খোদনওয়াবের আদেশ, অন্তত এক লক্ষ টিপুশাহি মোহর নিয়ে কোম্পানির কাছে। পৌঁছে দিতে হবে। এবং চুপিচুপি, কাকপক্ষীতে যেন টেরটি না পায়।
কোম্পানির গভর্নর বাহাদুর বেন্টিঙ্ক সাহেবের খাস পয়গাম নিয়ে পরশু এক ফিরঙ্গ এসেছিল বটে।
নওয়াবের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার কক্ষে কিছু আলোচনাও হয়, আর কারও থাকার হুকুম ছিল না, এক মির্জা আজিজ ছাড়া। তারপর গত কাল রাতে আহমেদ খানের হাভেলিতে হঠাৎ করে মির্জা আজিজের ডানহাত শওকত জঙ্গ এসে হাজির, ওয়জির-এ-আজমের খাস এত্তেলা নিয়ে। আর তারপরেই এই হাঙ্গাম।
ঘোঁট কিছু একটা পাকছে, বুঝতে পারছিলেন আহমেদ খান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখন ভারতশাসক, দিকে দিকে আরও দৃঢ় হচ্ছে তাদের শাসন। দিল্লির মুঘল সালতানত তো না থাকারই মতন, সুলতান শাহ আলমের ছেলে আকবর শা নামেই ভারতসম্রাট, বস্তুত লালকিলা থেকে জুম্মা মসজিদ, ব্যস, এই পর্যন্তই ওঁর হুকুমত চলে। এই লালমুখো নাসারা ফিরঙ্গরাই এখন হিন্দুস্তানের বেতাজ সুলতান। শুধু তখত-এ-তাউস দিল্লির বদলে কলকাতায়, এই যা। তা এর মধ্যে নয় নয় করেও ভোপালের নওয়াবশাহি দেড়শো বছরের হল প্রায়। তাকে আরও কয়েকশো বছর জিন্দা রাখতে গেলে নতুন শাহেনশাহদের খুশ করাটা বাধ্যতামূলক তো বটেই। আবার কথাটা সর্দার রণজিৎ সিং এর কানে ওঠাও চলবে না, শাহেনশাহ আকবর শাহের কানে তো নয়ই, হাজার হোক, মরা হাতিও লাখ টাকা বরাবর। আওধ আর মাইসোরের ক্ষেত্রে কোম্পানির নাক গলানো দেখে অনেক রাজা নওয়াবেরই রাতের নিন্দ হারাম হয়ে। গেছে। ফলে নতুন সুলতান বেন্টিঙ্ক বাহাদুরকে খুশ রাখতে হলে এই লুক্কাছুপি ছাড়া উপায় নেইই, আহমেদ খান সেটা ভালোই বোঝেন।
এখন নওয়াবের আদেশ অমান্য করা আত্মহত্যার শামিল। তা ছাড়া কাজও তো তেমন আহামরি কিছু নয়। সগরে কোম্পানির অফিস আছে, সেখানে ম্যালোনি সাহেব। আছেন, সেখান অবধি টাকা পৌঁছে দিয়েই ব্যস, ঘরের ছেলে ঘরে। বাকিটা কোম্পানিই না হয় বুঝে নেবে। ভোপাল থেকে সগর বেশি দূরে নয়, সত্তর ক্রোশ মতন। এই যে আজ ফজরের পর রওয়ানা দিলেন, পা চালিয়ে গেলে এশার নামাজ রাহবোগড়ে আদায় করে ওখানেই রাত্রিবাস। আর পরের দিন জোহরের নামাজ না হয় সগরে পৌঁছেই আদায় করবেন। ওখানেই কোম্পানির কুঠিতে রাত কাটিয়ে পরের দিন ফিরতি পথ। ধরা, তেমন কঠিন কিছু না।
মুশকিল একটাই, পুরো কাজটাই করতে হবে চুপিচুপি, অত্যন্ত সন্তর্পণে, কেউ। যেন কিচ্ছুটি টের না পায়। এমনকি নিজের তিন বেগমের কাছেও এ বিষয়ে টু শব্দটি উচ্চারণ করেননি আহমেদ খান। একই কারণে বেশি লোকলস্কর নেওয়াও বারণ। এক পালকিতে আহমেদ খান নিজে, আরও দুটোয় পেটির মধ্যে একলাখ টিপুশাহি মোহর। লোকজনের মধ্যে তো আঠারোটি পালকিবাহক কাহার আর এই মহার্ঘ উপঢৌকনের। পাহারাদার হিসেবে কয়েকটি মাত্তর ফৌজি সিপাহি। তা সেই সিপাইদের বিরিয়ানি গোশত খাওয়া বিশাল ভূঁড়ি দেখে অবজ্ঞায় নাক সিটকোলেন উনি, ছোঃ, এই নাকি নওয়াবের দেহরক্ষীবাহিনীর খাস সিপাহি! বিপদে পড়লে সবার আগে এরাই কোতল হবে বেশক। নড়তে চড়তেই তো এদের সময় কাবার।
