তারপর একটি বিশেষ ভাবে তৈরি রুমাল হাতে নিয়ে, যার নাম পেলহু, এরা বেরিয়ে পড়ত। হাঁটতে থাকত মাইলের পর মাইল। অপেক্ষায় থাকত শিকারের, অপেক্ষায়। থাকত মা ভবানীর নির্দেশের। কোনো তিলহাই বা গুপ্তচর এনে দিত কাঙ্খিত খবর, এই পথেই সদলবলে আসছে কোনো এক ব্যবসায়ী, সঙ্গে দুটি খোনতুরি, বাচ্ছা মেয়ে। দলের মধ্যে যারা দক্ষ সোথা তারা গিয়ে আলাপ জমিয়ে, বন্ধুত্ব পাতিয়ে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাত্রে নির্জন জায়গায় থাপ, মানে তাবু ফেলাত। তারপর রাত্রে শুরু হত গান আর গল্প। অলক্ষিতে প্রতিটি দুর্ভাগার পিছনে তিনজন করে এসে দাঁড়াত।
একজন পিছনে। দুইপাশে দুই জন।
পিছনে দাঁড়ানো ভুরকোত, অর্থাৎ প্রধান খুনির কোমরে গোঁজা থাকত সেই কালান্তক পেলহু।
গানে-গল্পে-আড্ডায় মজে যেতে যেতে কেউ একজন হাঁক দিত, পান কা রুমাল লাও।
ঘাতকদের হাতে হিলহিলে সাপের মতন নিঃশব্দে উঠে আসত সেই রুমাল। তারপরেই উঠত ঝিরণী, কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠত, সাহেব খান, তামাকু লাও।
আর লোকগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।
লাশগুলোকে চৌকো কুরাওয়া কিংবা গোল গব্বায় ফেলে, মাটি চাপা দিয়ে, তার ওপর বসে মন্ত্রপূত তুপোনির গুড় খেয়ে তারপর শুরু হত পথচলা। হতভাগ্যদের দলে কোনো খোনতুরি থাকলে অবশ্য তাকে ঝিরণী দেওয়া হত না। বাঘের আশেপাশে যেমন শিয়াল ঘোরে উচ্ছিষ্ট খাবার আশায়, তেমনই এদের সঙ্গে ঘুরত ব্রিনজাররা। ওদের কাজই হচ্ছে বাচ্ছা মেয়ে বিক্রি করা। ভুকোতের দলের উপরিলাভ।
তিনবছর আগে এমনই এক যাত্রাশুরুর আগের দিনে ভুকোতের বাড়ি গিয়ে এই ব্রাহ্মণকে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল খোদাবক্সরা। কিন্তু যাকে সবার আরও আজব লেগেছিল, সে হচ্ছে ভুকোত নিজে! কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে লোকটা, মুদামাফিক হাবভাব। যেন নিজের মধ্যে নেই, হামেশা একটা ধুনকির মধ্যে রয়েছে। মাথা ঘাড় এতোই নিচু করে রেখেছে যে চোখমুখ প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কথাবার্তাও বলছে তাজ্জব করা, জানটা যেন কলিজার মধ্যেই নেই। বিড়বিড় করে বলল, এবার থেকে দলের ভার এই ব্রাহ্মণের হাতেই থাকবে। এই দল ভুকোত ছেড়ে দিল।
তাজ্জব কী বাত! ছেড়ে দিলাম বললেই ছেড়ে দেওয়া যায় নাকি? কথা নেই বার্তা নেই, কে এই বরাম্ভন তার হিসেবপতা কিছু নেই, হঠাৎ করে সর্দার বলে মেনে নিতে হবে? রীতিমতো বিদ্রোহ করেছিল খোদাবক্স, মোরাদুনরা। কিন্তু ভুকোতের ওই এক কথা। এই দল ভুকোত ছেড়ে দিল, এই বরান এবার থেকে সর্দার, এতে যার ইচ্ছে হবে সে দলে থাকবে, না হলে বেরিয়ে যাবার দরজা খোলাই আছে!
