একশো সাতটি শবসাধনা সম্পূর্ণ হল। আর একটি। মাত্র একটি। শেষ সাধনা। মহাভৈরব মন্ত্রে মহাকালী আর কালভৈরবের শেষ আরাধনা, তারপরেই…।
পুব আকাশে লাল আভার ক্ষীণতম আভাস পাওয়ামাত্র চঞ্চল হয়ে ওঠেন দুর্গাশঙ্কর। এই শব এখানে ফেলে রাখা যাবে না, ব্রাহ্মমুহূর্তের আগেই একে নিক্ষেপ করতে হবে উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রে। দ্রুত মৃতদেহটির পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করেন উনি।
মেঠো জঙ্গুলে পথ। দ্রুত চলন দেখে বোঝা যায় যে, এ পথে ওঁর আসা যাওয়া। আছে ভালোই। শ্মশানঘাট থেকে বেশি দূরও নয়, কয়েকশো গজ গেছেন মাত্র, একটা শুড়িপথ ঘুরেই থেমে যান উনি। সামনে মাটির ওপর একটা গোলাকার বড় জায়গা, শুকনো ঘাসপাতা, খড় আর নারকেল গাছের ঝরা শাখা দিয়ে ঢাকা।
দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত দ্রুত অভ্যস্ত হাতে সেই সব ডালপালা সরিয়ে রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে এক বিশাল কুয়োর মুখ উন্মুক্ত হয়।
আর একটা প্রাচীন মড়াপচা গন্ধ ধাক্কা মারে ওঁর মুখে। ধীরেধীরে সেই ম্লান বিষণ্ণ কটু গন্ধ আশেপাশের বাতাস ভারী করে দিতে শুরু করে। দুর্গাশঙ্কর দ্রুত এই মৃতদেহটিকে কুয়োর মধ্যে ঠেলে দেন।
ধপ করে একটা আওয়াজ হয়।
কোনো হাহাকারের আওয়াজ পাক খেতে খেতে উঠে এল নাকি? নাকি কোনো পুঞ্জীভূত নিলা ক্রোধের আঁচ অব্যক্ত আক্রোশে মাথা কুটছে নিঃসীম পাতালের নীচে? গোঙানির মতন একটা চাপা কান্না মাটির দেওয়াল ধরে উঠে আসতে চাইছে না?
ওরা সব কেমন আছে নীচে? ওরা সবাই? দুরন্ত কৌতূহল হয় দুর্গাশঙ্করের। ক্ষণেকের মানুষী দুর্বলতা গ্রাস করে নিষ্ঠুর দুর্গাশঙ্করের অন্তঃকরণকে।
জঙ্গলের মধ্যে তখনও অন্ধকার। ভালো করে কিছু দেখা যায় না। কোচড় থেকে চকমকি পাথর বের করে কিছু শুকনো ঘাসপাতা জ্বালান তিনি। তারপর একটি ঝকড়া দেখে শুষ্ক বৃক্ষশাখা জ্বালিয়ে নেন তাতে। চমৎকার মশালের মতন আলো হয়।
ধীরে ধীরে সেই অন্ধগহ্বরের সামনে মশালটিকে নিয়ে যান উনি।
মুহূর্তের আলোয় দেখেন অগণন মৃতদেহ শুয়ে আছে কুয়োর নীচে। আর কেউ না জানুক, দুর্গাশঙ্কর জানেন যে ওরা সংখ্যায় একশো সাত!
ধক করে একটা হাওয়া এসে নিভিয়ে দেয় সেই মশাল। দুর্গাশঙ্কর মা ভবানীর নাম নিয়ে কুয়োর মুখ ঢেকে দিতে থাকেন অভ্যস্ত হাতে।
উনি কি ঠিক দেখলেন? মুহূর্তের আলোয় মনে হল যেন প্রতিটি মৃতদেহ একেবারে অবিকৃত, যেন সব কটিকেই গতকালই নিক্ষেপ করা হয়েছে এখানে। ঠিক দেখলেন কি? নাকি এ শুধুমাত্র শ্রান্ত স্নায়ুর মতিচ্ছন্নতা, রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে?
কোথাও একটা তক্ষক ডেকে উঠল। উঠে দাঁড়ালেন দুর্গাশঙ্কর, পিছন ফিরে জঙ্গলের বাইরে, লাকরাদৌনের রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আরও একজোড়া পা সেই একই রাস্তা ধরল।
চিন্তামগ্ন হওয়ার দরুন দুর্গাশঙ্কর, পিশাচসিদ্ধ দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত এই অনধিকার। চর্চার খোঁজ পেলেন না!