এদের যেতে বলো বুল্লা খাঁ।বেকার ঝঞ্জাট বাড়ানোর শখ নেই আমার। এখনও বিদিশা অবধি পৌঁছাইনি।হারামির অওলাদ কাহারগুলো করছেটা কী? কোড়া লাগাও সালোঁকো, দওড়াও ইনকো জলদি। আর এই ভিখিরিগুলোকে নিজেদের রাস্তা দেখতে বল, যত্তসব ফালতু হুজ্জত।
আদেশ শুনেও বুল্লা খাঁ দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে থাকে, নড়ার কোন লক্ষণই দেখায় না।
কী হলটা কী? কথা কানে যাচ্ছে না? ধমকেই ওঠেন উনি।
মালিক, এরা গরিব ইনসান, সঙ্গে থাকলে একটু লোকবল বাড়ে। একটু গপশপ করতে করতেও যাওয়া যায়। বেসাহারা মজবুর তোক সব…
বুঝলেন আহমেদ খান। এই লম্বা বেহড়ের সুনসান রাস্তায় এদেরও তো দুটো কথা বলার লোক চাই। তাছাড়া বুল্লা খাঁ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও তো এইদিককার গাঁও-দেহাতেরই মানুষ। দুটো সুখদুঃখের কথাই না বলবে দেশোয়ালি ভাইদের সঙ্গে। থেকেই যাক তাহলে এরা, সঙ্গে চলুক। চোখের ইঙ্গিতে এদের সঙ্গে আসার ইজাজত দিয়ে পালকিতে উঠে পড়েন উনি, যদিও প্রৌঢ় বরানটির আভূমি সেলাম ওঁর নজর। এড়ায় না।
বহর ফের চলতে শুরু করে, কিন্তু আগের চেয়ে শ্লথগতিতে। স্বাভাবিক। এই উটকো জুটে যাওয়া চল্লিশজন না কাহার না সিপাহি, গাঁও-দেহাতের গরিব-গুরবো। লোকজন সব। যাগগে যাক। আসর না হোক, মাগরিবের নামাজের আগে গায়ারাসপুর। পৌঁছালেই হল। গায়ারাসপুর ছোট গঞ্জ মতন। ভালো অম্বুরি তামাক পাওয়া যায়। অম্বুরি তামাকের কথায় মনে পড়ল, পরের মাসে অম্বরে গিয়ে…
একটু ঝিমিয়ে পড়েছিলেন উনি। বুল্লা খাঁ এসে গলা খাঁকারি দিতে ঝিমুনিটা ভাঙে। বিদিশা এসে গেছে, হুজৌরের হুকুম হলে এখানেই দস্তরখান লাগানো হোক?
খানাটা একটু গুরুপাকই হয়ে গেছিল, দেরিও হয়ে গেছে খুব। ওঁকে কাল দুপুরের মধ্যে সগরে পৌঁছাতেই হবে, ফিরলেই আবার একটা মেহফিল আছে বড়। বেশকিছু মোহর খসিয়ে লাখনৌ থেকে বেগম সামরুকে আনা হয়েছে। বেগম সামরুর ক্ষীণ। কটি, উদ্ধত স্তন, আর ঝটকা ঠুমকা মনে পড়তেই আহমেদ খানের গলা শুকিয়ে উঠল। হাঁকার পাড়েন উনি,
বুল্লা খাঁ, জলদি চলো। দের হয়ে যাচ্ছে বহুত।
এরপর একটু জোরেই দৌড়তে থাকে বহর। খিজিরপুর পেরিয়ে গেলো মুহূর্তেই। এরপর আরোনা, দোহুরা আর তারপরেই গায়ারাসপুর। আজকের মতন ডেরাডান্ডা। বাঁধবেন উনি। রাত্তিরে রাহতোগড় পৌঁছতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।কাল সকাল সকাল বেরোলেই দুপুরে সগর পৌঁছে যাবেন।
মাঝখানে দু-দুবার বুল্লা খা এসে প্রস্তাব দিয়েছে একটু জিরিয়ে নেওয়ার। যথেষ্ট প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও সে ইচ্ছে দমন করেছেন আহমেদ খান। আনিস এখনও আধা সুরাহি আছে, শিরাজি প্রায় পুরোটাই। যা মৌজমস্তি, সেটা গায়ারাসপুর পৌঁছেই। করবেন না হয়।
এমন সময়ে হঠাৎ আবার থেমে গেলো বহর। টং করে মাথায় রক্ত চড়ে গেল। আহমেদ খানের। পালকি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই লাল লোহুলোহান চোখে ইতিউতি তাকালেন, কোথায় সেই বেয়াদববুল্লা খাঁ, পারলে আজই বরখাস্ত করেন এই ইবলিশের বাচ্চাকে। এত টাকা নিয়ে এতদূর যাচ্ছেন, তার মধ্যে উটপটাং ঝামেলা জড়াচ্ছে কে? এই নিচু জাতের ভিখিরি আতরাফ বুল্লা খাঁ কী ভেবেছেটা কী নিজেকে?