জলদি চল বেটা, পা চালিয়ে। আসরের নামাজ আগে যদি গায়ারাসপুর পৌঁছে। দিতে পারিস, মোটা ইনাম পাবি। এই বলে কাহারদের একটু তাড়না দিয়ে উনি পালকির দরওয়াজা বন্ধ করলেন। সঙ্গে দু দুটো চান্দির সুরাহি ভর্তি করে বহুমূল্য শিরাজি আর আনিস নিয়ে এসেছেন। এখন দুপাত্তর খেয়ে একটু ঝিমোবেন।
চটকাটা ভাঙ্গল দিওয়ানগঞ্জ পেরিয়ে সালামতপুরে ঢোকার মুখোমুখি। এক বরকন্দাজ সবিনয়ে এসে জানাল, কিছু গরিব-গুরবো লোক এসেছে হুজৌরের কাছে আর্জি নিয়ে, উনি যদি একটু মেহনত করে শোনেন।
জমিতে পা দিয়েই বুঝলেন যে কোমর টাটিয়ে গেছে। খর রৌদ্র মাথার ওপর, মানে জোহরের সময়ও পেরিয়ে গেছে। নিজের ওপরেই বিরক্ত হলেন আহমেদ খান।এভাবে নামাজ আদায় কাজা হলে হাসরের ময়দানে রোজ-এ-কেয়ামতে কী জবাব দেবেন উনি?
চোখ কুঁচকে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখেন একদঙ্গল গ্রাম্য পথচারী ভারী বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ধূলিধূসরিত খালি পা, শতছিন্ন পোশাক, মাথায় মলিন পাগড়িতে দারিদ্র অতি প্রকট। বেশ কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি গালে, চোখে ভিরু উদাস দৃষ্টি। তা জনা তিরিশ চল্লিশেক লোক হবে। কয়েকজন তো পথশ্রমে কাহিল হয়ে মাটিতেই বসে পড়েছে গাঁঠরি পাশে রেখে। বাকিরা শঙ্কিত দৃষ্টিতে হুজৌরের সাক্ষাতে হাত জড়ো করে দণ্ডায়মান।– একটি দীর্ঘদেহী লোক এগিয়ে এল। মাথার টিকি দেখে বুঝলেন যে এ ব্রাহ্মণ, হয়তো বা দলের নেতাও। ফাটা ফতুয়ার ফাঁক দিয়ে নোংরা জনেয়ু উঁকি দিচ্ছে।
রাগ হয়ে গেল আহমেদ খানের। এই হিন্দু বরান্তনের বাচ্চাটা কী চায় এখন? এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে অনেক।
কী চাই হে? খ্যাক করে ওঠেন আহমেদ খান।
হামলোগ বহোত গরিব আমি আছি হুজৌর। কুম্ভমেলা থেকে গাঁও-দেহাতে ফিরে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট ভালো না, কখন কী পরেশানি হয় কিছু বলা যায়? হুজৌর যদি মেহেরবানি করে এই বদনসিবদের সঙ্গে থাকার ইজাজত দেন, তো বহত শুকরগুজার থাকবে এই বান্দা।
না, লোকটা বেতরিবত নয়। তবুও আহমেদ খান হাঁকিয়েই দিচ্ছিলেন। সঙ্গে মেলা টাকাকড়ি আছে, এই লোকজন নিয়ে বেফালতু ঝামেলা বাড়াবার কোনও মানেই হয় না। যদিও টাকার ব্যাপারটা কাহাররা অবধি জানে না, তবুও অনজান খতরা ঘাড়ে নিয়ে লাভ? তাছাড়া এইসব ঘিনঘিনে নোংরা ভিখিরির বাচ্চা গেঁয়ো লোকগুলোকে শখত নাপসন্দ আহমেদ খানের, ফলে হাতের ইশারায় সিপাহিদের সর্দার বুল্লা খাঁকে ডেকে পাঠালেন উনি।