কাঁচা কাঁচা খায়। বুঝেছিস? চুপ থাক।
ইয়া আল্লাহ।
এর পর দুজনে নিঃশব্দ হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে খোদাবক্স। নাসিরকে বলে,
তুই পা চালিয়ে যা। আমি এক দোস্তের সঙ্গে দেখা করেই আসছি। এক রোজ বাদ মিলব। খিজিরপুরের কাসটম হাউসের আশেপাশে থাকিস। পৌঁছে যাব। ঠাকুর জিজ্ঞেস করলে সত্যি কথাই বলিস।
কার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ ওস্তাদ?
দোস্ত। বললাম তো।
নাম বললে না যে?
কী করবি তুই নাম জেনে? বলে ক্ষণিকের জন্য থেমে যায়।
কাউকে বলিস না কিন্তু। ফিরিঙ্গিয়া, ওর নাম ফিরিঙ্গিয়া।
*********
একটা কথা খেয়াল করেছেন সাহেব?
নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্লিম্যান।কথাটা কিছু পরে ওঁর কানে পৌঁছায়।ততক্ষণে সামনে কতগুলো পচে যাওয়া লাশ কবর থেকে উঁকি দিচ্ছে। লাশপচা গন্ধে বাতাস ভারী। দুএকটা শকুনও ওড়াউড়ি করতে শুরু করেছে এদিকওদিক।
বলো।
ভোপাল থেকে কী খবর পেলেন সাহেব? কতজন ছিল বহরে? সবশুদ্ধ?
আঠারোটা কাহার, চারটে সিপাই, আর আহমেদ খান নিজে। তেইশ। টুয়েন্টি থ্রি।
কটা লাশ দেখতে পাচ্ছেন সাহেব?
ওয়ান টু করে গুনতে শুরু করেন স্লিম্যান।
টুয়েন্টি টু। স্ট্রেঞ্জ! আরেকটা বডি গেল কোথায়?
চোখ কুঁচকে উনি সঙ্গীটির দিকে তাকান। দুচোখে প্রশ্ন আর সংশয়।
সঙ্গীটি মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতে থাকে। ওকে ঘাঁটান না স্লিম্যান।এই অসম লড়াইয়ে এই লোকটিই ওঁর অন্ধের যষ্টি।
দো সাল আগে আমার এক দোস্ত একটা আজব কথা বলেছিল আমাকে।তখনও আমি আপনার হাতে ধরা পড়িনি। আচানক নাকি তাদের সর্দার বদল হয়ে গেছে। আগের সর্দার নাকি মুর্দা লাশের মতন হয়ে গেছিল অচানক। তখনই নাকি এক বরাম্ভন নতুন সর্দার হয়ে বসে, আর তারপর থেকেই নাকি দলের নসিব গেছে ফিরে। মা ভবানী নাকি ধনদৌলত ছপ্পড় ফাড়কে এনে দিচ্ছেন ওদের। কিন্তু…
কিন্তু কী?
সর্দারটি নাকি বড় আজিব কিসিমের।
এক্সপ্লেইন।
ধনদৌলত পয়সাকড়ি কিছু নেয় না। শুধু লাশ নেয়।
হোয়াট? সচকিত হয়ে ওঠেন স্লিম্যান, লাশ নেয়? শুধু লাশ নেয়? মানে কী এর?
জানি না সাহেব। এসব আমাদের প্রথার বাইরে। আমাদের প্রথায় সবাইকে, সবাইকেই কবর দেওয়াটাই নিয়ম, ছোটবেলা থেকে তাই শুনে এসেছি। কিন্তু এই বরাম্ভনের ওপর কেউ কথা বলতে পারে না সাহেব। সবার মনে এমনই খওফ বানিয়ে রেখেছে লোকটা।
কীসের খওফ?
কেউ জানে না সাহেব। লোকটার মধ্যে নাকি কী একটা ডরাওনি খুবিয়া আছে, কেউ এর ওপর কোনও কথাই বলতে পারে না।
স্ট্রেঞ্জ, এক্সট্রিমলি স্ট্রেঞ্জ। বাট, লাশ নিয়ে করে কী লোকটা?
কেউ জানে না সাহেব।
হুমম, কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে কী ভাবেন স্লিম্যান।
নাম কী সেই ব্রাহমিন সর্দারটির?