বুল্লা খা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে মালিক বহোত নাশ হয়েছেন। সশঙ্কচিত্তে এগিয়ে এসে বলে গোস্তাখি মাফ হুজৌর, এদিকে একটু তশরিফ নিয়ে এলে বান্দা ব্যাপারটা বোঝাতে পারে।কসুর মাফ, লেকিন মজবুর মুসলমানকে সাহায্য করা উম্মতি সুন্নাহ বলে বহর থামাতে বাধ্য হয়েছি মালিক।
কী হয়েছেটা কী? একটু রূঢ় স্বরে প্রশ্ন করেন আহমেদ খাঁ, মাগরিবের নামাজ গায়ারাসপুরে আদায় করতে চাও কি চাও না সেটা স্পষ্ট করে বলতো বুল্লা খাঁ।
মালিক, একটু মেহনত করে এদিকে দেখুন।
ঘাড় ঘোড়াতেই কারণটা বুঝতে পারলেন আহমেদ খাঁ।
একটু দূরে জনাদশেক লোক, মুসলমানি সিপাহির পোশাক পরনে। মাটিতে শোয়ানো একটা সাদা কাপড় দিয়ে মোড়া মৃতদেহ ঘিরে জবুথবু হয়ে বসে আছে। বিলাপের চিহ্ন সর্বাঙ্গে স্পষ্ট। এদেরই একজন সর্দার গোছের লোক উঠে আসে, আভূমি সেলাম ঠোকে, আসোলাম ওয়ালেকুম হুজুর।
ওয়ালেকুম আসোলাম। কী হয়েছে বিরাদর?
মালিক, আমরা কোম্পানির সিপাহি। আওধ যাচ্ছিলাম ফৌজে যোগ দিতে। কী নসিব দেখুন, রাস্তায় এই সাথি উলটি করতে করতে ফৌত হয়ে গেল। বাকি সবাই তো এগিয়ে গেছে। এই আমরা দু-চারটে মুসলমান এর কবর দেবার জন্যে বসে আছি। মুশকিল এইহুজুর, যে আমাদের মধ্যে তেমন লিখাপড়ি কেউ নেই যে নামাজ-এ-জানাজা আদায় করবে। হুজুর আলেম লোক মালুম হয়। মেহেরবানি করে যদি একটু নামাজটা পড়ে দিতেন তো আমাদের দোস্তকে মাটি দিতে পারতাম। হুজুর পাকসাফ লোক মালুম হয়, যদি মেহেরবানি করে একটু… বলে লোকটি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
আহমেদ খানেরমন দয়ার্দ্র হয়ে ওঠে। আজলাফ হোক, আরজাল হোক, মুসলমান তো বটে।তিনি, প্রবল প্রতাপশালী আহমেদখ, তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকতে মুসলমানের বাচ্চা গোর পাবে না,এ হতেই পারে না। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে বুল্লা খাঁকেওজুর জল আনতে বলেন।
ততক্ষণে কাহাররা দূরে সরে গেছে। জায়গাটা ঘন জঙ্গল মতন, লাকরাদেীনের আগের কোনো জঙ্গুলে জায়গা বোধ হয়। বড় রাস্তা একটু দূরে, কাছেই একটা বিল। সেদিক থেকে বাতাস বইছে ঝিরিঝিরি। বিলের পাশ দিয়ে ঘন জঙ্গল। সিপাহিরা একটু ঢিল দিয়েছে। তা দিক, এতক্ষণ ধরে দৌড়ে আসছে। বুল্লা খাঁ ওর ঘোড়াটার পা দুটো একটু দলাইমলাই করে দিচ্ছে, আহা করুক। ঘোড়া, তলোয়ার আর ভুখা পেট ছাড়া বেসাহারা সিপাহির আর আছেটাই বা কী, অ্যাঁ?