দৌড়ে আসেন স্লিম্যান, কাহা?হোয়ের? হাউ কুড ইউ…
সেই মানুষটি একটা লম্বা গাছের ডাল নিয়ে বিলের ঠিক সামনে একটা বিশাল বর্গাকার ক্ষেত্র চিহ্নিত করে দেয়, আপনার ফৌজকে বলুন এখানে খুঁড়তে।
এখানেই পাওয়া যাবে বলছ?
বেশক সাহেব, নইলে আমার নামে কুত্তা পালবেন।
সাহেবের অঙ্গুলিহেলনে কুড়িজন দেশীয় সিপাই ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে নেমে পড়ে, একটু দূরে অধীর উত্তেজনায় অপেক্ষা করতে থাকেন স্লিম্যান আর তার সঙ্গী।
*********
বাইশটি মৃতদেহ কুরওয়াতে শোওয়ানো। শুধু একটি মৃতদেহ, এক অল্পবয়সি হিন্দুস্তানি কাহারের লাশ আলাদা করে রাখা।
ঝপাঝপ মাটি পড়তে থাকে কবরে।
নাসির খান মাদারি একজন দক্ষ কুথাওয়া। মৃতদেহের হাতেপায়ের জোর ভেঙে, ভাঙা হাঁটু থুতনি অবধি তুলে কবরে শোয়াতে ওর জুড়ি নেই। ছুটনিয়া দোসাদও ওর একজন যোগ্য সহকারী। ছুটনিয়া আরও একটা কাজ সবার থেকে ভালো পারে, সে একজন দক্ষতম ফুরজানা। কবর হবার পর, সবকিছু পরিষ্কার করে, মাটির সমান করে মিলিয়ে দিয়ে, আগের চেহারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াতে তার প্রতিভা অবিশ্বাস্য।
ছুটনিয়া সেই কাজই করছিল মন দিয়ে শেষ হলে একটা সাদা চাদর এনে পেতে দেয় কবরের ওপর। শুরু হয় প্রথামাফিক ভোজসভা। মন্ত্রপূত তুপোনির গুড় তুলে দেওয়া হয় সবার মুখে।
সাচ্চা আউলা বা সুন মাত্রেই এই গুড়কে অমৃততুল্য জ্ঞান করে। ভোজসভা শেষ হলে, একজন সদস্যকে মাউলি বানানো হয়। তার কাজ সামান্যই। পরিবার প্রতি শিকারের ভাগ নিয়ে দলের সবার বাড়ি বাড়ি সেই ভাগ পৌঁছে দেওয়া।
সব কিছু শেষ হয়ে যাবার পর সেই দীর্ঘদেহী ব্রাহ্মণ উঠে দাঁড়ালেন। গম্ভীর গলায় আদেশ করলেন, তোমরা বুরোউতের রাস্তা ধরে খিজিরপুরের দিকে যাও। কাল সকালে তোমাদের সঙ্গে দেখা করব।
এই প্রৌঢ়ের আদেশে এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক দৃঢ়তা থাকে। অচেতন পরতে কিছু ক্রুর শীতলতাও মিশে থাকে নির্ঘাত। নইলে কেউ মুখ তুলে কিছু জিজ্ঞাসা করে না কেন? কই, ভুকোতের সময় তো এমন হত না, সে তো সুখেদুঃখে সবার সঙ্গেই থাকত। মা ভবানীর প্রতিটা প্রসাদের পর সে একটি লাশ নিয়ে দল থেকে আলাদা হয়ে গেছে কোনোদিন? কে এই ব্রাহ্মণ? প্রতিবার কী করে এক একটা তাজা লাশ নিয়ে?
এসব ভাবনা খোদাবক্সের মাথা গুলিয়ে দেয়। অব্যক্ত একটা ক্রোধ তার শিরদাঁড়া। বেয়ে উঠে আসতে চায়। কিন্তু কোথায় যেন প্রতিবাদটা বোবা হয়ে আসে।
ভয়? বিষাদ? বন্ধুবিচ্ছেদের বেদনা?
হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে সাজিয়ে নেয় খোদাবক্স। তা নয়। এই হাতে কম করে। দুশোর বেশি খৌরকে কবরে পাঠিয়েছে খোদাবক্স। ডর কাকে বলে ও জানে না। আজ তক আঁচড় অবধি লাগেনি। মা ভবানীর কৃপা ছাড়া আর কি হয় এসব?