এর ওপরে আর কথা চলে না।
ভুকোতের আওরতকেও তো সেবার দেখাই গেল না বাইরে আসতে। দুটো কথা যে জিজ্ঞেস করে নেবে, তারও রাস্তা বিলকুল বন্ধ!
আড়ালে আবডালে ওরা চেষ্টাও করেছে ভুকোতকে বোঝাবার। অস্পষ্ট বিড়বিড় করে মাথা নাড়াতে নাড়াতে কী যে বলেছে, তা কেউ বোঝেনি। কথাও বলেছে দূরে থেকে, কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, এমন কি জিগরি দোস্ত খোদাবক্সকে অবধি না। শুধু একবার, একবারই, জোর করে ভুকোতের হাত চেপে ধরতে গেছিল খোদাবক্স, অবিশ্বাস্য রকমের অমানুষী ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে উঠে গেছিল ভুকোত।
রাতে শুতে যাবার আগে নাসির মাদারি চুপচাপ জিজ্ঞেস করেছিল,
কী হল ওস্তাদ? কী বললে ভুকোত সর্দারকে?
খবর ভালো না। বহুত বড়া গড়বড় আছে। তুই আমি বুঝব না।
কেন ওস্তাদ? এরকম বলছ কেন? কিছু দেখলে নাকি তেমন?
হ্যাঁ।
কী দেখলে ওস্তাদ? একটু খোলসা করে বলো না।
ভুকোতের চোখটা দেখেছিলিস?
না ওস্তাদ। কেন? তুমি দেখেছ?
হুমম। যখন কাছে গেছিলাম।
কী দেখলে ওস্তাদ?
ভুকোতের চোখ বিলকুল খালি।
মতলব?
চোখের পুরোটাই সাদা, আঁখ কি পুতলিটাই নেই।
কী বলছ ওস্তাদ? ঝুট বলছ না তো?
তোকে ঝুট বলে আমার লাভ?
ইয়া আল্লা, কীসব কথা বলছ ওস্তাদ?
কাউকে বলিস না। ঘুমিয়ে পড়। আরেকটা ব্যাপারও দেখেছি। যখন হাত পাকড়াতে গেছিলাম।
কী ওস্তাদ?
ভুকোতের হাত ঠান্ডা, বিলকুল ঠান্ডা। মুর্দা লাশের মতন।
* * * * * * *
লাকরাদৌনের সেই বিলের পাশে যখন ঘোড়া থেকে নামলেন উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান, তখন দুপুরের রোদের তেজ একটু কমেছে। তবে গরমের তাতটা একটুও কমেনি। তাতে অবশ্য স্লিম্যানের বিশেষ কিছু এসে যায় না। ভারতবর্ষের প্রখর সূর্যের প্রভাবে ইতিমধ্যেই খাঁটি ইংরেজটির গাত্রবর্ণ ঘোর বাদামি।
বাদামি গাত্রচর্ম ছাড়াও ভারতবর্ষের আরেকটি দান সশ্রদ্ধায় বুকে তুলে নিয়েছেন ইনি, ভাষা। উত্তরভারতে বলা হয় অথচ ইনি জানেন না, হেন ভাষা নেই, এমনকি পুশতু অবধি!
স্লিম্যান নেমে ঘোড়াটাকে একজন সিপাইয়ের হাতে ধরে দিলেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে পর্যবেক্ষণ করলেন পুরোটা। বিলের প্রায় পুরোটাই ঘুরে এলেন। ঝোঁপঝাড় গুলো সরিয়ে সরিয়ে দেখলেন। জঙ্গলের দিকেও খানিকটা গেলেন। সঙ্গে আসা জনাবিশেক সেপাই প্রায় ঝড়ই তুলে দিল আশপাশে।
শুধু একজন দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। সে শুধু মাটি দেখছিল। আর কিছু না। তার জহুরি চোখ শুধু একটা চেনা দাগ খুঁজছিল, শুধুমাত্র বহুদিনের অভিজ্ঞতা ছাড়া যে দাগ খুঁজে বের করা শুধু মুশকিলই নয়, বস্তুত অসম্ভব।
হঠাৎ করে চেঁচিয়ে ওঠে সে, হে সাহেব, মিল গ্যায়া। এদিকে আসুন।