কিছু একটা বলতে গিয়েও আটকে গেল লোকটা।
তাড়া দিলেন স্লিম্যান, বলো ফিরিঙ্গিয়া, নাম কী ওর।
ভয়ার্ত থমথমে মুখে নামটা উচ্চারণ করে ফিরিঙ্গিয়া, ভারতের ইতিহাসে ধূর্ততম খুনিদের মধ্যে অন্যতম খুনি, ।
সাহেব, ওর নাম পণ্ডিত, ঠগিদের বেতাজ বাদশা দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত।
*********
রাত তখন গভীর। জঙ্গলের অনেক ভেতরে একটি ছোট মজে যাওয়া খালের পাশে শবদেহটিকে ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামান্য হাঁফাচ্ছিলেন দুর্গাশঙ্কর। এই শবটিকে কাঁধে করে টেনে আনতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে ওঁকে। হাজার হোক, বয়েস তো হয়েছে। আর তার ওপর এই অল্পবয়েসি কাহারটি যথেষ্ট ভারী।
বয়েস, কথাটা মনে পড়তেই একটা মৃদু হাসি দেখা দিল দুর্গাশঙ্করের মুখে। সময়, আয়ু, জর এসব জয় করবার জন্যেই তো এত পরিশ্রম, আর পরিকল্পনা।
সময় মানে কাল, আর সে কালের অধীশ্বরী মা কালিকা। কালিকার পূজায় একাগ্র যে সাধক, তিনি লাভ করেন অনিঃশেষ দৈব সিদ্ধি, অতুল ঐশ্বর্য, অগণন সম্পদ, অপরিমিত সুখ, আর সে সব ভোগ করার জন্যে এক জরাহীন, দুঃখহীন, রোগহীন অনন্ত পরমায়ু।
আর লাভ করেন একটি অচিন্তনীয়, অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা!
অতুল ঐশ্বর্য চাই না দুর্গাশঙ্করের, এত সাধনা শুধু ওই অশ্রুতপূর্ব, অসম্ভব, অভাবনীয় ক্ষমতাটি করায়ত্ত করার জন্যেই! ‘ বড় কঠিন, বড়ই কঠিন এ পথ, নিজের মনেই মাথা নাড়েন দুর্গাশঙ্কর। বিন্দুমাত্র পদঃস্থলনের অর্থ তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। দুর্গাশঙ্করকে কি কম কষ্ট করতে হয়েছে এতটা পথ আসতে? এ কি গ্রাম্য গৃহস্থের সাধারণ মূর্তিপূজা? এই সাধনায় লাগে নিগূঢ়তম সাধন উপচার, নিশ্চিদ্র সাধনপ্রক্রিয়া, নিবিড় মনঃসংযোগ।
আর লাগে নির্মমতম অর্ঘ্য।
আজ তেমনই এক অর্ঘ্য নিয়ে এসেছেন দুর্গাশঙ্কর পণ্ডিত। চেনা জঙ্গলে, চেনা। মজে যাওয়া খালের ধারে, চেনা শ্মশানে।
আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে এইখানেই ছিল এক ক্ষুদ্র শ্মশান।খুঁজলে তার কিছু চিহ্ন এখনো ইতিউতি চোখে পড়বে। তখন খালে আসত ছলছল জলপ্রবাহ, তার সংযোগ ছিল রেওয়া, বা নর্মদার সঙ্গে। পার্শ্ববর্তী জনপদ থেকে দেহ সৎকার করতে যাবতীয় শবদেহ নিয়ে এখানেই আসত গ্রামের লোকজন। প্রায়ই রামনাম সৎ হ্যায় ধ্বনিতে মুখরিত হত এই ছোট শ্মশানটি। দাহকার্য সমাধা করে, খালের জলে অস্থি বিসর্জন করে, হাত পা ধুয়ে দেহাতি লোকজন ফিরে যেত চেনা সংসারবৃত্তে। কালের গতিতে ক্রমে নদীর বাঁক দিক পরিবর্তন করে। খাল মজে যায়। কমে যায় লোকজনের যাতায়াত। ধীরে ধীরে জঙ্গল এগিয়ে এসে গ্রাস করে এই এলাকা। শুধু খাল যেখানে বাঁক নিয়ে নর্মদার দিকে এগিয়ে যেত এককালে, সেখানে থেকে যায় এক বিল।