কিন্তু ভুকোত? মাথার ওপর বটগাছের মতন ছায়া হয়ে থাকা ভুকোত? তিন বছর। আগে সেই শেষ সাক্ষাতের পর হঠাৎ করে একদিন চিতায় ছাই হয়ে যাওয়া ভুকোত? তার ভালোবাসার ঋণ কী করে শুধবে খোদাবক্স খা?
ভুকোতের সঙ্গে সুখেই ছিল সবাই। সুখ, মিলেমিশে থাকার বেরাদরি সুখ। এই ব্রাহ্মণ যবে থেকে দলের রাশ হাতে নিয়েছে, দলের হাতে টাকা এসেছে বিপুল। তিন বছরে অন্তত বিশবার বিভিন্ন দলের ওপর খোমুসনা হয়েছে তারা।থিবই দিয়ে, অর্থাৎ ভুলিয়ে-ভালিয়ে বসিয়ে দিয়ে ঝিরণী দিয়েছে অসতর্ক মুহূর্তে। আশ্চর্যজনক ভাবে। প্রতিবারই দেখা গেছে তারা পেয়েছে চিসা শিকার, সম্পন্ন গৃহস্থ। ফুলেফেঁপে উঠেছে দলের সবার সম্পদ। বাকি দলগুলো তো রীতিমতো ঈর্ষা করতে শুরু করেছে এদের। হবে নাই বা কেন? তাদের কপালে জুটেছে সব ফালতু ভাঙ্গি, গরিব দেহাতি লোকজন। নেহাত ভবানীর আদেশ, কোনো শিকারকে ছেড়ে দিতে নেই, তাতে মায়ের অসম্মান হয়, তাই তাদেরও কবরস্থ হতে হয়েছে। পয়সা পেয়েছে যৎসামান্যই।
ফিরে আসছিল খোদাবক্স। তার মনে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। ভুকোতের শাসনে। বড় ভাইয়ের প্যায়ার মিশে থাকত। এই ব্রাহ্মণ শুধু জানে আদেশ করতে। আর সেই আদেশে মিশে থাকে কঠিন নিষ্ঠুরতা। তাকে অমান্য করার কথা ভাবাও পাপ।লোকটা যেন সব জানে, সব বোঝে, সর্বত্র চোখ তার। ঠান্ডা চোখে যখন তাকায়, কলিজাটা জমে যায় বরফের মতন মনে হয় লোকটা ভেতরের সব কিছু পড়ে নিচ্ছে।
আরও আশ্চর্যের কথা এত খোর, তামার ব্রুস, সেটাকের গয়নাগাটি, লোকটা এর এক পয়সাও ভাগ নেয় না! তা হলে এসেছে কেন এই দলে? কী চায় ও? কীসের লোভে পড়ে আছে ও? আর প্রত্যেকবার একটা করে তাজা লাশ নিয়ে কী করে ও? কোথায় যায় একা একা? বারবার এই লাকরাদৌনেই ও বিয়াল খোঁজে কেন? কী আছে। জঙ্গলের ভিতর? আর কোন মন্ত্রবলে সকাল হতে না হতেই দস কোস হোক, বিস কোস। তোক, ঠিক পৌঁছে যায় দলের কাছে? কী কৌশলে?
নাসির চপচাপ হাঁটছিল পিছনে, এবার একটু পা চালিয়ে ধরে খোদাবক্সকে।
কী ভাবছ ওস্তাদ? চুপচাপ যে। এবার তো মা ভবানী ছপ্পড় ফাড়কে পয়সা দিয়েছেন। নসিবে এত পয়সা ছিল, ভেবেছিলে কোনোদিন?
হুমম।
একটা কথা বলব ওস্তাদ?
বল। শুনি।
গুসসা করবে না তো?
বল। জ্যায়াদা তামাশা করিস না।
এই লোকটা প্রত্যেকবার একটা লাশ নিয়ে কী করে?
আমি কী করে জানব বুরবক? আমি কী ওর সঙ্গে থাকি?
আরে, গুসসা কেন কর ওস্তাদ। বলছি তোমার কী মনে হয়? কী কী করতে পারে লোকটা লাশ নিয়ে?