যেটা উনি এতক্ষণ খেয়াল করেননি, সেটা হচ্ছে যে কোন এক অদৃশ্য সুতোর টানে সেই বেসাহারা পথিকদের মধ্যে অনেকে উঠে এসে প্রতি সিপাহির পাশে তিনজন করে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ঠিক পাশে নয়, একজন করে পিছনে, দুইজন করে দুই পাশে।
এদের মাঝখানে, সেই দীর্ঘদেহী উপবীতধারী ব্রাহ্মণ দলনেতাটি অত্যন্ত নিরাসক্ত নৈর্ব্যক্তিকভাবে এসে দাঁড়ালেন। পুরো দৃশ্যটির মাঝে আমোঘ নিয়তির মতন।
ওজুর জল এল বিল থেকে। মৃতদেহসঙ্গী মুসলিম সিপাহিরা একটু সরে এল। তাদের মধ্যেও তিনজন করে খুবই সশ্রদ্ধভাবে আহমেদ খান আর বুল্লা খাঁর পিছনে এসে দাঁড়াল।
ঠিক পিছনে নয়, একজন করে পিছনে, দুইজন করে দুই পাশে।
কাহাররা দুরে জটলা করছে, বাতাস নিঃশব্দে বয়ে চলেছে, দূরে কোথাও একটা ঘুঘু একটানা ডেকে চলেছে।
আহমেদ খান নিচু হয়ে ওজু করলেন, তারপর এসে দাঁড়ালেন মৃতদেহের সামনে। ওঁর দুইপাশে দুই শোকস্তব্ধ মুসলমান সিপাহি, মৃতবন্ধুর সদগতি কামনায়। একজন। পিছনে।
এমন সময়ে সেই প্রৌঢ় ব্রাহ্মণটি অনুচ্চ কিন্তু তীব্রস্বরে বললেন, পান কা রুমাল লাও।
নামাজ-এ-জানাজা পড়ার আগে একটু ধন্ধে পড়ে গেলেন আহমেদ খান। এই বুরবক হিন্দু বরান কি জানে না যে এখানে কারও গোর হতে চলেছে? এইটা কি তোর। রুমাল হাতে পান খাবার সময়? কোম্পানির রাজত্বে এই হিন্দুগুলো বহুত বদতমিজ হয়ে উঠেছে। গোর দিয়ে উঠেই উনি এর খবর নেবেন, এই মনস্থির করে উনি তিনবার আল্লাহু আকবর বলে নামাজ পড়তে শুরু করেন।
মৃতদেহের কাছে এসে একটু ঝুঁকে আহমেদ খান সবে উচ্চারণ করেছেন। আল্লাহুম্মাগফিরলি হায়িনা ওয়া মাইতিনা ওয়া, এমন সময় শুনলেন সেই প্রৌঢ় দরিদ্র গ্রাম্য ব্রাহ্মণটি গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, সাহেব খান, তামাকু লাও।
তীব্র রোষে ঘাড় ঘোরাবার আগেই আহমেদ খান ক্ষণিকের ভগ্নাংশে দেখলেন যে একটা হলুদ রঙের সিল্কের রুমাল পিছন থেকে উড়ে এসে ওঁর গলায় বসে দ্রুত। শক্ত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে দিল। জ্ঞান হারাবার আগে স্তম্ভিত চোখে ভোপালের ওয়জির।–এ-আজমের খাস সহচর আহমেদ খান দেখলেন যে ওঁর সামনে শোয়ানো মৃতদেহ কোন জাদুমন্ত্রবলে জিন্দা হয়ে লাফিয়ে উঠে ওঁর ঘাড় ধরে নীচের দিকে টানছে। আতঙ্কিত চোখে এইসব দেখে উনি ইয়া আল্লা বলতেও ভুলে গেলেন। যদিও সেসব ভাবার। সময়ও পাবার আগেই পিছন থেকে একটা হাঁটু ওঁর মেরুদণ্ড বরাবর সামনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে কড়াক আওয়াজ করে মেরুদণ্ডটি ভেঙে দেয়।
সেই আলো আঁধারিয়া সন্ধ্যায়, অজানা সড়ক ঘেঁষে, লাকরাদৌনের পাশে এক জঙ্গুলে বিলের ধারে আহমেদ খানের চোখে যে চির অন্ধকার নেমে এল তা আর ঘুচে যাবার নয়।
*********
জব্বলপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাপ্টেন ম্যালেনি যখন অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ভোপাল থেকে
আগত সংবাদদাতাকে বিদায় দিলেন, তখন সগরের এই কোম্পানিকুঠিতে গ্রীষ্মের। দপরেই অন্ধসাঁঝআঁধারের হিমশীতল স্তব্ধতা।
বিশেষ দূত মারফত ভোপাল নওয়াব ওয়ান ল্যাক টিপুশাহি গোল্ড কয়েন পাঠিয়েছিলেন, অ্যাট দ্য বিহেস্ট অফ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক হিজ হাইনেস, গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া। ক্যাপ্টেন ম্যালোনির ওপর দায়িত্ব ছিল সেই আর্জেন্ট কনসাইনমেন্ট লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে উইথ ডিউ সিকিওরিটি পাঠিয়ে দেওয়া। এই কাজের পাত্তা কারও হাতে লাগার কথা নয়। সিক্রেসি ইজ অফ আটমোস্ট ইম্পর্ট্যান্স হিয়ার। লর্ড বেন্টিঙ্ক তাই আর কাউকে ভরসা করেনি। ইটনের ছোটবেলার বন্ধু ডিক, অর্থাৎ রিচার্ড ম্যালোনিকেই এই কনসাইনমেন্টের রেসপন্সিবিলিটি দিয়েছিল।
অ্যান্ড আই ফেইল্ড টু কমপ্লিট দিস সিম্পল গডড্যাম টাস্ক, মনে মনে এই কথা বলে দেরাজের ওপর অন্ধ আক্ষেপে একটা সজোর ঘুষি মারলেন ক্যাপটেন ম্যালোনি।
সেই আওয়াজ শুনে খাস অর্ডারলি মুহম্মদ খাঁ দৌড়ে এল, কোই সেবা মেরে মালিক?
ম্যালোনির ইচ্ছে হল জুতিয়ে এই লোকটার মুখ ছিঁড়ে দিতে। ব্লাডি ভিখিরি নেটিভ সব, পরনে নোংরা সব ধোতি আর পাগড়ি, সুপারস্টিশনের ডিপো, ইললিটারেট ফুল এক একটা। এই ব্লাডি ব্রাউন নিগাররা এত ট্রাবল দেবে জানলে উনি হোম পোস্টিং ছেড়ে এই গডড্যাম স্টুপিড কান্ট্রিতে আসতেনই না।
ক্যাপ্টেন ম্যালোনি স্থির সাপের চাউনিতে বলেন, ছোটে সাহেব কো এত্তেলা দো নিগার। আবভি।
একটু পরেই এক ইংরেজ যুবাপুরুষ এসে সামনে দাঁড়ালেন।
গুড আফটারনুন ক্যাপ্টেন ম্যালোনি।
গুড আফটারনুন জেন্টলম্যান। খবরটা শুনেছ?
ইয়েস ক্যাপ্টেন।কালকেই একটা খবর কানে এসেছিল। আজকে ইনভেস্টিগেট করে এলাম। আপনি আর আমি বোধহয় একই আন্দাজ করছি এবং সেই সন্দেহটাই বোধহয় ঠিক।
এক্সপ্লেইন প্লিজ।
রাহাতোগড়ের বাজারে আজ এক পুওর আনোন ভিলেজার দুটো সিলভারের জার আনে। একটা ফুল, আরেকটা হাফ ফিলড।
হুম। সো?
দুটোতেই খুবই এক্সপেনসিভ লিকার ছিল। আনিস আর শিরাজি। এদিককার লোক এইসব চোখেও দেখেনি। রাজা বা নওয়াব ফ্যামিলি ছাড়া এসব অ্যাফোর্ড করা ইম্পসিবল।
অ্যান্ড?
সিলভার জার দুটো দেখার মতন। সপ্লেন্ডিড ক্র্যাফটসম্যানশিপ, উইথ বিউটিফুল ইন্ট্রিকেট ডিটেইলিং। আ পারফেক্ট ওয়ার্ক অফ আর্ট। রাস্তাঘাটে এ জিনিস পাওয়ার কথা নয় ক্যাপ্টেন।
আর ইউ শিওর?